অভিজিৎ রায়ের সাথে কবে কোথায় প্রথম পরিচয় তা আর আজ মনে নেই। তবে ধারণা করি মুক্তমনার সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিউইয়র্কে বসবাসরত বন্ধু জাহেদ আহমেদের মাধ্যমে এই বিজ্ঞানি, মুক্তচিন্তার ধারক, আলোর পথের যাত্রী, সদালাপি মানুষটির সাথে যোগাযোগ এবং পরে বুন্ধত্ব হয়। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ করেন মুক্তমনায় লেখার জন্যে। বিগত বছর তিনেক বাদ দিলে তাঁর ব্লগে প্রায় নিয়মিত একসময়ে ইংরেজী বাংলা উভয় শাখায় লিখেছি। কয়েকটি বিশেষ সংখ্যায় লেখার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন তিনি, যেমন হুমায়ুন আজাদ সংখ্যা, ডারুইন সংখ্যা ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো ডারুইন সংখ্যায় তিনি আমার ‘বিবর্তন’ নামের কবিতাটি ইংরেজী বাংলা দুই ভাষায় ছেপে দিয়েছিলেন, এবং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছিলেন এমন কবিতা যেনো আরো লিখি। আমি যেহেতু কবিতা বা কবিতার ছন্দ নিয়ে কাজ করি, তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন ছন্দ নিয়ে যেনো মুক্তমনার পাঠকদের জন্যে দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখি। আমি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম, এবং খানিকটা সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত ‘তিনপ্রকার ছন্দ’ ও ‘বাংলা ছন্দের ধারাবাহিক বিকাশ’ নামে দুটি প্রবন্ধের পাঠকপ্রিয়তা দেখে আমি নিজেই বিস্মিত হয়েছি। তবে, মুক্তমনায় নানা সময়ে আমাকে নানা ব্যক্তি এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেও অভিজিৎ রায় আমার পক্ষ নিয়েছেন, কবিতার পক্ষে থেকেছেন, মুক্তচিন্তা ও মানুষের নানাবিধ উদ্ভাবনার সাথে একাত্ম হয়েছেন। যেমন আমার লেখা ‘বিবর্তন’ কবিতা তিনি গুরুত্বসহকারে ছেপেছেন তেমনি ‘গাজার ক্রন্দন’কেও কম গুরুত্ব দেননি। তিনি ছিলেন, (এই ‘ছিলেন’ শব্দটি ব্যবহার করতে একেবারেই ইচ্ছা হচ্ছে না, কিন্তু অন্ধকার ও দেশীয় নির্মমতা এমন এক পর্যায়ে নেমে গেছে যে আজ বুকের ভেতর থেকে যতো কষ্টই ঠেলে উঠুন না কেনো শব্দটি ব্যবহারের বিকল্প নেই) সত্যিকার অর্থে একজন মুক্তচিন্তা, মুক্তমন ও বিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত প্রকৃত মানুষ। একবার স্ত্রী বন্যা আহমেদ ও সন্তানসহ নিউইয়র্কে আমাদের আতিথেয়তাও গ্রহণ করেছিলেন। ফিরে গিয়ে আমার মহাকাব্যিক গ্রন্থ ‘নক্ষত্র ও মানুষের প্রচ্ছদ’-এ বিজ্ঞানের ব্যবহার ও বিস্তার নিয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, যা পরে ‘শব্দগুচ্ছ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তাঁর নিজের লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ পড়েছি; পড়েছি তিনখানা গ্রন্থ: ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’, এবং ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। পড়েছি বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’। ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ গ্রন্থখানা অবশ্য তাঁর সম্পাদিত একটি প্রবন্ধ সংকলন, যেখানে আমার নিজেরও একটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছিলো, এবং গ্রন্থের শিরোনার আমার লেখা ‘স্বতন্ত্র সনেট’-এর অনুগামী হওয়ায় আমার কিছুটা আপত্তিও যে ছিলো না তা বলবো না, কিন্তু প্রবন্ধগুলো পড়ে মনে হয়েছে, ওই সংকলনের জন্যে নামটি ছিলো যথোপযুক্ত। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ তাঁর এই গ্রন্থ দুটিতে তিনি বিজ্ঞানকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ করেছেন, মানুষের উৎপত্তি ও চলমানতায় বিজ্ঞানের যে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগের সুস্পষ্ট ধারণার সুচারু সমন্বয় রেখেছেন তার তুলনা ড. হুমায়ুন আজাদের ‘মহাবিশ্ব’ ছাড়া বর্তমান বাংলা ভাষায় অন্যকোনো গ্রন্থে আছে কি না আমার জানা নেই। একই কথা খাটে বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ গ্রন্থের ক্ষেত্রেও। অতএব এই দুইজন ব্যক্তি, এই দুইজন বিজ্ঞানি, মুক্তচিন্তক যে অন্ধকারের কুটির বাসি সাপ-কুচে-ব্যাঙ-বিচ্ছুর টার্গেটে পরিণত হবেন সেটা ছিলো স্বাভাবিক। এই দুইজনকে পিছন থেকে কাপুরুষেরা আঘাত করে, অভিজিৎ রায়কে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে হয়তো ওইসব ‘শয়তানেরা’ আপাতত স্বস্তির ঠেকুর তুলছে, কিন্তু অন্ধকার সর্বদাই আলোর কাছে পরাজিত হয়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। অভিজিৎ রায়ের লেখনি, তাঁর চিন্তার বিনাশ বস্তুত নেই।

২.
অভিজিৎ রায়কে হত্যার পিছনে শুধু যে তাঁর লেখালেখি দায়ী তা কিন্তু নয়, মুক্তমনা নামের ব্লগের প্রতিষ্ঠা এবং এই ওয়েবসাইটটির জনপ্রিয়তা ধর্মবাদীদের যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছিলো। এই ওয়েবসাইটটি সেকুলারিজমের জন্যে এতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এর মূল্যায়ন হয়েছে নানা ভাবে। আমার একটি অভিজ্ঞতা ছিলো এমন: বছর কয়েক আগে এক ভদ্রলোক ফোনে জানালেন যে তিনি আমার সাথে দেখা করতে চান। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর নিজেরও লেখালেখির অভ্যেস আছে, এবং দেশে থাকা অবস্থায় একখানা বইও প্রকাশিত হয়েছে। সময় মতো একদিন জ্যাকসন হাইটসের এক বাঙালী রেস্টুরেন্টে আমাদের আলাপ হয়, তিনি তখন আমাকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্যে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছেন, এবং নিয়মমাফিক দরখস্তও করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে দেশে ফিরে গেলে মৌলবাদিরা প্রকাশিত ওই বইয়ের জন্যে তাঁর প্রাণ নাশ করতে পারে। ফেডারেল কোর্টে এই কেসের শুনানিতে মহামান্য বিচারক নাকি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, “কই মুক্তমনায় তো তোমার বই নিয়ে কোনো আলোচনা আসেনি। আমি কি করে বুঝবো, তুমি দেশে ফিরলে তোমার প্রাণ নাশের আশঙ্কা আছে?” এরপর ভদ্রলোক আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেনো তাঁর বইটি নিয়ে মুক্তমনায় কিছু লিখি। তাৎক্ষণিক ভাবে আমি কথা দিতে না পারলেও আগে বইটি পড়ে দেখার কথা বলি। পরে, আমি ওই বই নিয়ে মুক্তমনার ইংরেজী শাখায় একটি আলোচনা লিখি। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, পরবর্তী শুনানিতে সেই ভদ্রলোকের কেসটি মঞ্জুর হয়ে যায় এবং তিনি পরে গ্রীনকার্ডও পান। অতএব অভিজিৎকে হত্যা করে মৌলবাদিরা শুধু মুক্ত চিন্তার উপর আঘান হানেনি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটটি বন্ধ করারও স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন কোনো অবস্থাতেই পূরণ হবার নয়। মৃত্যু ও হত্যার মাধ্যমে বিজ্ঞানের আলো কোনো কালেই নিভানো যায়নি, যাবে না।