আলোকিত হওয়া, আলোকিত করা বা এনলাইটেনমেণ্ট কি নিছক একটা শব্দ, নাকি এর অন্তর্নিহিত কোন তাতপর্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তর শব্দের ভিতরে খোঁজার থেকে তার প্রয়োগিক প্রতিবেশে খোঁজা সহজতর হবে। কারন প্রযুক্তিগত বা ব্যবহারিক আঙ্গিকে আলো বলতে আমরা একটা ভৌত অস্তিত্বের কথাই বুঝি, বিমুর্ত কিছু আমাদের মানসে ধরা দেয় না। তাহলে কিভাবে বুঝবো অন্য আলোর স্বরূপ? কিছু মানুষ আছে যাদের জীবনাচার, তথা চিন্তা-কথা-কাজ পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে অন্য-আলোর স্বরূপ ধরা পড়তে পারে আমাদের অন্তঃদৃষ্টিতে।

বিবর্তিত প্রাণের এই পর্যায়ে মানুষ প্রজাতি তার দেহে-মনে বংশানুক্রমিক ধারায় যে উতকর্ষতা লাভ করেছে সেখান থেকে তাকে একটা বিশেষ ধ্রুপদী অবস্থানে নিতে হলে যে পারিপার্শ্বিক, মনস্তাত্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবেশের দরকার সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সেই প্রতিবেশ নির্বিশেষে মানুষ তার নিজস্ব ধীশক্তি বলে যদি মননকে ঐ বিশেষ অবস্থানে নিতে পারে, তবে সেই অবস্থানই তার আলোকিত অবস্থা। অনেককে বলতে শোনা যায়, আলোকিত হওয়া যায় না। এটা প্রকৃতির একটা নির্বাচন এবং তা অতিন্দ্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। এই অনুসিদ্ধান্ত সঠিক হলে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত এমন হতে পারে- আলোকিত হবার জন্যে প্রয়োজনীয় শর্তসমূহ পূরণ হলেই সে আলোকিত হয়। সেইসব শর্তের কিছু দৃশ্যমান, কিছু আমাদের বোধশক্তিরও বাইরে। এই কারণে আলোকায়ন অলৌকিক অবিধা পেয়ে যেতে পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে আলোকায়ন মানুষের সাধ্যের অতীত নয়।

একটা বৃক্ষের দেহে অসীম না হলেও, যে বহু সংখ্যক তথ্যের সমন্বয় ঘটে গাছ কি তা জানে? গাছ এসব বিষয়ে অবগত নহে, এবং আমরা তাদের এই অজ্ঞতার কথা বুঝতে পারি নিজস্ব ধীশক্তি বলে। গাছ যদি আত্মসচেতন হতো, নিজের বিষয়ে জানতো, তাহলে হয়তো মানুষের মতন তারাও পৃথিবীটাকে অস্থির করে তুলতো। মানুষ তার দেহ-মন এবং পারিপার্শ্বিক জীব ও জড়ের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানে এবং বুঝে, নিজেদের মত করে বুঝে। জানাজানির এই অনির্দেশ্য ও অসীম যাত্রায় যারা আমরন যাত্রী, কোন লাভালাভের হিসেব না কষে যারা এই ভ্রমনে শামিল হয়, ভ্রমনের স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দ যাদের পথের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়, তারাই আলোকিত মানুষ। তাদের এই যাত্রা সমগ্র প্রাণের স্বল্প ও দীর্ঘ্য মেয়াদী কল্যান বয়ে আনে। কি সেই প্রভাবক যা মানুষকে এমন একটা ভ্রমন পথকে বেছে নিতে অনুপ্রেরনা দেয়, উতসাহ যোগায়? প্রশংসা-পুরস্কার? অমরত্ব? নাকি অন্য কিছু? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া অতটা সহজ নয়। তবে কোন কাল্পনিক পরশপাথরের সংস্পর্শে এসে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ইঙ্গিতে যে অলোকায়ন সম্ভব নয় তা বলা যায় জোর দিয়ে।

নিঃশর্তভাবে কিছু করার ক্ষমতা অনেক প্রাণীর থাকে না, অনেক মানুষেরও থাকে না। তবে কিছু মানুষ তো পারেই নিঃশর্ত হতে, একান্ত আত্মপ্রচেষ্টায়। নিবিড় আন্তরিক অনুশীলন তাদের সেই অবস্থানে পৌছে দিতে পারে। কোন অলৌকিকতা সেখানে বড় একটা কাজ করে না। যারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে কোন বৈষয়ীক লাভ-ক্ষতি দ্বারা তাড়িত হয় না। যারা স্বাধীনভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে যতটুকু বিষয় প্রয়োজন, তার বাইরে কোন কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যাদের সব আগ্রহ আসক্তি সেই নিঃশর্ত আনন্দ যাত্রায় এসে ঠেকে, তারা আসলে কেমন মানুষ? দৈহিক কাঠামোর দিক দিয়ে তারা আমাদের মতন হলেও, মানসিক গঠনের দিক দিয়ে তাদের সাথে আমাদের অনেক ফারাক। তার মানে তারা কি সংসার ত্যাগী সাধু-সন্যাসী? মোটেই তা নয়। তারা সব বিষয় অর্জন করার পরেও বিষয়-লাভ-স্বার্থ দ্বারা বিজীত বা অধিকৃত নয়। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, পরিপূর্ণ আলোকায়ন বা পরম-চেতনা অর্জন সম্ভব নয়। এই অবস্থার কম-বেশী কাছে যাওয়া যেতে পারে। আলোকিত মানুষ কোন অবস্থাতে অন্ধকারে ফিরতে পারে না। আলোর যাত্রা তাই একমুখি। তবে ইচ্ছে করলে অন্ধকারের প্রাণীরা আলোর পথে ফিরতে পারে।

বাঙালী সংস্কৃতি ও চেতনার মানস যে লালন সাঈ, তিনিও চেষ্টা করেছেন মানুষের আলোকিত অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করতে। একজন আলোকিত মানুষের দেহভাষা, শারীরিক অভিব্যক্তি কেমন হয়, সেসব উঠে এসেছে তার গানে।

মহাভাবের মানুষ যে জনা
দেখলে যায়রে চেনা।
ও তার আঁখিদুটি ছলছল
মুখে মৃদু হাসির পতন হয়না
দেখলে যায়রে চেনা।
সদাই থাকে নিগুম ঘরে………।

এছাড়া ধ্যানগ্রস্থ অবস্থা, তাদের আনন্দ, হাঁসি-কান্নার রকমফেরও উঠে এসেছে সাঈজীর একতারাতে। তিনি তার মতন করে বিশ্লেষন করেছেন, সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার এই গানটার ভিতরে কী-ওয়ার্ডটা আমার মনে হয়েছে ‘মহাভাব’ ও ‘নিগুম ঘর’। এই মহাভাব আসলে কি? হতে পারে তা সাহিত্য-শিল্প, গণিত-বিজ্ঞান, অথবা অন্য যে কোন বিষয়, যা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে আশ্রয় করে নেয় মনের নিগুম ঘরে। যার চর্চায়, সাধনায় মানবতা উপকৃত হয়। উপকৃত হয় সকল প্রাণ। লালনের নিগুম ঘর প্রাচীন পারস্য সাহিত্যের সেই সরাব-নেশা-সাকির রূপক, যে বিষয়ে সাঈজি ওয়াকেবহাল ছিলেন। দ্রাক্ষারস নয়, আঙ্গুরের নির্জাসও নয়- মহাভাবের নেশা যাকে নেশাগ্রস্থ্য করেছে, সেই আলোকিত মানুষ। অস্বীকার করার উপায় নেই, লালনও একজন আলোকিত মানুষ। বাঙালী মন ও মননের উপরে যার প্রভাব দৃশ্যমান হয় আজো। কিন্তু আর কতদিন বাঙালী হৃদয় তাঁকে ধরে রাখতে পারবে, সেই ব্যাপারে মাঝেমাঝে সন্দিহান হয়ে উঠি। প্রযুক্তিহীনতার সেই যুগে সম্পূর্ণ বিপরীত মত ও পথের উদ্ভাবক হয়েও লালন যেখানে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে মানুষের সন্দেহ-অবিশ্বাস ভঞ্জন করতেন, আজ সেখানে চরম প্রযুক্তি সভ্যতার ভিতরে বিরুদ্ধ মত-পথগুলোর চরম অসহিষ্ণুতা, আর হানাহানি দেখে মনে হয় অন্ধকার নেমে আসতে বুঝি আর বাকী নেই।

এমনই এক অসহিষ্ণুতার বলী হুমায়ুন আজাদ। অতি সম্প্রতি অভিজিত রায়ও সেই একই অশুভের শিকার। তারা দুজনই লেখক-গবেষক। কথায় বলে- লেখকরা জাতির বিবেক। ভিন্নমত হলেও বিবেক। মত কখনও একমাত্র হয় না। যত মত, ততো পথ। এই সব পথ দিয়ে চলতে চলতে শ্রেষ্ঠ পথে পৌছাতে হয়। একমাত্র পথ কখনও শ্রেষ্ঠ পথ হয় না। একটা মাত্র পথের শেষে বড় খাদ থাকলে বাঁচার আর কোন পথ থাকে না। কাজেই বহু পথের লালনই একটা জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা এবং তা প্রকারান্তরে জাতিকে আত্মহননের হাত থেকে বাঁচায়। এই অসহিষ্ণু মাটিতে হুমায়ুন আজাদ, অভিজিত, দুজনকেই শেষ করে দেয়া হয়েছে। এইভাবে মানুষকে সরিয়ে দিয়ে কি আসলেই তাদের বিনাশ করা সম্ভব? সম্ভব না। সাধারন মানুষকে চাপাতি দিয়ে মুছে ফেলা গেলেও, তাদের মতন কাউকে অপসৃত করা যাবে না, যায় না। কারন তাদের আলোকায়ন ঘটেছিল, তারা আলোকিত। সামসুর রহমান থেকে সুফিয়া কামাল, আরজ আলী মাতুব্বর থেকে আহমেদ ছফা, আলোকিত মানুষের তালিকা এমনি করে আরো বড় ছিল এক সময়। তারা সবাই চাপাতির কোপের ঝুকিতে থেকেও আমাদের আলো দিয়ে গেছেন নির্বিকার চিত্তে। ঐ মাটিতে আজ তারা সংখ্যালঘু। ভয় আর হুমকি পেরেছে কি তাদের স্তব্ধ করে দিতে? আলোকিত মানুষকে চাপাতির আঘাতে সরাতে চাইলে, তারা আরো বেশী ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। প্রদীপের শিখা ফু দিয়ে নিভিয়ে দিলে কি ফোটনের বিস্তার রোধ করা যায়? হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিতরা আলোকিত মানুষ, তার প্রমান পাই তাদের জীবনাচারে, চিন্তা-কথা-কাজে এবং লেখায়। অভিজিত রায়ের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনাচারের বিষয়ে মানুষ জানছে, আরো জানবে আগামীতে। মানুষ হাতেনাতে প্রমান পাবে একজন আলোকিত মানুষ যা লেখে বা চিন্তা করে, তার ব্যক্তিজীবনেও তাই প্রতিফলিত হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা শান্তিপ্রিয় বাঙালী। আমরা কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। আমরা আলোকিত মানুষ দিয়ে কি করবো? ভোগবাদী দেশের রাষ্ট্রপতি মিস্টার ওবামা প্রথম ক্ষমতায় এসে পণ্ডিত আর আলোকিত মানুষ দিয়ে তার উপদেষ্টা মণ্ডলীর কক্ষটাকে ভরে ফেলেছিল। আমরা এত বেশী চরিত্রবান আর ধার্মিক হওয়া সত্তেও কি পেরেছি আলোকিত মানুষ দিয়ে দেশের স্টেয়ারিং হুইলটা ধরাতে, দেশ-গাড়ির সহকারীর আসনে কোন আলোকিত মানূষকে নিয়োগ দিতে? পারিনি। কারণ বাংলাদেশ নামক পিরামিডটা উল্টে গেছে। শীর্ষের আলোকিত মানুষেরা চাপা পড়েছে মাটিতে, অন্ধকারে। গোড়ার মানুষেরা উপরে বসে ক্রমাগত ছড়াচ্ছে তাদের মুর্খতার অন্ধকার। পিরামিডটা সঠিক অবস্থানে থাকলে দেশটা অন্যরকম হতো- অন্য-আলোয় উদ্ভাসিত হতো দেশের সকল দুর্গম চরাচর।

আমরা যদি আমাদের সন্তানদের আলোকিত ভবিষ্যতের কথা ভাবি, তবে আলোর পথের যাত্রীদের কথা ভাববো। তাদের অস্তিত্ব ও চিন্তা-চেতনার রক্ষন, পৃষ্ঠপোষণ, শীর্ষায়নের কথাও চিন্তায় রাখবো। তারা পরীক্ষিত আলোর দুঃসাহসী অভিযাত্রী। গভীর আঁধারের বুক চিরে তারা আলো হাতে এগিয়ে যায় আত্মস্বার্থ ভুলে। নিজের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে তাদের পাশে দাড়াবার দায় আমরা কেউ কি এড়াতে পারি? পারি না। ভয়হীন হৃদয়ে বাস করে বীরের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে অন্তরে পুষে রেখে আলোর আসা যাওয়ার পথকে কন্টকহীন করতে হয়। হাজার দিন ভেড়ার মতন বেঁচে থাকার চেয়ে একদিন সিংহের মত তীব্র আলোয় বেঁচে থাকার ভিতরে বাস করে বীরের ইচ্ছা। ট্রয় বিজয়ী ইউলিসিসের মুখেও শুনি সেই একই কথার প্রতিধ্বনি।

One equal temper of heroic Hearts,
Made weak by time and fate,
But strong in will
To strive, to seek, to find,
And not to yield.