চুমাচুমি আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট হিন্দুত্ববাদিদের ( সঙ্গে দোষর বাংলাদেশের জামাতি) গঙ্গাজল পূত গালাগালি দেখে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ, রামমোহনের সতীদাহ উচ্ছেদ -সব ইতিহাসই চোখের সামনে ভেসে এল! সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের দুশ বছর হতে চলল-হিন্দুত্ববাদিদের গালাগালের ভাষা বদলাইল না !বিধবাদের পুনঃবিবাহ দেওয়ার অপরাধে বিদ্যাসাগরের মতন শ্রেষ্ঠ বাঙালীকেও অকথ্য গালাগাল এবং শারীরিক আক্রমনের শিকার হতে হয়েছে। বিরোধিতার নোংরা ভাষা এবং ভাব দুশো বছর বাদেও এক! দেশ, সমাজ রসাতলে যাবে! পাশ্চাত্যে যা শোভন, ভারতে তা হবে কেন? তখন বিদ্যাসাগরকেও আক্রমন করা হয়েছিল-আপনি কি আপনার মায়ের বিধবা বিবাহ করাবেন?? আজকে এদের ভাষাটা-আপনার মা-বাবা যদি প্রকাশ্যে চুমু খায় আপনি কি সমর্থন করবেন??
Kiss of Love, Kolkata

হিন্দুবাদিদের হনুমানুত্ব দুশো বছরেরও বদলাইল না । ইতিহাস যেমন বিদ্যাসাগরের বিরোধি শোভাবাজার রাজাবাড়ির রাধাকান্ত দেবকে আস্তাকুঁড়ে ফেলেছে-আজ যেসব উগ্র বা ছুপা হিন্দুত্ববাদি ছেলে মেয়েদের প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার বিরুদ্ধে গর্জাচ্ছেন-তাদের জন্য ইতিহাসের অন্ধকার কূপই বরাদ্দ।

তবে ভারতে হিন্দু ধর্ম এবং সমাজের সংস্কারের ইতিহাস বেশ কিছু দুর্ভাগ্যেরও। বিংশ শতাব্দির শুরুতে মহামান্য গোখলে এবং রানাডে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স বারো করতে আইন সভাতে বিল আনার চেষ্টা করতেই উগ্র হিন্দুত্ববাদি বাল গঙ্গাধর তিলকের দলবল দাঁত নখ খুলে বেড়িয়ে আসে। কংগ্রেসে সেই সময় বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে যে ভ্রান্ত হিন্দু জাতিয়তাবাদির আন্দোলনের শুরু হয়, তার বর্তমান ধারা হচ্ছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদ। এসব জাতিয়তাবাদ, দেশ গৌরব, সংস্কারের পেছনের গল্প একটাই-মেয়েদের পুরুষতন্ত্রে আটকে রাখা।

চুমু খাওয়ার এই আন্দোলনটাকেও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একধাপ প্রগতি হিসাবে না দেখার কোন কারন নেই ।

ঋত্বিকের মেঘে ঢাকা তারার নীতাকে মনে পড়ে? সেই নীতা-সেই বাঙালী মেয়েটা যে সংসারে দিতে দিতেই, তার জীবন, তার নিজের জীবন যৌবন সব শেষ। হিন্দুত্ববাদিদের মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, তারা চাইছে মেয়েরা সবাই নীতা হোক-তারা নিজেদের মানবী না দেবী হিসাবে ভাবুক! নীতারা একই সাথে সংসার ইঞ্জিনের কয়লা এবং বাস্প-পুরুষ শুধুই সওয়ারী। সেই দেবী নীতারা প্রকাশ্যে চুমু খেলে, ইঞ্জিনের কয়লা এবং বাস্প কোথা হইতে আসিবে?

পূর্ব বাংলা থেকে উঠে আসা উদ্বাস্তু মেয়েরা সবাই এককালে মেঘে ঢাকা তারার মতন সংসারের ঘানি টেনে গেছে-গেছে বলেই হয়ত আমাদের মতন একটি প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত নব্য সমাজ উঠে এসেছে দেশ বিভাগের শত অভিশাপের পরেও। কিন্ত তাদের মেয়েরাও নীতার মতন নিবেদিতা হবে, মানবীর মতন তাদের কামনা বাসনার পেছনে ছুটবে না – এসব আহাম্মকি, পশ্চাৎপর চিন্তা।

আমি নিজে খুব বেশী লিব্যারাল নই -চাইল্ডলেস বাই চয়েস এসব লিব্যারাল দৃষ্টিভংগীকে সমর্থন করি না। কারন লিব্যালার বা রক্ষনশীল যাইহোক না কেন, সমাজের প্রতি সবার একটি নুন্যতম দায়বদ্ধতা থাকতেই হয়। জন স্টুয়ার্ট মিলের লিবার্টি বা ব্যাক্তি স্বাধীনতার সীমানা সেখানেই শেষ হয়। লিব্যারালিজম যদি সমাজের নুন্যতম দায়বদ্ধতার বিরুদ্ধে যায়-(সন্তান ধারনটাকে আমি নুন্যতম দায়বদ্ধতার মধ্যেই ফেলি) -আমি তার বিরুদ্ধেই থাকব। তবে এসব জোর করে চাপানোরো আমি বিরুদ্ধে। একজন নারীর শরীর তার একান্ত। সে কি সিদ্ধান্ত নেবে তার ব্যাপার। আমি শুধু আমার মত প্রকাশ করতে পারি, বিরক্তি প্রকাশ করতে পারি-কিন্ত জোর করে কোন মেয়ের ওপর সেই সিদ্ধান্ত চাপাতে পারি না ।

কিন্ত চুমুর বিরুদ্ধে কেন? চুমু ভালোবাসার একটি পবিত্র প্রকাশ। আমেরিকাতে রাস্তাঘাটে পার্কে তরুন তরুনীদের চুমু খেতে দেখলে মন বেশ ভাল লাগে। এতে সমাজের কোন ক্ষতি হচ্ছে না – বরং আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে যে জোর করে নীতা বানানোর চেষ্টা করা হয়- চেষ্টা করা হয় মেয়েটির প্রতি মা, বোন ইত্যাদি স্টিকার এঁটে-তাকে দেবী বানিয়ে-ফাইনালি সেই ইঞ্জিনের কয়লা আর বাস্প বানানোর গল্পের হারিকাঠে মাথা দিতে-তার থেকে এটা মুক্তির একটা ধাপ।

আমি জানি পশ্চিম বঙ্গের অর্থনৈতিক এবং শিল্পের উন্নতি না হলে প্রগতির কথাবার্তা না বলাই ভাল। কিন্ত চুমু খেলে শিল্প স্থাপনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতিই তৈরী হবে। কারন শিল্পোন্নত সমাজের জন্য ব্যক্তি স্বতন্ত্র্যবাদের দরকার। সরকার বা সরকারী দলগুলির গুন্ডাগর্দি শিল্প স্থাপনের অন্তরায় নয় কি?

এই ধরনের চুমু আন্দোলন অবশ্যই সরকারি উর্দি এবং বেউর্দি ধারি গুন্ডাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। যা ব্যক্তি স্বাধীনতাকেই সুরক্ষিত করবে। আর ব্যাক্তিস্বাধীনতা শিল্পোন্নত সমাজের প্রাথমিক শর্ত।