1507983_10205956376735548_4378355157164181633_n

অবশেষে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল তুহিন। আজ আট বছর পর বাড়ি ফিরছে সে। এবারও যাওয়া হত না, মা এতটা অসুস্থ হয়ে না পড়লে। এ-যাত্রা না গেলে হয়ত শেষ দেখাটাই হবে না। তাই অত না ভেবে অফিসে বসের সঙ্গে কাজের কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে ফেলল– ‘পরশু বাড়ি যাচ্ছি। ক’দিনের ছুটি দরকার।’ আটবছরে এই প্রথম কটা দিন একসঙ্গে ছুটি চাচ্ছে সে। আটবছর আগে এমন ছুটি নিয়েছিল বড় ভাই তার স্ত্রী-সন্তানসহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় গত হলে। একই কারণে বাগেরহাট থেকে ফিরছিল তুহিনের ছোটভাই রাতুল। রাতে চুয়াডাঙার জীবননগরে এসে ওদের বাসডাকাতি হয়। ডাকাতরা নামার সময় কি মনে করে রাতুলের বুকে চাকুটা চালিয়ে যায়। তাতে অবশ্য রাতুলের বাড়ি পৌঁছাতে কোনো সমস্যা হয় না। ঠিক সময় মতো বাড়ি ফেরে সে, তবে লাশ হয়ে। সেই যে এলো তুহিন, আর বাড়ি যাওয়ার নাম নেয়নি। আজ এত বছর পর তাই বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে অবাক হলেন বস। অফিস লিভে না করার কোনো কারণ নেই। তবুও কি যেন ভেবে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলেন। আমতা আমতা করে বললেন, ‘যান। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি।’

‘আপনি করবেন প্রার্থনা! আপনি না ওসবে বিশ্বাস করেন না?’ তুহিন সহাস্যে বলল।

‘করি। আবার করিও না।’ হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন বস দীপেন্দু ভট্টাচার্য। তারপর আবার তারা কাজের আলাপে ফিরে গেলেন।

অফিস থেকে ফেরার পথে কল্যাণপুর থেকে বাসের টিকিটটা কেটে এল তুহিন। জেআর পরিবহনের গাড়ি। বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে পাবনা-কুষ্টিয়ার মাঝখান দিয়ে মেহেরপুর পৌঁছাতে সময় লাগবে সাড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। মেহেরপুর শহর থেকে গ্রামে পৌঁছাতে আরো আধাঘণ্টা। এই তার মোটামুটি জানা। স্ত্রী রিতা তখনও কিছু জানে না। বাসায় ফিরে তুহিন যখন কোনো রকমে বলল বাড়ি যাওয়ার বিষয়টি, রিতা মাথায় বাজ পড়ার মতো করে আঁৎকে উঠল।

‘না। না। এতবড় সিদ্ধান্ত তুমি এভাবে একা একা নিতে পারো না।’ বলে রিতা গোঁ ধরে বসে থাকলো।

‘জানি তো। এজন্যেই তো তোমাকে বলা।’ বোঝানোর জন্যে নরম স্বরে বলল তুহিন।

‘টিকিট কেটে এসে বলছ বাড়ি যাচ্ছি। এই তোমার সিদ্ধান্ত নেয়ার নমুনা?’

‘আমি কি আর সখ করে যাচ্ছি? বড় বোন ফোন করেছিল। মায়ের অবস্থা ভীষণ খারাপ। মা ছাড়া আমাদের আর কে আছে বলো?’ তুহিনের এই কথার পর আর কোনো কথা থাকে না। মানতে না পারলেও বুঝতে পেরে চুপ করে যায় রিতা। মাঝে একদিন কেনাকাটা, পরদিন রওনা। কেনাকাটার জন্যে এ দিনটাও ছুটির খাতায় যোগ করে নিয়েছে তুহিন। এতদিন বাদ বাড়ি যাচ্ছে, তাই শপিংটা বেশ গুরুত্বসহকারে সারতে চায় সে।

খ.

ওদিকে মোবাইলে ছেলের আসার সংবাদ ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাকা করছেন মা। ছয় ছেলের এই এক ছেলেই টিকে আছে। আর আছে এক মেয়ে। তাও স্বামীহারা। মা আর মেয়ে গাঁয়ের বাড়িতে থাকে। জমি জায়গা যা আছে তাতে ভাত-কাপড়ে খারাপ নেই তারা। কাল বাড়ি আসছে তুহিন। মা মেয়ে গায়ের প্রতিটা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হিষ্টপুষ্ট দেশি মোরগ, স্বাদের কান্তাকচুর ডাটা, কচি লাউ, ঘন দুধ, খাঁটি ঘি– এসব একে একে জোগাড় করেছে। একদিকে তুহিন ঢাকার শপিংমল থেকে শপিংমল ঘুরে ঘুরে মা আর বোনের জন্য কেনাকাটা সারছে, অন্যদিকে মা আর মেয়ে ঘরে ঘরে হন্যি হয়ে খুঁজছে তুহিনের এক সময়ের পছন্দ যত খাবার। তুহিন যে এখন লাউ-কুমড়োর বড়ির ঘণ্টের স্বাদ ভুলে গেছে, এলার্জি বাড়ার কারণে তার যে হাঁসের মাংস খাওয়া বারন, অকারণেই বেগুণ ভর্তা আর ভাল লাগে না তার। এসব মা আর বোনের এখন অজানা। এমন সাত সতের জোগাড়ে ব্যস্ত থাকলেও মায়ের বুকে গোপন ভয়টা থেকেই গেছে। একবার জায়নামাজে বসলে আর ওঠার নাম নিচ্ছেন না। সৃষ্টিকর্তার কাছে এখন তার শুধু একটিই বায়না, ছেলেটি যেন সহী সালামলে বাড়ি ফেরে। এজন্যে তিনি বাড়ির আদরের খাসিটা মানতও করে বসেছেন। আসেপাশের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে তুহিনের বাড়ি আসার খবর পৌঁছে দেয়ার ফাঁকে বার বার করে দোয়াও করতে বলে আসলেন। মসজিদের ইমামকে রাতে খেতে ডেকেছেন। উদ্দেশ্যে নামাজ শেষে মুসল্লিদের সঙ্গে করে যেন তুহিনের জন্য দোয়াদরুদ করেন তিনি। ইমামকে মসজিদের জন্য হাতের রুপোর বালাটাও দিয়ে দিলেন মা। ছেলেটা বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তার আর ঘুম নেই। ঘুম নেই তুহিনের স্ত্রীরও। সে কিছু বুঝতে না দিলেও, তুহিন যখন কেনাকাটায় বাইরে ছিল, তখন পাঁচজন ফকিরকে খাইয়ে দিয়েছে। বাড়ির সামনেই হায়দার বাবার ঔরশ। অন্য সময় ফাজিল বাবা বলে মজা করলেও আজ ওখানে গিয়ে কিছু সদকা করে এসেছে। কাউকে কিছু বলেনি। শুধু মনে মনে যাকে বলার তাকেই খালি বলেছে।

গ.

দুপুর দুটো। তুহিন বাসে উঠে বসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। সবাই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে অনর্গল ফোনে কথা বলছে। তুহিনও এরই ভেতর মা ও বৌয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা চালাচালি করেছে। প্রতি দশমিনিট পরপর ফোন দিয়ে যাত্রাপথের আপডেট জানানোর জন্যে উভয়পক্ষের আর্জি। তুহিন খালি হেসেছে। বুকটা যে তার একেবারে ধুকধুক করছে না, তা কিন্তু নয়। তবুও সে মা আর বৌয়ের আচরণ একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে বলে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আবারও ফোন। তুহিন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। না, এবার আর তার না। পাশে বসা বয়স্ক লোকটার মোবাইল বাজছে। তিনি ফোনটা না ধরে ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি’ বলতে বলতে ঘুমানোর ভান করে চোখদুটো বন্ধ করলেন।

ঘ.

তরু তরু করে মায়ের হাঁক। রোয়াকে মাদুর পেতে শুয়ে আছেন মা। খানিক পরপরই এমন হাঁক আসছে। সামান্য কথা, কিন্তু মায়ের তোড়জোড় দেখে মনে হচ্ছে হুলস্থুল বিষয়। তরু রয়েসয়ে আসে।

‘বলো।’ নিজের উপস্থীতি জানান দেয় মাকে।

‘গোলার ওপাশে না কালো বেড়ালটাকে আবার দেখলাম! আমার কিছু ভাল ঠেকছি না, মা। একটু আল্লার কালাম পড়ি দেয়ালটাতে ফুঁ দি’ আয় না, মা?’

‘কালো বেড়াল কোথা থেকে আসবে? তোমার দেখার ভুল মা। খারাপ চিন্তা মাথা থেকে নামিয়ে ফেল, দেখ ওসব কালো বেড়াল এমনিতেই সরে যাবে।’

‘তবুও যা না মা। দোয়া কালাম পড়ি একটু ওদিকটা ঘুরি আয়। আমি মনে হয় আর বাঁচবু না! ছেলির মুখটা শেষবারের মতোন দেখা হলু না। আমার কিছু হলি খোকা না ফেরা পর্যন্ত যেন আমার মাটি না হয়।’

‘কি যা-তা বকছ মা। সারারাত ঘুমাওনি। এখন একটু খান্ত দাও পায়ে পড়ি। দেখো, তুন এলো বলে। আমি যাচ্ছি তোমার বাড়ি চক্কর দিতে। কালো বেড়াল পেলে কান ধরে নিয়ে আসবো তোমার সামনে।’ বলে তারামন গোলাঘরের ওপাশে চলে যায়।

ঙ.

মির্জাপুরে ঢুকতেই গাড়ি থামাল পুলিশ। কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হবে। সামনে বাস-ট্রাক মুখোমুখি বেঁধেছিল। একাকার কা- ঘটে গেছে। রাস্তার রক্ত আর দেহগুলো না সরানো পর্যন্ত গাড়ি চলবে না। প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা। তুহিন ঘটনাটা চেপে গেল মা আর বৌয়ের কাছে। বলল, জ্যামে আটকা পড়েছে। গাড়ি আবার চলা শুরু করল। যমুনা সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জে এসে হোটেল বিরতি। দশ মিনিট থামবে। তুহিন নেমে বিড়িটা কেবল ধরাবে, মোবাইল বেজে উঠল তাইরে নাইরে করে। মায়ের ফোন। ফোনে বোনের উতলা কণ্ঠ।

‘তুই ঠিক আছিস তুন?’ তুহিনের নামের মাঝের হি বর্ণমালা সেই কবেই সে হটিয়ে দিয়েছে।

‘হ্যাঁ, আছি তো!’ উত্তর করে তুহিন। ‘কেন কিছু হবার কথা ছিল নাকি?’ মজা করে পাল্টা প্রশ্নও করে সে।

‘না, মানে টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখাচ্ছে, সদ্যপ্রাপ্ত: যমুনার ওপাশে বাসের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। তাই তোকে ফোন দিলাম।’

‘বুঝেছি। টেলিভিশন খাটিয়ে বসে আছিস, না? তুই তো বুবু খবর শোনার পাবলিক না! যাকগে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা খানিক আগেই যমুনা ছেড়ে চলে এসেছি।’ বোনের কথার উত্তর করে তুহিন।

‘আলহামদুলিল্লাহ। সাবধানে আসিস। আর ফোন করিস।’

‘আচ্ছা করবো, কিন্তু আমাকে করার সুযোগ দিলেই তো!’

বোনটা হাসতে হাসতে ‘রাখি’ বলে ফোনটা রেখে দেয়। মোটামুটি পথে আর কোনো বিপদ ছাড়াই ভালভাবেই কুষ্টিয়া পৌঁছে যায় বাস। কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুরও চলে আসে যথারীতি। মাঝখানে দুইদিকে বহুবার কথা হয়েছে। মোবাইলের ব্যাটারি ডায়িং। সিগনাল দিচ্ছে ঘনঘন। মেহেরপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস থেকে নেমে একটা অটো ঠিক করে তাতে চেপে বসে বৌকে ঝটপট এসএমএস করে দিলো তুহিন: রিস হোম সেফ। চার্য শেষ। ফোন অফ পেলে চিন্তা করো না। বিলকুল আউট অব ড্যাঞ্জার নাও।’ মেসেজটা সেন্ড করেই মাকে ফোন। জানিয়ে দিল অটোতে মেহেরপুর থেকে রওনা হওয়ার সংবাদ। আরও দু একটি কথা হয়ত হত, ফোনটি তার আগেই কোমায় চলে গেল।

বাড়িতে মিষ্টি বন্টন শুরু হয়ে গেছে। মেহেরপুর আসা আর বাড়ি আসার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। মাঝে আর মাত্র কটা মিনিট সময় লাগবে। মা আর বোন মিলে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। সঙ্গে যারা হাত লাগাতে এসেছিল তারাও তাড়াহুড়োই সবকিছুতেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। ছেলে বাড়ি চলে এসেছে। অসুস্থ মা এখন পরিপূর্ণ সুস্থ্য যেন! মানত করা ছাগলটাকে মসজিদে পাঠিয়ে দিতে বললেন মেয়েকে। আয়োজন যখন চুড়ান্ত, অপেক্ষার প্রহর যখন টানটান, এই ছিঁড়লো বলে, তখনই এল সংবাদটা। বাড়ির পুস্করিণীর ওপরেই নসিমনের সঙ্গে ধাক্তা লেগেছে তুহিনের অটোর। রাস্তার যেদিকটাতে গভীর খাদ, সেদিকেই ছিটকে পড়েছে অটোখানা।

মা খালি প্রলাপ বকছেন। ‘রাস্তায় ওর বাপেরে খাইছে। পাঁচ ভাই আর বোন-জামাইরে খাইছে। বাড়ির সব ব্যাটারে খাইছে। তারা সব চলি গিছে। রাস্তা আর আমার তেমন কিছুই করতি পারবি না। যখন গাড়ি উল্টি যাবে, ব্রিজ ভেঙি পড়বি, অন্ধকারে বাস থামাবে একদল গুণ্ডালোক, তখন আর আমার ভয় পাবার কিছু থাকবি না। আমার আর জায়নামাজে বসি কারো জন্যি প্রার্থনা করার প্রয়োজন পড়বি না। আমার আর হারানুর কিছু থাকলু না। আমি আর কাঁদুম না। আজ আমি সুখি মানুষ! মেলা সুখি!’

উৎসর্গ: গত ২০ অক্টোবর নাটোর সড়কে মুখোমুখি দুটি বাসের সংঘর্ষে নিহত ছয় ভাইয়ের মাকে।