দুই উপায়ে মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায়- সাক্ষাত স্বশরীরে, আর দ্বিতীয় কোন মাধ্যমের সহায়তায় তার চিন্তা-চেতনা-বুদ্ধির অশরীরি সংস্পর্শে এসে। এই অশরীরি পরিচয়ই সবচেয়ে শক্তিশালী ও টেকসই লাগে আমার কাছে। একজন পিতার দুই ধরনের সন্তান থাকতে পারে- জাত-সন্তান ও ভাব-সন্তান। জাত-সন্তান তার জৈবনিক অস্তিত্ব থেকে আসে, কিন্তু ভাব-সন্তানের সৃষ্টি হয় পিতার চিন্তা ও ভাব থেকে। তবে জাত-সন্তানও ভাব-সন্তান হয়ে উঠতে পারে। একজন আদর্শ পিতার কাছে ভাব-সন্তান অনেক বড়। এই সন্তানই তার সত্যিকারে উত্তরাধিকার। তেমনি ভাবে একজন শিক্ষক বা গুরুর শিস্য যদি তার ভাবনাকে ধারন করতে ব্যর্থ হয় তবে সেই শিক্ষক ও ছাত্র উভয়েই ব্যর্থ। গুরুর সত্যিকারের উত্তরাধিকার তার ভাবশিষ্য। অশরীরি পরিচিতির মাধ্যমে ভাবশিষ্য তৈরী হতে পারে। অভিজিতের সাথে আমার পরিচয় তার চিন্তা-ভাবনা আর জগতচেতনার পরিচয়ের মাধ্যমে। দুয়েকটা ইমেল, মন্তব্য আর তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে তার সাথে আমার যে পরিচয় সেটা আমার মনে হয় তাকে সত্যিকার ভাবে জানা। এই জানা তার আত্মার চেতনাকে জানা, এই জানা তার মুক্ত চেতনার গতি প্রবাহের সাথে পরিচিত হওয়া। তার সাথে আমার অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকা সত্বেও, এইভাবে জানতে জানতে কখন যে আমি তার বিজ্ঞান-চিন্তা এবং জগত-চেতনার ভাবশিষ্য হয়ে গেছি জানতে পারিনি। অনেকবার অভিজিত কানাডায় এসেছে, সময় করে উঠতে পারিনি কোন বারই। ভেবেছি আমেরিকায় নিজে যখন যাবো দেখা করে আসবো। সে যাওয়া আর হয়নি। একটা আফসোস তাই থেকে গেছে। তবে অভিজিতকে চিনিনি একথা বলা যাবে না।

২০০১ সালে মুক্তমনার জন্ম। এই ব্লগের জন্ম তাও সেই অভিজিতের হাত ধরে। সেখানকার লেখা পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে যেতাম, অনেক আইডিয়া, চিন্তা-চেতনা মাথায় আসতো। যুক্তি-বুদ্ধির বৈজ্ঞানিক প্রকাশকে আস্তে আস্তে জীবনে অংশ করে নেই এইভাবে। বেশ কয়েক বছর পর, সম্ভবতঃ ২০০৬ সালে অভিজিতকে ইমেল করি মেম্বরশীপের জন্যে, মুক্তমনার লেখক হবার জন্যে। পরদিনই বিনয়ালোকিত একটা উত্তর পাই, যাতে লেখা ছিল- অতিথি লেখক হিসাবে লিখতে লিখতে লেখক হওয়া যাবে, মেম্বার হওয়া যাবে। মনে আছে, প্রথমদিন খোয়াব নামে একটা ছোটগল্প পাঠিয়েছিলাম। দেখলাম ছাপিয়েছে এবং সাথে একটা ইমেলও পাঠিয়েছে, যেখানে আছে মুক্তমনার মেম্বরশীপের ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড। সেই থেকে থামিনি, একটার পর একটা গল্প প্রকাশ করেছি ব্লগে পাঠকদের জন্যে। উপদেশ, পরামর্শ, উতসাহ পেয়েছি তার কাছ থেকে অনেক সময়। অবাক হয়েছি, তার সেইসব মন্তব্যে বিনয়, প্রজ্ঞা আর উতসাহের আলোর কখনও এতটুকু অভাব হয়নি।

বিজ্ঞান নিয়ে লিখেছে বা লিখছে অনেকেই। জনপ্রিয় বিজ্ঞান বা পপুলার সাইন্সের জগতেও অনেক লেখক এসেছে। তাদের সাথে অভিজিতের একটা মৌলিক ফারাক আমার চোখে ধরা পড়েছে। একধরনের বিনোদনের মাধ্যমে বিজ্ঞান সম্পর্কে অনুসন্ধিতসা তৈরী হয় জনপ্রিয়-বিজ্ঞান পাঠে। এটা বিজ্ঞান জানার ক্ষেত্র তৈরী করে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জানাজানির ভেতর দিয়ে কতজন বিজ্ঞানমনস্ক হয়? বিজ্ঞান শেখা আর বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া এক জিনিস নয়। ধর্মান্ধরাও তো বিজ্ঞান পড়ছে, বিজ্ঞান জানছে, বৈজ্ঞানিক হচ্ছে। তাই বলে তারা কি বিজ্ঞানমনস্ক? মোটেই তা নয়। বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে বিজ্ঞানের দর্শন এবং ইতিহাস জানতে হয়। জানতে হয় বিজ্ঞান পাঠের অভিজ্ঞান, অনুভুতি, ও ধারকে কিভাবে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনে প্রতিফলিত করতে হয়। অভিজিত তার সব রচনায় জ্ঞাতসারে এই কাজটি করেছে। সে তো সমাজের মৌলিক গলদ চিহ্নিত করে ভুলে ভরা সমাজের রশি ধরে টান দিয়েছে। তার এই কাজই তাকে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র ও মহিমান্বিত করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলতার মাঝখানে বসে, যথেষ্ট আত্মসাবধানী না হয়ে সবথেকে ঝুকির কাজটা সে করেছে। এই শ্রেণীর আলোকিত মানুষেরা এমনই সাহস বুকে পুষে চলাফেরা করে। হুমায়ুন আজাদও তেমনই ছিলেন। সক্রেটিসও তাই। সব আলোকিত মানুষ তাইই।

প্রবাসের কর্ম ব্যস্ততা আর বিষন্বতার মাঝখানে বসে তিতাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত সাত-আটখানা অমূল্য পুস্তক অভিজিত আমাদের কাছে রেখে গেছে, আমাদের বুদ্ধিতে শান দেবার উদ্দেশ্যে। তার এইভাবে চলে যাওয়াটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। যারা তার কিছু দেওয়ার অধিকার, আমাদের পাওয়ার অধিকারটা হরন করলো, তাদের সাথে আমাদের আমরন শত্রুতা, কেসাসের সম্পর্ক। আমরা শোকাহত, আমরা অপমানিত। আমরা প্রতিশোধ নেবো প্রথেমে তার বিজ্ঞান-চিন্তা ও চেতনাকে মাথায় তুলে নিয়ে, পরে অন্য হিসাব আছে আমাদের। আমরা শুধু মরবো না, মারবোও। হত্যাকারীরা শাসকের চোখের সামনে দিয়ে তার কাজ সেরে চলে যায়। ইচ্ছা-অন্ধ শাসক চোখ বন্ধ করে হত্যাকারীর দেহে-মনে পুষ্টি জোগায়। তাই আমরা চিনে গেছি, জেনে গেছি কে হত্যাকারী আর কে তাদের পৃষ্টপোষক। আমরা সবাই তা জানি কি?

অনেকে বলে, যে জাতির উপর দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্বত-প্রমান দুর্ভিক্ষ, মহামারী, জলোচ্ছাস আর গণহত্যা বয়ে গেছে, তাদের প্রাণশক্তি সব নিঃশেষ হয়ে গেছে সেইসব বিনাশী শক্তির মোকাবেলায়। তারা কিভাবে বাঁধা দিবে অভিজিতের খুনে, কিভাবে ঠেকাবে বন্যার হাহাকার। বিয়াল্লিশ বছর ধরে যে জাতি চেয়ে চেয়ে দেখে গেছে গণহত্যার আর্তচিতকার আর হত্যাকারী বিজয় উতসব, তারা পকেটে হাত পুরে বা বুকে হাত বেঁধে উদাস নয়নে অভিজিত হত্যা দেখবে এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। অভিজিত হিন্দু না মুসলমান, আস্তিক না নাস্তিক সেই বিচারে আমরা যাবো না। আমরা জানি একজন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। মানুষ হিসাবে তাই আমরা ক্ষুব্ধ ও অপমানিত।

অভিজিত কোন মহামানব ছিল না, এখন ও নয়। সে ছিল সাধারন ও সহজ মানুষ। একটু একটু করে শ্রমে সাধনায় সে অভিজিত হয়ে উঠেছিল, শুধুই আমাদের জন্যে। তার চিন্তা-চেতনা ছিল অনন্য সাধারন, অসাধারন। অসাধারন যে কেউ হতে পারে। অসাধারন হতে হলে প্রথমে সহজ মানুষ হতে হয়ে। অভিজিতকে মহামানব বানাবার দরকার আছে বলে মনে হয় না। কারণ মহামানব উপাধী দিয়ে একজন সহজ মানুষকে সাধারন থেকে পৃথক করে ফেলানো হয়। ধারনা তৈরী করা হয়, মহামানবই এমন চিন্তা করতে পারে, আর কেউ নয়। মহান চিন্তা থেকে পলায়ন করার একটা সুজোগ এসে যায় তাতে। অভিজিতের বেলায় আমরা তা হতে দিতে পারি না। সে আমাদের মতন সহজ মানুষ। তাই আমি অভিজিত, আমরা সবাই অভিজিত। কেউ কি কখনও সাহস করে বলতে পারবে- আমি যিশু, আমরা যিশু।

অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাসের ভাইরাস অভিজিতের এই বই দুটো পড়েছি, তবে পুরোটা শেষ করে উঠতে পারিনি সময়-সুযোগের অভাবে। সব ধর্ম-বিশ্বাসে কথা এসেছে সেখানে। একটা বিষয়ে আমার নজর এড়ায়নি, কারও এড়াবে না- প্রতিটা বিতর্ককে সেখানে খণ্ডন করা হয়েছে অত্যান্ত যত্নের সাথে বিশ্বমানের যুক্তির ক্ষুরধারে। অতিবড় সমালোচকও সেখানে বালখিল্লতার চিহ্ন পাবে না, আমিও পাইনি। তার বিশ্বাস সংক্রান্ত এইসব রচনায় কোথাও উস্কানীর চিহ্নও আমি খুজে পাইনি। তাহলে কোন আক্রান্ত অনুভুতির কথা বলে বেড়ায় চিহ্নিত খুনিরা। অভিজিতকে আমরা হারিয়েছি, এই ত্রিমাতৃক জগতে আর তাকে পাওয়া যাবে না। তাকে হারিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন- আমরা কি খুনিদের চিনতে পেছেছি? সাগর-রুণির হন্তা আর অভিজিতের হত্যাকারী কি একই মাজহাবের লোক? আমার মনে হয় আমরা সবাই এইসব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি, জেনে গেছি। যদি জেনেই থাকি সব, তবে কি আমরা শুধু ভাগ্যকে দায়ী করবো? নাকি শুধু ঈশ্বরের উপরে অভিমান করে বুক শ্বাস আটকে রেখে বলবো-

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের করিয়াছ ক্ষমা, তুমি কি বেসেছ ভাল?

এই কবিতা আমরা আওড়াবো না আর। আমরা তা করবো না। আমাদের শোকের ধারা, আমাদের চোখের স্রোত দাহ্য, অগ্নিগর্ভা পেট্রলের মতন। আমাদের সেই গলিত শোক দিয়ে তৈরী হবে সহস্র অযুত বোমা। নিরীহ বাস নয়, ভারবাহী ট্রাক নয়, সেইসব বোমা পড়বে খুনি ও খুনিদের পুষ্টিদাতাদের আতুর ঘরে। বার্ন ইউনিট ভরে উঠবে অসংখ্য হাইব্রিড পশুর মৃতদেহে। আহত পশুরা কাতরাতে কাতরাতে ভোগ করবে যন্ত্রনা। মানুষের হাসপাতালে পশুর ডাক্তারের অভাবে তারা দিন গুণবে নরক যাত্রার। সেই দিন সমাগত প্রায়। মহিষ তার ধারাল মজবুত একজোড়া শিং নিয়ে পৃথিবীতে আসে আমৃত্যু যুদ্ধ করতে। বাতাসে শিং ঘুরিয়ে তাদের প্রাণে তৃপ্তি আসে না। সামনে বাধা আসলেই তাদের সংগ্রাম শুরু হয়- প্রকাশ হয়ে পড়ে শিংয়ের শক্তি। আমাদের সামনেও বাঁধার বিন্ধাচল। আমরা শত্রু চিনি। শত্রুর বিপক্ষে তাই আমরা বাফেলো সোলজার। জ্যামেইকার প্রফেট বব মার্লি গেয়েছিল একদা নির্যাতিতের গান। দলিত কৃষ্ণাঙ্গদের করেছিল অধিকার সচেতন। আমরাও আমাদের অধিকার ছিনিয়ে আনবো লুটেরা হাইব্রিড জন্তুর মুখ থেকে, প্রতিষ্ঠা করবো ভিন্নমতের প্রকাশাভিলাশ। তাই ঐ অভিমানের গান আর গাইবো না, গলা মেলাবো বব মার্লির আগুন ঝরা সুরে।

Get up, stand up.
Stand up for your right.
Don’t give up the fight.