দেশের মানুষ পুড়ছে আগুনে। পেট্রোল বোমা ও ককটেল ছুড়ে মারা হচ্ছে সাধারণ মানুষ কিংবা মনুষ্যবাহী যানবাহনকে লক্ষ্য করে। আগুনে দগ্ধ মানুষ-কেউ অক্কা পাচ্ছে অকালে, আর কেউ অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মেডিকেল হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে-প্রহর গুণছে আসন্ন মৃত্যুর।

আমাদের জনদরদী নেতা-নেত্রীরা-যারা সুশোভিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসায় কিংবা অফিস কক্ষে বসে এসব লোমহর্ষক দৃশ্য উপভোগ করছেন নিরুদ্বেগে-এসব গণহত্যার দায়িত্ব তারা কেউ নিতে চান না একদম। অবশ্য তারা ইতোমধ্যে জীবন্ত দগ্ধ মানুষের রুহের মাগফেরাত কামনা করে গায়েবানা জানাজা ও দোয়া মাহফিল করেছেন-সারা দেশে-আল্লাহ যেন তাদের বেহেস্ত নসীব করে। দেশের নিরীহ জনগণের সাথে কি নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ তামাশা !

কারা মারছে এ পেট্রোল বোমা ও ককটেল-সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে ? আওয়ামী লীগ বা সরকার বলছেন- জামাত শিবির ও বিএনপি জোট।
যেহেতু বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা অবরোধ-হরতালের সময় এগুলো মারা হচ্ছে-মানুষ যাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাস্তায় বের না হয়-যাতে হরতাল অবরোধ সফল হয়, সেহেতু এ সন্ত্রাসী হামলার দায় অপরিহার্যভাবে বর্তায় আন্দোলন আহ্বানকারী দল বা জোটের উপর।

আবার কোথাও কোথাও সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীও বোমাসহ গ্রেপ্তার হয়েছে পুলিশের হাতে। তাই বিএনপি বলছে-সরকারী দল বা সরকারী এজেন্সী এসব করছে।
উভয় পক্ষই তীব্র নিন্দা করছে বোমাবাজদের। কঠোর শাস্তির দাবীও করছে তারা। তবে এ বোমাবাজ কারা? এরা কি ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা কোন এলিয়েন ? যদি তাই হয়, তারাই বা কেন এদেশের গরীব আমজনতার উপর এত ক্ষুদ্ধ হল?

জানি এসব প্রশ্নের কোর সদুত্তর নেই।
উদর পূর্তির আদিম তাগিদে রাস্তায় বের হওয়া অতিসাধারণ মানুষ-রিক্সাওয়ালা, ভ্যানগাড়ী ওয়ালা, ট্রাক-বাস-টেক্সি-লেগুনা ড্রাইবার-যানবাহনের নিরীহ যাত্রী-নারী-শিশু আবাল বৃদ্ধ-বণিতা-সমাজের সর্বস্তরের গরীব মানুষ দগ্ধ হচ্ছে এসব পেট্রোল বোমার আগুনে-প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে।

অথচ দুর্নীতির বরপুত্র, এমনিতেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যে মারা গেল-তার দেশে ফেরার মিছিলে, গাড়ী বহরে, জানাজায়, কোথাও একটি পেট্রোল বোমা ফুটল না-যদিও অবরোধ তখনো বহাল ছিল।

২০১৪ ইং সালের ৫ ই জানুয়ারী তারিখে, দেশে অনুষ্ঠিত হল একটি জাতীয় নির্বাচন-যে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির পরিমাণ ছিল গড়ে ৫-১০ শতাংশ; অবশ্য লজ্জার মাথা খেয়ে, সরকারী দল, এমন কি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দাবী করছেন ৪০ শতাংশ ভোটার নাকি ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এ নির্বাচনে ১৫৪ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে একটি অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এমন একটি জাতীয় নির্বাচন, যেটাতে দেশের অর্ধেক মানুষ তাদের ভোটাধিকারও প্রয়োগ করার সুযোগ পায় নি।

নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের নেতারাসহ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একাধিক বার বলেছিলেন-এ নির্বাচন হবে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। অর্থাৎ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য এ নির্বাচন ছিল অপরিহার্য। অথচ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর তারা সুর পাল্টে এখন বলছেন, ২০১৯ ইং সালের আগে, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্তির একদিন আগেও কোন নির্বাচন নয়।
নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করা বিএনপি’এর নেতৃত্বাধীন জোট বলছে-দেশে চলছে একদলীয় স্বৈরশাসন-গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন করবেন তারা। তারা নাকি মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করছে।

বড় দুর্ভাগা এ দেশের মানুষ। রক্ত দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে, তারা এদশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু তার সুফল থেকে তারা আজ বঞ্চিত। আজকের বাংলাদেশ তাদের সে স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়। এমন দুর্নীতিগ্রস্থ, সন্ত্রাসাক্রান্ত, রাষ্ট্রধর্মের তকমা আটা ধর্মান্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েতো তারা যুদ্ধ করে নি। আজ স্বাধীনদেশেও গণতন্ত্রের জন্য তাদের জীবন দিতে হয়। আর সে তথাকথিত গণতন্ত্রের সিড়ি বেয়ে ক্ষমতায় যায় দুর্নীতিতে আকণ্ঠ-নিমজ্জিত লুটেরা রাজনৈতিক নেতারা।
তারা এখনো চিনতে ভুল করে, কে বা কারা আসলে তাদের প্রকৃত বন্ধু।
তারা ভুলে যায়-যে সমস্ত দল বা নেতা-নেত্রীরা দেশনেত্রী ও জননেত্রীর তকমা এটে অহরহ তাদের জন্য মায়াকান্না কাঁদে, তারা সকলেই আসলে মুখোশধারী দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী। মুখোশের আড়ালে তাদের চেহারা বড়ই খুৎসিৎ, বড়ই নোংরা। আসলে তারা কেউই জনগণের সুখ-দু:খ, ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়।
তাদের সকল চিন্তা কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তারা কিভাবে আকঁড়ে ধরে রাখবে, কিংবা কিভাবে ক্ষমতা লাভ করবে। তারা গণতন্ত্রের জিকির করে, অথচ তারা কেউই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।
তাদের স্ব স্ব দলে গণতন্ত্রের লেশমাত্র চর্চা নেই। তাদের কাছে গণতন্ত্রের একটিই সংজ্ঞা-তাহল এদেশের সহজ-সরল আম জনগণকে ভোলবাল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করে, কোন রকমে বোকা বানিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। এক্ষেত্রে তাদের কেউ ব্যবহার করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, আর কেউ ব্যবহার করছে ধর্ম ও তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ।
তাদের দলের কোন নেতা কর্মীদের ভোটে নির্বাচিত হয় না। নেত্রীরা তাদের নিয়োগ দেন। একটি কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তার মত তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন-কখনো স্থায়ীভাবে, কখনো ভারপ্রাপ্ত হয়ে ।
তাদের দলে আলোচনা-সমালোচনার কোন সুযোগ নেই। তাদের নেত্রীর বাণী তাদের কাছে বেদবাক্য সম। হীরক রাজার দেশের মত, তাদের আপ্ত বাক্য হল-নেত্রী (রাজা) বলেন যা-করতে হবে তা।
তারা দিনের পর দিন কার্যকরী কমিটির সভা করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না-সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার অর্পন করেন তাদের নেত্রীর উপর। তারা বিশ্বাস করে, তাদের নেত্রী কোন ভুল করতে পারে না-the queen can do no wrong।
তারা বিশ্বাস করে-তাদের নেত্রী ও তদীয় নিকটাত্মীয়রা ধোয়া তুলসী পাতা। তারা কোন অন্যায়, দুর্নীতি করতে পারে না। করলেও সেটা কোন গ্রাহ্য বিষয় নয়। রাজা-বাদশাহদের ছেলেপুলেদের নাকি একটু-আধটু দোষ থাকতেই পারে।

তাদের কাছে দুর্নীতি খারাপ কাজ বলে আর নিন্দনীয় নয়। এ গরীব দেশের গরীব মানুষদের ভাগ্য বিড়ম্বিত করে, হাজার হাজার কোটি টাকা যারা বিদেশ পাচার করে, যারা শত কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে জাতীয় নানা উন্নয়ন প্রজেক্ট বিদেশী বিশেষ কোন কোম্পানীকে টেন্ডার পাইয়ে দেয়, এ সকল ব্যক্তিদের তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে না। বরং তাদের কাছে তারা আজ সর্বাপেক্ষা সন্মানিত ব্যক্তি। তাই তাদের জানাজায় লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। তাদের জন্য জেলায় জেলায়, থানায় থানায় গায়েবানা জানাজা হয়। সারাদেশ ছেয়ে যায় শোকের কালো ব্যানারে। অথচ আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া নিরাপরাধ মানুষগুলোর জন্য কোথাও কোন কাল ব্যানার নেই।

আমাদের আজ বুঝতে হবে-কেবল ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেই গণতন্ত্র অর্জিত হবে না। ভোট দিয়ে সরকার গঠন করলেও সে সরকার যদি ক্ষমতায় দিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, দলবাজি করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, ক্রস ফায়ারে মানুষ মারে-তাহলে সে সরকার তো আর গণতান্ত্রিক থাকে না। আজ যারা ক্ষমতার মসনদে বসে গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিচ্ছে বলে দাবী করছে, আর যারা গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আমাজনগণকে জিম্মি করে, বলির পাঠা বানিয়ে তথাকথিত আন্দোলন করছে-তাদেরকে বহুবার আমারা ক্ষমতায় দেখেছি। ক্ষমতায় থাকার অবস্থায় তারা কেউই গণতান্ত্রিক আচরণ করে নি বা করছে না। কেউই আইনের শাসন কায়েম করার কোন উদ্যোগ নেয় নি। অপারেশন ক্লিন হার্ট থেকে ক্রস ফায়ার, এসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কারা কারা করেছে সব আমাদের জানা আছে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও দলবাজি তাদের অলঙ্কার। ঘুষ, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, হাট-বাজার এর ইজারা, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ ইত্যাদি আজ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমার্থক হয়ে গেছে। তাই তাদের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলে, জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। বরং জনগণ বারংবার উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষিপ্ত হবে।

ভাবতে অবাক লাগে-এদেশের আমজনগণ-একাত্তুরে যারা রুখে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানী হায়না ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর রাজাকারদের বিরুদ্ধে-সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল দেশের স্বাধীনতা, তারা আজ সবকিছু যেন মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। সকল অন্যায় অবিচার মুখ বুজে সহ্য করার এক নিষ্ক্রিয়তা তাদেরকে যেন বুদ্ করে রেখেছে।
না-যাদের ধমনীতে এখনো শহীদের রক্ত, বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তারা কখনো পরাভব মানে না-মানতে পারে না।

আসুন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল আমজনতা রুখে দাঁড়াই্- জনগণকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্য প্রচণ্ড ঝাকুনি দিই-আর তারস্বরে বলি -এদেশ আমার-আমিই বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। সংঘাতময়, আদর্শহীন দুর্নীতিপরায়ন ও দুর্বৃত্ত কবলিত এ রাজনীতির বিরুদ্ধে আর একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করি। এ ছাড়া মুক্তির কোন বিকল্প নেই।