মানুষ স্বপ্ন আর সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। ভাবলে অবাক হতে হয়, একটা শহর পানির তলে ডুবে গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ জায়গা বন্যায় আক্রান্ত, অথচ আমরা সময়ের প্রহেলিকা শীর্ষক আপেক্ষিক তত্ত্বের সময় সংক্রান্ত বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, হাটু সমান পানি ঠেলে পোস্টার লাগাচ্ছে, টিকিট বিক্রি করছে বিজ্ঞান কর্মীরা, পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রেসে যাতায়াত করছি। অনেক সুবিধা সত্ত্বেও এগুলো এখন স্বপ্নের মতো, এর মধ্যে দিয়ে আমি হেটেছিলাম। আমরা পরমাণু শক্তিকমিশনে বক্তৃতা দেয়ার পর মাইক্রো নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম খোলা প্রান্তরে, তন্ময়তা নিয়ে দাড়িয়েছিলাম কাচপুর ব্রিজে। বয়ে যাওয়া নদী কোথায় যায় ভেবেছিলমা সেই সময় কাউকে লেখা অথবা নিজের কাছে নিজেকে লেখা এ চিঠিটি-

এভদা, রাত ১টা। ১৯৯৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। বারান্দায় একাকী দাঁড়িয়ে। খুব মনোযোগে বন্যার পানির ক্রমবৃদ্ধিকে লক্ষ্য করে চলেছি। আজ রাতেই সম্ভবত নারায়ণগঞ্জের বন্যার পানির যে উচ্চতা তা পূর্বের প্রায় সব রেকর্ডকে ভেঙে ফেলবে। সব জায়গা থম থম করছে। কখনও পানির ছপ ছপ শব্দ। হয়তোবা তা মাছের অথবা জলজ প্রাণী অথবা শহরের রাস্তায় চলা কোনো নৌকার। মাঝে মাঝে ঝিরঝির বাতাস নতুন কোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। চোখের সামনে ভাসতে থাকে এলোমেলো সব কল্পনার কথামালা, যদি এ রকম হতো_

মানুষ প্রথমে ডাঙার মুক্ত হাওয়া থেকে ঘরে বন্দি হলো। তারপর ঘরের মেঝে থেকে খাটে, এরপর মাচা বাঁধতে বাঁধতে চালে ঠেকে গেল মাথা। এরপর গাছে, এ যেন বিবর্তনের উল্টো প্রক্রিয়া। ৩৮ লাখ বছর সময় লেগে গিয়েছিল ওই গাছ থেকে মাটিতে নেমে ঘর বানিয়ে আজকের পর্যায়ে আসতে। বন্যার পানি সেখানেই ফিরে যেতে যেন মাত্র দু’মাসেই বাধ্য করছে। কিন্তু এখন তো গাছ নেই, আমরা সব কেটে ফেলেছি। বাস্তুসংস্থান ভিত্তিকেই নষ্ট করে ফেলেছি। অথচ কর্টেক্স দেখিয়েছিল আমাদের মুক্তির স্বপ্ন। এভদা, ভারত মহাসাগরের জাভা দ্বীপে গেলে দেখতে পাবে পূর্বপুরুষদের গাছ থেকে নেমে আসার সেসব চিহ্ন পিথাকানথ্রোপাস, সিনানানথ্রোপাস। দেখতে পাবে কী অকল্পনীয় সংগ্রাম আর রূপান্তরে মানুষের এই উত্তোরণ।

মস্তিষ্কের বিকাশে এক আধুনিকতম অংশ এই সেরেব্রাল কর্টেক্স, জিনের সহায়তা ছাড়াই মানুষকে কাজে সক্ষম করেছে। আর কর্টেক্স শিখিয়েছে ভালোবাসতে, দিয়েছে যুক্তি আর বিবেচনাবোধের ক্ষমতা, জেনেছি সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুভবের সেসব গভীরতা, যা অন্যকে স্পর্শ করে। বুদ্ধিমত্তাকে দেহের বাইরেও প্রসারিত করেছে, বুদ্ধিমান যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে জুগিয়েছে গ্রহান্তরে যাওয়ার শক্তি। এটা ছিল বলেই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। জান এভদা, একটা বিড়ালের বাচ্চা করুণ কণ্ঠে ডেকে চলেছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে কুকুরের হীমশীতল আর্তনাদ। রাতের অন্ধকারকে চিরে দূর থেকে ভেসে আসছে গরুর অসহায় ভরাট চিৎকার, যা রাতের অন্ধকারকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ওরা সবাই স্থলভূমির জন্য কাঁদছে। মানুষ কী অসহায়। তোমার কষ্টগুলো এখন একটু হালকা মনে হচ্ছে না কারণ পুরো সভ্যতা ভুল করে চলেছে।

এখন রাত ১টা ৩০ মিনিট। চাঁদের টান শেষ হবে। ফলে ভাটার টানে পানি কমতেও পারে, তবে সম্ভাবনা খুবই কম। মানুষের পক্ষে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব। হয়তো একদিন বুঝবে জ্ঞান এবং এর অখণ্ডতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন হয়তো সময় থাকবে না। আচ্ছা, অন্য নক্ষত্রের বুদ্ধিমান প্রাণীরা যদি থাকে তারাও কি এ রকম ভুল করে চলেছে। জান, এভদা কেন জানি সেই দিনটার কথা মনে হলো। তখন আমি মানসিকভাবে প্রশান্ত সাগরীয় আগ্নেয় পাথরের অজানা দ্বীপে দাঁড়িয়ে উদ্দাম বাতাসের ঝাপটা অনুভব করছিলাম আর সাগরের নীল জলরাশি ছাড়িয়ে ওই দূরদিগন্তে কীভাবে সমুদ্র আর আকাশ মিশে যায় তাই লক্ষ্য করছিলাম। এদিকে লিংকন দ্বীপে ওরা পাঁচজন, নতুন বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ওদের ঘিরে আছে অসাধারণ প্রতিভাবান আলো-ছায়ায় ঘেরা ক্যাপ্টেন নিমো আর সাবমেরিন নটিলাস_ এক আশ্চর্য স্বপ্নময় স্মৃতি।
এ সবই জুলভার্নের মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ডের ঘটনা। তোমার আগমনে ভাবনার অন্তরাল থেকে জেগে উঠলাম। একটু অস্থির আর বিষণ্ন। অনেক কথা বলতে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি ছিলাম লিংকন দ্বীপের মায়াবী পরিবেশে জীবনের অন্য এক পটভূমিকায়, যেখানে মানবীয় কোনো অস্থিরতা স্পর্শ করে না। তবুও তোমার কথাগুলো শুধু শুনছিলাম। বিকেলে ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টির মধ্য দিয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন নিমো, নটিলাস ও অভিযাত্রীদের কথা ভাবছিলাম কিন্তু চারদিকের ভেজা পরিবেশ তোমার কথাগুলোকেই প্রতিধ্বনি করছিল, রোদের আসা-যাওয়ার সঙ্গে। আর সেই আলোতে দু’পাশের জলাশয়গুলোকে হ্রদের মতো মনে হচ্ছিল।

আচ্ছা এভদা যারা পৃথিবী দেখতে বের হয়, তাদের কাছে সব ঘটনাই আনন্দের, না বেশিরভাগ দুঃখজনক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি? হয়তো তার মধ্যে দুই-একটি ঘটনা অপরূপ জগতের সন্ধান দেবে। হয়তো তা মহাজাগতিক সভ্যতায় পেঁৗছানোর দরজা অথবা বলা যায় কসমিক ডোর_ যেমন ধলেশ্বরীকে একবার মনে হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে অনুভব করেছিলাম ভূমধ্যসাগরীয় দুপুরকে, দেখেছিলাম ফিনিশীয় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরন্তর ছুটে চলা।_

এভদা, এখন রাত ২টা। আজ রাতটা খুবই বিপজ্জনক, পানি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ঘরগুলো ডুবে যাবে। বিছানায় শুয়ে আমি পড়ে চলেছি মিসরীয় আর মেসোপটেমীয় সভ্যতার ইতিহাস। অদ্ভুত সব গল্পগাথা ছড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে নুহের প্লাবনের উপকথা। লেখা আছে_ মিসরের নদী একটা কিন্তু মেসোপটেমিয়ার দুটি, সমুদ্র প্রত্যেকের দুটি। দুই নদীর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মেসোপটেমিয়ার প্রান্তর, দুই উপত্যকার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া সিনার প্রান্তর। এখানেই অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে। লেখা আছে : চার হাজার বছর আগের এক প্লাবনের কথা, অনেকে বলে উপসাগর অঞ্চলের জোয়ার, তাই হয়তো বাইবেলে বর্ণিত প্লাবন। তবে প্লাবনে আগে বর্ণিত প্রাচীন রাজার সম্পর্কে অদ্ভুত সব কথা লেখা আছে। তারা নাকি প্রত্যেকে হাজার হাজার বছর রাজত্ব করেছেন। ইতিহাস অবশ্য কিছু বলেনি। প্লাবনের পরের রাজাদের সময়কাল নিশ্চিত করেছে।

পানি ক্রমাগত ঢুকে পড়ছে। রেকর্ডারে বাঁশির শব্দ সবকিছুকে আরও বিষণ্ন করে তুলেছে। যুগ যুগ ধরে নদীর গভীরতা পলি পড়ে কমে যাওয়া, পরিকল্পনাহীন শহর তৈরি, পরিবেশকে ধ্বংস এবং বিজ্ঞানের অবদানগুলোর চরম বাজে ব্যবহারের পাপ আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এ যেন পুরো সভ্যতার পাপের প্লাবনে ডুবে যাওয়ার ইঙ্গিত। তবুও পানির মধ্যে ছোট কোনো ঢেউয়ের আলোড়ন বা শব্দ মনে করিয়ে দেয় নটিলাস আর তিমিদের কথা, ইত্থিয়ান্ডারের অন্তহীন পথচলার কথা। কেমন আছ তুমি?

রাত ১২ টা
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮