পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের একটা কপি গতকালই অফিসের বাবুর কাছ থেকে চেয়ে এনেছে ত্রিনয়ন। অষ্টম শ্রেণী পাশ ত্রিনয়ন পাড়ার সবথেকে শিক্ষিত এটা জাহির করাই তার উপন্যাস পড়ার মূল উদ্দেশ্য। উপন্যাসের নিগুঢ় অর্থ তাকে নাড়া দেয় না, তা কিন্তু না। উত্তাল পদ্মার মতো তার শরীরের নিম্নাঙ্গও সমান উত্তাল হয় যখন—কপিলা বাঁশের কঞ্চির মতো উপন্যাসের পাতায় পাতায় হেলে পড়ে, যখন মালার শরীরে সন্তান ধারণের গোপন প্রক্রিয়া বান ডাকে, যখন রাসু নির্জন দুপুরে গোপীর হাত ধরে টানাটানি করে। “এই না হলে উপন্যাস!”—ভাবে ত্রিনয়ন। তবে কি বোদ্ধা পাঠকের মতো সে’ও ঘাবড়ে যায় কপিলাকে সরলীকরণের বৃত্তে বাঁধতে গিয়ে। কপিলার ভয়ঙ্কর উষ্ণ অচেনা গভীরতায় হারিয়ে যেতে চায় সে’ও—হারিয়ে যেতে চায় উত্তাল পদ্মার তাল ভাঙ্গা ঢেউয়ে দোল খাওয়া কুবের মাঝির নৌকার ছাউনির আড়ালে—বাঁধ সাধে বাসন্তী’র আর্তনাদ। বাসন্তী—শম্ভুর বৌ। পাশের ঘরেই থাকে। তিন বছর হল শম্ভুর ঘর করছে, বিয়ের ফুল বছর না ঘুরতেই শুকিয়ে গেছে—ভিজে ভরে উঠেছে বাসন্তীর তলপেট। মাস কয়েক ওখানটার তরল অক্সিজেনে নিঃশ্বাস নিয়ে—লাফিয়ে বেড়িয়েছে একটা আস্ত কাতলা মাছ। বছর দুয়েক হয়ে গেছে ওটা লেজ হারিয়ে শম্ভুর জবা—ফুল গাছের বেড়া দেয়া উঠানে দু’ পায়ে হেঁটে বেড়ায়। শম্ভু সপ্তাহে দুই—দিন হাটবারে মজিদ কোম্পানির তেলের দোকানের পেছনে শূকরের মাংস বেঁচে। ডোম-আর সাঁওতাল পাড়ায় ওটা ভালো চলে। “শুঁয়োয়ের কারাবার করতে করতে মাগীর ব্যাটার স্বভাব’ও হয়ে গেছে শুঁয়োয়ের মতো নোংরা!—ভাবে ত্রিনয়ন। রাত আট’টা না পেরুতেই চলে যায় সাঁওতাল পাড়ায়,—ভরপেট বাংলা মেরে, চোখ লাল করে অন্ধকারে চলে যায়, বাজারের উত্তরের খারাপ পাড়ায়। সংসারের প্রতি আত্মিক টান শম্ভুর সামান্য—বললেও ভুল বলা হবে। প্রথম যৌবন থেকেই শম্ভু বহুগামি। বিয়ে না করা পুরুষ নপুংসক—বন্ধু মহলের এই নির্মম অপবাদ গায়ে মাখার লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পেতেই বাসন্তী’র কপালে সিঁদুর দিয়েছে শম্ভু। সন্তান প্রজননের ভার চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও শরীরের ডাকে সাড়া দিতে তাকে ছুটে যেতে হয় বেশ্যা পল্লীতে। বাজারের মেয়েছেলেদের সোনা—লক্ষ্মী ডেকে মাঝরাত অব্দি ফুর্তি করে টলতে টলতে ঘরের দরজায় লাথি মেরে বৌকে জানায় শেষ রাত্তিরের ভালোবাসা—“মাগী দরজা খোল! ভিতরে তোর কোন ভাতার লুকাইয়া রাখসস? সহ্য করতে শিখে যাওয়া আর নির্লজ্জতার মধ্যে যে গোপন সম্পর্ক আছে—তা বোধ করি এই পাড়ায় বাসন্তীর চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝতে পারে না। তবু মাঝে মাঝে, বলা যায় আফিমের নেশায় হুস হারিয়ে বাসন্তী নিজের সত্যিকারের পরিচয় দিতে চায়। কোন এক কালে বাসন্তীর ঠাকুরদা মাছ মারা চল দিয়ে মেছো বাঘ মেরে এলাকায় কতকটা বাহাদুরের স্বঘোষিত সম্মান পেয়েছিলো। শম্ভু’কে মুখ ঝামটা মেরে মাগী বাড়ি ফিরে যেতে বলার দুঃসাহসিক বাঘ—মারা বাহাদুরি ডাঙ্গায় তোলা মাছে’র মতো ঘরের কোনায় হামাগুড়ি খায়, তল পেটে দু’ঘা লাথি খেয়ে। নিত্য এই চাঁদ সূর্যের পালা বদলের খেলায় বিরতি আসে যেদিন সাঁওতাল পাড়ায় বাংলার সঙ্কট পড়ে, লাল চোখ না করে খারাপ পাড়ার লাল—নীল বাতির অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বড় একটা শান্তি বোধ করেনা শম্ভু। সেদিন বাসন্তী’র টানটান শরীরের নেশায় বুদ থাকতে হয় তাকে। ঘরে ফিরেই সন্তানের ঘুমন্ত মুখের দিকে না তাকিয়েই বাসন্তীর অনিচ্ছায় মেলে দেয়া অভুক্ত আগ্নেয়গিরিতে ডুব দেয় শম্ভু। শম্ভুর গায়ের ঘাম, খাঁড়া পশমের সাথে লেগে থাকা শূকরের লোম, সাঁওতাল পাড়ার বাংলা’র গন্ধ, মাগীদের সস্তা স্নো—পাউডারের সূরভি আটার দলার মতো মিলে মিশে বাসন্তী’র শরীরের ঘামের গন্ধকে মলিন করে দেয়—“শুয়োরের লগে রাইত কাটাই”—ভেবেই হাসি—কান্নার শীৎকারে মেতে ওঠে বাসন্তী। “চুপ যা মাগী, লোক ডাকাবি নাকি?”-ঘোৎ ঘোৎ করে ওঠে শম্ভু। তবু কলিজা কামড়ে ধরা আর্তনাদ থামায় কার সাধ্য?
বাসন্তী’র চামড়া—মাংসের রাজ্য দখলের একপেশে যুদ্ধের সাক্ষী থাকে ভাঙ্গা খাট আর ওপাশের রাত জাগা ত্রিনয়ন। কাছের প্রতিবেশী বলে কথা! বলে রাখা ভালো ত্রিনয়ন বাসন্তী’র প্রেমে পাগল। বাসন্তী’র শরীরে আফিমের নেশা তার দিবাস্বপ্নে দেখা—কপিলার কাদার মধ্যে ছেড়ে দেয়া জল—ল্যাপটানো ভেজা শরীর। সুঢৌল নিতম্ব, উঁচু বুক, গলার নীচে চামড়ার ভাজ গুনতে শিখে গেছে সাহিত্য রসিক শিক্ষিত ত্রিনয়ন। শম্ভুর রসুই ঘরের পেছনে হোগলা পাতার জঙ্গলের ধারে সকালের প্রথম সূর্য উকি মারে—সে উত্তাপে সদ্য জলে নেয়ে আসা বাসন্তী শুকোতে দেয় কাল রাত্তিরে’র যুদ্ধক্লান্ত ঘামে-জলে ভেজা শাড়ী। দাঁত মাজার ছলে উঁকি দেয় ত্রিনয়ন’ও। মানিক বাবুর নতুন বইটার মতোই আনকোরা বাসন্তী’র শরীর—কাঁচা গন্ধ মাখা, শম্ভুর বাড়ির সীমানা প্রাচীর হয়ে থাকা সকালের টাটকা জবার মতো রঙিন—লাল। “এ শরীর থুয়ে শম্ভু মাগীর ব্যাটা বাজারের মেয়েছেলের নাভির তলে পড়ে থাকে!”—ভাবে ত্রিনয়ন। মাঝে মাঝে বাসন্তী’র জন্য একটু কষ্ট হয় বৈকি ত্রিনয়নের, তবে সে কষ্ট ধুয়ে যায়, তার সম্ভাবনার কথা ভেবে। নিজের দুর্বলতার কথা বাসন্তী’কে জানাতে বাকি রাখে’নি ত্রিনয়ন। হোগলা জঙ্গলের ধারে, মালি বাড়ির কলতলায়—আর যেখানেই নির্জন পেয়েছে সেখানেই বাসন্তী’র কাছ ঘেঁষার সুযোগ সে নিয়েছে। বাসন্তী বড় একটা পাত্তা না দিলেও—শম্ভুর কানে লাগায় নি। নিজেকে কখনো কবের মাঝির মতো দক্ষ, কখনো রবি’ বাবুর অপুর মতো শিক্ষিত—করে বাসন্তীর সামনে দেখাতে চেয়েছে; কতটা পেরেছে সে এক বাসন্তী’ই জানে। শরীরের মতো মুখটাও সারাদিন কালো করে রাখা বাসন্তী—ত্রিনয়নের জন্য সে এক বড় বিস্ময়! কপিলার দাবার ছকে হাতি—ঘোড়া মারা যায়, তবু বাসন্তীর মনের সাদা—কালো দাগ চেনাই দায় ত্রিনয়নের জন্য। “অফিসের বড় বাবুকে বলে দিনাজপুরে বদলি হয়ে গিয়েছি বাসন্তী, যাবি আমার লগে?’’—বাসন্তী’র কোন ভাবান্তর হবে না জেনেও বলে যায় ত্রিনয়ন। “তুই মেসে ভাত রান্দবি, আমি অফিসে কাম সাইরা—রাইতে তোরে নিয়া নাইট শো দেখমু! যাবি আমার লগে? সুখে রাখুম তোরে!”—কল্পনায় বাসন্তীর শাড়ীর তলে সুখ আঁকতে শুরু করে দেয় ত্রিনয়ন। ত্রিনয়ন শম্ভুর চেয়ে ভিন্ন কেউ না, শম্ভুর মতো সেও বাসন্তীকে একটা শরীর ভিন্ন কিছু ভাবতে পারে নাই, তবু ত্রিনয়ন শিক্ষিত! খারাপ মেয়ে লোকের ঘরে যায় না, সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে মদে চুর হয়ে থাকে না। “কখন নিবা আমারে?”—বাসন্তীর কথায় কুবের মাঝির নৌকার পাল ছিঁড়ে যায়! দমকা বাতাস উঠে মাঝ পদ্মায়, কাঁপতে থাকে নৌকার পাটাতন—ত্রিনয়নের বুক। আজ রাইতে। তোর স্বোয়ামী ফিরার আগে, কি কস বাসন্তী?—কপিলাকে বড় তুচ্ছ মনে হচ্ছে তার বড়। এ কোন বাসন্তী? বাসন্তী কোনোদিন তার একটা কথার জবাব দেয়নি। করুনার দৃষ্টিতেও তাকায়নি তার প্রেমিক মনের দিকে। সে বাসন্তী আজ তার এক ডাকে ঘর ছাড়তে প্রস্তুত? ত্রিনয়নের সাহিত্য পড়ার সার্থকতা যেন এখানেই! নিজের ভেতর সদ্য শেষ করা রবি ঠাকুরের “হৈমন্তী” গল্পের নায়ক অপুর গর্বিত পদচারনা টের পায়, অপুর মতো করে তার মনও বারবার করে বলতে চায়—“আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম, তাহাকে আমি পাইলাম!” তবু অষ্টম শ্রেণী পাশ শিক্ষিত বিবেক জানতে চায়—“তোর সাওয়াল টার কি হবেরে বাসন্তী? ওরে নিবি লগে? আমি পালুম নিজের পোলার মতো কইরা!” “না! নিমুনা, অয় থাক ওর বাপের লগে।” “ক্যান! নিবিনা ক্যান?”—অবাক বিস্ময়ে জানতে চায় ত্রিনয়ন। উত্তর দেয় না বাসন্তী, হেঁটে পেরিয়ে যায়—মালী বাড়ির কলতলা—হোগলা পাতার জঙ্গল—ত্রিনয়নের আসমান—জমিন বুক! ত্রিনয়ন তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকে অদৃশ্য পায়ের ছাপের দিকে।
কৃষ্ণপক্ষের রাত! হারিয়ে যাবার রাত—তলিয়ে যাবার রাত। আদিম উৎসবে মেতে উঠার রাত। সাঁওতাল পাড়ায় বিয়ের উৎসব। ডাক—ঢোল বেজে চলেছে, বাজনার তালে তালে চলছে লাঠি নাচ। মাতাল হয়ে আছে মানুষ গুলো—মাতাল হয়ে আছে বাতাস আর কৃষ্ণপক্ষের রাত। ত্রিনয়ন দাঁড়িয়ে আছে। বাসন্তী আসবে। বাসন্তী কথা দিয়েছে। বাসন্তী ঘর করবে—ঘর ভেঙ্গে। নির্ভয়—বড় সাহসী ত্রিনয়ন—অহঙ্কার শরীর ভেদ করে বেরিয়ে আসতে আসতে দাড় করিয়ে দিচ্ছে শরীরের প্রতিটি লোম। কপালে ঘাম জমছে—যুদ্ধ জয়ের দামামা বাজছে বুকের ভেতরে। সিংহ বাড়ীর সীমানার শেষ কাঁঠাল গাছটার অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো বাসন্তী। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে—যেন কোন তাড়া নাই—কোন সঙ্কোচের লেশ মাত্র নেই। “চলো আগাই”—বাসন্তীর নিরুত্তাপ স্বরে নিশাচর বাদুড়’ও পথের দিশা হারিয়ে দিক-বিদিক ছুটতে শুরু করলো। স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো ত্রিনয়ন। রাত এগারোটার লোকাল ট্রেন ধরতে হবে। বাসন্তীর এক কাপড়ে ঘর ছাড়া তাকে বিচলিত করে দিয়েছে। নিজের ভেতর এক ধরনের অনভিপ্রেত চাপ অনুভব করতে শুরু করেছে সে। “একখান কাপড়ও আনলি না বাসন্তী?”—অনেক কষ্টে কথাটা মুখ দিয়ে বের করলো ত্রিনয়ন। “মাইয়া মাইনসের শরীর লইয়া ঘর করবার চাও, আর হেই শরীর ঢাকবার দুইখান কাপড় কিন্যা দিবার মুরোদ নাই তোমার?”—বলেই হেসে ফেলে বাসন্তী। অপমান বোধ করার পর্যায়ে নেই আর সে—ভয় লাগছে ত্রিনয়নের। আগুনে ঝাপ দেবার ভয়। যমুনার উত্তাল কালো জলে গা ধোঁয়ার ভয়। নিজেকে গুছিয়ে নিতে আপ্রান চেষ্টা করছে সে, কিন্তু পারছে আর কই? সব তাল পাকিয়ে যাচ্ছে—মানিক বাবুর উপন্যাসের মতো, বড় নির্মম লাগছে বাসন্তীর সঙ্গ!
পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে ত্রিনয়নের। তবু পথ চলতে হবে। ফিরে যাবার পথ পেছনে প্রতি পদক্ষেপে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে—মিলিয়ে যাচ্ছে মাড়িয়ে আসা ধূলার সাথে সাথে। “তোর ছাওয়াল টারে লইয়া আইতে পারতি বাসন্তী। আমি কইলাম না অরে পালবাম।” “নদীতে বান ডাকলে ইলিশের ঝাঁক বানের টানে আপনা থেকেই আসে?”—এখনো নিরুত্তাপ বাসন্তী। কিছুই বুঝতে পারছে না ত্রিনয়ন। তার উপন্যাস পড়া শিক্ষা এর বেশী কূলকিনারা করতে পারছে। তার দৃষ্টি এ আন্ধকার পথের শেষ দেখতেই ঝাপসা হয়ে আসছে—তার শিক্ষা তাকে শুধু বলে দিতে পারছে বাসন্তী’র সাথে ঘর করা শরৎ বাবুর উপন্যাসের মতো সরল না। এ বড় জটিল এক খেলা—বেঁচে থাকার আলো আঁধারি লুকোচুরি খেলা। এ খেলায় ত্রিনয়নের দৃষ্টি শুধু ঝাপসা হয়েই আসবে বারেবার, শম্ভু রাতের পর রাত কাটাবে বাজারের উত্তরের রঙিলা পাড়ায়—আর বাসন্তীর দৃষ্টি মালী বাড়ীর কলতলা—হোগলা পাতার জঙ্গল কিংবা সিংহ বাড়ীর সীমানার শেষ কাঁঠাল গাছটার ছায়া পেরিয়ে বহুদূর কোন গন্তব্যের পথে নিরন্তর হেঁটে যাবে। ছুটে চলবে সে পথে যে পথে পেছন বলে কিছু নেই।