আমি তাঁকে ডাকি ‘গুরু’ বলে। অভিজিৎ বিরক্ত হন। কারণ এক অর্থে এই পৃথিবী তথাকথিত গুরুদের জ্বালায় অস্থির। রাজনৈতিক গুরু, ধর্মীয় গুরু, সন্ত্রাসের গুরু এরকম আরো কত কী গুরুর দাপটে সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া সরল মানুষ, লেখাপড়া জানা ছাপোষা মানুষ, লোভী মানুষ, হাজার বছরের লালিত সংস্কারে আচ্ছন্ন দুর্বল মানুষ বড়ই বিপন্ন আজ। তাই ‘গুরু’ ডাকে অভিজিতের আপত্তি। আমিও বুঝি ব্যাপারটা। কিন্তু গুরু বলতে শিক্ষকও তো বোঝায়। যাঁর কাছ থেকে প্রতিদিনই আমি মুক্তমনা হবার পাঠ নিই তিনি তো আমার গুরুই।


বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই পড়ছি সেই কৈশোর থেকে। আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন, জহুরুল হক, তপন চক্রবর্তী, সুব্রত বড়ুয়া থেকে শুরু করে পশ্চিম বঙ্গের অনেক লেখকের বইও পড়া হয়েছে ততদিনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যখন ইংরেজিতে কিছু জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই পড়ার সুযোগ হয় – তখন এক নতুন ধরনের তৃষ্ণা জেগে ওঠে। মনে হতে থাকে, বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের বইগুলো কেন এরকম প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে না? ২০০৫ সালে হাতে এলো ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। বইটি পড়ে মনে হলো – এরকম একটা বইয়ের জন্যই আমি আকুল হয়ে বসেছিলাম। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান যে কত গভীর অথচ কত তরতাজা হতে পারে তার প্রমাণ অভিজিৎ রায় তাঁর প্রকাশিত প্রথম বইতেই দিয়েছেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তরুণ বিজ্ঞানী অভিজিৎ রায়ের চিন্তা ও লেখার আকাশচুম্বী ক্ষমতা।

230049_222385901121976_1927343_n

‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’র মলাট-তথ্য থেকে জানতে পারলাম ‘মুক্তমনা’ নামে একটা ওয়েবসাইট আছে যেখানে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোচনা হয়। পশ্চিম বঙ্গের প্রবীর ঘোষ যেভাবে যুক্তিবাদী সমিতি দাঁড় করিয়ে ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ এবং অন্যান্য বইগুলোর মাধ্যমে মানুষের মানসিক অন্ধত্ব দূর করার সংগ্রাম শুরু করেছেন, সেরকম কোন প্রচেষ্টা বাংলাদেশে হতে পারে তা ভাবতেও সাহস পাইনি সেই সময়। কিন্তু মুক্তমনা ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম – যে মহৎ কাজের কথা আমি ভাবতেও সাহস পাচ্ছিলাম না তা ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন অভিজিৎ রায়, ফরিদ আহমেদ, বিপ্লব পাল, জাফরউল্লাহ সহ আরো অনেক মুক্তমনা মানুষ।

২০০৬ সালে আমি মুক্তমনায় লিখতে শুরু করি। শুরু থেকেই অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের কাছ থেকে যে উৎসাহ পেয়েছি তা আমাকে ঋদ্ধ করেছে। তারপর আমার যা কিছু লেখা তার সবটুকুই হয়েছে মুক্তমনার জন্য। মুক্তমনার সংস্পর্শে এসে প্রতিদিন একটু একটু করে মুক্তমনা হতে চেষ্টা করছি আমি এবং আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষ। মুক্তমনায় আমরা মন খুলে আলোচনা করছি, সমালোচনা করছি, লিখছি, পড়ছি, শিখছি এবং ক্রমশ মুক্ত মনের মানুষ হবার পাঠ নিচ্ছি। আর এসব কর্মযজ্ঞের প্রধান পরশ পাথরের নাম অভিজিৎ রায়।

২০০৭ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর দ্বিতীয় বই ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’। বইটি তিনি লিখেছেন ফরিদ আহমেদের সাথে। মহাকাশ গবেষণার সাম্প্রতিকতম ফলাফল পর্যন্ত বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ এই বই বাংলাভাষায় বিজ্ঞান বইয়ের জগতে আরেকটি মাইলফলক।

61496_116777981711814_8340536_n

বাংলাদেশের মত রক্ষণশীল দেশে সমকামিতা বা সমপ্রেম, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে যৌক্তিক কোন আলোচনা কখনোই হয় না বললে চলে। কারণ আমরা লজ্জা পাই, ভয় পাই সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার। কিন্তু প্রকৃত গবেষক অভিজিৎ রায় কী নির্মোহ অথচ প্রাঞ্জল যুক্তিবোধের আলোকে আমাদের জন্য রচনা করেন সমকামিতা বিষয়ে বাংলাভাষায় প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র গবেষণাগ্রন্থ ‘সমকামিতা একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’। শুদ্ধস্বর থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে।

35505_116880038368275_5496779_n

পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’। বইটির যুগ্মলেখক রায়হান আবীর। বাংলায় বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মনন-দর্শনের এই বই ব্যাপক সাড়া ফেলে বিদ্বজন সমাজে। প্রকাশিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বইটির কয়েকটি মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। বইটির তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এ বছর।

avijit_raihan_obisshasher_dorshon

ভালোবাসা-বাসি নিয়ে আমরা বাঙালিরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বড় বেশি ভাবুক। মনে মনে আমরা সবাই কমবেশি প্রেমিক/প্রেমিকা। কিন্তু আমাদের ভাবনার স্তর একটা নির্দিষ্ট মাত্রার গভীরে কখনোই প্রবেশ করে না। বহুমাত্রিক অভিজিৎ রায় হাত দিলেন এই বিষয়ে। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ভালোবাসা কারে কয় মানব মনের বৈজ্ঞানিক ভাবনা’। ভালোবাসার এমন মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ গবেষণা আর কোন বাংলা বইতে আমরা পাইনি। একজন বিজ্ঞানী যে কতটা বহুমাত্রিক হতে পারেন – তার উজ্জ্বল উদাহরণ অভিজিৎ রায়।

424469_299819156741028_1395134609_n

শত যুক্তির আলোকেও কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা আলোকিত হতে চান না। আসলে চান না নয়, পারেন না। কারণ তাঁদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ভাইরাস আক্রমণ করেছে – বিশ্বাসের ভাইরাস। এই বিশ্বাসের ভাইরাস যে কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে – তার সাম্প্রতিক নমুনা আমরা দেখলাম। কিছু ভাইরাস আক্রান্ত মানুষ অভিজিৎ ও বন্যাকে আক্রমণ করলো। ধারালো চাপাতির আঘাতে তাঁদের ছিন্নভিন্ন করলো। অভিজিৎ রায় তাঁর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইতে লিখে গেছেন যে কীভাবে মানুষের মগজ ধোলাই হয়, কীভাবে মানুষ হয়ে পড়ে বিশ্বাস নামক ভাইরাসের দাস, কীভাবে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার সমস্ত মানবিক গুণ। ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি আমাদের বাংলাভাষার পাঠকদের একটা অবশ্য-পাঠ্য বই।

10403327_837919962930942_1955713321263936705_n

‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে এ বছর। বইটির সহলেখক অধ্যাপক মীজান রহমানকে আমরা হারিয়েছি সম্প্রতি। মহাবিশ্বের উদ্ভব কীভাবে হয়েছে তার এমন চমৎকার প্রাণবন্ত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেয়া একমাত্র অভিজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব।

Print

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাঁর ভ্রমণ ও গবেষণামূলক বই ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’ প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের বইমেলায়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে শতাধিক বছর ধরে, প্রকাশিত হয়েছে হাজারো গ্রন্থ। কিন্তু অভিজিৎ রায় তাঁর এই বইতে এমন কিছু সন্নিবেশন করেছেন যা আগে কোন রবীন্দ্র-গবেষক আমাদের দিতে পারেননি। বাংলার খ্যাতিমান গবেষক গোলাম মুরশিদ নিজে বলেছেন এই কথা অভিজিৎ রায়ের বইটি সম্পর্কে।

Avijit_victoria_ocampo

এই বইগুলো ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন দুটো বিশাল বই: ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ এবং ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’। বাংলাভাষী মুক্তমনাদের লেখা ছাড়াও ইংরেজিভাষী মুক্তমনাদের লেখার স্বাদ আমাদের দেবার জন্য তিনি অনেক দরকারি লেখা অনুবাদ করেছেন, করিয়ে নিয়েছেন আমাদের দিয়ে। নিজের যোগ্যতায় ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার আধুনিক মননের বাতিঘর। আমরা অনেকেই তাঁকে বাংলার ‘রিচার্ড ডকিন্স’ বলেও মানি।

62027_116880075034938_5573677_n

396993_276774652378812_1229487714_n

অভিজিৎ রায় এমন একজন মানুষ যিনি যখন কিছু বলেন – পুরোটা জেনেই বলেন। গবেষণা তাঁর ধমনীতে। বিষয়ের গভীরে ঢুকে যাবার ব্যাপারে তাঁর মতো আর কাউকে তেমন দেখা যায় না। অথচ এই মানুষটার একটুও অহংকার নেই। যে কোন মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে এই মানুষটার একটুও সময় লাগে না। ব্লগে এই মানুষটার নামে কত যা তা বলেছে ভাইরাস-আক্রান্ত মানুষেরা। কিন্তু অভিজিৎ একটা বারের জন্যও পরিমিতিবোধ হারাননি। একটা শব্দও তাঁর কলম দিয়ে কখনো বের হয়নি যেটা কোন মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করতে পারে। জীবন বাঁচানোর জন্য যে ইন্‌জেকশান দিতে হয়, তাতে কিছুটা ব্যথা লাগে। তার জন্য কেউ কি কোন ডাক্তারকে খুন করে? অভিজিৎ রায় আমাদের মননের ভাইরাস সারানোর ডাক্তার।

Roy


অভিজিৎ রায় – শুধু একজন মানুষের নাম নয়, একটি আন্দোলনের নাম – মুক্তমনা আন্দোলন। বাংলাভাষী মুক্তমনাদের প্রাণের শক্তি আজ অভিজিৎ রায়। ঘাতকের ধারালো চাপাতি ভেদ করেছে অভিজিতের মগজ, হত্যা করেছে অভিজিতের শরীর। কিন্তু অভিজিৎ রায় যে আন্দোলনের সূচনা করে গেছেন, বিজ্ঞান ও যুক্তির যে আলো জ্বালিয়ে দিতে পেরেছেন অসংখ্য মানুষের মনে, তাকে হত্যা করার সাধ্য কারো নেই। আমাদের শোক পরিণত হোক আমাদের শক্তিতে। আমাদের লেখনি চলবেই।