সেনাশাসনের বুটে পিষ্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর, খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থানের পরিণতিতে ৬ নভেন্বর খন্দকার মোস্তাক ক্ষমতাচ্যূত হন। প্রায় ৮২ দিনের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিমূলে একের পর এক আঘাত হেনে বাংলাদেশকে অনেকটা পাকিস্তানমুখী করে তুলেছিল খুনী মোশতাক। এমনকি পাকিস্তানের সাথে নতুন করে কন্ফেডারেশন করার উদ্যোগও গ্রহণ করেছিল সে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে, সেটা হয়ত ভাবতে পারে নি খন্দকার মোশতাক। তার পদত্যাগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে শপথ নেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মো: সায়েম। খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থান ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে মেজর জিয়াউর রহমান গৃহবন্ধী থেকে মুক্ত হয়ে আবারো সেনাবাহিনী প্রধান হন এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন।

পরিস্থিতির বরপুত্র মেজর জিয়াউর রহমান-একাত্তুরের ২৭ সে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে যেমন প্রথম বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করার সুযোগ পেয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান, ঠিক তেমনি এবারও হঠকারী কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে সংগঠিত সেনা বিদ্রোহ খালেদ মোশারফের অভ্যূত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ফলে পদচ্যূত, বন্ধী জিয়াউর রহমান পুন: সেনাবাহিনী প্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হলেন।

অত:পর ১৯৭৬ ইং সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি সায়েম এর কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব কেড়ে নেন মেজর জিয়া । ১৯৭৭ ইং সালের এপ্রিল মাসে এসে আর লোভ সামলাতে পারলেন না জিয়া- সায়েমকে অসুস্থ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির পদটাও তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মেজর জিয়া দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।

রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেওয়ার পর জিয়ার আসল চেহারা উম্মোচিত হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাকে গ্রাস করতে থাকে ক্রমে। তাই সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি জিয়া এবার ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করেন এবং তার ক্ষমতারোহনকে বৈধতা দেওয়ার প্রত্যাশায় ঐ বছর মে মাসে গণভোটের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

হ্যাঁ, না, ভোট। কোন প্রতিদ্বন্ধী থাকবে না। জনগণ একতরফাভাবে ভোট দেবে। হ্যাঁ ভোট বেশি হলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসাবে বৈধ হবেন, না ভোট বেশি হলে কী হবে বলা নেই। তবুও ভোট অনুষ্ঠিত হল কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সরকারী আমলাদের সাহায্যে-৩০ মে, ১৯৭৭ ইং সালে। আলম পতেঙ্গা এলাকার প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখে। কোন ভোট কেন্দ্রেই পুলিশ আনসার ও নির্বাচনী কর্মকর্তা ব্যতীত ২০/৩০ জন সাধারণ ভোটার উপস্থিত ছিল না। অথচ নির্বাচন কমিশন ফল ঘোষণা করল ৯৮% এর বেশি হ্যাঁ ভোট পড়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এহেন মিথ্যাচার !

১৫ই আগস্টের অভ্যূত্থান পরবর্তী খুব দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের এক পর্যায়ে মেজর জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিলেন, তখন নানা দু:খ, বেদনা ও হতাশা সত্ত্বেও আলমের মনে আশার ক্ষীণ শিখা জ্বলছিল এই ভেবে যে, সবকিছুর পরও জিয়াউর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং বঙ্গবন্ধুর নামে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানকারী। অন্তত মোশতাকের মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না জিয়া। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরবে না বাংলাদেশ। নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করবে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া। বাংলাদেশ জিন্দাবাদের পরিবর্তে একাত্তুরের সে রক্ত-কাঁপানো শ্লোগান-জয় বাংলা-আবার ফিরে আসবে জাতীয় জীবনে। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার ভাবমূর্তি আবারো পুন: প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু না, হা হতোস্মি ! এসব কিছুই হল না। প্রথম যে ন্যাক্কারজনক কাজটি করলেন মেজর জিয়া, তাহল বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের হাত থেকে অব্যাহতি দিয়ে মোশতাক যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করেছিল, আইনী প্রক্রিয়ায় তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৭ ইং সালে নতুন একটি অধ্যাদেশ জারী করে জিয়া সে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি করলেন। ১৯৭৭ এর মে মাসে তামাসার গণভোট সম্পন্ন করার পর এবার ১৯৭৮ ইং সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা করলেন। সেনাবাহিনী প্রধান পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমান নিজে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হলেন-যা সুস্পষ্ট সংবিধান পরিপন্থী। তার প্রতিদ্বন্ধী হিসাবে বিপর্যস্থ আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রার্থী হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম,এ,জি, ওসমানি।
১৯৭৮ ইং সালে ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ নিয়ে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে আলম দক্ষিণ পতেঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হল। সে সুবাদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কর্ণেল ওসমানীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেয় আলম। পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সভা ছাড়াও পশ্চিম পটিয়ার কয়েকটি জনসভায়ও আলম বক্তৃতা করে বেড়াল। প্রচণ্ড প্রতিকুলতার মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় একজন তুখোড় বক্তা ও প্রচারকর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হল আলম।

স্থানীয় পর্যায়ের সভা-সমাবেশগুলোতে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ভাষায় আলম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিত। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তখন পর্যন্ত জানা ঘটনার আবেগময় বর্ণনা শয়ে শয়ে দর্শক শ্রোতা তম্ময় হয়ে শুনত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের দাবী জানাত আলম এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্মুন্নত রাখার জন্য এম,এ,জি ওসমানীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাত। কিন্তু ইতিমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সুবিধাবাদী লোকজন, বিশেষভাবে জামাত, মুসলিম লীগ সহ স্বাধীনতা বিরোধী স্থানীয় হোমরা-চোমরা ব্যক্তিরা জুটে গেল জিয়ার পক্ষে। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ সারা দেশ ব্যাপী পরিচালিত একক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন মোকাবেলা করার মত সাংগঠনিক অবস্থা তখনো গড়ে তুলতে পারে নি। তাছাড়া প্রশাসনও ছিল সম্পূর্ণ বৈরী। ফলাফল যা হওয়ার তাই হল। বিপুল ভোটের ব্যবধানে ওসমানী হারলেন। জিয়াউর রহমান পেলেন ৭৬ শতাংশের উপর, আর ওসমানী পেলেন ২১ শতাংশের উপর। অবশ্য এটা পূর্ব থেকেই ধারণা করা ছিল যে, এ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানই জিতবে। হারার জন্য তিনি নির্বাচন দেন নি।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে তিনি উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করলেন। অত:পর তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে মনোনিবেশ করলেন। স্বাধীনতা বিরোধী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ সহ চরম ডানপন্থী দলগুলো এবং কট্টরপন্থী বাম-যারা বস্তুত: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে মাংশ নিয়ে দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি বলে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল-সে সকল দলের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে তিনি প্রথমে জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি) নামক রাজনৈতিক দলের জন্ম দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বাঙালি জাতিয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের শ্লোগানকে তিনি সামনে নিয়ে আসলেন। মুসলিম লীগের নেতা শাহ আজিজুর রহমান-যিনি জাতিসঙ্গে গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তৃতা করেছিলেন-তাকেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করলেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের গুরু গোলাম আজমকে-স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যিনি পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং যার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল-তাকে দেশে আসার সুযোগ করে দিলেন। অত:পর জামাতে ইসলামীর পলাতক নেতারা একে একে দেশে পুনর্বাসিত হতে লাগলেন। তারই প্রশ্রয়ে পুনর্গঠিত হতে লাগল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের নতুন ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির।

গোলাম আজমের দেশে ফেরার প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আন্দোলন
১৯৭৮ ইং সালেই আলম মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যোগদেয় এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বন্দর থানা কমান্ডের কমান্ডার নির্বচিত হয়। কুখ্যাত গোলাম আযমের দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ প্রদানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তখন সারা দেশব্যাপী একটি আন্দোলন গড়ে তুলে। সারা দেশে প্রতিটি জেলায় সংসদের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হতে লাগল। বন্দর থানার কমান্ডার হিসাবে আলম প্রায় সকল প্রতিবাদ সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করত। পতেঙ্গা থেকে মিরেশ্বরাই, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনানইশ, লোহাগড়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া প্রভৃতি থানায় থানায় অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আয়োজিত সভা-সমাবেশে আলম উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করে বেড়াতে লাগল। কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বানে সারাদেশ ব্যাপী হরতালও পালিত হল। কিন্তু সেনাশাসক জিয়াউর রহমান গোলাম আজমের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কোন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন না। বরং গোলাম আজমের দায়ের করা রীট মামলায় আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে গোলাম আজম তার নাগরিকত্ব ফেরত পেলেন। অত:পর গোলাম আজম পূর্ণোদ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করলেন।

মুক্তিযুদ্ধের একজন সেনানায়ক যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন, তখন একজন স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী দেশে পূনর্বাসিত হলেন। ব্যর্থ হল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আন্দোলন। অথচ মু্ক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রায় সকলে রাষ্ট্রপিত জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ঠ ছিলেন । মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিভিন্ন সভায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে আলমের প্রায় বিতর্ক হত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ঘোষণা যখন প্রদান করা হচ্ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধার নয়- মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন চাই-এমন একটি শ্লোগানের পক্ষে ছিল আলম। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক সভায় সংসদের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বক্তৃতায় বললেন-মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের কোন অবদান নেই।
জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বানানোর প্রয়াস চলতে লাগল। তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা তলে সমবেত মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অবশ্য নিরীহ ও হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন আদায়ের জন্য নানা টোপও দিচ্ছিল জিয়াউর রহমান। আশাহত হয়ে আলম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে চলে আসতে বাধ্য হলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন: প্রচণ্ড প্রতিকূলতায় আওয়ামী লীগ
১৯৭৮ ইং সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ ইং সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদের নির্বাচন ঘোষণা করলেন। ঐ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ বন্দর-ডবলমুরীং নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে ১৯৭০ ইং সালের নির্বাচনে এ এলাকা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব ইসহাক মিঞা (চেয়ারম্যান)। বিএনপি থেকে প্রার্থী হলেন-পারিবারিকভাবে স্বাধীনতা বিরোধী সাবেক মুসলিম লীগার ব্যারিষ্টার সুলতান আহমদ। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী প্রচারণা সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য উত্তর পতেঙ্গা, দক্ষিণ পতেঙ্গা ও দক্ষিণ হালিশহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ একটি যৌথ নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। জনাব ইসহাক মিঞার নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা করে চাঁদা সংগ্রহ করা হল। অত:পর এ তিনটি ইউনিয়নে সমন্বিত কর্মসূচী প্রণয়ন করে সভা-সমাবেশ-মিছিল অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হল। নির্বাচনী প্রচারে নেমে আলম লক্ষ্য করল, বিএনপি তখন চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষকে নিদারুন ভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারে কাজে লাগাচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, রুটি-তাওয়া-বেলুন লঠকিয়ে তারা সাধারণ মানুষদের চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল। তাদের এ প্রচারণা সাধারন মানুষ, বিশেষ ভাবে মহিলাদের মধ্যে দারুন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হল।
এতবড় যুদ্ধের সাফল্য, দেশের স্বাধীনতা অর্জন, সব কিছু ভুলে মানুষ কেবল চুয়াত্তর সালে চালের দাম, নুনের দাম, মরিচের দাম কত হয়েছে এসব প্রশ্ন করত। এহেন প্রতিকুল পরিবেশেও আলম তার সহকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচার আপোষহীনভাবে চালিয়ে যেতে লাগল। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ যে কৃত্রিম, আমেরিকার যড়যন্ত্র, ফিডেল কা্স্ট্রোর কিউবায় চটের থলে রপ্তানী করার অজুহাতে আমেরিক পিএল ৮৪ এর গমের জাহাজ অর্ধপথ থেকে ফেরত নিয়ে যাওয়া, ইত্যাকার বিষয় তার বক্তৃতায় বলতে বলতে গলদঘর্ম হয়ে যেত আলম। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে সাধারণ মানুষের জন্য আসা বিভিন্ন রিলিফ সামগ্রী বিতরণ নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অনিয়মের অজস্র অভিযোগ এর মুখোমুখী হতে হত তাদের। তবুও হাল না ছেড়ে ক্লান্তিহীন প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যেত আলম ও তার সহকর্মীরা।
নির্বাচনী প্রচারণাকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু জায়গায় সংঘর্ষেও ঘটনাও ঘটতে থাকল।
একদিন সকালে ওঠে আলমেরা দেখল, চট্টগ্রাম স্টিল মিলের প্রধান ফটক হতে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত শয়ে শয়ে বঙ্গবন্ধুর কুশপুত্তলিকা বানিয়ে তার হাতে রুটি-তাওয়া-বেলুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ছাবের কন্ট্রাক্টর ছিলেন এর নাটের গুরু। আলমেরা গোপনে সিদ্ধান্ত নিল একটি মিছিল নিয়ে এক সাথেই এসব সরিয়ে ফেলতে হবে। স্টিল মিল বাজারে অনুষ্ঠিত হল এক নির্বাচনী সভা। রাত প্রায় ৯-০০ঘটিকার সময় সে সভা যখন সমাপ্ত হল, তখন একটি মিছিল সিমেন্ট ক্রসিং এর দিকে রওয়ানা দিল। এক পর্যায়ে পরিকল্পনা মাফিক সে মিছিল জঙ্গীরূপ ধারণ করল। পথের দুপাশে এবং সড়ক দ্বীপে বঙ্গবন্ধুর যত কুশ পুত্তলিকা ছিল একে একে সবই উপড়ে পেলে ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া হল। চুঁড়ে ফেলা হল রশী দিয়ে ঠাঙানো সকল রুটি-তাওয়া বেলূন উপড়ে ফেলা হল। লাঠিসোটা নিয়ে সিমেন্ট ক্রসিং সংলগ্ন ছাবের কন্ট্রাকটরের বিল্ডিয়ে জমায়েত বিএনপি’র কর্মীরা মিছিলের পেছনে হামলা করার চেষ্টা করলে পূর্বে থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত কর্মীরা পাল্টা হামলা চালালে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হল।
এভাবে সারা দেশে নানা সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। এ এলাকায় যেমন জিততে পারল না ইছাক চেয়ারম্যান, সারাদেশেও ৩০০ আসনের মধ্যে ২২০ টি আসন পায় নবগঠিত জাতীয়তাবাদী দল।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান দেশে বাকশাল পদ্ধতি রহিত করে বহুদলীয় পদ্ধতি ঘোষণা করলেও ৪র্থ সংশোধনীতে প্রণীত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার বহাল রাখলেন। ফলত: তার অধীনে নির্বাচিত সংসদ বস্তুত: তারই রাবার ষ্টাম্প হয়ে রইল।
এই সংসদের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ ইং সালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশে পরিণত করলেন-যার অর্থ দাঁড়াল বঙ্গবন্ধু ও পরবর্তী সময়ে নিহত ৪ জাতীয় নেতা হত্যাকারীদের কোন বিচার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকিস্তান আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অভিসিক্ত করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মোশতাক যে ভাবে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানমুখী অভিযাত্রার রথে সওয়ার করিয়েছিল-এবার সে রথের হাল ধরলেন একাত্তুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা-সেক্টর কমান্ডার। ওল্টো রথে চলল বাংলাদেশ! —–চলবে।