গত বছরের জুন মাসে হঠাৎ করেই আর্জেন্টিনা এবং পেরু ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সে সময় এক ফাঁকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসের অদূরে সান ইসিদ্রোতে ‘ভিলা ওকাম্পো’ দর্শনের এক মনোরম অভিজ্ঞতা হয় আমার। এ বাড়িটি এবং তার অদূরে মিরালরিও নামের আরেকটি বাড়ির সাথে রবীন্দ্রনাথের কিছু অমলিন স্মৃতি জড়িয়ে আছে, অনেকেই হয়তো জানেন। ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে আমি মুক্তমনায় একটি লেখা লিখেছিলাম – ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’  শিরোনামে। আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া নতুন কিছু তথ্যের আলোকে  নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর সম্পর্ককে বুঝবার প্রয়াস ছিল সে লেখায়।  আরেকটি ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছিল বিডিনিউজেও[1]।  আমি ভেবেছিলাম এ ধরণের একঘেয়ে নিরস লেখা পড়তে পড়তে হয়তো পাঠকদের ক্লান্তি চলে আসবে একটা সময়। পাঠকদের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে মনে হয় সেরকম কিছু হয়নি। বরং, যে কোন কারণেই হোক, লেখাটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। অনেক পাঠক লেখাটিকে পূর্ণাঙ্গ বইয়ে রূপ দিতে অনুরোধ করেন।

তবে বই লিখতে বললেই চট করে লেখা যায় না। আর তাছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তার কাজের নানা দিক নিয়ে, এমনকি তাঁর জীবনের নানা অলিগলি নিয়ে ইতোমধ্যেই অজস্র গ্রন্থ লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কাজেই নতুন বইয়ে চর্বিতচর্বণের একটা ভয়তো আছেই। তাই ঠিক করেছি বই যদি হয়ই তবে সেটা স্রেফ রবীন্দ্রনাথের উপর না হয়ে ওকাম্পোর কিছু অনালোকিত দিক, এবং রবীন্দ্রজীবনে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে, কিংবা এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব নিয়ে কিছু একটা হলেও হতে পারে ভবিষ্যতে। তবে বই টই না হোক, এ নিয়ে নতুন কিছু তথ্য যদি পাওয়া যায় – যেটা অনেকেরই অজানা, তা পাঠকদের সাথে বিনিময় করতে তো কোন বাধা নেই। বাধা নেই এ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতেও। সে থেকেই শুরু হল বাড়তি কিছু অনুসন্ধান।  আমার এ লেখাটি আমার সেই অনুসন্ধানেরই একটা সংক্ষিপ্ত রূপ বলা যায়।

আমার আগ্রহ ছিল জানার, রবীন্দ্র-জীবনে ওকাম্পোর প্রভাব কি কেবল ‘বিদেশী ফুল’, ‘অতিথি’ কিংবা ‘আশঙ্কা’র মত কবিতা সৃজনে সীমাবদ্ধ ছিল? সীমাবদ্ধ ছিল কেবল ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গের মাঝেই? না, তা নয় মোটেই। রবীন্দ্রনাথের উপর ওকাম্পোর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ বয়সে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠা।  রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি আঁকার শখকে উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর ভিত্তিটি গড়ে উঠেছিল ওকাম্পোর বাড়িতেই, সেই ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ তৈরির সময় [2]।  ওকাম্পো লিখেছেন[3]

‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন-তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা … এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’

tagore_purabi_katakuti

চিত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র কাটাকুটি:  এই কাটাকুটি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল।

তবে এটি উল্লেখ্য যে, পূরবীর পাণ্ডুলিপিতে এ ধরণের বিচিত্র কাটাকুটি হঠাৎ করেই তিনি শুরু করেননি। আর্জেন্টিনা আসার আগেই ১৯২৩ সালে রক্তকরবীর পাণ্ডুলিপির খসড়ার পাতায় তাঁর কাটাকুটি থেকে ছবি তৈরির উদাহরণ আছে।  এমনকি তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছেন, তবে হয়তো লাগাতার ভাবে নয়। ১৮৭৮-৮২ এই সময়কালে রবীন্দ্রনাথ ‘মালতী’ নামে একটি পুঁথির পাতায় ছবি আঁকতেন। ১৮৮৯ সালের দিকে তিনি একটি পকেটবুক রাখতেন, তাতে যখন যা মনে হত, তাই আঁকতেন[4]।  আসলে রবীন্দ্রনাথ পুরাদস্তুর ছবি আঁকা শুরু করেন ১৯২৮ সাল থেকে[5]। আজ আমরা ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’ বলতে যা বুঝি তা হল সেই সময় থেকে পরবর্তী দশ বারো বছরে আঁকা তাঁর আড়াই হাজারের ওপর ছবি। তবে ওকাম্পোর ব্যাপারে এটুকু অন্তত বলা যায় – শেষ বয়সে সাহিত্য ছেড়ে চিত্রকলায় মনোনিবেশের পেছনে রবীন্দ্রনাথের আর্জেন্টিনা উপাখ্যান এবং ওকাম্পোর উৎসাহের ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে খুব বড়  ভূমিকা রেখেছে।

আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর বাসায় বসে কবিতা লিখতে গিয়ে কবিগুরু যে সমস্ত বিচিত্র কাটাকুটি করতেন, তা দেখে মাঝে সাঝে ওকাম্পো ঠাট্টা করে বলে বসতেন[6] – ‘সাবধান, তোমার কবিতায় যত ভুলভ্রান্তি থাকবে, তুমি তো তত বেশিই ছবি এঁকে মজা পাবে। শেষে দেখবে যে, নিজে ইচ্ছে করেই বাজে কবিতা লিখছো’।

ওকাম্পো আরো লিখেছেন[7]  –

‘… তাঁর এই আঁকিবুঁকিতে তো আমি মেতে গেলাম। ব্যাপারটায় ওঁকে উশকে দিলাম।  সান ইসিদ্রোর ছ’ বছর পর প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’।

তবে ওকাম্পো যত সহজে বলেছেন ‘প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’ – ব্যাপারটা আসলে এতো সহজ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মাথায় তাঁর ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর সুপ্ত একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল বটে, আর সেজন্য  ১৯৩০ সালে প্যারিসে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর হাতে আঁকা চারশো ছবি; কিন্তু সেখানে গিয়ে বুঝলেন, সেখানে ছবির প্রদর্শনী করা অত সহজ নয়।  ভাল গ্যালারি এমনিতেই চট করে পাওয়া যায় না, আর তার মধ্যে আবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনাও ছিল কম।

কিন্তু এবারেও উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সেই ‘সেনিওরা ওকাম্পো’। সৌভাগ্যবশত সেই সময়টা ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। তিনি আসলে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর জীবনের ‘নতুন পুরুষ’ পিয়া দ্রিউ রা হোসেলের সাথে। ওকাম্পো প্যারিসে আছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেছিলেন । হয়তো ভেবেছিলেন এতো মানুষের সাথে সংযোগ রাখা ওকাম্পো কোনভাবে সাহায্য করতে পারবেন।

খবর পেয়েই চলে এলেন ওকাম্পো। সময়টা ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাস। রবিঠাকুরের সাথে তাঁর ২য় সাক্ষাৎ এটি। এসেই খুব কম সময়ের মধ্যে পিগ্যাল গ্যালারিতে রবিঠাকুরের ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। এমনকি তাঁর বন্ধু লেখিকা  কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্রসূচীর একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো[8]।  এত দ্রুত এবং সুচারুভাবে তিনি কাজগুলো সমাধান করে ফেললেন যে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল।  ভূমিকায় নোয়াই লিখেছিলেন[9]

‘… টেগোরের মতো একজন মেধাবী স্বপ্নদ্রষ্টা কীভাবে যে তাঁর আশ্চর্য সব সৃষ্টির কাছে গিয়ে পৌঁছান! এই সব সৃষ্টি আমাদের দৃষ্টিকে নন্দিত করে, সেই সব দেশে আমাদের চক্ষুকে নিয়ে চলে যায়, যেখানে যা সম্ভাব্য তা বাস্তবের চেয়েও অধিক সত্য!  শ্বেতকপোতের মতো রঙের অসামান্য সুন্দর হাত দিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেন, আর এক অনির্বচনীয় সুরার নেশায় আবিষ্ট হয়ে তিনি তার পাণ্ডুলিপির কিনারায় নিজেকে ছেড়ে দেন – সূক্ষ্ম, জটিল ও বুদ্ধিনির্ভর শিল্পসৃষ্টির আওতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তুলে নেন কল্পনার অনিয়ন্ত্রিত শক্তির কাছে।  প্রথমে তিনি স্কেচ করতেন মাত্র; তার থেকে ক্রমশ তাঁর হাতে  অজ্ঞাত সব দেশের অদ্ভুত সব সম্পদ এসে পৌঁছুতে শুরু করল। তিনি যেন মহাজাগতিক শিক্ষকের দ্বারা নির্দেশপ্রাপ্ত বাধ্য ছাত্রের মতো সেসব নির্দেশ লিপিবদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন। তিনি পেয়েছিলেন অশ্রুর উপহার – কান্নার উপহার, যে ক্রন্দনের কারণ তিনি জানতেন না; ক্রমশ তাঁর মুখের উপর শিশির জমতে শুরু করল, তৈরি হতে আরম্ভ করল সূক্ষ্ম তরল নকশার কাজ – দেবদূতেরা যেন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

পরীরা যেভাবে আমাদের তন্দ্রায় প্রবেশ করে – অস্পষ্ট স্বপ্নের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে, নিজেকে দেখাতে দেখাতেই নিজের সংজ্ঞা নির্মাণ করে তোলে, টেগরের আঁকা ছবিও আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে সেইভাবে; এই মহান সৃষ্টিকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় – কারণ এই মহত্ত্ব – তুচ্ছ ও বিশাল – উভয়ের মধ্য দিয়ে সমভাবে প্রকাশিত হয়েছে …’।

ওকাম্পো যে কী অসাধারণ দ্রুততায় এবং দক্ষতায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার সাক্ষ্য সমসাময়িক অনেকের লেখাতেই ছড়িয়ে আছে। যেমন, রথীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ তে উল্লেখ করেছেন[10]

‘১৯৩০ সালে বাবা আবার যখন প্যারিস যান, সঙ্গে ছিল তাঁর আঁকা কিছু ছবি। ছবি দেখে কয়েকজন ফরাসি শিল্পী বাবাকে একটা চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, চট করে প্যারিস শহরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা অসম্ভব বললেই হয়। মোটামুটি একটা পছন্দসই হল পেতে হলে বছর খানেক আগে থেকে চেষ্টাচরিত্র করতে হয়। বাবা সেনিওরা ওকাম্পোকে তারযোগে অনুরোধ জানালেন তিনি এসে যেন বাবার সহায় হন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হল বিনা আয়াসেই প্রদর্শনীর সব রকম ব্যবস্থা তাঁর সাহায্যে হয়ে গেল’।

এ ধরণের অনেক সাক্ষ্যই পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের সেই সময়কার নতুন সেক্রেটারি আরিয়ম উইলিয়ামস কিংবা রথীন্দ্রনাথকে লেখা আঁদ্রে কার্পেলেসের চিঠিতে। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রতিমা দেবীকে ২ মে, ১৯৩০ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন,

 ‘ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, তাহলে ছবি ভালই হোক আর মন্দই হোক, কারো চোখে পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনিই ঘটে – অত্যন্ত ভুল। এর এত কাঠখড় আছে যে, সে আমাদের অসাধ্য- আঁন্দ্রের পক্ষেও। খরচ কম হয়নি – তিন চারশো পাউন্ড হবে। ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্চে। এখানকার সমস্ত বড় বড় গুণীজনদের ও জানে – ডাক দিলেই তারা আসে। কঁতেস দ্য নোয়াইও উৎসাহের সঙ্গে লেগেচে – এমনি করে দেখতে দেখতে চারিদিক সরগরম করে তুলেচে। আজ বিকেলে দ্বারোদঘাটন হবে – তারপরে কি হয় সেটাই দ্রষ্টব্য…’

পরে যেটা হল, সেটা সামান্য নয়। চিত্রকর আঁদ্রে কার্পেলেস কিংবা পল ভেলেরি এবং আঁদ্রে জিদের মতোন কলা-বিশেষজ্ঞরা ছবিগুলোকে চিহ্নিত করলেন ‘আগামী যুগের আর্ট’ হিসেবে[11], দেশে অবনীন্দ্রনাথ কিংবা শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর মত চিত্রকররা সেগুলোকে ‘অনন্যসাধারণ’ বলে রায় দিলেন। শুরু হল রবীন্দ্রচিত্রকলা নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা এবং আলোচনা। এ নিয়ে দেশের বাইরে রজার ফ্রাই, স্টেলা ক্রামরিশ, আর্চার থেকে শুরু করে এণ্ড্রু রবিনসন যেমন মূল্যবান অভিমত দিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশে এবং ভারতে আনন্দকুমারস্বামী, মুলকরাজ আনন্দ, জয়া আপ্পাস্বামী, পৃথ্বীস নিয়োগী, অশোক মিত্র, রতন পারিমু, গীতা কাপুর, শোভন সোম, প্রণবরঞ্জন রায়, দেবরাজ গোস্বামী, কেতকী কুশারী ডাইসন, সুশোভন অধিকারী, ও.সি গাঙ্গুলি, শুভো ঠাকুর, বিষ্ণু দে, কৃষ্ণ কৃপালনি, সত্যজিৎ রায়, দিনকর কৌশিক, কে.জি. সুব্রামনিয়াম, অশোকমিত্র, শিবনারায়ণ রায়, কানাই সামন্ত, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বুলবন ওসমান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং আনিসুজ্জামান প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সমালোচনা যে হয়নি তা নয়। প্যারিসে প্রথম প্রদার্শনীর সময় রবীন্দ্রনাথের কাছের বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই মুখটিপে হেসেছিলেন[12]। তা সত্ত্বেও প্রদর্শনী থেমে থাকেনি। ১৯৩০ সালের মে মাসে প্যারিসের পিগ্যালে প্রদর্শনীর পর রবিঠাকুরের চিত্র-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হল জুন মাসে বার্মিংহ্যাম ও ইন্ডিয়া সোসাইটি, লণ্ডনে। জুলাই মাসে বার্লিন, ড্রেসডেন, মিউনিখে। আগস্ট মাসে কবিগুরুর ছবি প্রদর্শনী হয় কোপেনহেগেন ও জেনেভায়। সেপ্টেম্বরে মস্কোয়, অক্টোবর মাসে আমেরিকার বোস্টনে এবং ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায়।  জার্মানিতে সফল চিত্রপ্রদর্শনীর পর কবিগুরু প্রায় শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে সে সময়কার আরেক ‘গুণমুগ্ধা’ রানী মহলানবিশকে (ভারতের বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী যিনি নির্মলকুমারী নামে সমধিক পরিচিত) লিখলেন[13],

‘আজ আমার জার্মানির পালা সাঙ্গ হল, কাল যাব জেনিভায়। এ পত্র পাবার অনেক আগেই জানতে পেরেছ যে, জার্মানিতে আমার ছবির আদর যথেষ্ট হয়েছে। বার্লিন ন্যাশনাল গ্যালারি থেকে আমার পাঁচখানা ছবি নিয়েছে। এই খবরটার দৌড় কতকটা আশা করি তোমরা বোঝো। ইন্দ্রদেব যদি হঠাৎ তাঁর উচ্চৈঃশ্রবাঃ ঘোড়া পাঠিয়ে দিতেন আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য তা হলে আমার নিজের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতুম’।

লেখার এই জায়গায় এসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা সেরে নেয়া যাক।  তাঁর চিত্রকর্মের সংখ্যা আড়াই থেকে তিনহাজার বলে ধরা হয়।  এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো হয়নি, পুরো অ্যালবামও প্রকাশিত হয়নি। বুলবন ওসমান রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের উপর আলোচনা করতে গিয়ে পর্বগুলোকে সাজিয়েছেন  এভাবে[14]:

ক. ভূদৃশ্য

খ. প্রকাশবাদী চিত্র – বিভিন্ন কিম্ভুতকিমাকার সব জান্তব চিত্র

গ. পরাবাস্তববাদী চিত্রকর্ম – বিশেষ করে প্রতিকৃতি

ঘ. আত্মপ্রতিকৃতি

আমি এখানে প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে না বলে রবীন্দ্রচিত্রকলা সম্বন্ধে সার্বিক কিছু অভিমত দিব আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ধারণা চালু আছে যে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মগুলো খুবই মৌলিক, পৃথিবীর কোন শিল্পকর্মের সাথেই সেগুলো মেলেনা। সে অর্থে তিনি শুরু থেকেই অনন্য একটি ধারা চালু করেছেন, যা আগে চিত্রকরদের ট্রেণ্ড হিসেবে ছিল না। শুরুটা তিনি করেছিলেন মনের খেয়ালে – শিশুরা যেমন মনের আনন্দে যা মনে আসে তাই ড্রইং খাতায় আঁকে, রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্মগুলোর শুরুটাও অনেকটা তেমনি। একান্তই শিশুসুলভ।  অবশ্য এ ধারণা সঞ্চারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও অবদান আছে।  যেমন রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন[15], “আমি কোন বিষয় ভেবে আঁকিনে – দৈবক্রমে একটা অজ্ঞাতকুলশীল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে।” এখন ‘কবির বচন’ যেহেতু, অতএব এটিকে ‘বেদবাক্য’ হিসেবে নিয়ে অন্য সবকিছু খণ্ডন করার একটা প্রবণতা বেশ কিছুদিন ধরেই চালু ছিল। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রসঙ্গে বলতে গেলেই বিশেষজ্ঞরা ‘childlike’ এবং ‘naive’ শব্দদুটি ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথের ছবি নয়, তার ছেলেমানুষির দিকটিই যে গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকের উক্তিতে উঠে এসেছে। কুমারস্বামী বলেছেন, ‘childlike, but not childish’। অর্থাৎ ‘শিশুদের মতো, কিন্তু শিশুসুলভ নয়’।  শব্দদুটোর ব্যঞ্জনা নিয়ে দার্শনিকভাবে হয়তো তর্ক করা যায়, কিন্তু চিত্রকর দেবরাজ গোস্বামী যেমনটি বলেছেন, ‘কথাটি শুনতে ভালই, কিন্তু সারাৎসার বিশেষ কিছু নেই’। ও.সি গাঙ্গুলি আবার বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্তবয়স্ক কবিমন যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বা বিশ্রাম নেয়, তখন তাঁর শিশুমন জেগে উঠে ও খেলা করে’।  তার চেয়েও বড় কথা -কুমারস্বামী থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত অনেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে কোন প্রভাব খুঁজে পাননি।  তারা অভিমত দিয়েছেন তার ছবিগুলো ‘সম্পূর্ণ অরিজিন্যাল’।

সম্প্রতি অবশ্য এই ‘অরিজিন্যালিটি’র ধারণা বৌদ্ধিক সমাজে বেশ ভালভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শুরুটা হয়েছিলো মূলত গবেষক কেতকী কুশারী ডাইসন এবং শিল্পী সুশোভন অধিকারীর যুগ্ম প্রয়াসে বেরুনো ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’-গ্রন্থটি বেরুনোর পর থেকেই[16]।  তারা দেখিয়েছেন রবীন্দ্র-চিত্রকলাকে সারা পৃথিবীব্যাপী তদানীন্তন চিত্রকর্মের ধারার বলয়ের বাইরে বলে যে ভাবা হয় তা ঠিক নয়। বইটি থেকে কিছু উদাহরণ হাজির করি। যেমন, ‘রঠ’ নামক তার স্বরচিত মনোগ্রামটির কথা বলা যায়। এতে যে উত্তর আমেরিকার ‘haida’ শিল্পকলার সরাসরি প্রভাব রয়েছে তা দুটো ছবি পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছেন কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী।

haida_ratha_tagore_kataki

চিত্র:বাম পাশের চিত্রটি দক্ষিণ আমেরিকার ‘haida’ শিল্পকলা, এবং ডান পাশেরটি রবীন্দ্রনাথের ডিজাইন করা বিখ্যাত  ‘রঠ’ মনোগ্রাম।  কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী তাদের ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে  এধরনের বহু সাযুজ্যের উল্লেখ করেছেন।

কেবল রঠ মনোগ্রাম নয়, রবীন্দ্রনাথের আঁকা সে সময়কার বেশ কিছু ছবিতে আফ্রিকান, মালাঙ্গান, চৈনিক (ব্রোঞ্জ), পেরুভিয়ান, হাইদা এবং তিলিঙ্গিত আর্টওয়ার্কের প্রভাব উজ্জ্বলভাবে লক্ষণীয়। যেমন নীচে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ডানপাশের ছবিটির (রবীন্দ্রভবন সংগ্রহ নং ২১৫৫)  সাথে বাঁ-পাশের নিউ আয়ারল্যান্ডের মালাঙ্গান আর্টওয়ার্কের তুলনা করলেই দেখা যায় এদের মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে।

malanggan_ketaki

চিত্র:বাম পাশের স্থাপত্যকর্মটি  নিউ আয়ারল্যাণ্ডের মালাঙ্গান আর্টওয়ার্ক, এবং ডানপাশেরটি রবীন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রকর্ম (রবীন্দ্রভবন সংগ্রহ নং ২১৫৫)। এদুটোর মিল লক্ষণীয় ।

 

কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারীর বইটি নিয়ে অনুষ্টুপের একটি সংখ্যায় আলোচনা করেছেন চিত্রকর দেবরাজ গোস্বামী, অবশ্যই নিজস্ব অভিমত সহযোগে[17]।  প্রবন্ধে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা অনেকেরই ভাবনার খোরাক যোগাবে  –

‘আদিম শিল্পীদের কাজ বাদ দিয়ে আর কোনো শিল্পকেই ঠিক পুরোপুরি অরিজ্যিনাল বলা চলে না। বিশেষ করে আধুনিক যুগে এটা হওয়া সম্ভব ও নয়। সব শিল্পীকেই তাঁদের পূর্ববর্তীদের কাজ থেকে কিছু না কিছু গ্রহণ করতেই হয়, আর এর মধ্যে দোষেরও কিছু নেই। শিল্পকলায় অরিজিন্যালিটির মাপকাঠি হল, শিল্পী শেষ পর্যন্ত এইসব উপাদান ব্যবহার করেও পূর্ববর্তী শিল্পকলাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন কিনা। এমন কথা কল্পনা করাও কঠিন যে, বিংশ শতাব্দীতে বসে একজন চিত্রকর (বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ) এমন একটা কিছু সৃষ্টি করেছেন যার সঙ্গে পৃথিবীর কোন শিল্পকলার কোথাও মিল নেই। যা সম্পূর্ণরূপে অরিজিন্যাল, একমেবাদ্বিতীয়ম্‌। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এটা হয়নি। তিনি তাঁর দেখার অভিজ্ঞতা থেকে প্রচুর নিয়েছেন। নিজের মতো করেই নিয়েছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে নিজের কাজের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করেছেন’।

প্রবন্ধকারের অভিমত থেকে জানা যায়, ১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবার ইউরোপে যান, তখন সেখানকার শিল্পকলার মূলধারা ছিল ইম্প্রেশনিজম (১৮৬৯-১৮৯০)। এরপর এলো পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম (১৮৮৫-১৮৯০), জার্মান এক্সপ্রেশনিজম (১৯০০),  কিউবিজম (১৯০৮-১৯১৪), ডাডাইজম (১৯১৬-১৯২৪), ফিউচ্যারিজম (১৯০৯-১৯১৫), কন্সট্রাকটিভিজম (১৯১৭-১৯২১),  বাওহাউস (১৯১৯-১৯৩৩), স্যুরিয়ালিজম (১৯২০) হয়ে ১৯২৮ এ রাশিয়ায় সোশ্যাল রিয়ালিজম পর্যন্ত চিত্রশিল্পের ধারাগুলো স্বচক্ষেই দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুর পরিবারে প্রথম থেকেই শিল্প চর্চার পরিবেশ ছিল। ৬ নং জোড়াসাঁকোর ‘দক্ষিণের বারান্দায়’ শিল্প চর্চায় মগ্ন গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশবিদেশ থেকে বিখ্যাত শিল্পীরা মোলাকাত করতে আসতেন। এসেছিলেন ওকাকুরা, রদেনস্টাইন সহ অনেকেই। আর রবীন্দ্রনাথ নিজের বাড়িতে এবং শান্তিনিকেতনে বসেই অবলোকন করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, অসিত হালদার, নন্দলাল বসু এবং রামকিঙ্কর বেইজ প্রমুখের কাজ। কাজেই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মগুলো নেহাতই ‘শেষ বয়সের ছেলেমানুষি’ (এটা রবীন্দ্রনাথও হয়তো কখনো সখনো হাস্যরসে বলতেন, কিংবা কেউ বললে প্রশ্রয় দিতেন), এই ধারণা খুব ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও মোটের উপর সঠিক নয় বলেই মনে হয়। যদিও রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর হবার ব্যাপারটা অনেকটাই তিনতোরেত্তো, ভ্যান গঘ, আঁরি রুশো প্রমুখের মতো স্বপ্রশিক্ষিত, কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম ‘well-informed’ শিল্পী, তার কাজের উপর বিবিধ সংস্কৃতির শিল্পকর্মের প্রভাব  প্রথম থেকেই ছিল।

রবীন্দ্রনাথের ছবি প্রসঙ্গে দ্বিতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি এখানে আলোচনায় আনবো।  তার চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে এমন আরেকটি ধারণাও প্রচলিত যে, রবীন্দ্রনাথ তার বিচিত্র কাটাকুটির মাধ্যমে বিভিন্ন কিম্ভুতকিমাকার সব জান্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলতেন, তার সাথে মূলতঃ তাঁর সাহিত্যকর্মের কোন মিল নেই।  অর্থাৎ যে কবিতাটির লাইন কাটাকুটি করে শেষপর্যন্ত একটি মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ, তার সাথে মূল কবিতাটি মেলালে কোন যোগসূত্র পাওয়া যায় না। তাই বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন দুটো একেবারেই আলাদা ধারা, আলাদা কাজ।

কিন্তু সত্যই কি একেবারে আলাদা? ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রাজনীতি সচেতন এবং সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ একজন মানুষ। তার পোর্ট্রেটে যে নির্মম কাঠিন্য ফুটে উঠছে, যে অলংকারহীন, নকশাহীন চিত্রলতাবিহীন জান্তব মুখাবয়বের সন্ধান আমরা পেয়েছি তার সাথে সত্যই কি চারপাশের কোন যোগসূত্র ছিল না? এটা মেনে নেয়া কষ্টকরই বটে। রবীন্দ্রনাথের  সমসাময়িক সময়গুলোতে পৃথিবী ছিল উত্তাল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লব, অর্থনৈতিক অসাম্য, সাম্রাজ্যবাদ, দারিদ্র, শোষণ সবকিছু গ্রাস করে রেখেছিল চারদিক। তিনি জীবনের প্রথমদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, শেষ বয়সে যখন ছবি নিয়ে ‘ছেলেমানুষি’ খেলা শুরু করেছেন, সারা বিশ্ব তখন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে। এর প্রভাব কি তার চিত্রকর্মে একেবারেই অনুপস্থিত ছিল? অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি প্রবন্ধে সেই প্রশ্নগুলোই উত্থাপন করেছেন[18]

‘…সেজন্যই মানুষের মুখোশের পেছনকার মুখ, বিদ্যমান মূল্যবোধের আড়ালের জান্তবতা তার প্রতীক ঐসব অলীক জন্তু জানোয়ারের প্রতিচ্ছবি, নিসর্গের সুন্দরের বদলে ধূসরতা সব বেড়িয়ে এসেছে সামনে। সেজন্য তার কাজ অংশত বিষয়ভিত্তিক, তাঁর চারপাশের সর্বনাশ তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন, খুব সম্ভব ঐ স্বীকৃতি সাহায্য করেছে তাঁর বিষয়ভিত্তিক মনোভঙ্গী শক্তিশালী করে তুলতে। তাঁর এখন আর সাহিত্যের ছদ্মবেশ নেই, তিনি সম্মুখীন হয়েছেন নোংরা অদ্ভুত কিম্ভুতকিমাকার আকৃতির, চেহারার: তিনি সজ্ঞানে অস্বীকার করেছেন সাহিত্যের সুন্দর, মায়াবী জাল, মেলে ধরেছেন তার কাজে হাড়গোড়, ঔপনিবেশিক ফ্রেমের মধ্যকার জোড়াসাঁকোর বাড়ির, শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠানের কুৎসিত ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন, ছেঁড়াখোঁড়া এলোমেলো জীবন’।

একই প্রবন্ধে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আরো বলেন[19]:

‘এ যেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথ, ভয়ঙ্কর ও আদিম। সেজন্যই তার কাজে বারে বারে ফুটে উঠেছে রং-এর ঔজ্জ্বল্য সত্ত্বেও অসন্তোষ, রেখায় এসেছে তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা, ঐ সংঘাতের উৎস শ্বাসরুদ্ধকর পারিপার্শ্বিকতা। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের বাস্তব ভেঙে দিলেন, বেরিয়ে এলেন বিপর্যয়সঙ্কুল প্রাত্যহিকতায়, যখন দেশে চলেছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অভিযান, জাপান আক্রমণ করেছে চীন, স্পেনে হত্যা করা হয়েছে গণতন্ত্র, ফ্যাসিজম লণ্ডভণ্ড করছে জার্মানি ও ইতালি,  সর্বনাশ আসন্ন, দেশবিদেশ বিক্ষুব্ধ, বিচলিত : রবীন্দ্রনাথ কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের এই পরিসরেই, এই চেতনাই ধূসর থেকে ধূসর হয়ে গেছে তার নানা কাজে : তাকে যেন গিলে নিয়েছে তাঁর সমস্ত অতীত’।

এখন অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের এই অভিমত সঠিক কিনা আমরা জানিনা। জানার কোন উপায় নেই। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই বলে যাননি। বরং একসময় নিজের ছবি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এই ছবি ব্যাখ্যা করার নয়, নিজেকে প্রকাশ করার ছবি।  তাই ঐ ছবির মতো আমিও মৌন হয়ে থাকলাম’। এখন রবীন্দ্রনাথের মৌনতার কারণে স্বভাবতই এর ব্যাখ্যা-প্রতিব্যাখ্যার ভার তুলে নিচ্ছেন চিত্র-সমালোচকেরা।  অনেক সময়ই যে এসব ব্যাখ্যা প্রতিব্যাখ্যা মূল বাস্তবতা থেকে যোজন মাইল দূরে সরে যায় সেটাও স্মর্তব্য।  এটার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই।  ‘শেষের কবিতা’র অর্থ নিয়ে তাঁদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে তর্ক বেধে গিয়েছিল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে নিজেদের মতো করে তত্ত্ব গড়ে নিচ্ছিলেন, যার সাথে অন্যদের তত্ত্বের কোন মিল হয় না। তখন বাধ্য হয়ে তারা শরণাপন্ন হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার একটা দুর্ভাগ্য আছে, যেখানে আমার হাঁটু জল, লোকে সেখানে ডুব জল ধরে নেয়’[20]।  ব্যাপারটা হয়তো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের মতো ছবির ক্ষেত্রেও সত্য।

রবীন্দ্রনাথ এবং তার ছবির ব্যাপারে শেষ যে আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করব সেটার কথা অনেকেই জানেন না। ঘটনা হল, রবীন্দ্রনাথ খানিকটা বর্ণান্ধ ছিলেন, অর্থাৎ ‘রং-কানা’।  যিনি শেষ বয়সে সাহিত্য থেকে নিজেকে সরিয়ে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেছিলেন, এবং শেষ পনের বছরের মধ্যে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার ছবি এঁকেছিলেন, তাঁর মতো শিল্পী ‘বর্ণান্ধ’ ছিলেন –এটা হয়তো তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক এবং চিত্রকর্মের অগণিত দর্শকদের অবাক করবে, কিন্তু সত্যই তাই।  রবীন্দ্রনাথের মূল অসুবিধা ছিল লাল রঙটি নিয়ে। তিনি এই রঙ খুব ভাল করে দেখতে পেতেন না। লাল রঙের অংশগুলোকে তার ‘নেগেটিভ স্পেস’ বলে মনে হত। লাল এবং সবুজকে অনেক সময়ই আলাদা করতে পারতেন না। দৃকবিজ্ঞানে এ বিশেষ অবস্থাকে বলে ‘প্রোটানোপ’। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘প্রোটানোপিয়া’য় আক্রান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এটা একটা বংশগত রোগ।  রোগটির কোন চিকিৎসা নেই। চিকিৎসার যে খুব বেশি দরকার আছে তাও নয়, কারণ এটি কোন শারীরিক সমস্যা করে না, কেবল কোন কোন রঙকে স্বাভাবিকের চেয়ে ঝাপসা দেখেন রোগীরা। কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী তাদের ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে বেশকিছু উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন এই রোগের ব্যাপারটা সঠিক হবার সম্ভাবনাই বেশি।  তবে  কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী এ নিয়ে লেখার আগে থেকেই কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাপারটি জানতেন। যেমন চক্ষু চিকিৎসক জ্যোতির্ময় বসু  আর ডাব্লিউ পিকফোর্ডের সাথে মিলে ১৯৮৭ সালে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন ‘কালার ভিশন অ্যাণ্ড এসথেটিক প্রবলেমস ইন পিকচারস বাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ জার্নাল অফ অ্যাসথেটিক্স, ভল্যুম ২৭, সংখ্যা ১, ১৯৮৭তে[21]।  তারও আগে শিল্পী শোভন সোমের ‘শিল্পী, শিল্প ও সমাজ’ (অনুষ্টুপ, ১৯৮২) বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম ‘প্রোটানোপ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তিনি তার পরবর্তী গ্রন্থ ‘তিন শিল্পী’ (বাণীশিল্প, ১৯৮৫) তেও এ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন[22]।  তবে সর্বাগ্রে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন আমেরিকান লেখক এবং ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামরিশ, সেই ১৯৬১ সালে।  তিনি রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত ‘ড্রইংস এন্ড পেইন্টিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’  এ আলোচনাসূত্রে লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনি রং কানা, লাল আর সবুজ তিনি একইরকম দেখতেন। তথাপি তাঁর ছবিতে লাল এবং সবুজ পাশাপাশি এসেছে এবং মাত্রা বা ঘনত্ব আলাদা থেকেছে’[23]।  তবে স্টেলা ক্রামরিশ সেই ষাটের দশকে উল্লেখ করলেও ব্যাপারটা বহুদিন চিত্রকরদের জানা ছিল না। তাই দেখা গেছে পরবর্তী দুই তিন এবং চার দশক ধরে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের উপর গণ্ডায় গণ্ডায় বই পত্র এবং প্রবন্ধ লেখা হয়েছে বটে; কিন্তু সবাই কেবল রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের রীতি, ঢং, পর্ব, রূপায়ণ কিংবা এর নান্দনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানাভাবে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেছেন। তার বর্ণান্ধতার বিষয়টি এবং তার চিত্রকর্মের উপর এর প্রভাব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ লেখা একেবারেই দেখা যায়নি। ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ প্রকাশিত হবার আগে সাধারণদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি বিদগ্ধ জনের মধ্যেও এ নিয়ে কোন স্পষ্ট কোন ধারণা ছিল না।

কিন্তু ব্যাপারটি আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা নিঃসন্দেহে তার কাজকে দিয়েছে খানিকটা ভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র্য। ছবি আঁকার যেভাবে তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন, দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক থাকলে হয়তো সেভাবে ব্যবহার করতেন না।   এ কেবল আমার কথা নয়, বহু শিল্পীই আমার অভিমতের  সাথে আজ একমত হবেন।  যেমন,  চিত্রশিল্পী দেবরাজ গোস্বামী তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন[24]

‘রঙের রবীন্দ্রনাথ পড়বার পর আবার যখন রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো দেখি সেখানে লক্ষ করি  লাল রঙের পাশে সরাসরি কালো বা কোন গাঢ় অন্ধকার রঙ ব্যবহার করতে তিনি মানসিক দোলাচলের মধ্যে পড়েছেন।  যেখানে এই দুটি রঙ পাশাপাশি প্রয়োগ করলেই একটা জোরালো বৈপিরত্য তৈরি হয় এবং ড্রইংটি বেরিয়ে আসে।  সেখানে তিনি এই দু’রঙের মধ্যবর্তী স্থানকে সারফেসের সাদা কিংবা কোন হাল্কা রঙের একটি রেখা দিয়ে বিভাজন করেছেন। সম্ভবত হয় লাল ও কালো রঙের বৈপরীত্য সম্পর্কে কবি নিশ্চিত হতে পারতেন না অথবা তাঁর নিজস্ব বর্ণান্ধতার কারণে পাছে মূল ড্রইংটি হারিয়ে ফেলেন, এই আশঙ্কা থেকে ব্যাপারটি করতেন। কিন্তু এই কাজ করার ফলে আপনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবিতে একটা নিজস্ব চরিত্র তৈরি হয়েছে যা নান্দনিক বিচারে সদর্থক’।

রবীন্দ্রনাথ যে খানিকটা বর্ণান্ধ ছিলেন তার হদিস তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে মিলবে। যদিও আমরা জানি ফুল হিসেবে পলাশকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু লাল রঙের ব্যাপারে তিনি খুব কম সংবেদনশীল ছিলেন। ইতালিতে পথের ধারে পড়ে থাকা লাল পপিফুলের বিস্তীর্ণ  আচ্ছাদন দেখেও তিনি খুব একটা আকর্ষণবোধ করেননি। তারচেয়ে বরং সবুজ বা নীল রঙ তাকে ঢের বেশি আকৃষ্ট করতো।  শুধু তাই না, তিনি সুবজের বিভিন্ন ‘শেড’ তিনি সহজেই সনাক্ত করতে পারতেন, এবং অনেকক্ষেত্রেই সাধারণদের চেয়ে বেশি। তার কাছে সবুজের বৈচিত্র্য এতই বেশি ছিল যে প্রায়শই তাঁর মনে হত এত আলাদা আলাদা সবুজকে কীভাবে লোকে শুধু ‘সবুজ’ নামে ডাকে[25]!

রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতার সরাসরি সাক্ষ্য পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের একজন মানুষ, তাঁর গুণমুগ্ধা নির্মলকুমারী মহলানবিশের দেওয়া একটি তথ্য থেকে।  নির্মলকুমারী লিখেছেন[26]

‘পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে উনি রঙকানা ছিলেন। লাল রঙটা চোখে পড়তো না, মানে লাল আর সবুজের বেশী পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। কিন্তু কোন জায়গায়  নীলের একটু আভাসমাত্র থাকলেও সেটি তার দৃষ্টি এড়াতো না। বাগানে ঘাসের মধ্যেও খুব ছোট নীল রঙের একতা জংলী ফুল ফুটে থাকলেও ঠিক ওর চোখে পড়তো। বলতেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো, কী চমৎকার ফুলটা’। অথচ আমরা হয়তো লক্ষ করেও ফুলটি খুঁজে বের করতে মুশকিলে পড়তাম। হাসতেন আর বলতেন, ‘কী আশ্চর্য, এত স্পষ্ট জিনিসটা দেখতে পাচ্ছো না? অথচ আমি তোমার লাল ফুল ভাল দেখতে পাইনে বলে আমাকে ঠাট্টা করো। নীল রঙটা যে পৃথিবীর রঙ, আকাশের শান্তির রঙ, তাই ওটার মধ্যে আমার চোখ ডুবে যায়; আর লাল রঙটা হল রক্তের রঙ, আগুনে রঙ অতএব প্রলয়ের রঙ, মৃত্যুর রঙ – কাজেই বেশী না দেখতে পেলে দোষ কি?’

সেই একই রচনায় আমরা আরো দেখি নির্মলকুমারী লিখেছেন, ‘আমার লাল রঙ পছন্দ বলে আমাকে কত সময় নীলমণিলতার ফুলের গুচ্ছের দিকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে বলেছেন, কি এখনও তুমি লাল রঙ ভাল বলবে?’ আমিও…উত্তর দিয়েছি… তাহলে আপনি পলাশ এত ভালবাসেন কেন?’  উত্তরে তিনি বলে উঠতেন, ‘পলাশটা কি শুধুই লাল? ওতে কতখানি হলদে মেশানো রয়েছে, তাছাড়া ঘোর সবুজ – প্রায় কালো আর একটা রঙ আছে, এই দুই মিলিয়ে তবে তো পলাশের বাহার? তাছাড়া পলাশের গড়নটার কথাও তো ভুললে চলবে না’[27]।  এটা ধারণা করা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, রবীন্দ্রনাথের লালের প্রতি সংবেদনশীলতা একটু কম এবং সবুজ এবং নীলের প্রতি অত্যধিক বেশি থাকায় পলাশ ফুলকে আমাদের চেয়ে একটু ভিন্নরকম দেখতেন। তিনি তার মতো করেই সাজিয়েছিলেন পলাশকে, ভালবেসেছিলেন তার মতো করে।  অনেকটা কবির সে বিখ্যাত শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের ‘আমি’ কবিতার চরণগুলোর  মতোই –

‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

আমি চোখ মেললুম আকাশে,

জ্বলে উঠল আলো

পুবে পশ্চিমে।

গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,

সুন্দর হল সে’।

কেবল নির্মলকুমারী নয়, বিচ্ছিন্নভাবে  রোমা রঁল্যা, স্টেলা ক্রামরিশ, জগদীশচন্দ্র, রাণী চন্দ সহ অনেকের ভাষ্যেই রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতার ব্যাপারটা ধরা পড়ে। যেমন রাণী চন্দ তার ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’-এর ভূমিকায় লিখেছেন[28]

‘গুরুদেব প্রায়ই বলতেন তিনি রঙকানা, বিশেষ করে লাল রঙটা নাকি তার চোখেই পড়ে না। অথচ দেখেছি অতি হাল্কা নীল রঙও তার চোখ এড়ায় না। একবার বিদেশে কোথায় যেন ট্রেনে যেতে যেতে তিনি দেখছেন অজস্র ছোট ছোট নীল ফুলে রেললাইনের দুদিক ছেয়ে আছে। তিনি বলতেন, ‘আমি যত বউমাদের ডেকে ডেকে সে ফুল দেখাচ্ছি- তাঁরা যেন দেখতেই পাচ্ছিলেন না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলুম, এমন রঙও লোকের দৃষ্টি এড়ায়’।

কেবল তৃতীয়পক্ষের জবানবন্দিতে নয়, রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ভাষ্যেও তাঁর বর্ণান্ধতার কিছুটা প্রমাণ আমরা পাই। তিনি প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও যে অবহিত ছিলেন তার উদাহরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা অন্ততঃ দুটি চিঠি থেকে। আঠারোশো চুরানব্বই সালে তিনি ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন[29], ‘কত রকমেরই যে রঙ চতুর্দ্দিকে ফুটে উঠেছিল সে আমার মতো সুবিখ্যাত রঙকানা লোকের পক্ষে বর্ণনা করা ধৃষ্টতামাত্র।  কেবল আকাশে নয়, পদ্মার জলে এবং বালির চরেও কাল হঠাৎ রঙের ইদ্রজাল লেগে গিয়েছিল…’।

১৯৩১ সালে ড. সরসীলাল সরকারকে আরেকটি চিঠিতে লিখেছিলেন,

‘চৈতন্যের নানা দিক আছে, এক আলো থেকেই নানা রঙের বোধ, এও তেমনি। কেউ লাল রঙ দেখতে পায় না, কেউ নীল, কেউ বা এটা বেশী দেখে, কেউবা ওটা। আমি আজকাল ছবি আঁকি, সেই ছবিতে বর্ণসংযোজনের বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষত্বের কারণ আমার চৈতন্যে রঙের বিশেষ ধারণার মধ্যে। আমি সব রঙকে সমান দেখিনে, পক্ষপাত আছে, কেন আছে কে বলবে?’

কেবল চিঠিপত্রে নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যে চোখ রাখলেও দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথ লালের বদলে বেশির ভাগ সময় ‘রাঙা’ আর সবুজের বদলে ‘শ্যামল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন[30]। লাল যেন ছিলো তাঁর কাছে ধূসর যন্ত্রণার মতোন – ‘মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুক রক্তিমরাগে’। আর নিজের ‘রঙকানা’ দুর্বলতা বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই হয়তো ছবি আঁকার ব্যাপারে ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথকে সারা জীবন ধরে উৎসাহ দিলেও নিজে প্রথাগত অঙ্কন শিক্ষায় কোনদিন ঢোকেননি রবীন্দ্রনাথ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতার ব্যাপারটা হঠাৎ করেই ধরা পড়ে গিয়েছিল বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর একটি ছোট পরীক্ষায়। পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ছিলো সারা জীবনের গভীর বন্ধুত্ব[31]। তাঁদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একসময় বলেছিলেন,

‘বিজ্ঞান ও রসসাহিত্যের প্রকোষ্ঠ সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন মহলে, কিন্তু তাদের মধ্যে যাওয়া আসার দেনা পাওনার পথ আছে। জগদীশ ছিলেন সেই পথের পথিক। সেই জন্য বিজ্ঞানী ও কবির মিলনের উপকরণ দুই মহল থেকেই জুটত। আমার অনুশীলনের মধ্যে বিজ্ঞানের অংশ বেশী ছিল না, কিন্তু ছিল তা আমার প্রবৃত্তির মধ্যে। সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর ছিল অনুরূপ অবস্থা। সেই জন্য আমাদের বন্ধুত্বের কক্ষে হাওয়া চলত দুই দিকের দুই খোলা জানালা দিয়ে’।

অর্থের অভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণা যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগাড় হয়েছিল, তখন বন্ধুর গবেষণা যেন কোনভাবে বন্ধ না হয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু জগদীশের গবেষণার জন্য টাকা জোগাড়ের জন্যই একবার ত্রিপুরা ভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ধর্না দিয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের কাছে।  আবার কবির নোবেল পুরষ্কার বিজয়ের খবর শুনে জগদীশচন্দ্র বসু চিঠি লিখেছিলেন এই বলে, ‘বন্ধু, পৃথিবীতে তোমাকে এতদিন জয়মাল্যভূষিত না দেখিয়া বেদনা অনুভব করিয়াছি। আজ সেই দুঃখ দূর হইল…’ । এ উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায় কতটা গাঢ় ছিল তাদের বন্ধুত্ব।

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু  একবার সিসের স্ফটিক বা গ্যালিনা দিয়ে তৈরি একটি ‘গ্রাহকযন্ত্র’ বানিয়েছিলেন, যাকে তিনি ডাকতেন ‘কৃত্রিম চক্ষু’ বলে।  এটাকে কৃত্রিম চক্ষু ডাকার কারণ হল, যন্ত্রটি সাধারণ আলো তো বটেই এর বাইরে বিদ্যুৎ রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মিতে সংবেদনশীল ছিল। আমাদের চোখ যে সকল আলোতে সংবেদনশীল, জগদীশচন্দ্রের যন্ত্রটি এর চেয়ে আরো অনেক বেশি তরঙ্গের আলো সনাক্ত করতে পারতো। জগদীশ বোস যন্ত্রের সাথে যুক্ত তারগুলোকে অপটিক নার্ভের সাথে তুলনা করেছিলেন। অপটিক নার্ভ আলোর উদ্দীপনা বহন করে মস্তিষ্কে নিয়ে যায়।  জগদীশের যন্ত্রের ক্ষেত্রে ‘মস্তিষ্ক’ ছিল একটি ব্যাটারি বা পাওয়ার সেল, যা ক্রমাগত শক্তির যোগান দিচ্ছিল।  একদিন রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটি দেখতে আসলেন, এসে যন্ত্রটি যে আংশিক ‘সবুজ কানা’ সেটা সনাক্ত করে ফেললেন।  এটা দেখে জগদীশচন্দ্র বিস্ময়প্রকাশ করে পরে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে[32]

‘আমি সম্প্রতি একটি অত্যাশ্চর্য কৃত্রিম চক্ষু প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছি। এই চক্ষে অনেক আলো দৃষ্ট হয়, যাহা আমরা দেখিতে পাই না। তা ছাড়া ইহা রক্তিম বা নীল আলো অতি পরিষ্কার রূপে দেখিতে পায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইহা slightly green-blind। আপনার চক্ষু ইহা কি করিয়া অনুকরণ করিল বুঝিতে পারি না।

অনেকেই আজ মনে করেন, জগদীশ্চন্দ্রের কৃত্রিম চক্ষু যে আংশিক সবুজকানা ছিল, অর্থাৎ সবুজ দেখার যে উনতা যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, তা ধরা সম্ভব ছিল একজন লালকানার পক্ষেই[33]। সেজন্যই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ অতি সহজেই সেটা ধরতে পেরেছিলেন, আর সেটাই প্রকারান্তরে হয়েছিল জগদীশচন্দ্র বসুর বিস্ময়ের কারণ।

jagadish_bose_tagore

চিত্র: কবি ও বিজ্ঞানী। ‘রাজর্ষি’ রচনাকালীন সময়ে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সাথে কবি রবীন্দ্রনাথ ।

কেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বর্ণান্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল বলা মুশকিল। আগেই বলা হয়েছে এ ধরনের আংশিক বর্ণান্ধতার ব্যাপারটা মূলতঃ বংশগত। এ ব্যাপারে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা দেখেছেন,  আমাদের এই মানব প্রজাতির জনপুঞ্জে পুরুষদের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ লোক রঙ কানা, অন্যদিকে নারীদের মধ্যে এই সংখ্যা মাত্র দশমিক ৪ ভাগ। কেন পুরুষদের মধ্যে বর্ণান্ধতা বেশি আর নারীদের মধ্যে কম, সেটি আমাদের জন্য একটি রহস্য। কিন্তু বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এর কারণ লুকিয়ে আছে আমাদের বিবর্তনীয় যাত্রা পথে। বিবর্তনের যাত্রাপথের একটা বড় অংশে পুরুষেরা শিকারী হিসেবে এবং নারীরা সংগ্রাহক হিসেবে জীবন কাটিয়েছিল। সে সময় প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় নারীদের ক্ষেত্রে গন্ধ এবং বর্ণের ব্যাপারটা পুরুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উঠে এসেছিল। কোন্‌ ফল বিষাক্ত, কোন্‌ ফল শরীর জন্য উপকারী হতে পারে, কোন্‌ ফল সহজে পচনশীল, কোন্‌ ফল খেলে তার কোলের শিশু মারা পড়বে, আর কোনটা খেলে পুষ্টি দেবে  ইত্যাদি ব্যাপারে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে হত নারীদেরকেই।  নারীদের বর্ণ এবং গন্ধ সচেতনতা এ কারণেই পুরুষদের চেয়ে উন্নত।  নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশারের একটি ভিডিও দেখেছিলাম সেখানে তিনি এ ধরণের একটি অভিমত দিয়েছিলেন। বেশ কিছু সাম্প্রতিক পরীক্ষায় এ ধারণাটির পক্ষে সমর্থন মিলেছে[34]।  জেনেটিক্সের গবেষকেরা  এই বংশগত রোগের ব্যাপারে আরো কিছু বাড়তি তথ্য আমাদের দিতে পেরেছেন। বৈজ্ঞানিকভাবে এ রোগটির নাম ‘এক্সলিঙ্কড রিসেসিভ ডিসঅর্ডার’।  আমরা জানি মেয়েদের দেহকোষ গঠিত হয় দুটি এক্স ক্রোমোজোম (XX) দিয়ে, আর অন্যদিকে পুরুষদের থাকে একটি এক্স এবং আরেকটি ওয়াই (XY) ক্রোমোজোম। মেয়েদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকায় বংশে প্রটানোপিয়া  থাকলেও অস্বাভাবিক রিসেসিভ জিনটি মেয়েদের শরীরে প্রটানোপিয়ার প্রকট প্রকাশ ঘটে না। কিন্তু হেটারোজাইগাস মায়ের পুত্রদের মধ্যে প্রটানোপিয়াতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই জন্মগত রোগটি মায়ের দিক থেকে পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তাঁর মাতামহ প্রোটানোপ ছিলেন[35]

যারা রবীন্দ্রনাথের  ছবির সাথে পরিচিত তারা অনেকেই জানেন তার ছবিতে গাঢ় রঙের আধিক্য অনেক চোখে পড়ে। এটার কারণও সম্ভবত তার দৃষ্টির ‘উনতা’ অর্থাৎ বর্ণান্ধতা। প্রোটানোপদের ছবিতে নাকি এটা দেখা যায়। বিশেষ করে খয়েরি এবং কালো রঙের উগ্র ব্যবহার প্রোটানোপদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বহু ছবিতেই তার হদিস মেলে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় খয়েরির প্রাধান্য অনেক বেশি বলেই দর্শকদের কাছে প্রতীয়মান হয়। লালচে খয়েরি, কালচে খয়েরি, নীলচে খয়েরি, বেগুনি-খয়েরি প্রভৃতির অনেক শেড রবীন্দ্রচিত্রকলাকে আচ্ছন্ন করে আছে, এবং এর প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা।

তবে একথা না বললেও হয়তো চলে যে,  বর্ণান্ধতার ব্যাপারটি রবীন্দ্র চিত্রকলাকে একটি  ভিন্নমাত্রা দিলেও তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে এটি কোন সীমাবদ্ধতা তৈরি করেনি। তাঁর প্রতিভা আমাদের মনে করিয়ে দেয় লাডউইক ভ্যান বিথোফেনকে, যিনি জীবনের দীর্ঘ সময়টুকু কানে খাটো ছিলেন, কিন্তু তিনিই ছিলেন আবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের শিরোমণি। বিথোফেনের বধিরতা তার সুরের মূর্ছনা তৈরিতে কোন প্রতিবন্ধকতা আনতে পারেনি। একই ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের জন্যও খাটে। বিথোফেনের সুরের মূর্ছনার মতো রবীন্দ্রনাথের আঁকা স্বাতন্ত্র্য ধারার প্রায় তিন হাজার ছবি আমাদের জন্য আজ  অমূল্য সম্পদ। এমনকি অনেক সময়ই তা ছাপিয়ে গেছে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া তাঁর অতি পরিচিত কবি সত্ত্বাকেও।

তবে রবীন্দ্রনাথের এই চিত্রকর হয়ে ওঠার পেছনে নেপথ্যের নারীটি কেউ হয়ে থাকলে নিঃসন্দেহে তিনি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। সেই ১৯২৪ সালে পূরবীর খাতায় বিচিত্র কাটাকুটিতে উৎসাহ প্রদান থেকে শুরু করে এর ছ’বছর পরে প্যারিসের পিগ্যাল গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন – সর্বত্রই যেন লুকিয়ে আছে ওকাম্পোর মায়াবী হাতের ছোঁয়া।  রবীন্দ্রনাথের আঁকা বেশ কিছু নারীমুখের পোর্ট্রেটেও ওকাম্পো প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ আজ মনে করেন। কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্‌তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’  বইটিতে নায়িকা অনামিকা রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবির দিকে তাকিয়ে কীভাবে চমকে উঠেছিল তার বর্ণনা আছে এভাবে[36]

‘… অনামিকা চমকে ওঠে। ভিক্‌তোরিয়ার মুখের আদল না? মায়ারের বইটাতে যে আশ্চর্য ফটোগ্রাফগুলো আছে, সেগুলোর সঙ্গে একটা সাদৃশ্য আছে না? বিশেষত মলাটের ছবিখানার সঙ্গে?

পর পর আরো কয়েকটা ছবিতে ঐ একই মুখাবয়ব। অন্তত তাই মনে হয় অনামিকার। বিশেষত একটা ছবির সামনে এসে সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। সাদা কালোতে আঁকা এই নারীর মধ্যে কেমন একটা স্পেনীয় ভাব। উপরে তোলা ডানহাতটা স্পেনীয় কায়দায় একটা ছোট পাখা ধরে আছে না? মায়ারের বইটার জ্যাকেটের ছবিটার সাথে সত্যিই আশ্চর্যরকমের মিল: সেই দৃঢ় উন্নত কপাল, সেই ঋজু ভুরু, সেই তেজী নাসা, সেই বড় বড় চোখ, সেই তীক্ষ্ণ-গম্ভীর-বিষণ্ণ রহস্যময় চাহনি। অনামিকার চোখ ঝলসে যায়। তারিখটার দিকে তাকায়। ১৯৩৮। …’

ডার্টিংটন হলে রক্ষিত এ ছবিটি ছাড়াও রবীন্দ্র ভবনে রক্ষিত বেশ কিছু ছবিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মুখের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন কেতকী। এর একটি অসম্পূর্ণ তালিকা পাওয়া যাবে  কেতকী কুশারী ডাইসনের ইংরেজি বই –‘ইন ইয়োর ব্লোসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’-এ[37]

tagore_woman_face_and_ocampo_face_combined

চিত্র: রবীন্দ্রনাথ অঙ্কিত বহু নারীমুখের প্রতিকৃতিতে ভিক্টোরিয়ার মুখের আদল খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।

প্যারিসে চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে যাবার পর ওকাম্পোর থেকে বিদায় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের ১১ই মে। প্যারিসের গার্‌ দ্যু নর্‌ রেলস্টেশনে ধারণ করা আছে তাঁদের সেই শেষ বিদায়ের দৃশ্য। প্যাট্রিশিয়া স্টেইনারের ভাষ্য অনুযায়ী, রেলস্টেশনে তোলা বিখ্যাত সেই ছবিতে তাঁদের দেখাচ্ছিল ম্লান এবং বেদনার্ত[38]

Pic9_tagore_ocampo_last_vist

চিত্র: প্যারিসের গার্‌ দ্যু নর্‌ রেলস্টেশনে তাঁদের সেই শেষ বিদায়ের দৃশ্য।

কেতকী কুশারী ডাইসন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ বইয়ে নানা চিঠিপত্র দলিল উদ্ধার করে দেখিয়েছেন, কবিগুরু আসলে চেয়েছিলেন ওকাম্পো তাঁর সঙ্গে ইংল্যান্ড যান, হিবার্ট বক্তৃতা শোনেন আর তারপর রবীন্দ্রনাথের সাথে ফিরেন ভারতবর্ষে[39]। কিন্তু ওকাম্পোর মাথায় ছিল তাঁর সম্ভাব্য ‘সুর’ পত্রিকা নিয়ে নানা পরিকল্পনা, তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও তিনি রবিঠাকুরের সাথে ভ্রমণে যেতে পারেননি। ইনফ্যাক্ট, আমরা আজ জানি, ওকাম্পো তাঁর সারা জীবনে কখনোই ভারতে গিয়ে উঠতে পারেননি। রবিঠাকুর অবশ্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আশা করে গিয়েছিলেন ওকাম্পো কোন না কোন দিন ভারতে আসবেন, ভারতবর্ষে এসে রবিঠাকুরের কাজকর্মের সাথে পরিচিত হবেন।  যেমন, লন্ডনে চিত্রপ্রদর্শনীর পর পরই ওকাম্পোকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ … এ যেন সেই ডেড সী-র ভারি জলের মতো – সব কিছুই ভেসে থাকে যেখানে, তার ওজন যাই হোক না কেন। তুমি কোথায় আছ জানি না, শুধু চাই ভারতবর্ষে তোমার সঙ্গে দেখা হোক’[40]।  রবীন্দ্রনাথ যখনই তাঁর ‘বিজয়া’কে চিঠি লিখতেন, তখনই শান্তিনিকেতন ঘুরে যাবার কথা বলতেন। যেমন, ১৯৩৪ সালের  জুলাই  মাসের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন[41]  –

‘প্রিয় বিজয়া, … সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই তুমি তোমার ভ্রমণসূচীতে ভারতবর্ষে রাখো একবার, আমার নিজের জায়গা শান্তিনিকেতনে  এসে আমাকে দেখে যাও। অসম্ভব কেন হবে? নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া খুব ভাল এখানে, এবং তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবার চেষ্টায় আমার কোন ত্রুটি হবে না সে তুমি নিশ্চয় জানো।

সম্প্রতি সিলোনে তোলা আমার একটি ছবি তোমাকে পাঠাচ্ছি, আশা করি তোমার হাতে পৌঁছুবে।

আমার ভালবাসা সহ,

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এখানে উল্লেখ্য, এ চিঠির নীচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভালবাসা’ লিখেছিলেন এবং সাক্ষর করেছিলেন বাংলায়।  ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পত্র আদান প্রদান হয়েছে অনেক – নথি থেকে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৬  সাল পর্যন্ত ৩২টি, ১৯২৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৪টি, ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ৬টি,আর ১৯৩৯ সাল থেকে রবিঠাকুর মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৮টি চিঠির কথা জানা যায় (তাদের চিঠিগুলোর অনুবাদ বইয়ের পরিশিষ্টে সংকলিত হয়েছে)।  আর ওকাম্পোকে লেখা রবিঠাকুরের বহু চিঠিতেই এভাবে বাংলায় লেখা ‘ভালবাসা’ র হদিস মেলে। কখনো রোমান হরফেও ‘bhalobasha’ লিখে চিঠি শেষ করতেন রবিঠাকুর। এখানে একটি ব্যাপারও বলা দরকার, তাঁর দীর্ঘ রবি-জীবনে জীবনে ওকাম্পোই কেবল একমাত্র ‘অনুরাগী বিদেশিনী’ ছিলেন না। বিশ্বভ্রমণে তিনি বহু নারীর সংস্পর্শেই এসেছিলেন; কারো সাথে সখ্যতা হয়েছে, কারো সাথে বন্ধুত্ব,আঁদ্রে কার্পেলেসের মতো কারো সাথে জীবনভর চিঠি চালাচালি করে রঙ্গ-রসিকতা-নির্দোষ ফ্লার্টিংও করেছেন,কিন্তু ওকাম্পোর মতো কাউকেই ‘ভালবাসা’ সম্বোধন করে চিঠি শেষ করেননি তিনি।

:line:

তথ্যসূত্র:

 

[1] অভিজিৎ রায়, ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন, বিডি আর্টস, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪

[2] মনোরঞ্জন গুপ্ত, রবীন্দ্র-চিত্রকলা, সাহিত্য সংসদ, তৃতীয় সংস্করণ ২০০৭

[3] ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, Tagore en las barrancas de San Isidro, [অনুবাদ, শঙ্খ ঘোষ (ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ)]

[4] বুলবন ওসমান, ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – বাংলা একাডেমীর নিবেদন গ্রন্থে সংকলিত, ২০১১।

[5] দেবরাজ গোস্বামী, রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে তর্কাতর্কি মুখায়ব ন্যুডিটি উত্তরাধুনিকতা আরো কিছু, অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খণ্ড, ২০১২

[6] ‘রবীন্দ্রনাথ’ (কবিগুরু মারা যাবার পরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মৃত্যুসংবাদ জ্ঞাপক প্রবন্ধ), ১৯৪১

[7] ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, অনুবাদ, শঙ্খ ঘোষ, পূর্বোক্ত।

[8] চিত্রশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি লেখার কথা ছিল আঁদ্রে জিদের, কিন্তু এ সময় তিনি জার্মানী চলে যাওয়ায় দায়িত্বটি বর্তায় নোয়াই-এর উপর। ২৭.৫ x ২১.৫ মাপের বড় সড় কাগজে ১৬ পৃষ্ঠার এই পত্রীর তিন পৃষ্ঠা ব্যাপী ভূমিকা লেখেন তিনি, শিরোনাম দেন – ‘Les Reves Visibles de Rabindranath Tagore’ – বাংলায় বলা যায় – ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিগ্রাহ্য স্বপ্নসমূহ’। ভুমিকাটি সমালোচকদের বেশ প্রশংসা পেয়েছিল।

[9] সমীর সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা, সাহিত্য সংসদ, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ, ১৪১৭।

[10] রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতৃস্মৃতি, ১৯৭১, পৃঃ ১৯৪।

[11] মনোরঞ্জন গুপ্ত, রবীন্দ্র-চিত্রকলা, পূর্বোক্ত।

[12] যেমন, কবি এজরা পাউন্ড এক সময় বলেছিলেন, ‘এগুলো ছবি নাকি? কেউ এই সমস্ত হিজিবিজি কাটাকুটি (doodling)  দেখতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু কেউ টেগোরকে সত্য কথাটা গিয়ে বলেনি’।

রোমা রঁল্যা লিখেছিলেন, ‘ছবিগুলো ইউরোপে যে অভ্যর্থনা পেয়েছে, তাতে তিনি বুঁদ হয়ে আছেন। কিন্তু এর মধ্যে স্নবারি ও মিথ্যা ভদ্রতার অংশ যে কতখানি তা তিনি ধরে উঠতে পারেননি’ (রোমা রঁল্যা, ‘ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি’, অনুবাদ: অবন্তীকুমার স্যানাল , পৃঃ ২৮০)।

[13] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পথে ও পথের প্রান্তে, ১৯৫১, পৃঃ ১১১।

[14] বুলবন ওসমান, ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’, পূর্বোক্ত।

[15] সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – বাংলা একাডেমীর নিবেদন গ্রন্থে সংকলিত, ২০১১।

[16] কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারী, রঙের রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৭

[17] দেবরাজ গোস্বামী, রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে তর্কাতর্কি মুখায়ব ন্যুডিটি উত্তরাধুনিকতা আরো কিছু, পূর্বোক্ত।

[18] বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – বাংলা একাডেমীর নিবেদন গ্রন্থে সংকলিত, ২০১১।

[19] বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা, পূর্বোক্ত।

[20] নিত্যপ্রিয় ঘোষ, আকস্মিক শেষের কবিতা?, বিষয় রবীন্দ্রনাথ: নিত্যপ্রিয় ঘোষের প্রবন্ধসংগ্রহ ২, গাঙচিল, ২০১৩

[21] R. W. Pickford and J. Bose, ‘Colour Vision and Aesthetic Problems in Pictures by Rabindranath Tagore’, British Journal of Aesthetics, vol.27.1, Winter, 1987

[22] শোভন সোম, রবীন্দ্রনাথের ছবির রং এবং বর্ণান্ধতা, অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খন্ড, ২০১২

[23] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ‘ছবির অঙ্গ’, বিচিত্র প্রবন্ধ, রচনাবলী ১৪, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, ১৯৬১।

[24] দেবরাজ গোস্বামী, রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে তর্কাতর্কি মুখায়ব ন্যুডিটি উত্তরাধুনিকতা আরো কিছু, পূর্বোক্ত।

[25]  Romain Rolland, Inde – Journal, 1915-1943, Littérature française

[26] নির্মলকুমারী মহলানবিশ, ‘আনন্দমেলায় কবির গল্প’, বাইশে শ্রাবণ, মিত্র ও ঘোষ, ১৩৯৩

[27] নির্মলকুমারী মহলানবিশ, ‘আনন্দমেলায় কবির গল্প’, পূর্বোক্ত।

[28] রাণী চন্দ: ভুমিকা, আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী ১৩৯১।

[29] রবীন্দ্রনাথ, ছিন্নপত্রাবলী, ১৪ ডিসেম্বর, ১৮৯৪-এ লেখা পত্র।

[30] কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারী, রঙের রবীন্দ্রনাথ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৭

[31] অভিজিৎ রায়, রবীন্দ্রে বিজ্ঞান, দৈনিক ভোরের কাগজ, মে ৫, ২০০৬; সচলায়তন মে ০৯, ২০০৮; মুক্তমনা, জানুয়ারি ৭, ২০১১।

[32] জগদীশ্চন্দ্র বসু : রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি, মার্চ ৬, ১৯০০, পত্রাবলী, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু শতবার্ষিকী সমিতি, ১৯৫৮।

[33] শোভন সোম, রবীন্দ্রনাথের ছবির রং এবং বর্ণান্ধতা, অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খন্ড, ২০১২

[34] Females Distinguish Colors Better While Men Excel At Tracking Fast Moving Objects, SciTech Daily, October 2, 2012

[35] জ্যোতির্ময় বসু, রবীন্দ্রনাথের ছবি :বিতর্ক, অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খন্ড, ২০১২

[36] কেতকী কুশারী ডাইসন, রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্‌তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে, প্রথম দে’জ সংস্করণ, ১৯৯৭

[37] Ketaki Kushari Dyson, In Your Blossoming Flower-Garden ; Rabindranath Tagore and Victoria Ocampo, Sahitya Akademi (1988),  Reprinted, 2009.

[38] Victoria Ocampo: Writer, Feminist, Woman of the World, Translation: Patricia O. Steiner, University of New Mexico Press , 1999

[39] Ketaki Kushari Dyson, In Your Blossoming Flower-Garden, পূর্বোক্ত।

[40] অভিজিৎ রায়, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (প্রকাশিতব্য): পত্রাবলী: মে ১৪, ১৯৩০ তারিখে লেখা (৩৭ নং) রবীন্দ্রনাথের চিঠি (পরিশিষ্ট দ্রঃ)

[41] অভিজিৎ রায়, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (প্রকাশিতব্য): পরিশিষ্টে সংকলিত পত্রাবলী (৪১ নং নথি) দ্রষ্টব্য।