স্যার, আমার বয়স যখন দশ বছর, তখন কিশোর বাংলার ঈদ সংখ্যায় দীপু নাম্বার টু পড়ে আপনার লেখার ভক্ত হয়ে যাই। এরপর পড়ি কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, যা অনেকভাবেই আমাকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলে। পরে আপনার লেখা আরও কত পড়েছি, সব মনেও নেই। আপনি বিদেশে ভাল চাকুরী ছেড়ে দেশে কাজ করতে এসেছেন, আমাদের স্বাধীনতার কথা শুনিয়েছেন, দেশকে ভালবাসার কথা শুনিয়েছেন, সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের কথা বলেছেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক করার চেষ্টা করছেন, এমন আরও কত ভাল কাজ করে চলেছেন। আপনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/গবেষক; আপনার গুনগত মানের ধারে কাছে না হলেও আমারও একই নেশা ও পেশা। উপরের কারণগুলোর জন্য যদি আপনাকে আদর্শ হিসাবে সামনে রাখি তাহলে তা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু হবে না।

আমার দীর্ঘ ভূমিকার জন্য দুঃখিত, কিন্তু এর পরের কথা গুলোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে এর প্রয়োজন ছিল। দেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে আপনার সাম্প্রতিক লেখাটি (http://dailyjanakantha.com/index.php?p=details&csl=106195) পড়ে আমি বেশ হতাশ। আপনি সরাসরি না বললেও যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হল আমাদের দেশে যেহেতু যথার্থ গণতন্ত্র নেই, তাই নির্বাচনের তেমন উপযোগিতা নেই। আপনি প্রশ্ন রেখেছেন নির্বাচন হলেও সে নির্বাচনে অংশ নেবে কারা? এরপর আপনি উত্তর দিয়েছেন যেহেতু তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধুকে অশালীন সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছে এবং খালেদা জিয়া তা সমর্থন করেছেন তাই বিএনপির রাজনীতির কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে। এর আগে জামায়াতের সাথে সরকার করে তারা এদেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছিল। তারা সম্ভবত আর জনগণের কোন সমবেদনা খুঁজে পাবে না। তারেক জিয়ার বঙ্গবন্ধুর অশালীন সমালোচনা এবং তাতে খালেদা জিয়ার সায় অবশ্যই অন্যায়, কিন্তু এই সরকারের আমলে জিয়াউর রহমানকে যেভাবে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা কেমন ন্যায়? ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য তা তো তাঁকে দিতে হবে। বুঝতে পারছি, বিএনপির সাথে জামাতের সরকার গঠন অনৈতিক ছিল, কিন্তু অতীতে আওয়ামী লীগ যখন জামাতের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল সেটাও কি তাহলে অনৈতিক ছিল? আওয়ামী লীগে যারা রাজাকার আছে তাদের সম্পর্কে কি বলবেন? যদিও কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক, তবুও বাকশাল সম্পর্কে আপনার কি মূল্যায়ন তাও জানার কৌতূহল রইল।

আপনার মতে এই দেশের জন্য “এককভাবে” অবদান রেখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আমি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে, ত্যাগী জীবন সম্পর্কে জেনে আপ্লুত হয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশ তাঁর একক অবদান, একথা বলে আপনি বাংলাদেশের জনগণ যারা জান-বাজী রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন (আমার পরিবারের লোকও আছেন), যারা ভারতে বসে প্রবাসী সরকার চালিয়েছেন (তাজউদ্দীন সাহেব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য), ভারত সরকার আর এর জনগণ আমাদের যে সাহায্য করে চির-ঋণী করেছেন এর সবকিছুকেই তুচ্ছ করেছেন।

স্যার, আপনি দেশে গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু এর বিকল্প কি চাইছেন তা আপনার লেখায় পরিষ্কার না। দেশে কিভাবে নেতা নির্বাচিত হবে এবং তা নির্বাচনের মাধ্যমে হলে জনমতের প্রতিফলন কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়েও কিছু বলেন নি। আপনি ধরে নিয়েছেন যে নির্বাচন হলে বিএনপি জনগণের সমবেদনা পাবে না। ঠিক আছে, সেটা হতেই পারে; এর আগের কার্যকালে তারা যে অপকর্মগুলো করেছে আর এখন যে সন্ত্রাস আর নাশকতা করছে তার জন্য জনগণ তাদের সমবেদনা না দেখালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু জনগণকে সেই কথাটা বলার সুযোগ দিতে হবে; আমার, আপনার কথা জনগণের মুখে পুরে দিলে তো চলবে না। তাহলে বলুন কেন আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবীতে সোচ্চার হবো না?

একজন নিরপেক্ষ মানুষ একথা স্বীকার করবেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটাই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। ক্ষমতার লোভে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি দু’দলই করেছে। দু’দলেই এমন রাজনীতিক আছে যারা অনেক ভয়াবহ অপরাধের সাথে জড়িত। এখন আমরা যদি কেবল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে এদের অপরাধের প্রতিবাদ না করি, তাহলে প্রকারান্তরে আমরা তাদের সমর্থনই করছি। এই প্রবণতা খুবই বিপদজনক হতে পারে। মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন অথচ দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতার অপ-ব্যবহারকারী, দেশের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত এমন লোক আমাদের চারপাশে অনেক রয়েছে। কেবল মুক্তিযুদ্ধকে “ফিল্টার” হিসাবে ব্যবহার করলে এদের অনেকেই পার পেয়ে যাবে। এইসব লোকদের দিয়ে কি আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে?

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের দেয়া বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে না কেন দলটি তাদের মেয়াদ শেষে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে চায় নি? যদি দলটি বছরের পর বছর সত্যিকার নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে এভাবেই দেশ শাসন করার সুযোগ পায় তাহলে তাদের রাজনীতির গুনগত পরিবর্তন হবে কি? আমরা কি আমাদের রাজনীতির পরিবার-তান্ত্রিক ধারা থেকে বের হতে পারবো?

আমার মনে হয় সময় এসেছে দল আর ব্যক্তির চেয়ে দেশকে বেশী গুরুত্ব দেবার। আর একটা দেশের ভিত্তিমূল হচ্ছে সেই দেশের জনগণ, তাদের ঘিরেই দেশের সব কর্মকাণ্ড। সেই জনগণ যদি নিজেদের পছন্দ মতো নেতা নির্বাচন করতে না পারে, সংসদে নিজেদের পছন্দের প্রতিনিধি না পাঠাতে পারে, তাহলে কেন আমাদের তা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে বলতে পারেন? আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমার পূর্ব-পুরুষেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, কোন বিশেষ দল বা একনায়কতন্ত্রের সেবা বা ব্যক্তিপূজা করার জন্য নয়।