Born into brothels ডকুমেন্টারিটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বিবেকের অনেক প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছিলাম, আবার কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। Ross Kauffman ও Zana Briski’র কলকাতার রেড লাইট এলাকার বাচ্চাদের নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি এটি। Zana কলকাতার রূপোপজীবিনীদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখবেন বলে কলকাতায় রেড লাইট এলাকায় এসেছেন। তিনি এদের জীবনটা বুঝতে চান, উপলব্ধি করতে চান। পেশায় তিনি একজন ফটোগ্রাফার। তিনি ছবি তোলেন এই বাচ্চাদের, খেলেন তাদের সাথে। এভাবে তিনি অচিরেই বন্ধু হয়ে যান এই যৌনজীবী মেয়েদের বাচ্চাদের। নানা বয়েসের অগণিত বাচ্চা এখানে। এই বাচ্চাদের চোখে তিনি পৃথিবীটাকে দেখতে চান। অতি অসুস্থ নোংরা পরিবেশ চারিদিকে, ঘিনঘিনে নোংরা আবহাওয়া।অসুস্থতা গিজগিজ করে এখানে। জীবিকা ও পেটের দায়ে অপরিচিত পুরুষদের হাতে নিজের শরীর তুলে দেয় এখানকার মেয়েরা। তারই মধ্যে প্রতিনিয়ত অনাকাঙ্খিতভাবে জন্ম নেয় ফুলের মত শিশুরা। তারপর ফুলের মত নির্মল শিশুরা নর্দমায় ডুবে যায়। নর্দমা সাঁতরে ও হাতড়ে ওদেরকে বেঁচে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হয় জীবন সংগ্রামে। এদের হাতেই ক্যামেরা তুলে দেন Zana। বাচ্চারা ছবি তুলতে থাকে তাদের পারিপার্শ্বিকতার, তাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের। এইসকল পতিত, অচ্ছুৎ বাচ্চারা তাদের জীবন, তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের দর্শন, তাদের স্বপ্ন, তাদের দুঃখকষ্ট, আনন্দ ইত্যাদি বিষয়ে ছলছল করে বলতে থাকে তাদের বন্ধু Ross Kauffman ও Zana Briskiকে। তাই দিয়ে তৈরি করা হয় Born into brothels ডকুমেন্টারি ফিল্মটি।

এই ব্রথেলের একটি বাচ্চা মেয়ে বলছে, আমাদের বাড়িতে যারা ঢোকে তারা খারাপ লোক। মাতাল লোক। খিস্তি দেয়। ‘তুই কি লাইনে নামবি?’ এই ধরনের কথা বলে। দু’দিন পরে ইয়ে করবে বলে গালি দিয়ে যায়।

১০ বছরের পূজা তার কয়েকজন বন্ধুর কথা বলছে, কচি এমনিতে ঠাণ্ডা। হাসিখুশি সব সময়। কিন্তু রাগালে রেগে যায়।
অভিজিৎ এমনিতে ভালো। তবে মুটু। সুচিত্রা খুব ভালো। ঠাণ্ডা মেজাজের। কারুর সাথে ঝগড়া করে না। যাকিছু দেয় সে চুপচাপ তা নিয়ে নেয়।
শান্তিকে কোনো জিনিস না দিলে ও খুব রেগেমেগে যায়।
মাণিককে কেউ খোঁচালে সে রেগে যায়। গৌরকে গরু বললে রেগে যায়।

১০/১১ বছরের কচি উপরের তলার গীতামাসির বাসন মাজার কাজ করে। দোকান থেকে কিছু কিনে এনে দেয়। এজন্য সে সামান্য পারিশ্রমিক পায়। এই বয়েসে, এই পরিবেশে থেকেই কচি বুঝতে পারে, যদি সে পড়ালেখা শিখতে পারতো তাহলে তার জীবনটা অন্য রকম হতো।

তাপসী বলছে, একজনের ছবি তুলতে গিয়ে অনেক খিস্তি শুনেছে সে। কিন্তু সেজন্য তার দুঃখ নেই বা দমে যায়নি সে। সে বলে, কিছু শিখতে গেলে অনেককিছু শুনতে হয়, অনেককিছু সইতে হয়। ওর বড়লোক হবার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। গরীব হয়েও সে অনেক সুখি একটা জীবন যাপন করতে পারতো যদি তার অন্য রকম জীবন থাকতো। সে ফটোতোলা শিখছে, সেলাই শিখছে, লেখাপড়া করছে। যদি সে কোনোভাবে একটা কাজ পায় তাহলে এই জীবন থেকে সে নিষ্কৃতি পেতে পারবে।
ক্যামেরা হাতে পেয়ে ওরা খুশি। ওরা ছবি তুলে চলে। ওদের জীবনে ছবি, চারপাশের ছবি। ওদের প্রতিদিনকার জীবনের বাস্তব চিত্র ধারণ করে ওরা ক্যামেরায়। ছবি তোলা এখানে সহজ নয় একেবারেই। সবাই ক্যামেরাকে ভয় করে। ক্যামেরা দেখলে রেগে যায়, গালি দেয়। তবুও বাচ্চারা ছবি তুলে যায়। একটা ছবিতে দেখা যায়, খাবারের থালাবাসন, উচ্ছিষ্ট খাবার আর জুতো চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে একই জায়গায়। অভিজিৎ বলে, এটাই ওদের বাস্তব জীবন।
বাচ্চাদের কারো কারো ছবি তুলতে ভালো লাগে বেশি, কারো বেশি ভালো লাগে ছবি বাছতে। ওরা ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে গেলে নানান জনে নানান টিটকিরি করে। এরা ক্যামেরা কোথায় পেলো ইত্যাদি রকম কথা বলে। তবুও ওরা ছবি তোলে ওদের জীবনের। ছবি তুলতে ওদের আনন্দ লাগে।

শান্তি বলে, ওর দরজার মধ্যে একটা ফুটো আছে। সেখানটায় সে একটা পর্দা দিয়ে রাখে। যাতে তার মায়ের কাছে বা অন্যান্য রমণীদের কাছে লোকজনের আসা-যাওয়া সে দেখতে না পায়।
আরেকটি বাচ্চা মেয়ে বলছে, সে তার নানীর কাছে থাকে। তার নানী তাকে তার বাবামা’র কাছে থাকতে দেয় না। কারণ তার বাবা তাকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। সে চায় না বিক্রি হতে, তার দিদিও চায় না, ছোটবোনটি বিক্রি হোক।
একজন বলছে, তার মা কী কাজ করে সে জানে। তা মুখে বলতে লজ্জা করে। একজন বলছে, মা যখন কাজ করে তখন সে ছাদে খেলতে চলে যায়।

অনেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে এই রূপোপজীবিনী পেশায় আছে। কারুর কারুর মা, মাতামহী ও প্রমাতামহীও এই একই পেশায় ছিল। বংশ পরম্পরা ধরে চলছে এই পেশা। এইখানে জন্মাচ্ছে চাঁদের মত, জোছনার মত, ফুলের মত ফুটফুটে মেয়েরা। অভাব, অনাহার, খিস্তি খেউর পঙ্কিলতা তাদেরকে আচ্ছাদিত করে দেয়। আর কী-ই বা ব্যতিক্রমী পরিণতি হতে পারে ওদের। ওদের মায়েদেরও ত দোষ দেয়া যায় না। সন্তানদের এর চেয়ে ভালো জীবন দেবার সাধ্য তাদের নেই। অন্যকিছু এদের চিন্তায় আসারও কথা না। অনেক বৃদ্ধাও বাস করে এইখানে। তাদের আর রোজগার করার ক্ষমতা নেই। শরীরে রূপ নেই, যৌবন নেই। শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে তারা।

এখানকার মেয়েরা সেজেগুজে চিকন গলির দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকে খদ্দেরের জন্য। খদ্দেররা গলির মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখে মেয়েদের দিকে। কাউকে পছন্দ হলে নিয়ে যায় ধরে। তার সাথে কাটায় কিছুক্ষণ সময় বা কয়েক ঘণ্টা। বিনিময়ে টাকা পায় মেয়েটি। তাতে তার অন্নের ব্যবস্থা হয়।

পূজার বাবা তার মা’কে মারে টাকার জন্য। টাকা দিয়ে সে মদ খাবে। পূজার বন্ধু চায়, পূজা যেন এই পরিবেশ থেকে মুক্তি পায়। নইলে ওর বাবা ওকে বিক্রি করে দেবে। মুনমুনের মা তাকে বিক্রি করে দিতে চায়।

এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১১ বছরে। আরেকজনকে জোর পূর্বক রূপোপজীবীতায় বাধ্য করা হয়েছে। এখানে জন্মানো বাচ্চাদের সবারই অবস্থা ও জীবনের পরিণতি একই রকম। ছেলেরা বড় হয়ে অবৈধ ড্রাগ ডিলার হয়, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। মেয়েরা হয় বারবণিতা। এখানেই জন্ম, এখানেই মৃত্যু। আর কী করবে এরা, আর কোথায় যাবে?

অভিজিৎ ছবি আঁকে অদ্ভুত সুন্দর। কেউ শেখায়নি তাকে। কোনো সুযোগ সুবিধে পায়নি শেখার। সে নিজে নিজেই আঁকে। রং তুলির আঁচড়ে তার ভাবনাগুলিকে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে। এই জায়গায় জন্মেছে সে আশ্চর্য শিল্পী-প্রতিভা নিয়ে। সে তার বাবার কথা বলছে, তার বাবা আগে খুব ভালো লোক ছিল। মোটাসোটা ছিল। একাই দুটো লোককে ফেলে দিতে পারতো। এখন তার বাবা নেশা করে। শরীর কঙ্কালসার। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সারাক্ষণ। চোখ খোলারও শক্তি নেই। চোখ সামান্য একটু ফাঁক করে তাকানোর চেষ্টা করে আবার বন্ধ করে নেশায় ডুবে যায়।

অক্সফোর্ড গ্যালারিতে ওদের তোলা ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়। বাচ্চাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। গাড়িতে সারাপথে কত আনন্দ ওদের। গান, হৈ-হুল্লোড়, কলকল হাসির ফোয়ারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। নিজেদের তোলা ছবি দেখে ওরা কত খুশি। ওদের তোলা ছবি কত লোকে দেখতে এসেছে।

ওদেরকে বীচে নিয়ে যাওয়া হয়, চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কত খুশি ওরা। মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ছে ওরা, ফুলের মত হাসছে ওরা, পাখির মত কলকাকলি করছে ওরা। পরিপাটি করে সাজে ওরা কোথাও যাবার সময়। চুলে সিঁথি কাটে, সুন্দর জামা পরে, জুতো পরে। সুন্দর লাগে ওদের। ওদের আনন্দ, ওদের উচ্ছলতা আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়। একটু আদর পেলে, একটু সহানুভূতি পেলে ওরা জীবনকে ভীষণভাবে উদযাপন করে। খুশিতে ওদের চোখ ঝিলমিল করে। ওদের চোখেমুখে আনন্দ খেলা করে। অন্য বাচ্চাদের মতই তো ওরা দেখতে এবং স্বভাবে। তবুও আমাদের সমাজ ও সমাজের অনেকের কাছেই কেন ওরা অস্পৃশ্য, কেন ওরা অচ্ছুৎ, কেন ওরা ঘৃণ্য? কোনো নিরপরাধ শিশু কীভাবে অস্পৃশ্য, ঘৃণ্য হতে পারে?

Zana নিরলস চেষ্টা করে যান এই বাচ্চাদের এখান থেকে বের করে আনার জন্য। তিনি বর্ডিং স্কুলে গিয়ে কথা বলেন এদের ভর্তির ব্যাপারে। কোনো স্কুল এদের নিতে চায় না। কারণ এদের জন্ম পতিতালয়ে। এক স্কুল রাজি হয়। কিন্তু এই বাচ্চাদের সবার এইচআইভি টেস্ট করিয়ে রেজাল্ট আনতে বলে; এদের পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে। সবার ফলাফল নেগেটিভ আসে।

বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করানো হয় ওদের। অভিজিৎ আমস্টারডাম যায় ছবির প্রদর্শনীতে। আবার ফিরে আসে কলকাতায়। কলকাতার ফিউচার হোপ স্কুলে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। মাণিকের বাবা তাকে স্কুলে যেতে দেবে না। পূজার মা তাকে স্কুল থেকে ফেরত নিয়ে নিয়েছে। শান্তি স্বেচ্ছায় স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। গৌর এখনো বোর্ডিঙে আছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছে। সুচরিতার মাসি তাকে ব্রথেল ছেড়ে যেতে দেয়নি। কচি সাবেরা স্কুলে রয়ে গেছে, খুশি আছে এবং ভালো করছে।

আমাদের ও আমাদের সমাজের কাছে অস্পৃশ্য বঞ্চিত এই নিরপরাধ বাচ্চাগুলির সাথে Ross Kauffman ও Zana Briski’র কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। ভিনদেশী ও ভিনভাষী মানুষ এঁরা। তবুও এই বাচ্চাদের একটা সুস্থ সুন্দর আনন্দের জীবন দেবার জন্য কী আন্তরিক প্রাণান্তকর অক্লান্ত প্রচেষ্টা এঁদের। বিনিময়ে কিছুই ত চান না এঁরা। এমন নিঃস্বার্থ মহৎ মানুষ কী করে থাকেন এই হানাহানি লোভলাসলাময় চটুল পৃথিবীতে?