ভারতীয় পিকে সিনেমায় দেবদেবীকে মানহানী করা হয়েছে এই মর্মে অভিযোগ করে আদালতে গিয়েছিল কিছু দেবদেবী প্রেমি হিন্দু ধার্মীক। ভারতীয় আদালত অবশ্য সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো যে, তারা সিনেমায় মানহানীকর বা আপত্তিকর কিছু দেখতে পাননি। ভারতীয় আদালত সম্ভবত ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বা পাবলিক সেন্টিমেন্ট দ্বারাও প্রভাবিত হয় না। পিকে ইস্যুতে অবশ্য পাবলিক সেন্টিমেন্ট সিনেমাটির পক্ষেই ছিল। প্রমাণ স্বরূপ শেষপর্যন্ত ৬০০ কোটি রুপি ব্যবসা করে ফেলেছে ধর্মীয় বিশ্বাসকে নিয়ে কমেডি করা এই সিনেমাটি! তার মানে দর্শকদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগেনি সিনেমাটি দেখে। আমাদের ধর্মীয় মৌলবাদী নেতাদের অভিজ্ঞতা বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী’র পিকের প্রশংসা করাকে বিস্মিত করেছে! ভারতে পিকের মত সিনেমা হিন্দু ধর্মানুভূতিতে কোন রূপ আঘাত লাগার ঘটনা তো ঘটেইনি উল্টো ছবিটি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসা সফল ছবির মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশে পিকে’র মত ছবি তৈরি (মুসলিম বিশ্বাস নিয়ে কমেডি) আগামী দুইশো বছরেও সম্ভব হবে না। ইসলাম স্যাটায়ার করার জিনিস না। ইসলাম বাকী দুনিয়াকে নিয়ে স্যাটায়ার করতে পারবে কিন্তু ইসলাম নিয়ে স্যাটায়ার ইসলাম কোনদিন মেনে নিবে না। এসব আমাদের সবারই জানা কথা। আমরা সেভাবেই চলি। আমাদের সিনেমা, নাটক, গল্প, উপন্যাস সব সময় ইসলাম, নবী, সাহাবী ইত্যাদি বিষয়ে ভুলেও “মজা” করার কথা ভাবতেই পারি না। ধর্ম নিয়ে স্যাটায়ার মুসলিম বোধের বাইরে। পুরো বিশ্ব জেনে গেছে ইসলাম নিয়ে স্যাটায়ার মুসলিমদের কতটা ক্ষুব্ধ করে। এর ফল কতটা ভয়াবহন হতে পারে গোটা বিশ্বের অজানা নয়। ইসলাম নিয়ে রশিকতার বদলা নিতে খুন করতে দ্বিধা করে না ইসলাম ও নবী প্রেমি জিহাদীরা। বাকী মুসলিম সমাজ সেই খুনের সমর্থন করতে প্রকাশ্যে দাঁড়ায়। আর আছে কিছু ভদ্রগোছের আধুনিক লেবাসের মুসলিম, তারা “স্যাটায়ার করাও খারাপ হয়েছে, খুন করাটাও খারাপ হয়েছে” বলে ইসলামকেই ডিফেন্স করে। কাজেই আপনাকে মানতেই হবে ইসলাম নিয়ে হাস্যরস করলে তার পরিণতিটা আপনাকে আগেই ভেবে নিতে হবে। আপনি কি দাঙ্গা চান? আপনি কি এই রিস্ক নিবেন যে আপনার ঠাট্টা-তামাশার বলি হোক কিছু নিরহ মানুষ? একটা দাঙ্গায় প্রাণ যাক অগুণতি সাধারণ মানুষের যারা হয়ত নবী মুহাম্মদ সর্বমোট কয়টি বিয়ে করেছেন সেই তথ্যটিই জানেন না! তাই, আমরাও চাই না এই মুহূর্তে “পিকে” তৈরি হোক আমাদের এখানে। ভারতে হিন্দুরা সিনেমা হলে বসে পিকে দেখতে বসে হাসতে হাসতে পপকনের বাটিই উলটে ফেলে দিয়েছে। একবার দেখে বন্ধুকে নিয়ে দু’বার দেখতে গেছে। আমরা আমাদের সিনেমা হলে এরকম কোন স্যাটায়ার তিন ঘন্টা ধরে সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মাইনি। পর্দায় আগুন দিয়ে, সিনেমা হলকে পুড়িয়ে, প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতাদেরকে মেরেধরে, ফাঁসি চেয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করেই তবে ক্ষ্যান্ত হবো! তাই অনুভূতির জ্বালা আর শান্তির স্বার্থে আমরাও আপাতত চাই না ইসলাম নিয়ে কোন স্যাটায়ার, কমেডি, বিদ্রুপ, ঠাট্টা, রসিকতা হোক…।

কিন্তু নবী জীবনী কি নবীকে নিয়ে স্যাটায়ার? দুনিয়ার সমস্ত ইসলামী স্কলার, যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত শ্রদ্ধা আর সম্মানের সঙ্গে যাদের স্মরণ করা হয় নবী জীবনীকার হিসেবে, কুরআনের সঠিক ও সর্বসম্মত ব্যাখ্যাকারী হিসেবে “ইবনে হিশাম”, “ইবনে ইসহাক”, “ইবনে কাথির”…প্রমুখদের কি নবী কুৎসা রটনাকারী বলতে হবে? আজ তাদের লিখিত নবী জীবনের কোন অধ্যায়কে যদি নিজের ভাষা শৈলীতে প্রকাশ করা হয়- কেন তা “নবী অবমাননা” হবে? এতগুলো বছর, এতগুলো যুগ চলে গেলো কখনো কোন ইসলামী স্কলার এই সমস্ত বইগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবী করেননি। মুসলিমদের বইগুলো এড়িয়ে যাবারও আহ্বান জানাননি। বলেননি গ্রন্থগুলো দুর্বল বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং তারা নিজেরা বার বার নবী মুহাম্মদকে জানতে ইবনে হিশাম, ইবনে ইসহাককে পড়তে পরামর্শ দিয়েছেন। আজ নবী মুহাম্মদকে জানতে আমাদের হাদিস, সিরাত ছাড়া আর কোন উৎস আছে কি? একজন মুসলিম কেমন করে তার প্রিয় নবীজিকে জানার কৌতূহলকে মেটাবে? ইরানী লেখক আলি দস্তির “টুয়েন্টি থ্রি ইয়ারসঃ এ স্টাডি অফ দ্যা প্রফেটিক ক্যারিয়ার অফ মুহাম্মদ” পড়ে যদি আমাদের মনে হয় যে একজন মুসলিম তার নবীকে খারাপ হিসেবে ভাবতে পারে তাহলে ইবনে ইসহাক পড়ে একজন বিশ্বাসী মুসলিমের তার নবী সম্পর্কে কি ধারনা জন্মাবে? আজকের যুগের একজন বোধ সম্পন্ন শিক্ষিত ভদ্র মানবিক মুসলিম তার নবীকে কি চোখে দেখবে?

শুধুমাত্র নিম্নাঙ্গের চুল গজিয়েছে এরকম বালকদেরকে ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়ে হাত পিঠ মুড়া পরিখা খনন করে হত্যা করা হচ্ছে নবীর নেতৃত্বে! রায়ের বাজার বধ্যভূমির ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠি। ইবনে ইসহাক বর্ণিত এই নবীজির ছবি কি কিছুতেই “ইহুদীদের হাতে অত্যাচারিত নবী মুহাম্মদকে” মেলানো যায়? আমাদের শেখানো হয়েছে নবী কাফেরদের কাছে মার খেয়ে তাদের জন্যই দোয়া করছেন “প্রভু এরা জানে না এর কি করছে, এদের তুমি ক্ষমতা করো”! আমাদের শেখানো হয়েছে কল্পিত ইহুদী বুড়ির কাঁটা পুঁতে রেখে নবীকে কষ্ট দেয়া আর নবীর সেই বুড়িকে প্রতিশোধ না নিয়ে উল্টো তার সেবা করা! “নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর” আসলেই অস্বস্তিকর। অন্তত মদিনা গমনের পরেরটুকু। বাল্যকাল থেকে দেখা আসা মুহাম্মদ যেন পাল্টে গিয়েছিল আরবদের কাছে! তার প্রমাণ কুরআনের মক্কী আর মাদানী সুরার সুর পাল্টে যাওয়া। কুরআন তাই কোথাও উদার, সহনশীলতার বাণী, আবার সেই একই বিষয়ে প্রতিশোধ, হত্যা, রক্ত, লোভ, লালসা আর লাম্পট্যের ফ্রি লাইসেন্স দেয়ার ঘোষণা!

রোজকার মুসলিমদের ধর্মকর্ম, একজন মুসলিমের লেবাস-ছুরত, চিন্তা-চেতনা সমস্ত কিছু নির্ভর করে হাদিসগ্রন্থগুলোর উপর। প্রত্যহ মুসলিমরা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে সেই উঠবস, যে নির্দিষ্ট শারীরিক কসরত তার সমস্তটাই হাদিস থেকে, কুরআনে এসবের কোন বর্ণনা নেই। সবচেয়ে সহি আর গ্রহণযোগ্য ইমাম বুখারী সংগ্রহকৃত হাদিসগুলোকে ধরা হয়। সেই ইমাম বুখারীর হাদিস থেকে নবী মুহাম্মদকে একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহিৃত করা যা অতি সহজে! দেখতে পাই কেমন করে নবী সাফিয়াকে যুদ্ধে (আসলে আক্রমণ) তার স্বামী-ভাইদের হত্যা করে সেইদিনেই তাকে গণিমতের লুটের মাল হিসেবে বিছানায় তুলে নিয়ে “বাসরঘর” সম্পন্ন করেন! হাজার বছর ধরে ইমাম বুখারীর এইসব সহি হাদিস “নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা” রটনা হিসেবে দেখা হয়নি। আজতকও পবিত্র হিসেবে যে সব গ্রন্থ চুম্বিত মুসলিমদের কাছে সেই গ্রন্থেগুলোর সহায়তা নিয়েই লেখা বইকে কেন নিষিদ্ধ করতে হবে “নবীর বিরুদ্ধে অবমাননা” অভিযোগে? আলি দস্তির “টুয়েন্টি থ্রি ইয়ারসঃ এ স্টাডি অফ দ্যা প্রফেটিক ক্যারিয়ার অফ মুহাম্মদ”-এর বঙ্গানুবাদ “নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর” আবুল কাশেম আর সৈকত চৌধুরী অনুবাদ করেছেন। হযরত মুহাম্মদের ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই। হাদিস, সিরাত কোনটাই ইতিহাসের বই নয়। কয়েক প্রজন্ম ধরে মুখে মুখে চলে আসা গল্পের মধ্য দিয়েই নবী মুহাম্মদকে জানার একমাত্র উৎস। আলি দস্তির তার উৎস এর বাইরে থেকে গ্রহণ করেনি কারণ সেটা সম্ভব নয়। ইসলামের কোন ইতিহাস নেই বা রাখা হয়নি। আবুল কাশেম আর সৈকত চৌধুরী সেই ইংরেজি বইটিকে শুধুই অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য। রোদেলা প্রকাশনী সেই বইটিকেই প্রকাশ করেছেন পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। নবী মুহাম্মদের জীবনীর উৎস যেখানে সহি হাদিস আর সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত সিরাত গ্রন্থগুলো- সেখানে এসবকে রেফারেন্স করে লিখিত কোন ইংরেজি বইকে অনুবাদ করে ছাপার অপরাধে কেন একজন প্রকাশককে আজ মৃত্যুর ভয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হবে? কেন তার প্রকাশনী সংস্থাকে বন্ধ করে দেয়া হবে? কেন পুস্তক প্রকাশনি সমিতি রোদেলা প্রকাশনীকে বহিস্কার করবে? কেন জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি রোদেলা’র স্টলকে বন্ধ করে দিয়ে বইমেলায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করবে? “নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর” বইটি কোন স্যাটায়ার নয়, এটি একটি নবী জীবনী গ্রন্থ। এমনকি এটি কোন উপন্যাস নয়। যীশুকে নিয়ে সারামাগো’র লিখিত “যীশু খ্রিস্টের একান্ত সুসমাচার”-মত কোন কল্পনার আশ্রয়ের কোন সুযোগ এখানে নেই যা একজন উপন্যাসিক ভোগ করে থাকেন। একজন জীবনীকার চান একজন রক্তমাংসের মানুষকে তুলে ধরতে। একজন সৎ জীবনীকার ভক্তি বা বিদ্বেষ থেকে কারুর জীবনী লিখেন না। আলী দস্তির লিখিত নবী জীবনী যদি কারুর কাছে বিদ্বেষময় মনে হয় তাহলে তারা এতদিন হাদিস আর সিরাতগ্রন্থগুলোকে টিকিয়ে রেখেছেন কেন? বাংলা একাডেমি যেহেতু এতবড় নবী কুৎসাপূর্ণ বইকে নিষিদ্ধ করে দিয়ে তাদের ঈমানী দায়িত্ব পালন করেছে তারা কি এই মেলাতে খুঁজে দেখবে ইবনে হিশাম বা ইবনে ইসহাকের কোন বাংলা অনুবাদ আছে কিনা? বুখারী হাদিস তো অবশ্যই পুরো ভলিউম পাওয়া যাবে। বাংলা একাডেমির তো আজই উচিত খুঁজে খুঁজে সেইসব স্টলগুলোকে বন্ধ করা! ইসলামী ফাউন্ডেশন কি হাদিস গ্রন্থগুলো নিষিদ্ধের কার্যক্রম গ্রহণ করবে? আমরা হাদিস থেকে নবীকে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক, গণহত্যাকারী, আক্রমণকারী হিসেবে দেখালে তার দায় আমাদের নয়- হাদিস গ্রন্থের। নবীকে আমরা জানতে পেরেছি হাদিস আর সিরাত গ্রন্থ থেকে।

মানতে যতই আপত্তি থাকুক তবু এটাই সত্য যে বাংলাদেশে হাটহাজারী ঠিক করে দিবে এখানে কতটুকু বলা যাবে আর কতটুকু বলা যাবে না। রকমারি যখন অভিজিৎ রায়ের বইকে হিযবুর তাহরির এক জঙ্গির হুমকির মুখে তাদের সাইট থেকে সরিয়ে নিয়েছিল- সেই আত্মসমর্পন থেকে বাংলা একাডেমির আত্মসমর্পন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। বাংলা একাডেমি যখন ইসলামী অনুভূতিকে ভয় পেয়ে একটি পুরোনো, বহুল পঠিত গ্রন্থকে নিষিদ্ধ করে দেয় তখন বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল, মননশীল আর সৃজনশীলতার চর্চার কেন্দ্র যে মৌলবাদীদের দয়ায় বেঁচেবর্তে আছে সেটা দিন-দুপুরের মত পরিস্কার হয়ে যায়। এখন বাংলা একাডেমির মনোগ্রামে উপরে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” লিখে নিজেকে সমস্ত রকম ধর্ম বিরোধী জ্ঞান চর্চার বিপক্ষে বলে দাবী করে আগে থেকেই নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে। গোটা দেশটা যখন হাটহাজারী হয়ে উঠবে তখন প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে। রোদেলা প্রকাশনী নিয়ে আর কি কি হবে ভাবতে পারছি না। বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে প্রকাশককে নিয়ে। ওমর ফারুক লুক্স ভাইয়ের একটা ফেইসবুক পোস্ট পড়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন, ফেইসবুকের প্রথম দিকে তিনি কোন রকম মন্তব্য না জুড়ে শুধুমাত্র হাদিস হুবহু কপি-পেস্ট করেও বিস্তর গালাগালি খেয়েছেন! এই হিসেবে রোদেলা প্রকাশনীর ও দুই অনুবাদক (আবুল কাশেম ও সৈকত চৌধুরী) তো বিরাট অপরাধ করেছেন! এর কাফফারা গালাগালি দিয়ে শেষ হবে আশা করা যায় না। এ যে নবী জীবনী! শুনকে যতই অদ্ভূত লাগুক, একজন মুসলিমকে সবচেয়ে বেশি ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিতে পারে তাদের নবী জীবনীই! প্রকাশক আর অনুবাদকরা ইসলাম নিয়ে স্যাটায়ার করেনি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেনি- কিন্তু তারচেয়েও ভয়ংকর অপরাধ করেছেন, তারা নবীজির জীবনীর অনুবাদ করেছেন!