১.
সূরের মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছে ছোট্র চালাঘরটি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন শ্রোতারা, চোখ মুদে রয়েছেন কেউ কেউ, সঙ্গীত সরোবরে সম্পূর্ণই নিমজ্জিত! দরবারী রাগ, ধ্রুপদী, কানাড়া, শ্রুতি কানাড়া, সিন্ধি, কাফী। এছাড়া, চলে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী, শ্যামা, রামপ্রসাদী, এমনকি ইসলামী সঙ্গীত পর্যন্ত। এইসব অনেক কিছুই বোঝেন না শ্রোতারা, কিন্তু সঙ্গীতের অমিয় সুধা ঠিকই উন্মাতাল করে তোলে তাদের।

কখনো কখনো সাম্যের গান, দেশের গানও শোনান তিনি। নজরুলের ‘বল বীর/ বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ অথবা রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/কে বাঁচিতে চায় ?/দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,/কে পরিবে পায়’ ফুটিয়ে তোলেন গানে গানে। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক হলেও গান নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন। কিন্তু সময়টা যে বড্ড জটিল! পিঁপড়ের মত পিষে মারছে মানুষ, একটু নিজের মত করে বাঁচার স্বাধীনতা থাকবে না মানুষের?

বলিহার। নওগাঁ জেলার সদর উপজেলাতেই অবস্থিত। এখানকার বিখ্যাত জমিদারদের কথা কে না জানে! পুরনো জমিদারবাড়িটি এখনো টিকে আছে বলিরেখার মত! সেই বলিহার সরগরম হয়ে উঠেছিল একাত্তরেও।

নওগাঁ ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সেই ভাগ্যবান লোকালয়গুলির একটি, যেগুলি আক্ষরিক অর্থেই ছিল মুক্ত। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদাররা একসময় রাজশাহী পর্যন্ত চলে এলে মুক্ত নওগাঁকে টিকিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেন মুক্তিযোদ্ধারা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ১৯শে এপ্রিল নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নের মূল ব্রিজটি উড়িয়ে দেন তারা।

ভীষণ সংকটে পড়ে যায় পাক হানাদারগণ। কি উপায়! কি উপায়! নাহ্‌, সমাধানসূত্র তো রয়েছে হাতের কাছেই! লাখে লাখে নীরিহ মানুষের বুক ঝাঁঝরা করে দিতে যাদের বাঁধেনি, একটি পুরনো জমিদারবাড়িকে হত্যা করতে তাদের আটকাবে? একে একে খুলে নেয় তারা বলিহার জমিদারবাড়ির দরজা-জানালা-কলকব্জা; আর এভাবে ২৩ শে এপ্রিলের মধ্যেই ব্রিজ পুনর্স্থাপন করে ফেলে পাকিস্তানি হায়েনারা। এরপর আর যায় কোথায়? মুহুর্তের মধ্যেই বিপুল গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে না পেয়ে আক্রোশ মেটানোর জন্য বেছে নেয় বেসামরিক নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে। আর বলিহার গ্রামটিও ছিল বলিহারি! নব্বই ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত! হিন্দু রক্তপানের নেশায় জিহ্‌বাগুলি লকলক করতে থাকে পাকিস্তানি হানাদারদের!

বলিহার গ্রামের শতশত হিন্দু বাড়ি জ্বলছে। আগুনের শিখা আকাশকে ঢেকে ফেলেছে প্রায়। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দেশীয় বশংবদেরা নির্বিকারে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ।

ওরই মাঝে জমিদার বাড়ির ছেলে, মানিককিশোর, বাড়ির পশ্চিমদিকের একটি গর্তে লুকিয়ে পড়লেন, সত্তর বছর বয়সে তো আর গুলির মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন না তিনি, স্ত্রী ও পুত্রদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতায়। কিন্তু নিজে পালাননি। একজন শিল্পী হয়ে পালাবেন তিনি? আর তাছাড়া তিনি সারাজীবন ধরে এই শিক্ষাই কি দেননি যে, সঙ্গীতের কাছে হার মানে সমস্ত হিংসা-দ্বেষ, সুরের স্বর্গীয় পরশে গলে যায় পাষান হৃদয়?

খুনের নেশায় পাকিস্তানি হায়েনারা তখন মরিয়া, কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলে তারা মানিককিশোরকে, মারতে মারতে নিয়ে আসে বলিহার বাজারে, এরপর ঢুকিয়ে দেয় সামনের চালাঘরে। এরপর প্রেতোল্লাস!

পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় মানিককিশোরের গায়ে। আস্তে আস্তে পুড়ে যেতে থাকে মানিককিশোরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চামড়া, হাড়-মাংস, কয়লা হওয়ার আগ পর্যন্ত।

জমিদারবাড়ির ছেলে মানিককিশোর নান্যাসী। তবু মন ছিল না জমিদারীতে, বৈষয়িক কোন বিষয়ে। সঙ্গীত সুধার টানে ঘর ছাড়েন, বাংলার কিংবদন্তী আলাউদ্দিন খাঁর কাছেও দীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন বলবৎ হলে জমিদারী হারান মানিককিশোর; শোকে ভাসবেন কি, উল্টো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, যেন সুবিধেই হল মানিককিশোরের, সংগীত-জমিনে আরও নিবিষ্ট আবাদের পেয়ে গেলেন অনিঃশেষ অবকাশ। হয়ে উঠলেন নওগাঁর সাংস্কৃতিক দুনিয়ার অঘোষিত জমিদার!

উনিশশো একাত্তর সনের ৬ই মে, সেই মানিককিশোর সত্তর বছর বয়সে জীবন্ত বলি হলেন বলিহার বাজারের সেই চালাঘরটিতে, যেখানে টিনের চাল বেয়ে নামত সুরের বৃষ্টি, ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজিয়ে দিত সেইসময় সেই চালার তলায় আশ্রয় নেয়া ভাগ্যবান শ্রোতাদের! হয়ত বড় ভালবাসতেন চালাঘরটিকে, সে কারণেই সেই চালাঘরের যূপকাষ্ঠেই অগ্নি-স্নান করে সেদিন অমরলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন শহীদ মানিককিশোর, সপ্তা-কাশ জুড়ে তখন বেজেই চলছিল কোন ধ্রুপদী রাগ!

২.

প্রথম চিঠিটির উপর লেখা ছিল: Addressee left.
দ্বিতীয় চিঠিটির উপর লেখা ছিল: Addressee gone to India.

কিন্তু কি হয়েছিল আসলে? তিনি তো ইন্ডিয়া যেতে পারেন না!
তিন চিল্লা সমাপ্ত করে এসেছেন যিনি, যার রয়েছে শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ ও জোব্বা-পরিহিত অবয়ব? যিনি ছিলেন সরকারী প্রকৌশলী, যার কর্মস্থল রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টের পার্বতীপুর অফিস এবং বসবাস রেল কোয়ার্টারে?

হ্যাঁ, তিনি ছিলেন ধর্মানুরাগী এবং একই সঙ্গে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ; তিনি যখন সৈয়দপুরে চাকুরীরত ছিলেন, অসাধারণ সংকল্পের জোরেই নাইট কলেজে পড়াশুনো করে বি.কম. প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

কিন্তু সময়টা ভিন্ন, একেবারেই অন্যরকম। তিনি রাজনীতির সাথে কোন সংস্রব রাখেন না সত্য, কর্তব্যনিষ্ঠায় তিনি অবিচল সত্য, খোদার কাছে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সোপর্দ করে দিতে চাইছেন সত্য, কিন্তু সময়ের ডাক এড়িয়ে যাওয়া যায়?

একাত্তরের ২৫ শে মার্চ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কাছেই বগুড়ার শান্তাহারে কিছু বাঙালি কর্তৃক ব্যাপক বিহারী নিধন চলছে। এ খবর প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করে পার্বতীপুরে, কারণ এখানেও শান্তাহারের মতই ব্যাপক বিহারী আবাদ ঘটেছিল, পাকিস্তানি জান্তার সহায়তায় তারা স্থানীয় বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের (শান্তাহারে যারা সংখ্যালঘু হিসেবেই বিবেচিত ছিল) উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সর্বশক্তি নিয়ে!

চোখের সামনে এমন নির্যাতন ভীষণ দগ্ধ করছিল তাকে! এমনকি তার অধস্তন রেলের অনেক কর্মচারীও এই নির্যাতনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছিল না। কয়েকজন কর্মচারীর মধ্যে প্রতিশোধের আগুন গনগন করে উঠে, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে তারা। কিন্তু যুদ্ধে গেলে তাদের পরিবারগুলির কি হবে? তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলবে না পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, বিহারী এবং শান্তির কমিটির সদস্যরা?

ভীষণ চিন্তার পড়ে ঐ যুদ্ধ-গামী তরুণেরা শরণাপন্ন হলেন তার। এই অবস্থায় তিনিই দিতে পারেন তাদের যুদ্ধে যাওয়ার ছাড়পত্র। তিনি শুধু স্থানীয় রেলের সবচেয়ে বড় বাঙ্গালী বাবুই নন, তার আছে দাড়ি এবং জোব্বা এবং সর্বোপরি, অনেক বড় একটি বাংলো, যেখানে তাদের রেখে যাওয়া পরিবারের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত হতে পারে!

ঐ যে সময়টা বড্ড অন্যরকম! আর তার ডাক! তিনি তার স্ত্রী এবং ৪ পুত্রকন্যার জন্য মাত্র একটি ঘর রেখে বাকী ৬ টা ঘরই দিয়ে দিলেন আশ্রিতদের জন্য।

খবর চাপা থাকে না। এটিও থাকল না, বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন রাজাকার আর বিহারীরা খবরের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে সবখানে, শুঁকে বেড়াচ্ছে আগাপাছতলা এঁটো! বিহারীরা তাকে কয়েকবার ওয়ার্নিং দিয়ে গেল।

কিন্তু কানই দিলেন না তিনি। বরং আশ্রিতদের সেবায় পরিপূর্ণ নিয়োগ করলেন সস্ত্রীক। হয়ে উঠলেন তাদের অঘোষিত অভিভাবক। আসলে তিনি তো খারাপ কাজ করছেন না। কিছু অসহায় লোককে আশ্রয় দিয়েছেন। আর আশ্রিতের সেবাই কি আল্লাহর ধর্ম না? তিনি মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকেন, এই দুর্যোগ থেকে, এই বিপদ থেকে আল্লাহ্‌ যেন সবাইকে পানাহ্‌ দেন! অতি দ্রুত!

সেদিনও এশার নামায পড়ার নিয়তেই বদনা থেকে পানি ঢালছিলেন, কিন্তু ওযুটা সম্পূর্ণ করার আগেই কয়েকজন বিহারী অস্ত্র-শস্রে সজ্জিত হয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে, তাদের সাথে যেতে বলল, মেজর সাহেব নাকি ডেকেছেন।

তিনি আল্লাহ্‌র কাছে তো আগেই সমর্পণ করেছেন নিজেকে, তাই উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না তার মধ্যে, শান্তভাবে জবাব দিলেন, ‘একটু অপেক্ষা কর, নামাযটা পড়েই আসছি’।

নামাযের বিরতি দেয়ার সময় নেই উন্মত্ত বিহারীদের, এক অত্যুৎসাহী বিহারী তার গালে বেয়নেট চার্জ করলে স্রোতের মত রক্ত বেরুতে লাগল!

রেলে তখনও মাল বহনের জন্য কিছু কয়লার ইঞ্জিন ছিল। টেনে হিঁচড়ে তাকে তোলা হল এঞ্জিনে।

কি সাধনা, কি শ্রম দিয়েই না ইঞ্জিনিয়ারিং শিখেছিলেন। রেলেও অনেক বছর ছিলেন তিনি। ইঞ্জিন নিয়েই কাজ করতেন। কিন্তু কখনো কি ভেবেছিলেন? ইঞ্জিনের সুক্ষাতিসুক্ষু যন্ত্রপাতির মধ্যে ঢুকে পড়বেন?

বয়লারের ফায়ার-প্লেস দাউ দাউ করে জ্বলছিল! যখন একজন বিহারী ঢাকনাটা সরিয়ে দিল, গনগনে আগুনের আঁচে কাছে দাঁড়ানো পর্যন্ত যাচ্ছিল না! তাই খুব দ্রুত কাজ সারতে হয়েছিল বিহারী দলটিকে। তার মাথাটি ফায়ার-প্লেসের কাছে ঠেলে দিয়ে মুহূর্তেই নিক্ষেপ করা হল কুণ্ডের মধ্যে। তার স্ত্রীও কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গী হবেন তার, একই কুণ্ডে! ঢাকনাটি অবশ্য দুজনকে ঢোকানোর পর আবার টেনে দেয়া হয়েছিল! ভেতরে পুড়ছিলেন আলাহ্‌র কাছে নিজেদের পূর্ণাংগ সোপর্দ করা দুজন নরনারী!

যখন এমন অগ্নিপরীক্ষা ঘটছিল রেলের বাঙালি প্রকৌশলী সৈয়দ সরওয়ার আলম সোহরাব ও তার স্ত্রী আঞ্জুমা বেগম রানুর, তখন সেই আগুন নিশ্চয়ই শীতল হওয়ার নির্দেশ পেয়েছিল, আর ঐ আশ্রিত মানুষগুলোর অশ্রধারা টলটল করে পড়ছিল সেই ফায়ার-প্লেসের জ্বলন্ত কুণ্ডে!

(দুজন শহীদ বুদ্ধিজীবির স্মৃতিকথা গল্পাকারে সাজানোর চেষ্টা হয়েছে মাত্র। )