“জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা। সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবি দেখি তা না না না………….. গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়, লালন বলে জাত কারে কয়.. এই ভ্রমও তো গেল না ” – ঊনিশ শতকের লালন ধর্মতত্ব । লালন তখনেই বুঝে ছিলেন “ধর্ম”- বড়ই মহা মুল্যবান তত্ব। তাই আজ আমাদের ভাবনায়, গবেষণায় প্রশ্ন ‘ধর্ম মানুষকে জন্ম দিয়েছে নাকি মানুষ ধর্মকে’? ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গেলে লাল রক্তের রাম থেকে কৃষ্ণ, ইব্রাহীম থেকে মুহাম্মদ (সা:)বা যিশুর ধর্মের বিভিন্ন রূপ বা প্রকার নিয়েও বিস্তর আলাপ করা যাবে। একজন মুসলমান বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়ে বলতে পারি ইসলাম একটি একেশ্বরবাদী এবং ইব্রাহিমীয় ধর্ম। কোরআন দ্বারা পরিচালিত এই ধর্ম যাকে এর অনুসারীরা হুবহু মহান আল্লাহর বানী বলে মনে করেন এবং ইসলামের প্রধান নবী মুহাম্মদ(সা:)কে শেষ নবী মনে করেন।

দীর্ঘ পথ মানব সমাজ পারি দিলেও ধর্মকে নিয়ে যুদ্ধ আজও চলছে! পাকিস্তান, আফগানিস্থান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া সহ এর অনেক উদাহরন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে খিলাফত, ইসলামিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জিহাদের নামে আল-কায়েদা, আই এস, হিযবুত তাহরীর, লস্কর-ই-তায়িবা, তেহরিক তালিবান, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন সহ ইসলামিক মুজাহিদীনরা যে ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু করেছে তা কতটুকু যুক্তি সঙ্গত?

সম্প্রতি “বাংলাদেশ-ভারত” তাদের কালো পতকার নজরবন্দী হয়েছে। প্রথমত হিন্দুস্তান পুন:রুদ্ধারের যুদ্ধ এবং সেই সাথে বাংলাদেশকে পুরোপুরি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিনত করবার অপ:প্রয়াশ। বাংলাদেশে যার বীজ বপন করেছে জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আ’লা মওদূদী তার ইসলামী অপব্যাখ্যার মাধ্যমে। যেখানে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তোমার দায়িত্ব (হে নবী)কেবল বার্তা পৌছানো ।” আর মওদূদী তার রচিত হকীকতে জিহাদ বইয়ের পৃষ্ঠা ১০ ব্যাখ্যায় বলেন “রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়া ইসলাম হয়না ।” এটা ইসলামের নামে ভন্ডামী ছাড়া আর কিছুই নয়!

বাংলাদেশে তার চিত্র বহু আগে থেকেই আমরা দেখে আসছি। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে তথাকথিত আলেম উলামাদের কোন ইতিবাচক সমর্থন ছিল না বরং এক দুইজন নিজেদের বিবেক বোধ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরব সমর্থন দিয়ে থাকলেও সাংগঠনিকভাবে বা প্রকাশ্যে তাদের অবস্থান বা ভূমিকা ছিল নেক্কারজনক । স্বাধীনতার পর প্রথম সাড়ে তিন বছর এরা সমাজে মাথা উচু করে কথা বলার মত সাহস পর্যন্ত পায়নি। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তেন পর এরা দ্রুত সংঘবদ্ধ হতে আরম্ভ করে এবং ১৯৭৭ সালের মধ্যেই নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে। সর্বপ্রথম সংগঠিত হয় জামাতে ইসলামী। তাদের মধ্যপ্রাচ্য কানেকশনস কাজে লাগিয়ে তারা বিশাল নেটওর্য়াক গড়ে তুলে এদেশে। এরপর ঘর গোছানো আরম্ভ করে দেওবন্দ মতাবাদী ব্রাম্মনবাড়িয়ার বড় হুজুরের মাদ্রাসাগুলো। ’৯১ সালের পর থেকে দ্রুত মাঠে নামে এদেশীয় দেওবন্দ মতবাদের ঘাটি হিসাবে পরিচিত হাটহাজারী ও পটিয়া মাদ্রাসার হোতারা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী নেটওর্য়াকও উগ্রবাদীদের আরো উৎসাহিত করে; জন্ম নেয় জিহাদের।

মুক্তমনা বলেই আমাদের চিন্তার পরিসরটুকু ব্যাপক। তাই অন্ধাকারের মানুষগুলো আজ ধর্মান্ধ। আর মুক্তচিন্তার কলম ধরলেই এইসব ধর্মান্ধ মানুষগুলো জিহাদের নামে মুক্তচিন্তার ধারককে হত্যা করতে উদ্ধত হয়। এ যেন তরবারির থেকে কলম বেশি ধারালো।কিন্তু তারা কি জানে জিহাদের প্রকৃত অর্থ ? ইসলাম ধর্মের একটি শিক্ষা হল জিহাদ। এই শব্দের শাব্দিক অনুবাদ হল, চেষ্টা-প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম। কিন্তু এই শিক্ষার বিকৃত ব্যাখ্যাই মুসলমানদের একাংশকে বিপথগামী করেছে এবং এখনও করছে। অথচ কোরআন, সুন্নত ও সহীহ হাদীসের দিকে তাকালে অতি সহজেই জিহাদের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য্য স্পষ্ট হয়ে যায়। একবার এক আত্মরক্ষামূলক ধর্মযুদ্ধ থেকে মদীনায় শান্তিপূর্ণ জীবনে ফেরৎ আসার সময় মহানবী(সা:) তাঁর সাহাবীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমরা ‘সবচেয়ে ছোট জিহাদ’ থেকে এখন ‘সবচেয়ে বড় জিহাদের’ দিকে প্রত্যাবর্তন করছি।” (কাশফুল মাহজুব ও আল্লামা যামাখ্শারির তফসীরে কাশ্শাফ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ, সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধ শেষে আমরা এখন আত্মশুদ্ধির জিহাদে ফিরে আসছি। এই উক্তিতে মহানবী(সা:) স্পষ্টভাবে আত্মশুদ্ধির জিহাদকে সবচেয়ে বড় জিহাদ আর সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধকে সবচেয়ে ছোট জিহাদ বলেছেন।

আরও একটি জিহাদের ধরন কোরআন শরীফে উলেস্নখ করা হয়েছে। সূরা ফুরকানের ৫২ আয়াতে আলস্নাহ তা’লা নবীজী(সা:)-কে বলেছেন, ‘সুতরাং তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না এবং তুমি কোরআনের সাহায্যে তাদের সাথে প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’ এই আয়াতে কোরআনের পবিত্র ও আকর্ষণীয় শিক্ষা উপস্থাপনের মাধ্যেমে অস্বীকারকারীদেরকে প্রতিহত করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। লক্ষ করুন, এখানে কোরআনের সৌন্দর্য্য প্রচারের জিহাদকে বড় জিহাদ তথা ‘জিহাদে কবীর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় জিহাদ হল, আত্মশুদ্ধির জিহাদ এরপর হল বড় জিহাদ তথা কোরআনের শিক্ষা প্রচারের জিহাদ। এরপর আরেক ধরনের জিহাদ রয়েছে যাকে পরিভাষায় ‘জিহাদে সাগীর’ বা ছোট জিহাদ বলা হয়। সেটির উল্লেখ রয়েছে সুরা আস্ সাফের ১০ এবং নম্বর আয়াতে। আল্লাহ তা’লা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব যা তোমাদেরকে মর্মন্তদ শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? সেটি হল, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটিই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা জানতে!’ এই আয়াতদ্বয়ে ধন-সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করাকে উত্তম জিহাদ বলা হয়েছে। তাই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করাটা জিহাদের একটি অন্যতম প্রকার। এখানে ধন-সম্পদ ব্যয় করার পাশাপাশি জীবন ব্যয় করার কথা উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করাটাও এক মহান জিহাদ। মহানবী(সা:)-এর জীবদ্দশায় ‘আসহাবুস্ সুফ্ফা’ নামে পরিচিত কয়েকজন সাহাবী দিনরাত ধর্মচর্চা ও শেখার জন্য মসজিদে নববীতেই পড়ে থাকতেন। এরা জীবন উৎসর্গকারী খোদাপ্রেমিক মুসলমান ছিলেন। কোরআন, সুন্নত ও সহীহ হাদীসে কোথাও আত্মঘাতি বোমারু বা ঘাতক হবার শিক্ষা দেয়া হয় নি। বরং আত্মহননকে হারাম বলা হয়েছে। অতএব বর্তমানে উগ্র-ধর্মান্ধরা যা করছে তা সম্পূর্ণভাবে ইসলামী শিক্ষা পরিপন্থি।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার সহ অন্যদের এবং সম্প্রতি অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকান্ডে মুসলমান হিসেবে আমরা লজ্জিত। যে বা যারা-ই এই নৃশংস হত্যাকান্ড- চালিয়েছে তাদের সাথে ইসলামী শিক্ষার দূরতম সম্পর্ক নাই। যদিও এই সব উগ্রপন্থীরা নিজেদেরকে জিহাদী বলে আত্মতৃপ্ত হয়। বলা হচ্ছে অভিজিৎ রায় নাকি মুক্তবুদ্ধি চর্চার নামে ধর্ম অবমাননা করত। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় সে ধর্ম অবমাননা করত তাহলেও কি তাকে হত্যা করার বিধান ইসলামে আছে? কোন্ সূরার কোন্ আয়াতে এমন শিক্ষা দেয়া আছে আমরা তা জানতে চাই। ধর্ম কি একটা তাসের ঘর যা একজনের মুখের কথায় ধ্বসে পড়বে? অভিজিৎ রায় কি লিখেছে আর কোন প্রসঙ্গে লিখেছে সে কথা না পড়েই, সেগুলোর যুক্তিযুক্ত উত্তর না দিয়ে তাঁকে হত্যা করার বিধান এসব নব্য রাজাকাররা/জঙ্গিরা কোথায় পেল? এই নববিধান আর যাই হোক, ইসলাম নয়। বরং ইসলামের নামে অধর্ম। এসব নরপিশাচকে ইসলামের মহান নবী(সা:) কখনও সমর্থন দেননি এবং কোরআনও সমর্থন করে না।

ধর্ম নামে জঙ্গিবাদ তৈরিতে প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক টাস্ক ফোর্স গঠন করে এই ক্যান্সার নিরময় করতে হবে। নয়তো আজ অভিজিৎ কাল হয়তো আপনি বা আমি।