শুরু করছি একটা পুরাতন কৌতুক দিয়ে। শহরে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে গ্রামে চাষা বাবার কাছে বেড়াতে এসেছে। সেই অজ পাড়াগাঁয়ে কেউ ইংরেজীর একবর্ণও বোঝে না। তো বাবার খুব শখ, তার ছেলে গ্রামে দু’চারজনকে ইংরেজী শুনিয়ে দিয়ে বংশের নাম উজ্জ্বল করুক। পথে এক প্রতিবেশী কৃষকের সঙ্গে দেখা, যে কিনা তার পটলের ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছিল। বাবা-ছেলে সে পথে যাওয়ার সময় বাবা ওই প্রতিবেশীকে শুনিয়ে বলে, ‘জানিস, আমার ছেলে তো শহর থেকে ইংরেজী শিখে এসেছে’। প্রতিবেশী শুনে বেশ আশ্চর্য্য হয়, এবং কিছু ইংরেজি বোল শুনতে চায়। বাবা গর্বভরে ছেলেকে হুকুম দেয়, ‘বাবা, পটল নিড়ানির ইংরেজিটা শুনিয়ে দে তো।’ ছেলে ইংরেজী জানত ভালই, কিন্তু ঘটনাচক্রে পটল নিড়ানির ইংরেজিটা তার কখনো শেখা হয় নি, কাজেই সে বলে, ‘আই ডোন্ট নো’। ছেলের ইংরেজীর বহর দেখে বাপ আর তার প্রতিবেশী কৃষক সবাই দিলখুশ, যদিও ভিন্ন ভিন্ন কারণে – বাপ ভাবে, আমার ছেলে তো গটগট করে এক্কেবারে বিদেশীদের ঢঙে ইংরেজি বলে আমার নাম উজ্জ্বল করল, ছেলে বাপকে খুশী করতে পেরে খুশী, আর সেই কৃষক মুফতে পটল নিড়ানির ইংরেজী ‘আই ডোন্ট নো’ জানতে পেরে খুশী।

কৌতুকের জন্ম হয় বাস্তব জগতে। জীবনের নানান সময়ের নানান অসঙ্গতি আর ভুলগুলো এভাবে মানুষের মুখে মুখে গল্পের আকারে ঘুরে বেড়ায় – কেউ তা থেকে নেয় শিক্ষা, আর কেউ বিনোদন। সব কৌতুকই নিছক আনন্দদায়ী নয়, এর অনেকগুলোর মাঝে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে থাকে নানা ট্র্যাজেডি। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার মত এসব কৌতুকের পেছনের গল্প অনেকসময় ইতিহাসের নানা অন্ধকারাচ্ছন্ন অলিগলির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। তেমনি এক কৌতুকমিশ্রিত করুণ গল্প হল এই ক্যাঙ্গারুর জন্মবৃত্তান্ত।

ঘটনা সামান্যই। অস্ট্রেলিয়াজুড়ে স্ট্যান্ড-আপ কমেডীয়ানদের অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া একটা কৌতুক হল এরকমঃ ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নেমে ক্যাঙ্গারুর দেখা পেয়ে বেশ মুগ্ধ হন, পেটে বাচ্চা নিয়ে লাফিয়ে চলা এই প্রাণীটিকে তার অনভ্যস্ত ইউরোপীয়ান চোখে বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য্য মনে হয়। সেই প্রথম অস্ট্রেলিয়ান আর ইউরোপীয়ানদের সাক্ষাত, কাজেই কেউ কারো ভাষা বুঝতে পারার প্রশ্নই আসে না, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছাড়া। ক্যাপ্টেন কুক স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে ইশারা-ইঙ্গিতে প্রানীটির নাম জানতে চান। জবাবে স্থানীয় অধিবাসীদের কেউ হয়ত তাদের ভাষায় বলেছিল, আমি জানি না। স্থানীয় ভাষার সেই বাক্যটিকেই ক্যাপ্টেন কুক প্রাণীটির নাম মনে করেছিলেন, আর সেই থেকেই বাকী দুনিয়া প্রাণীটিকে ক্যাঙ্গারু নামে ডেকে আসছে, আদি অস্ট্রেলিয়ান ভাষায় যার অর্থ হল ‘আমি জানি না’।

যার নিশ্চিতভাবেই একটি নাম ছিল স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষায়, সেই প্রাণী যদি ঘটনাক্রমে কিম্বা দুর্ঘটনাক্রমে বিদেশীদের কাছে স্থানীয় ভাষার ‘আমি জানি না’ এর প্রতিশব্দ দিয়েই পরিচিত হয়, তাতেই বা কি আসে যায়? সেক্সপীয়র মহাশয় তো সেই কবেই রায় দিয়ে গেছেন, নামে কিচ্ছুটি আসে যায় না। আসলেই তো, নাম কোন বস্তুর নিজস্ব গুন নয়, এটা বাইরে থেকে আরোপিত। এ পৃথিবীতে অবস্থিত সকল প্রকার বস্তুর একটা নাম আছে। নামবিহীন কোন কিছু কল্পনা করা যায় না – কঠিন, তরল বা বায়বীয় যাই হোক না কেন। এই নামগুলো পুরোটাই ভাষার কারসাজি – আর তাই একই জিনিসের নাম হাজার ভাষায় হাজারো রকমের। আমরা যাকে বলি ভালোবাসা, তাকে উর্দু/হিন্দিভাষীরা বলে ইশক, ইংরেজীভাষীরা বলে লাভ। আবার, আমাদের ভাষায় যাকে আমরা পাহাড় বলি, তাকে যদি নদী বলতাম, আর নদীকে পাহাড় বলতাম, তাতে এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। তখন হয়তো বলতে হত ‘পাহাড়ে বান ডেকেছে’ অথবা ‘গারো নদীতে বাস করে আদিবাসীরা’ – পার্থক্য বলতে এইটুকুই। এখন বলি ‘পাহাড়সম বাধা’, তখন বলতাম ‘নদীসম বাধা’। কোথাও কোন সমস্যা নেই, তবে শুধু একটা প্রায় অগ্রাহ্যকরার মতন ছোট্ট খটকা রয়ে যাচ্ছে – নাম আদতে আলগা জিনিস হলেও সময়ের সাথে সাথে তা বস্তুর উপরে স্থায়িত্ব পেতে থাকে, ফলে তাকে সহজে বদলানো যায় না। সমাজে যে নাম প্রচলিত হয়ে যায়, তার একটা সহজাত অর্থ এবং ব্যঞ্জনা ভাষায় স্থান লাভ করে, ফলে তাকে বদলানো ভয়ানক কঠিন। একই সঙ্গে নামগুলো ইতিহাসকে ধারণ করে ও সেই গল্পকে বয়ে নিয়ে চলে প্রজন্মান্তরে। ক্যাঙ্গারু নামটাও যেমন, তথাকথিত ‘সভ্য’ দুনিয়ার বাইরের বাকী সবার প্রতি ইউরোপীয়ান সম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিদের তখনকার মনোভঙ্গী ও আচরণের এক ট্র্যাজিক ইতিহাসকে ধারণ করে। সেই ইতিহাসকে আরো একটু ভালোভাবে দেখতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে ১৭৭০ সালের জুলাই মাসে, আজকের কুকটাউনে।

ব্রিটিশ রয়াল নেভীর জাহাজ ‘এনডেভার’ নিয়ে ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭০ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকুলের যে জায়গায় নোঙ্গর ফেলেন, তার বর্তমান নাম কুকটাউন। অস্ট্রেলিয়ার পুর্ব উপকূলের সর্ব-উত্তরের এই ছোট লোকালয়টি ব্রিসবেন থেকে প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার উত্তরে, এবং এর আশেপাশে মানুষের বসতি খুবই কম (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী কুকটাউনের লোকসংখ্যা ২,৩৩৯)। এখানে একটি ছোট নদী ছিল, যার আসল নাম কেউ আর জানে না, কখনো জানত কি না তাও জানা যায় না। আজকের নাম ‘এনডেভার’ নদী। জাহাজ মেরামতের জন্য এই নদীর মোহনাতেই জাহাজ ভিড়িয়েছিলেন কুক, আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তার চোখে পড়েছিল এই মহাদেশের কিছু প্রাণী – মানবপ্রজাতি সহ আরো কিছু প্রজাতির। ক্যাপ্টেন কুক তার ডায়েরিতে লিখেছেন,

একদিন সকালে কয়েকজন স্থানীয় আদিবাসী আমাদের নজরে এল – ওরা গাছের কান্ড দিয়ে বানানো এক ধরণের নৌকায় করে মাছ ধরছিল বলে আমাদের মনে হল। নারী পুরুষ শিশু সবাই ছিল উলংগ, সারা গায়ে লাল সাদা কালো নানারকম উল্কি আঁকা, এবং মাথার চুল ছোট করে কাটা। নরম এবং মৃদু একটা ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল

এই ঘটনার দিনকয়েক পরেই কুকের নজরে পরে ক্যাঙ্গারু – তার ডায়েরীতে সেই ঘটনার বর্ণনা এরকমঃ

আমাদের একজনের আজ সেই প্রাণীটিকে শিকার করতে পারার সৌভাগ্য হয়েছে, যেটি কিনা আমাদেরকে বিস্মিত করে চলেছে গত কয়েকদিন। দীর্ঘ লেজবিশিষ্ট এবং সামনের দু’পায়ের উপরে ভর করে দ্রুত লাফিয়ে চলা এই জন্তুটি সব সময় খাঁড়া ভঙ্গীতে কৌতুহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত নিরাপদ দুরত্ব থেকে। স্থানীয়রা একে ডাকে ক্যাঙ্গুরু নামে (Kanguroo)। পরের দিন আমরা এই ক্যাঙ্গুরুর মাংস দিয়ে ডিনার করলাম। এত উপাদেয় মাংস আমি আমার জীবনে খুব কমই খেয়েছি।

পরের বছর ‘এনডেভার’ ব্রিটেনে ফিরে যায় ক্যাঙ্গারুর একটা চামড়া সঙ্গে নিয়ে, এবং সেই চামড়া ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনানুযায়ী জর্জ স্টাবস ক্যাঙ্গারুর একটা ছবি আঁকেন। সেটা ১৭৭২ সালের ঘটনা। সেই ছবি মোটামুটি ততক্ষনাত সেলিব্রিটির মর্যাদা পায় – ক্যাঙ্গারুর প্রতি ও সেই সাথে কুকের আবিষ্কৃত নতুন দুনিয়ার প্রতি লোকজনের সীমাহীন আগ্রহের ফলশ্রুতিতে কয়েকবছর পরে ‘দক্ষিনের অজানা দেশ’ অস্ট্রেলিয়া থেকে দুটো আস্ত ক্যাঙ্গারু লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং হেমার্কেট এলাকায় তার প্রদর্শনীও হয়। এভাবেই সভ্য দুনিয়ার ভাষা ইংরেজীতে এবোরিজিনালদের ভাষার একটা শব্দ ঢুকে পড়ে। ক্যাঙ্গারু শব্দটা ইউরোপে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক শব্দতালিকায় অস্ট্রেলিয়ান এবোরিজিনালদের প্রথম রপ্তানীকৃত শব্দ হল ‘ক্যাঙ্গারু’।

কিন্তু আসলে ঘটনাটা কি তাই? আপাতত সেটা নির্ভর করছে আপনি কোন দলের মানুষ, তার উপরে – সভ্য, নাকি অসভ্য।

‘ক্যাঙ্গারু’ শব্দের উতপত্তি যে অস্ট্রেলিয়ায়, তা নিয়ে কেউ সন্দেহ করে নি কখনো, কিম্বা এই প্রাণীটিকে তার বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্টগুলির জন্য খ্যাতির শীর্ষে বসাতেও কেউ আপত্তি করেননি দীর্ঘদিন। কিন্ত বাদ সাধে তখন, যখন আরো কিছু পরিব্রাজক অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে এই প্রাণীর দেখা পায়, এবং স্থানীয়দের কাছে সেটার নাম জানতে চায়। ততদিনে এবোরিজিনালদের সঙ্গে ইউরোপীয়ানদের কিছুটা ভাষিক যোগাযোগ হয়েছে, কাজেই তারা মনের ভাব পুরোটা না হলেও বেশ খানিকটা একে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারতেন। দেখা গেল, এবোরিজিনালরা এই প্রাণীটির যে নাম বলছে, তা ক্যাপ্টেন কুকের হাতে জনপ্রিয় হওয়া ‘ক্যাঙ্গারু’ শব্দের সঙ্গে কোনভাবেই মেলে না। আজকে এই ২০১৫ সালে বসে যখন এই লেখা লিখছি, তখন আমি/আমরা জানি যে সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কারণ অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অনেক আদিবাসী গোত্র বাস করত, যাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাষা ছিল, এবং এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের ভাষিক যোগাযোগ হত খুব কম। আলাদা আলাদা ভাষায় ক্যাঙ্গারুর আলাদা আলাদা নাম থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্যাপ্টেন কুক যেখানে জাহাজ ভিড়িয়েছিলেন, সেটা আজকের দিনেও দূর্গম এক এলাকা (নিকটতম শহর কেয়ার্নস থেকেও সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দুরে) – কাজেই তখনকার দিনে সেখানে কোন ইউরোপীয়ানের আস্তানা গাড়বার কথা নয়। ভাগ্যান্বেষী কিম্বা বিতাড়িত ইউরোপীয়ানদের আস্তানা তখন আজকের সিডনী-মেলবোর্ন-পার্থের যেখানে অবস্থান, সেসব এলাকায়। কাজেই যে গোত্রটি কুকটাউনের এনডেভার নদীর আশেপাশে বাস করত, তাদের সঙ্গে কোন ইউরোপীয়ানের সাক্ষাত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল একেবারেই সামান্য। ফলে ক্যাঙ্গারু নামটির জন্ম নিয়ে যে সন্দেহ, তা ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে মানুষের মনে। ইউরোপীয়ানরা কোন এবোরিজিনকে ক্যাঙ্গারুর নাম জিজ্ঞেস করলে তারা তাদের নিজের ভাষায় ওই প্রাণীটির যে নাম, সেটাই বলত, এবং খুবই স্বাভাবিক কারণেই তারা ‘ক্যাঙ্গারু’ শব্দটাকে চিনতে পারত না, এটা তাদের ভাষার শব্দ নয় বলে। সেকারণে অনেক এবোরিজিন আবার মনে করত, ‘ক্যাঙ্গারু’ শব্দটা আসলে ইউরোপীয়, ইউরোপীয়ানরা জোর করে তাদের চেনাজানা একটা প্রাণীর ইউরোপীয়ান নাম অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের উপরে চাপাতে চাচ্ছে!

বিশাল এই অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে অনেক গোত্র আর ভাষার সমাহার, সেখানে বিষয়টা এখনো ততটা দৃষ্টিকটু নয়। এখনো ধরে নেওয়া যায়, হয়তো যে গোত্রের লোকেরা এই প্রাণীটিকে ‘ক্যাঙ্গারু’ নামে ডাকত, তাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন কুকের পরে আর কোন ইউরোপীয়ানের দেখা হয় নি। সম্ভাব্যতার হিশেবনিকেশে এ যুক্তি একেবারে ফেলে দেবার নয়। কিন্তু তাতেও জল ঢেলে দেন আরেকজন পরিব্রাজক, ক্যাপ্টেন ফিলিপ পার্কার কিং, যিনি কিনা ক্যাপ্টেন কুকের ডায়েরীর বর্ণনানুযায়ী সেই এনডেভার নদী খুঁজে বের করেন ১৮২০ সালে। ক্যাপ্টেন কিং সেখানে একটা ক্যাঙ্গারু দেখিয়ে এক স্থানীয়কে সেই প্রাণীর নাম জিজ্ঞেস করলে তারা আরেকটা নাম বলেছিল, ‘ক্যাঙ্গারু’ বলে নি। হাতেনাতে প্রমাণ। ফলে ক্যাপ্টেন কিং রায় দিয়ে দিলেন, অস্ট্রেলিয়ান আবোরিজিনালদের ভাষায় ‘ক্যাঙ্গারু’ শব্দটার কোন অস্তিত্ব নেই, এটা সম্ভবত ক্যাপ্টেন কুকের উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার। বলে রাখি, এনডেভার নদীতীরের আবোরিজিনালরা ক্যাপ্টেন কিং এর কাছে ক্যাঙ্গারুর নাম বলেছিল ‘minnar’ বা ‘meenuah’। আপাতত একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও, এই শব্দগুলোও আমাদের কাজে লাগবে, বর্তমান আলোচনা আরেকটু এগুলে।

তাহলে কারা ছিল সেই উলংগ, গায়ে লাল সাদা কালো উল্কি আঁকা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা আদিম মানুষেরা, ক্যাপ্টেন কুকের ভাষায় যারা নরম এবং মৃদু একটা ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল? কি-ই বা ছিল তাদের ভাষা? ক্যাঙ্গারু শব্দের উতপত্তি জানতে হলে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। তারা কি আসলেই এই প্রাণীর নাম ক্যাঙ্গারু বলেছিল, নাকি ক্যাপ্টেন কুকের প্রশ্নের জবাবে ‘আমি জানি না’ বা ‘আমি বুঝতে পারছি না’ জাতীয় কিছু একটা বলেছিল, যেটিকে কুক ওই প্রাণীর নাম মনে করেছিলেন? এরকম ভাষাবিভ্রাটের ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার সেই সময়ে আরো ঘটেছে – ইতিহাসে সেগুলোর উদাহরণ মিলবে। কাজেই কমেডীয়ানরা যে ব্যাপারটা নিয়ে কৌতুক করবে, সেটা একেবারেই অনাকাঙ্খিত নয়। আজও পর্যন্ত অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি ‘ক্যাঙ্গারু’ শব্দের অর্থ দেওয়ার সময় নোট দিচ্ছে এরকম, Origin: late 18th century, the name of a specific kind of kangaroo in an extinct Aboriginal language of northern Queensland, Australia (অনলাইন ভার্শান, লিংক এখানে- )। আরো কয়েক বছর আগে এই ডিকশনারিতে নোটটা অন্যরকম ছিল – Kangaroo: Stated to have been the name in a native Australian language. Cook and Banks believed it to be the name given to the animal by the natives at Endeavour river, Queensland (তথ্যসূত্রঃ Deutscher, Guy: Through the Language Glass – Why the World Looks Different in Other Languages, Metropolitan Books, New York 2010, pp 159)। ১৭৭২ সাল থেকে পরের প্রায় দুশো বছর কেউ এই রহস্যের কুলকিনারা করতে পারেননি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাঙ্গারু শব্দের আসলত্ব-নকলত্ব নিয়ে বাজারে নানারকমের সন্দেহ ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫০ সালে বিশিষ্ট প্রাচ্যবিশারদ জন ক্রফোর্ড ‘Journal of the Indian Archipelago and Eastern Asia’-তে বলেন,

It’s very remarkable that this word, supposed to be Australian, is not to be found as the name of this singular marsupial animal in any language of Australia. Cook and his companions, therefore, when they gave it this name, must have made some mistake, but of what nature cannot be conjectured’

অবশেষে ১৯৭১ সালে এই রহস্য উদঘাটন করেন নৃতাত্বিক ও ভাষাতাত্বিক জন হ্যাভিল্যান্ড, অনেকটা আকস্মিকভাবে। হ্যাভিল্যান্ড আধুনা কুকটাউনের মাইল তিরিশেক উত্তরে বসবাসরত একটা এবোরিজিনাল গোত্রের ভাষার উপরে গবেষণা করছিলেন সে সময়। তাদের ভাষার নাম ছিল গুগু ইমিথির (Guugu Yimithir), এবং এই গোত্রের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র হাজারখানেক। তিনি পরে জানতে পারেন যে, এই গোত্রটি বহু আগে এনডেভার নদীর আশেপাশের এলাকায় বাস করত। হ্যাভিল্যান্ড একসময় দেখলেন যে, গুগু ইমিথির ভাষায় এক ধরনের বড় ধুসর বর্ণের ক্যাঙ্গারুর নাম গ্যাঙ্গুরু (Gangurru)। সেখান থেকেই ক্যাঙ্গারু শব্দটার পিতৃপরিচয় নিয়ে সব সন্দেহ মুছে ফেলা যায়। এবোরিজিনালদের গ্যাঙ্গুরু উচ্চারণকে কুক ও তার সহযাত্রীরা ক্যাঙ্গারু শুনে থাকতেই পারেন। তবে একটা ছোট সন্দেহ রয়েই যায় – তাই যদি হবে, তাহলে ১৮২০ সালে ক্যাপ্টেন ফিলিপ পার্কার কিং যখন ক্যাপ্টেন কুকের ডায়েরীর বর্ণনানুযায়ী সেই এনডেভার নদীতীরে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তখন সেখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা ক্যাঙ্গারুর নাম গ্যাঙ্গারু বা গাঙ্গুরু-জাতীয় কিছু না বলে ‘minnar’ বা ‘meenuah’ বলেছিল কেন? সে রহস্যেরও উত্তর মিলেছে। গুগু ইমিথির ভাষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হ্যাভিল্যান্ড পরে আরো জেনেছিলেন যে, ক্যাঙ্গারু অনেক প্রকারের আছে, এবং সেগুলোর আলাদা আলাদা নামও আছে। এই নামগুলি পরস্পরের খুব কাছাকাছি। ধারণা করা যেতে পারে যে, ক্যাপ্টেন কুক যে ধরণের ক্যাঙ্গারু দেখেছিলেন, ক্যাপ্টেন কিং হয়তো সেই একই ধরণের ক্যাঙ্গারু দেখেন নি। হয়তোবা কোন এক প্রকারের ক্যাঙ্গারুর নাম সত্যিসত্যিই ‘ক্যাঙ্গারু’ ছিল। এ সবই অনুমান মাত্র। তবে ক্যাপ্টেন কিং এর বলা ‘minnar’ বা ‘meenuah’ শব্দটা গুগু ইমিথির ভাষার Minha শব্দটার সাথে মেলে, যার অর্থ হচ্ছে ‘মাংস’ অথবা ‘উপাদেয় মাংস সরবরাহ করে, এমন প্রাণী’। হ্যাভিল্যান্ডের ধারণা ছিল যে, একটি আদিম অসভ্য জনগোষ্ঠীর ভাষা আদিম, সরল ও কাঁচা গাঁথুনীরই হবে। কিন্তু সেখানে এক ক্যাঙ্গারুর নানারকম সুক্ষ শ্রেণীবিভাগ দেখে তিনি কিছুটা বিস্মিত হন। পরে তিনি এই ভাষা নিয়ে গবেষণায় এমন কিছু পান, যা শুধু তাকে নয়, সারা দুনিয়াকেই বিস্মিত করেছিল। সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।

কিভাবে বা কি কারণে গুগু ইমিথির-ভাষীরা এনডেভার নদীর তীরবর্তী এলাকা ছেড়ে তিরিশ মাইল উত্তরে গহীন অরণ্যের দিকে চলে গিয়েছিল? সে ঘটনারও লিখিত ইতিহাস আছে – সভ্য মানুষদের সভ্য ভাষা ইংরেজীতে লিখিত কাগজে ছাপানো ইতিহাস। ক্যাপ্টেন কুকের পরের একশ বছর ইউরোপীয়ানরা আর এনডেভার নদীর এলাকায় পা বাড়ায়নি। তখনো কুক টাউনের পত্তন হয় নি। কিন্তু কি এক দৈবদূর্বিপাকে ১৮৭৩ সালে সেখানে সোনার সন্ধান পাওয়া যায়, এবং দলে দলে স্বর্ণসন্ধানীরা সেখানে আস্তানা গাড়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। রাতারাতি সেই গহীন জঙ্গলে আবোরিজিনদের আদি ভিটায় কুকটাউন জুড়ে বসে। স্বর্ণসন্ধানীদের পেছনে পেছনে আসে আরো নাগরিক ও বণিকেরা – শহরের চরিত্র যেমন হয় আর কি। আশেপাশের এলাকায় বাজারঘাট রাস্তাঘাট দোকানপাট সেলুন বেশ্যালয় পুলিশকেন্দ্র ভূমিঅফিস ধর্মপ্রচারমিশন রেস্তারা জুয়ারআসর সবই গড়ে ওঠে। সেখানে গুগু ইমিথিরভাষীদের জন্য কোন জায়গা বরাদ্দ থাকার উপায় ছিল না। তারা তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, কিম্বা বলা চলে সভ্যতা ও প্রগতির চাকার তলায় পিষ্ট হয়েছিল। তারা কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল বটে, তবে তাতে উন্মত্ত নগরবাসীরা ক্ষেপে গিয়ে এবোরিজিনদেরকে একেবারে সমূলে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এবোরিজিনদেরকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে তাদেরকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এবং তাদের বাড়িঘরগুলিকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটাকে সভ্যতার দাবীর কাছে বর্বরদের স্বাভাবিক পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করে ১৮৭৪ সালে কুকটাউন হেরাল্ড পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে,

When the savages are pitted against civilization, they must go to the wall; it is the fate of their race. Much as we may deplore the necessity for such a state of things, it is absolute necessary, in order that the onward march of civilization may not be arrested by the antagonism of the aboriginals.

(তথ্যসূত্রঃ )। এভাবে ক্যাঙ্গারু শব্দটির রহস্য ধারণ করা গুগু ইমিথির ভাষাভাষী লোকেরা আস্তে আস্তে দুরে ছড়িয়ে পড়ে, যাদের একটা বড় দলের সঙ্গে আরো একশ বছর পরে ১৯৭১ সালে দেখা হয় জন হ্যাভিল্যান্ডের।

সত্যিকার অর্থে, এত ঝড়ঝাপটার পরেও মাত্র সেদিন, এই ১৯৭১ সালে, জন হ্যাভিল্যান্ড যে গুগু ইমিথিরভাষী কাউকে খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটাকে একটা অলৌকিক ব্যাপারই বলতে হবে। ইউরোপীয়ানদের সঙ্গে সংস্পর্শ এবোরিজিনদের নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারা ধরে রাখার পক্ষে অনুকুল ছিল না। আগেই যেমন বলেছি, নগর পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে কুকটাউনে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রচারকেরাও আস্তানা গাড়ে, এবং তাদের অনেকেই সভ্যতার তরফ থেকে অসভ্য আদিবাসীদের ‘ধর্মীয় জীবন’কে সমৃদ্ধ করার অভিপ্রায়ে নানারকম কর্মকান্ড শুরু করে দেয়। গুগু ইমিথির ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করা হয়। গুগু ইমিথির ভাষায় আজকে ইংরেজীর নানা শব্দ ও ব্যাকরণ ঢুকে গেছে, শব্দতালিকায় আবহমান আদিবাসী সংস্কৃতির নানা উপাদান বিলুপ্ত হয়ে সেখানে ঢুকেছে ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত আধুনিকতা। কাজেই, সেখানে আজ ক্যাঙ্গারুর নানান প্রকারভেদের জন্য নানারকমের শব্দ নেই। এনডেভার নদীর নাম যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি ক্যাঙ্গারুর জন্মরহস্যও হয়তো হারিয়ে গিয়ে থাকবে। এমনকি বিকৃত এই গুগু ইমিথির ভাষাও আজ বিলুপ্ত; মাত্র ৫০ থেকে ১০০ জন লোক এই ভাষায় কথা বলতে পারে (তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া)। তবে ক্ষতি নেই, ক্যাঙ্গারুর জন্মবৃত্তান্ত হারিয়ে গেলেও, এই শব্দটি চিরদিন সবাইকে মনে করিয়ে দেবে, কিভাবে সভ্য ইউরোপীয়ানদের হাতে পড়ে অসভ্য আদি অস্ট্রেলিয়ানদের জীবন ও জগত হারিয়ে গিয়েছিল ঔপনিবেশিকতার সেই অন্ধকার সময়ে।

তথ্যসূত্রঃ

কুকটাউন হেরাল্ড পত্রিকার রিপোর্টঃ
“A STATE OF OPEN WARFARE”: FRONTIER CONFLICT IN THE COOKTOWN AREA” by Mr. I Hughes. http://espace.library.uq.edu.au/eserv/UQ:241804/Lectures_on_NQ_History_S2_CH3.pdf

উইকিপিডিয়াঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Guugu_Yimithirr_language

Deutscher, Guy: Through the Language Glass – Why the World Looks Different in Other Languages, Metropolitan Books, New York 2010