2

কুয়াশার ঘোমটা দেয়া মাঘের প্রচণ্ড শীতে বিশাল বহর নিয়ে সাগরপালিতা ‘নিঝুমদ্বীপে’ বেড়াতে এসে ‘কেতুপর’ গ্রামের নাম শুনে মনটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো! হৃদয়ে আলোড়ন তোলা আগ্রহ নিয়ে বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম অচেনা কেতুপুরের উদ্দেশ্যে। স্থানীয় জেলে আর নদীর পারে ঘোরা অবোধ প্রকৃতির উলঙ্গ-উদম শিশুরা জানালো, এ গাঁয়ের সবচেয়ে পুরণো বয়বৃদ্ধ বাসিন্দার নাম ‘কুবের মাঝি’, সে-ই নাম রেখেছে এ গাঁয়ের ‘কেতুপুর’। বয়সের ন্যূজতায় তেমন কাজ করতে পারেনা সে। নদীর পারে একটি ছোট চায়ের দোকান চালায় এখন, আগে মাছ ধরতো আর অবসরে কৃষি কাজ করতো সরকারি খাস জমিতে। এখন জীবনের ভারে পরিশ্রান্ত কুবের! তেমন শক্ত কাজ করতে পারেনা সে।

দ্বিগুণ উৎসাহ আর প্রবল আগ্রহে কেতুপুরের কুবেরের সন্ধানে চললাম একাকি কেবল বোনটিকে সাথে নিয়ে। আমার প্রবল আগ্রহে বিদেশি ভার্সিটি পড়ুয়া আমার সফরসঙ্গি একমাত্র বোন মুখ টিপে হাসে, আর তার মা’র কপালে সুষ্পষ্ট বিরক্তির রেখাও আমায় দমাতে পারেনা একটুও। নল-খাকড়ার মেঠোপথ পেরিয়ে সূর্য ডোবার আগেই পৌঁছে গেলাম কুবেরের দোকানে! স্থানীয় স্বল্পশিক্ষিত কোন জেলে হয়তো ঘরের হোগলা-পাতার বেড়ায় চুনের সাদা অক্ষরে লিখে রেখেছে ‘‘পদ্দা নদির মাজি কুবের মাঝির চায়ের দোকান’’। ধবধবে বকরঙা চুল-দাড়ি-ভ্রু’র লেংটি পড়া পৌঢ়ত্বের ভারে ম্রিয়মান কুবেরের দিকে পলকহীন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে, সামনের টুলে বসা কয়েক আড্ডাবাজ চাপিয়াসী গ্রাম্য জেলে উঠে দাঁড়ান সামনের টুল ছেড়ে! মনে পড়ে আমার ‘কেতুপুর’ নামক স্বর্গগ্রাম থেকে বাঁচার জন্য সমুদ্রবেষ্টিত একটি দ্বীপ, সমাজ ও সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, ময়নাদ্বীপের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছিল কুবের ও কপিলা বহুদিন আগে।
প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই অবাক বিস্ময়ে-‘আপনি কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কুবের? যাকে হোসেন মিয়া নিয়ে এসেছিল ময়নাদ্বীপে’?

‘হ’ কুবেরের সংক্ষিপ্ত ক্ষীয়মান নির্লিপ্ত জবাব! ‘আপনি জানেন ক্যামতে? পাল্টা প্রশ্ন কুবেরের’!
‘জানি কুবের সব জানি! তাহলে ‘কপিলা’ কোথায়’?
‘আছে! ঘরের পিছে। আমার পরিবারকে ক্যামতে চেনেন আপনেরা’? কণ্ঠে ট্রাজিক ধূসরতায় ভরা প্রশ্ন!
‘ও গড! বলে কি? আমি চিনবো না তো কে চিনবে? উপন্যাসটি পড়লাম কমপক্ষে ১০-বার, আর ছবিটাও দেখেছি ৫/৬-বার ঢাকা আর কোলকাতাতে। কত আলোচনা আর সমালোচনা করলাম এর! আর আমি চিনবো না পদ্মা নদীর মাঝি কুবের আর কপিলাকে! যারা ছিল আমার স্বপ্নের হিরো-হিরোইন এককালে’!
অনুনয় করি কুবেরকে, ‘ডাকুন না একটু কপিলাকে, দেখি আমার স্বাপ্নিক ‘রূপা গাঙ্গুলী’কে’!

‘হে তো আইতে পারবো না এহানে, হাঁটতে পারেনা বালা কইরা। দোকানের পেছনের ঘরে সুইয়া থাহে একলা সারাদিন’! আবেগ আপ্লুত কুবেরের কাঁপা কণ্ঠ করুণ অন্ধকার আর বেদনার্ত ধোয়াসায় ভরা!

অনুরোধ আর পীড়াপীড়িতে কুবের দোকান ফেলে আমাদের নিয়ে চলে তার নাড়ার চালের পাতার বেড়ার কাঁচা ঘরে। বেড়ার ফাঁকে আবছা আলো-আঁধারিতে উঁকি মারে কপিলার অসুস্থ্য ভঙুর শরীর। প্রায় খোলা হোগলা পাতার দরজা খুলে আস্তে ডাকে কুবের, ‘কপিলা অ কপিলা! উইঠে বহ, তোমারে দেখতে আইছে কইলকাততার মানুষ, দ্যাহ’।

আঁতকে উঠি হোগলার চাটাইয়ে শোয়া হাড়-মাংসে মিশে যাওয়া লিকলিকে কপিলাকে দেখে, যার কোথাও রূপা গাঙ্গুলীকে খুঁজে পাইনা আমি। কাঁপা হাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও উঠতে পারেনা কপিলা। আমার সুশিক্ষিতা বোন স্বর্ণপ্রভা তাকে যত্নে ধরে বসায় হোগলা পাতার চাটাইয়ে! ভাঙা গলায় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে কপিলা আমার বোনের দীর্ঘায়ূ আর মঙ্গলের জন্য! কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেখে তার চিবুক আর গাল!
‘কোলকাতা নয়, ঢাকা থেকে এসেছি আমরা’ বলে স্বর্ণপ্রভা। সাথে থাকা বিস্কিট আর পানীয় তুলে ধরে কপিলার দিকে, বলে আমার ভাইয়ের খুব ইচ্ছে আপনাদের সংসার দেখে, কেমন আছেন আপনারা এ দ্বীপে’!

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সপ্তপদী রোগ্রাক্রান্ত কপিলার এ বয়সে। আভরণহীন এ আবাসে নানা অসুখে আক্রান্ত সে। কোন হাসপাতাল কিংবা ডাক্তার নেই এ গাঁয়ে। সরকারি হাসপাতাল আছে পাশের দ্বীপ ‘হাতিয়া’ আর ‘মনপুরা’য়। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সাধ্য নেই কুবের-কপিলার। তাই বিনা চিকিৎসায় কাতরাচ্ছে ঘাস-পাতায় ছাওয়া নিজ ক্ষয়িষ্ণু কুঁড়েতে! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর নায়ক-নায়িকা কপিলা-কুবের! বাঙালির মননে যারা অনন্য!
জীর্ণ ক্ষুদ্র কুটীরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়লো পদ্মা নদীর মাঝির শেষ দৃশ্য যখন পুলিসাতঙ্কে কেতুপুর ছেড়ে হোসেন মিয়ার নৌকায় ওঠে কুবের বলে, ‘‘হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা অতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারব না’’।

সুখের কি আশাই না ছিল তখন কুবের আর কপিলার মনে! কিশোরী কন্যা গোপী, পঙ্গু স্ত্রী মালা, আজন্ম লালিত জেলেপল্লী কেতুপুর, কেউ ধরে রাখতে পারেনি কুবেরকে। এক সুখস্বপ্নের টানে কুবের কপিলা পাড়ি জমালো আলোকিত এ সুখদ্বীপে। কিন্তু হোসেন মিয়ার স্বাপ্নিক ময়নাদ্বীপই আজ রাজনৈতিক বিভাজিত মানুষের ভীড়ে গিজগিজে বাংলাদেশের ‘নিঝুম দ্বীপ’। যেখানে বন বিভাগের হাজারো হরিণ আর মানুষেরা বাস করে পাশাপাশি নানাবিধ প্রতিকুলতা, সুখ আর রেশারেশি সত্বেও। এক সময় ঝানু জেলে কুবের সাগর থেকে ফিরতো অঢেল মাছ নিয়ে, কপিলা শুকিয়ে রাখতো তা শুটকির জন্যে। মাছহীন সময়ে কুবের নামতো কৃষি কাজে বাড়ির আশপাশের সরকারি জমিতে। উঠোন আর ঘর ভরে যেত ধান, কাউন, কলাই আর তিল-তিষিতে। সুঠাম স্বাস্থ্যবতী কপিলা সারাদিন ব্যাপৃত থাকতো ফসল শুকোতে আর সংরক্ষণে।

এরপর জীবন গড়িয়ে গেল কখন দিগন্তে পরিশ্রান্ত সূর্যের মত। সরকারি জমিগুলো সব নবাগত মুসলিম সন্ত্রাসীরা নিজ নামে রেকর্ডভুক্ত করলো ক্রমান্বয়ে। কুবের হলো পরম ভূমিহীন মানুষ, ঈশ্বরের এ বিস্তৃত বিশাল বিস্তৃত জগতে। নদী আর সমুদ্র ভরে গেল নোয়াখালী আর বরিশালের যান্ত্রিক ট্রলারে। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত কুবের আর তার সমগোত্রীয়রা কুলিয়ে উঠলো না তীব্র সন্ত্রাসী প্রতিযোগিতার বাংলাদেশে। সব হারিয়ে এখনো কপিলাকে নিয়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে সাগরকন্যা নিঝুম দ্বীপে কি এক নেশায় যেন।

নিঝুম দ্বীপে শেয়াল ডাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত নামে। বয়ে চলা নদীর শো-শো শব্দে এক ট্রাজিক কান্নার অর্ক্রেস্ট্রা ধ্বনিত হয় চারদিকে। ক্ষয়ে যাওয়া জীবনে কপিলার অন্ধকার ঘরে কেরোসিনের কুপি জ্বালায় বিদেশাগত বোন স্বর্ণপ্রভা। রাতের দ্বীপাকাশে দেখা দেয় ভরা যৌবনময়ী চাঁদ। জোৎস্না-স্নাত নিঝুম রাতে কপিলাকে ছেড়ে নদীর তীর ঘেষে যখন ফিরছি আমরা আমাদের ঢাকাগামী দ্বিতল লঞ্চে, কুবের এলো অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটেহেঁটে আমাদের সঙ্গী হয়ে ঘাট পর্যন্ত! কাঁপা গলায় জানতে চাইলো তার ফেলে আসা কেতুপুর, গোপী, মালা, রাসু, ধনঞ্জয়, গণেশ আর হোসেন মিয়ার কথা!

কিন্তু এক দম বন্ধ করা অব্যক্ত চিনচিনে ব্যথায় কিছুই জানাতে পারি না আমি কুবেরকে! হু হু করে বুকের ভেতর ক্লেদাক্ত কান্নার ঝড় বইতে থাকে আমার। জানিনা কোথায় কেতুপুর, কোথায় কুবেরের মালা আর গোপীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশ, সমুদ্র আর ত্রিভূবনে কিংবা কোন মহাসমুদ্রে অনাথ কাঠখন্ড হয়ে ! হয়তো গোপী কাজ করে ঢাকার কোন গেটবদ্ধ বস্ত্রশিল্পে সকাল থেকে গভীর রাত অবধি। থাকে কোন বস্তিতে ৩০০-টাকার মাসিক ভাড়ার বাঁশের ঘরে। কিংবা রানাপ্লাজার ধ্বসে ঢাকা পড়েছে তার বিকৃত লাশ! যার ডিএনএ মেলেনি অদ্যাবধি! মালা হয়তো খোঁড়া পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোপীর ছবি নিয়ে রানাপ্লাজার সামনে, জুরাইন কবরস্থানে কিংবা প্রেসক্লাবে? কিন্তু কে সন্ধান রাখে কেতুপুর, গোপী আর মালাদের? এ আলোকজ্জ্বল অনন্ত আকাশ, সপ্তর্ষিমণ্ডল আর স্বাতী নক্ষত্রের ছুটে চলা জ্বলজ্বলে তারার অসীম বিশ্বে!

1

[মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের শেষাংশ হিসেবে লিখিত]