ছোট্ট বেলায় জেনেছিলাম সুজলা সুফলা সবুজ দেশ আমার প্রিয় জন্মভূমি – বাংলাদেশ। আমার শিশুমন বিশ্বাস করেছিল এর প্রতিটি শব্দ। দেশপ্রেম নামের আবেগের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলাম সেই ছোট্ট বেলাতেই। ভালোবেসেছিলাম যে মাটিতে জন্ম আমার সেই মাটিকে। সেই সাথে ছিল বাবার কাছে শোনা মুক্তিযুদ্ধের গল্প। হ্যাঁ, ভূত প্রেত দৈত্য দানোর গল্প শুনে বড় হইনি আমি, বড় হয়েছি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে। কিভাবে আমাদের আগের প্রজন্ম জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে যুদ্ধ করেছিল, পাকিস্তানী মিলিটারিকে কিভাবে বাংলাদেশ ছাড়া করেছিল সেই গল্প শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম আমি। পাকিস্তানের অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে সেই লড়াইয়ের গল্প শুনে শুনে দেশাত্ববোধ জন্মেছিল। জন্মেছিল মনুষত্বের চেতনা, অধিকার বোধের চেতনা, সাংস্কৃতিক চেতনা, সব মিলিয়ে বাঙ্গালীত্ববোধের চেতনা। ছেলেবেলা থেকে আমরা যে চেতনা নিয়ে বড় হয়েছিলাম, সেই চেতনায় ধর্মের বিভাজন ছিল না, বরং ছিল মানবতা বোধ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্মিলন। এই ছিল আমার দেশ, এভাবেই হয়ে উঠেছিলাম একজন মানুষ আমি, একজন বাংলাদেশী।

যে বাংলাদেশে জন্মেছিলাম আমি, সেই বাংলাদেশটি আজ কোথায়? আমি যে বাংলাদেশে জন্মেছিলাম সেই দেশের ভৌগলিক অবস্থান আর আজকের বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান একই, কিন্তু চেতনাগত দিক থেকে মোটেও তা আর এক নয়। আমার দেশের মানুষগুলো মানুষ ছিল, মুসলিম কিংবা হিন্দু হবার চেয়ে তারা মানবতাবোধে উন্নত ছিল। ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে তাদের মানব পরিচয়টা মুখ্য ছিল বলেই পাকিস্তানী মুসলিমদের অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। সেই মানবতাবোধ আজকে কোথায়?

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ পাকিস্তানীরা বাংলাদেশকে মেধাশূণ্য করে দেবার জন্যে বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল, এতোকাল আমরা সকলে তার নিন্দা করেছি। আমরা আরেকটি প্রজন্মের স্বপ্ন দেখেছি যে প্রজন্মের শাণিত মেধায় পূরণ হবে একাত্তরের হারানো মেধার শুণ্যতা। আজ আমরাই সেই প্রজন্ম, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম। আজ যখন আমাদের হেমন্তের বিকেলে ফসল তোলার সময়, তখন আমাদেরই দেশের কিছু জানোয়ার ধর্মের নামে কেড়ে নিল ড. অভিজিৎ রায়ের প্রাণ। ড. অভিজিৎ রায়, যিনি জ্ঞানের আলো, মুক্তচিন্তার আলো ছড়াতে চেয়েছিলেন তারই প্রিয় জন্মভূমিতে, তারই দেশের জনগণের মাঝে, তার প্রাণ কিনা কেড়ে নিল সেই জনগণ। হ্যাঁ আমি অভিযুক্ত করছি পুরো জাতিকেই। আমি অভিযুক্ত করছি সেই জাতিকে যারা কিনা মানুষ হবার চেয়ে ধার্মিক পশু হতে গর্ববোধ করে। যারা কিনা এক এক করে কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। যারা এখন গালি দেবার জন্য চায়ের দোকানের বদলে ফেসবুকে সংগঠিত হয়। যেখানে সমগ্র বিশ্ব জ্ঞানে বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, আলো ঝলমলে হয়ে উঠছে, সেইখানে তারা হয়ে উঠছে সন্ত্রাসী। তাদের হাতে এখন কলম নয়, চাপাতি শোভা পায়। হয়ত একদিন তারা চাপাতির বদলে হাতে নেবে এ.কে. 47, দেশের নামটা বদলে রাখবে আফগানিস্তান।

ওরা অভিজিৎ দাকে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে, ফুটপাতে পড়ে ছিল অভিজিৎদার মগজ আর চশমা। ওদের সাহস হয়নি অভিজিৎদার লেখা একটা বিজ্ঞানের বই পড়ে উনার সাথে বিতর্কে নামার। ওদের সাহস হয়নি অভিজিৎদার যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দেবার। ওদের সাহস হয়নি অভিজিৎদার মত মুক্তমনের বিশাল হৃদয়ের মানুষ হয়ে দেখাবার। তার পরিবর্তে তারা দিয়ে গেছে তাকে হুমকি ধামকি। ওরা শুধু জানতো না, অভিজিৎ রায়ের মত মানুষকে হুমকিতে থামানো যায় না। অভিজিৎ রায়ের মত মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়া যায় না কুপিয়ে। অভিজিৎ রায় কেবল একজন নন, অভিজিৎ রায় একা মুক্তচিন্তা করতেন না, অভিজিৎ রায় অজস্র মানুষকে মুক্তচিন্তা করাতেন। তিনি শিখিয়ে গেছেন, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে কি করে চালিয়ে যেতে হয় মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন। একজন অভিজিৎ রায়ের মাথা ছিন্নভিন্ন করে দিলেই মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন ভেস্তে যায় না, অভিজিৎ রায়ের অজস্র ছাত্র বেঁচে আছে, থাকবে। অভিজিৎ রায়ের লেখা প্রতিটি অক্ষর কথা বলবে, অভিজিৎ রায়ের সতীর্থরা কথা বলবে, ক’জন অভিজিৎ রায়কে থামাবে ওরা? অভিজিৎ রায় হবার যোগ্যতা যেমন ওরা রাখে না, অভিজিৎ রায়কে থামিয়ে দেবার যোগ্যতাও ওরা রাখে না। বরং ওরা অভিজিৎদাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে দিয়ে গেছে। অভিজিৎদা আমার দেখা অন্যতম সাহসী ব্যক্তি। উনার অনুপ্রেরণাতেই এগিয়ে যাব আমরা।

একবার যুক্তিবাদী হয়ে গেলে আর অযৌক্তিক হওয়া যায় না। একবার বিজ্ঞানের সৌন্দর্য জেনে গেলে এরপর আর বেহেশতী হুরে লোভ হয় না। একবার জ্ঞানতৃষ্ণায় পেলে মূর্খতাকে আর প্রশ্রয় দেয়া যায় না। অভিজিৎদা আমাদের শিখিয়ে গেছেন এই যুক্তিবাদিতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, জ্ঞানতৃষ্ণা। তিনি ছিলেন আমাদের শিক্ষক, পথিকৃৎ। আমরা মুক্তচিন্তা ভিন্ন অন্য কোন পথে চলতে পারব না। মুক্তচিন্তা চলবেই। একদিন আলো আসবেই। ধন্যবাদ অভিজিৎদা অপরাজিত জীবনের পথ দেখিয়ে যাবার জন্য।