আপনারা হয়তো এর মধ্যে জেনে গেছেন যে, গত ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা এবং এর অন্যতম মডারেটর অভিজিৎ রায় গুপ্তঘাতকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।  অসুস্থ মা-কে দেখার জন্য তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন।  ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় যাবেন – এটা ছিল স্বাভাবিক।   এবারের বইমেলায় তাঁর দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘শুন্য থেকে মহাবিশ্ব’ (অধ্যাপক মীজান রহমানের সাথে) ও ‘ভিক্টোরিয়া ওকেম্পোঃ এক রবিবিদেশিনীর খোঁজে’। বইগুলো পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে।  বন্ধু-বান্ধব এবং তাঁর গুণগ্রাহী পাঠকদের সাথে বইমেলায় অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলাপচারিতা ছিল তাঁর জন্য অত্যন্ত সুখকর অভিজ্ঞতা।  অত্যন্ত সুন্দর একটা সময় তিনি উপভোগ করছিলেন এবারের বইমেলায়।

বইমেলা থেকে ফেরার পথে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ, যিনি নিজেও মুক্তমনার সাথে সংশ্লিষ্ট, টিএসসির ঠিক সামনেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন জনাকীর্ণ সড়কে অজ্ঞাতনামা দুই আততায়ীর হামলার স্বীকার হন। আততায়ীরা চাপাতি নিয়ে দুজনকে গুরুতরভাবে আহত করে। অভিজিৎ রায়কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত বন্যা আহমেদকে শুরুতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় স্কোয়ার হাসপাতালে। বর্তমানে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছেন।

অভিজিৎ রায় শুধুমাত্র মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তচিন্তা আন্দোলনের প্রধান পুরুষ। বাংলাভাষাভাষীদের মধ্যে যুক্তিবাদ, মুক্তবুদ্ধিচর্চা, মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা এবং বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়িয়ে দেবার জন্য শুধুমাত্র মুক্তমনা প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেন নি, প্রতিনিয়ত লেখালেখি এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়েছিলেন সক্রিয়ভাবে। এই আন্দোলনের প্রধানপুরুষ এবং আইকন হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর অসাধারণ মেধা, নিরলস প্রচেষ্টা এবং গভীর আন্তরিকতা দিয়ে। তিনি ধর্মের অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখেছেন, ধর্মের ত্রুটি নিয়ে লিখেছেন, লিখেছেন ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে, লিখেছেন ধর্ম কীভাবে সমাজ প্রগতিতে বাধা দেয় তা নিয়ে।  কিন্তু, এটাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। তিনি বাংলাভাষীদের যুক্তিবাদী হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন প্রতি মুহুর্তে। অন্ধের মতো কোনো কিছু বিশ্বাস করাটা শুভ কিছু বয়ে আনে না সমাজের জন্য। প্রতিটা বিষয়কে দেখতে হয় যুক্তির মাপকাঠি দিয়ে। তিনি বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি করেছেন। বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখনিতে তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা বর্তমান সময়ে কারো নেই। বিজ্ঞানের একেবারে সদ্য প্রাপ্ত জ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় এরকম লেখা আগেও কেউ লেখে নি, তাঁর সময়েও কেউ লিখতো না।

তাঁর স্ত্রী ও সহযোদ্ধা বন্যা আহমেদ নিজেও একজন প্রথম সারির মুক্তমনা, নিজ নামেই পরিচিত তিনি। মুক্তমনার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তিনি এর সাথে জড়িত রয়েছেন। বিবর্তনের উপর লেখা তাঁর বই ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় লেখা বিবর্তনের উপর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।

এই দুজন মুক্তচিন্তার অগ্রপথিক। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার এবং ছদ্ম-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন অনেকদিন ধরে। আর এই লড়াইয়ের কারণেই মৌলবাদীরা টার্গেট বানিয়েছে তাঁদের। এঁদের উপর হামলা তাই শুধুমাত্র দুজন ব্যক্তির উপরে হামলা নয়। মুক্তমনার চলমান আন্দোলনকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা মাত্র।

অভিজিৎ রায় নিহত হবার চার পাঁচদিন আগে থেকেই বাংলাদেশ থেকে মুক্তমনায় ঢোকাটা সমস্যা হচ্ছিলো। অনেকেই ভেবেছেন যে মুক্তমনা ওয়েবসাইটটি বাংলাদেশ সরকার ব্লক করে দিয়েছে। আমরা নানা উৎস থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেও এর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারি নি। আমাদের টেকনিক্যাল টিমের ধারণা কারিগরি ত্রুটির কারণেই এই সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমরা আশা করছি যে, অতি দ্রুত আপনাদের এই অসুবিধাটি দূর করতে সক্ষম হবো। এর মধ্যে যাঁরা মুক্তমনা ভিজিট করতে চান, তাঁরা টর ব্রাউজার (https://www.torproject.org/projects/torbrowser.html.en) ডাউনলোড করে নিতে পারেন। এর মাধ্যমে মুক্তমনায় ঢুকতে কোনো অসুবিধা হবে না। আপনাদের পরিচিত যাঁরা মুক্তমনায় ঢুকতে পারছেন না, তাঁরা এই সংবাদটি শেয়ার করে দিলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো।

যুগে যুগে মুক্তচিন্তা যাঁরা করেছে, প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাঁদের সহ্য করতে পারে নি, নৃশংসভাবে হামলে পড়েছে। সক্রেটিসকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, হাইপেশিয়াকে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে, ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, গ্যালিলিওকে বন্দি করা হয়েছে অন্ধকার কারাকক্ষে,  অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে, বন্যা আহমেদ মারাত্মক আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী।  কিন্তু, তারপরেও মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল আন্দোলনকে থামানো যায় নি। আমরা অভিজিৎকে হারিয়েছি, কিন্তু অভিজিৎ হারে নি।  মুক্তমনারাও হারবে না।

সমাজ সামনের দিকেই এগোবে, পেছন থেকে তাকে যতোই টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন। কিন্তু, তারপরেও প্রতিটি আন্দোলন হয় রক্তক্ষয়ী।  রক্ত দেয়া ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না। তাই তো অভিজিৎ রায় লিখেছিলেন,

যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি। জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোরা সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম পড়িনি। আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই কম আহত হয় নাই।

বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটাই হত্যাকারীদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে অবিরাম। আমরা দেখেছি, হুমায়ূন আজাদ হত্যার কোনো বিচার হয় নি, রাজীব হায়দারের হত্যার কোনো বিচার হয় নি। আমরা চাই না অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু ঘটুক। সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে দ্রুত তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক, এটাই এই মুহুর্তে বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তমনার দাবী।

মুক্তমনা এই মুহুর্তে একটি দুঃসময় পার করছে। এই দুঃসময়, বিপর্যস্ত অবস্থা সামাল দেবার জন্য আপনাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সাহায্য এবং সহযোগিতা আশা করছি। সাথে থাকুন, পাশে থাকুন, একত্রিত হয়ে শক্তি যোগান একে অন্যকে। আপনাদের পাশে থাকাটা আমাদের সাহসকে বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।

যে আদর্শ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে অভিজিৎ রায় মুক্তমনা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই আদর্শ এবং উদ্দেশ্য থেকে একচুলও নড়বে না মুক্তমনা। অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদের উপর হামলা থেকেই প্রমাণিত যে, আমরা প্রতিক্রিয়াশীলতার দূর্গে আঘাত হানতে পেরেছি। ব্যাপক ছাত্র-তরুণ ও সমাজের প্রগতিশীল অংশের কাছে অভিজিৎ রায় ও মুক্তমনার গ্রহনযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধদের কাছে।  অভিজিত-এর ধারালো যুক্তিতর্কের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা এই কাপুরুষদের ছিল না।  তাই তারা হাতে তুলে নিয়েছে চাপাতি। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেও অভিজিৎ এর বিজয়কে তারা ঠেকাতে পারে নি। মানবতাবাদী এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিটি নিজের মরদেহ বিজ্ঞানের কাজে লাগানোর জন্য দান করে গেছেন জীবিত থাকার সময়েই। বেঁচে থাকতে তিনি কাজ করেছেন মানুষের কল্যানে, মরণেও সেই মহৎ কাজ থামে নি।

অন্ধকারের হিংস্র প্রাণীরা মরণ কামড় দিচ্ছে। সবাই শক্ত হয়ে থাকুন, ঘন হয়ে থাকুন, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। অভিজিৎ রায়ও মৃত্যুর আগে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন।

জামাত শিবির আর সাইদী মাইদী কদু বদু যদু মোল্লাদের সময় যে শেষ এ থেকে খুব ভাল করেই আমি বুঝতে পারছি। এরা সব সময়ই মরার আগে শেষ কামড় দিতে চেষ্টা করে। ৭১ এ বিজয় দিবসের দুই দিন আগে কারা আর কেন বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল শকুনের দল, মনে আছে? মনে আছে স্বৈরাচারের পতনের ঠিক আগে কি ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল ডাক্তার মিলনকে? এগুলো আলামত। তাদের অন্তিম সময় সমাগত। পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে!

বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।

হ্যাঁ, বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। কোপ দিয়ে গলা কাটা যায়, কিন্তু কণ্ঠস্বরকে দমানো যায় না।

সবাই কণ্ঠ ছাড়ুন জোরে।