পর পর দুটি চমৎকার খবর শুনে মনটা ভাল হয়ে গেল। দুটিই বিয়ের খবর। সাধারণত বিয়ের খবর শুনে উত্তেজিত বা উৎফুল্ল হবার মানুষ আমি নই। কিন্তু এ বিয়েগুলো অন্যরকম। এগুলো বিজাতীয়, সংকর। মুসলমান পরিবারের মেয়ে, হিন্দু পরিবারের ছেলে। দুটোই। ক্যানাডা-আমেরিকাতে সচরাচর যা হয়না। সচরাচর হয় শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে। কিন্তু হিন্দুর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক, যাদের আমরা উঠতে-বসতে মালাউন, কাফের আর নাপাক বলে গালাগাল করতে অভ্যস্ত, তাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া? সেটা কি করে হয়।
প্রবাসের শিক্ষিত পরিবারে অবশ্য বিয়ে দেয় না কেউ কাউকে, বিয়ে হয়। ছেলেমেয়েরাই বাছাই করে নেয়। তারপর বাবামায়েরা উপায়ান্তর না দেখে তাতে সম্মতি দেন, যদিনা তারা মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানী বাবামায়েদের মত উগ্রপ্রকৃতির হন। আজকাল এসব সংকর বিয়েগুলোতে আরো একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে—-বাবামায়েরা জোরজবরদস্তি করে ওপক্ষের ছেলে বা মেয়েটিকে কলমা পড়িয়ে ‘মুসলমান’ বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন না। ‘চালাচ্ছেন না’ ঠিক নয়, চালিয়েও লাভ হচ্ছে না। প্রথমত ছেলেমেয়েদের আপত্তি। তাদের চোখে এটা অত্যন্ত অপমানজনক প্রথা। অপরপক্ষের অভিভাবকরা তো একই দাবি তুলতে পারেন। এটা ইউম্যান রাইটসের দেশ—-ধর্মের নামে ছেলেমেয়েদের ওপর জোরজবরদস্তি চলবে না। আমি এক মৌলবিসাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অতীব তাহজিবের সাথেঃ আচ্ছা হুজুর বলুন তো, একটা হিন্দুঘরের মেয়ে প্রেমের খাতিরে কলমা পড়ে স্বামীর ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেল। ঠিক আছে, মেনে নিলাম, সে একটি মুসলিম পরিবারের বৌ। কিন্তু খোদা না করুণ তাদের বিয়েটা একসময় ভেঙ্গে গেল, যা বর্তমান যুগে অহরহই হচ্ছে, তাহলে কি বৌমা তার পৈত্রিক ধর্মতে ফিরে যেতে পারবে? মৌলবিসাহেব সজোরে মাথা নেড়ে বললেনঃ ‘না, তা সম্ভব নয়। একবার কলমা পড়ে মুসলমান হলে অন্য ধর্ম গ্রহণ করা কবিরা গুনাহ। তারা ধর্মত্যাগী। অ্যাপোস্টেট। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ’। শুনে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল।

মুসলিমপ্রধান দেশে প্রেমে পড়াটা এমনিতেই একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, তার ওপর বিজাতীয় প্রেম হলে তো সোনায় সোহাগা। মনের আদানপ্রদান করতে গিয়ে জান নিয়ে টানাটানি তখন। কোন কোন ক্ষেত্রে বাবামা হয়ত মত দিয়ে দেন বিয়েতে, কিন্তু মুসলমান হতে হবে এই শর্তে। তারা নিজেরা হয়ত নামাজরোজা কোনটাই করেন না, কিন্তু বৌমাকে, বা দুলামিয়াকে, কলমা পড়ে মুসলমান হতে হবে। বাবামা যত উদারমনা মানুষই হন এই ধর্মান্তরিতকরণের ব্যাপারে তাদের কোনও হাত নেই। সমাজে থাকতে হলে সেটা করতেই হয়। আধুনিক প্রগতিশীল বাবামা যে আমাদের দেশে নেই তা নয়, প্রচুর পরিমাণেই আছেন, এমনকি পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মত অভিশপ্ত দেশগুলোতেও আছেন, কিন্তু তাঁরা তাদের ছেলেমেয়েদের মতই অসহায়। ধর্মের বিধান অমান্য করতে গেলে তাদেরই বিপদ।
পশ্চিমের কথা আলাদা। সেখানে তরুণ ছেলেমেয়েদের প্রেমে পড়াটা কেবল স্বাভাবিকই নয়, সেটাই নিয়ম। সমাজ এবং ধর্ম দুয়েরই পুরোপুরি সমর্থন রয়েছে তাতে। না-পড়াটাকে অভিভাবকরা উদ্বেগের সাথে দেখতে শুরু করেন একটু বয়স হলেই—-মেয়ের কি হল, বয়ফ্রেণ্ড হচ্ছে না কেন এখনো? আমাদের ছেলে কি এতই কুৎসিৎ যে কোনও মেয়ে তাকাচ্ছে না তার দিকে? আমাদের প্রাচ্য কালচারে ঠিক তার বিপরীত। মেয়ের বয়ফ্রেণ্ড? তার মানে পরিবারের মান ইজ্জত সব গেল। মুসলমান ঘরের কিশোরী আর যুবতীদের মুখ যাতে কেউ দেখতে না পারে বাইরে থেকে সেজন্যে কতপ্রকার আয়োজনই না করা হয় ঘরে ঘরে। রাখঢাক করে চলবে, একা একা বাইরে যাবে না, যেতে হলে বাবা বা ভাইদের সাথে যাবে, হিজাব পড়বে সবসময়, চোখ নিচু করে হাঁটবে, ইত্যাদি। ছেলেদের বেলায় কড়াকড়িটা একটু কম, তবে বিয়েশাদীর ব্যাপারটা পুরোপুরিই অভিভাবকদের হাতে, সেখানে দুলা বা দুলহিনের মতামতের খুব একটা মূল্য নাই। সমাজ, তথা ধর্ম, যা বলবে তা’ই করতে হবে তোমাকে। ধর্ম ও সামাজিক প্রথা, দুয়ের মূল উদ্দেশ্যটা তো একই—-মানুষকে বিভক্ত করে রাখা। এই ধর্মভিত্তিক বিভক্তি প্রাগৈতিহাসিক যুগের গৌত্রিক বিভক্তির একটা নতুনতর সংস্করণ ছাড়া কিছু নয়। সেহিসেবে মানুষ আদিযুগের তুলনায় খুব একটা অগ্রসর হয়নি। বিভক্তি জিনিসটা আসলে আমাদের অস্থিমজ্জার ভেতরে প্রবেশ করে গেছে। যেখানে বিভক্তি নেই বা থাকার কথা নয় সেখানেও আমরা বিভক্তি স্তৃষ্টি করি। সেকারণেই হয়ত পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত বিভক্তিমুক্ত দেশে অভিবাস গ্রহণ করার পরও আমরা ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্যে সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকি।

কোন কোন গোঁড়া মুসলমানকে আমি দেখেছি যারা অমুসলমানদের সঙ্গে সাধারণ সৌজন্যমূলক করমর্দন করতেও ইতস্তত করেন। তাদের বাড়ির মেয়েরা কস্মিনকালেও কোনও পরপুরুষের সাথে হাত মেলাবেন না। তারা ভদ্রতার খাতিরে যদিবা কোনও ক্রিসমাস পার্টি বা থ্যাঙ্কসগিভিং পার্টিতে গিয়ে উপস্থিত হন, ভুলক্রমেও তারা সেখানে কমলার রস আর চা-কফি ছাড়া অন্য কোনও খাদ্যস্পর্শ করবেন না, পাছে কোন হারাম ঢুকে যায় তাদের পেটে। দৈনন্দিন জীবনে তারা হয়ত অহরহ হারাম খেয়ে যাচ্ছেন—যেমন ভূয়া দলিলপত্র দেখিয়ে শরণার্থীর স্ট্যাটাস আদায় করে নেওয়া, মিথ্যা কথা বলে সরকারি ভাতা আদায় করা, ট্যাক্স ফাঁকি দেবার মতলবে নগদ ব্যবসা করা—–অথচ একরত্তি শূকরের চর্বি যদি ভুলক্রমে মুখগহ্বরে প্রবেশ করে গেল, হয়ত একটা কেকের টুকরোতে বা ছোট একটা বিস্কুটের ভেতর, তাহলেই সর্বনাশ—-একলক্ষ সত্তুর হাজারবার তৌবা পড়ে তবেই রক্ষা। ব্যক্তিগতভাবে তারা যে কোনও অমুসলমানের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষের ভাব পোষণ করেন তা হয়ত নয়, কিন্তু তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি তাদের বাহ্যিক আচার আচরণের ভেতরে সেই ঘৃণা আর বিদ্বেষের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হল যে আমরা, মুসলমানরা, যখন একসাথে মিলে আড্ডা দিই তখন মুখর হয়ে উঠি আমেরিকানদের, বিশেষ করে ইহুদীদের, বর্ণবিদ্বেষ আর ইসলাম বিদ্বেষ যে কত উগ্র পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং সেকারণেই যে নির্দোষ নিষ্পাপ মুসলিম ছেলেমেয়েরা সহিংসতার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে, সেসব নিয়ে। ইউরোপ-আমেরিকাতে ‘হুয়াইট সুপ্রিমিস্ট’দের উপদ্রব আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এনিয়েও আমাদের উদ্বেগের অন্ত নেই। কিন্তু বলুন তো আমাদের মত সুপ্রিমিস্ট জাতি কারা পৃথিবীতে? আমাদের ধর্ম সব ধর্মের সেরা ধর্ম, এই দাবিটা জোরগলায় উচ্চারণ করে কারা? কাদের ধর্মগ্রন্থে পরিষ্কার লেখা আছে যে, আমাদেরটি ছাড়া, অন্য কোনও ধর্মের মানুষদের প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার দরবারে পৌঁছুবে না?(৩ঃ৮৫) কাদের মুখ থেকে বারবার উচ্চারিত হয় যে আমাদের ধর্মই একমাত্র নিখুঁত ধর্ম, আমাদের কাছে প্রেরিত পয়গম্বর মহানবী হজরত মোহম্মদ মোস্তফা (দঃ) হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ, মহান আল্লাতা’লার প্রিয়তম বান্দা? অতএব আমার সহধর্মবলাম্বীরা, আমাদের মুখে অন্যের নিন্দা ঠিক মানায় না।

মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের মগজ ধোলাই করা হয় কিভাবে তার উদাহরণ তো আমি নিজেই। জ্ঞান হবার পর যে-কটা জিনিস আমাকে শিখতে হয়েছে তড়িঘড়ি করে তার মধ্যে অন্যতম হল যে ইহুদীরা আল্লাতা’লার অভিশপ্ত জাতি। হিন্দুরা কাফের, মালাউন, মূর্তিপূজক, অতএব অতিশয় ঘৃণ্য জাতি। খৃস্টানরা মদখোর মাতাল, যীশুকে মনে করে আল্লাতা’লার পুত্র। তার মানে ঘৃণার দীক্ষা দিয়েই ছিল আমার যাত্রা শুরু। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ঠিক একইরকম উগ্র বিদ্বেষের কালচারে বেড়ে উঠতে হয় গোঁড়া ইহুদী আর গোঁড়া খৃস্টান পাড়ার ছেলেমেয়েদের। সম্ভবত অন্যান্য ধর্মের বেলাতেও ছবিটা প্রায় একইরকম কুৎসিৎ।

ছোটবেলায় স্কুলে পড়াকালে হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা প্রবেশ করানোর চেষ্টা চালানো হত আমাদের মনে। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র একজন মুসলিমবিদ্বেষী লেখক, কারণ তাঁর বইতে মুসলমানদের ‘ম্লেচ্ছ’ বলে গাল দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের বইতে মুসলমানদের ভূমিকা সবসময়ই চাকরবাকর বা চাষাভূষার চরিত্রে। ডি এল রায়ের ‘শাহজাহান’ নাটকে সম্রাট আওরঙ্গজীবের চরিত্রকে অত্যন্ত খাটো করে দেখানো হয়েছে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। মুসলমান জাতির চিরকালীন নালিশ-প্রিয় চরিত্রেরই একটি উদাহরণ ছাড়া কিছু নয়। আমরা ঐতিহাসিকভাবে ‘ভুক্তভোগী’র ভূমিকায় থাকতে পছন্দ করি। কোথাও কোনও মুসলমানের গায়ে বা আঁতে সামান্য একটু আঁচড় লাগামাত্র আমরা ‘ইসলাম বিরোধী’, ‘মুসলিম বিরোধী’ বলে চেঁচামেচি করতে শুরু করি, যেন আমরা কখনো কারো বিরোধিতা করার চেষ্টা করিনি। জানি কি বলবেনঃ পবিত্র কোরাণেই তো লেখা আছেঃ “আমরা সকলেই জানি অবিশ্বাসীরা কি বলছেন, কিন্তু তাদের ওপর কোনও জোরজবরদস্তি চালাতে নেই” (৫০ঃ৪৫)। বাহ, কি সুন্দর কথা। পরমতসহিষ্ণুতার প্রকৃষ্টতর উদাহরণ আর কি হতে পারে? কিন্তু দাঁড়ান এক মিনিট। ওটা ছিল মক্কায়, যখন মুসলমানদের অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিল না। তারপর মদিনাতে গিয়ে গায়ে-গতরে একটু তাগদ হবার পর কি বাণীগুলো প্রচার হতে লাগল সেটা শোনা যাক একবারঃ “হে বিশ্বাসীগণ, অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ কর তোমরা, তারা বুঝুক তোমরা কত কঠোর হতে পার” (৯ঃ১২৩)। তারপর (৯ঃ৫)এতে আছে আরো ভয়ানক কথাবার্তাঃ “মূর্তিপূজকদের যেখানে পাও সেখানেই বধ কর”। এখানে কি ইসলামিক ‘সহিষ্ণুতা’র একটা ভিন্ন রূপ প্রকাশ পাচ্ছে না?
যাই হোক, বঙ্কিম বাবুর ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটি যে আসলে কেবল মুসলমানদের বেলায় প্রযোজ্য নয়, বৃহত্তর অনার্যজাতির বেলাতেও, সেটা হয়ত তৎকালীন মুসলিম পাঠকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এদিকে মুসলমান একাধিক লেখকের লেখালেখিতে হিন্দুদের সম্বন্ধে নেতিবাচক উক্তি পড়েছি আমি নিজেই। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান আপত্তির কারণই হল এটা ‘হিন্দুর লেখা’! মুসলিম লেখকদের লেখা নাটক-উপন্যাসে কজন ‘হিন্দু’ চরিত্র দাঁড় করানো হয়েছে ভাববার বিষয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কয়টি হিন্দু-প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের হিন্দু নাম পরিবর্তন করে মুসলমান নাম রাখা হয়েছে ভেবে দেখুন। অতএব সাম্প্রদায়িকতার দায়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে সমষ্টিগতভাবে অভিযুক্ত করার আগে আমাদের নিজেদের মনোভাবটার কথাও কি ভেবে দেখা উচিত নয়? যুক্তির দিক থেকে উচিত মনে হলেও কি তা সম্ভব? আমরা যে ‘ভুক্তভোগী’ জাতি! নালিশ করার অধিকার তো কেবল আমাদেরই!

আমার এক বাঙালি মুসলমান বন্ধুর একমাত্র কন্যা একটি ইহুদী ছেলেকে বিয়ে করেছে। ইহুদীজাতির সাথে মুসলমান সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সম্পর্কটা যে খুব মধুর নয় সেটা তো সবারই জানা। ঐ যে বললামঃ ইহুদীরা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার অভিশপ্ত জাতি। আমি যতদূর জানি ইহুদী-মুসলিমের শত্রুতা দেড় হাজার বছরের পুরনো, হিজরি সালের গোড়া থেকে। তার বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যাবে পবিত্র কোরাণের বিভিন্ন ছুরাতে। বোখারি সাহেবের সহি হাদিস ঘাঁটাঘাঁটি করলেও বহু উদাহরণ পাবেন আপনি। সুতরাং ইহুদী ছেলের সাথে মুসলমান মেয়ের বিয়ে, এর চেয়ে জঘন্য খবর আর কি হতে পারে। এটা দেশে থাকলে একেবারেই সম্ভব হত না। মধ্যপ্রাচ্য আর প্যালেস্টাইনে হলে তো মেয়ের কল্লাটাই তরবারির নিচে চলে যেত। ক্যানাডা-আমেরিকাতেও যে কল্লা-কাটা যাচ্ছে না তা নয়, মাঝে মাঝেই অনার-কিলিংএর খবর শোনা যায় এখানে ওখানে। সৌভাগ্যবশতঃ বাংলাদেশী মুসলমানরা এখনো ততটা মনোযোগ দিচ্ছেন না মধ্যপ্রাচ্যের এই গৌত্রিক বর্বরাচারটির প্রতি। তবে আরবরা যে হারে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে, যেমন বাড়ি বাড়ি মেয়েদের হিজাব পরার হুজুগ, চিরকালের ‘খোদা হাফেজ’ বাদ দিয়ে ‘আল্লা হাফেজ’ বলা, ইনশাল্লাহ আর আলহামদুলিল্লাহ ছাড়া কোনও বাক্য ব্যবহার না করা (আজকাল কাউকে যখন জিজ্ঞেস করিঃ কেমন আছেন, তার জবাব আসে “আলহামদুলিল্লাহ”, বা “মাহশাল্লাহ”, যা থেকে মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝার উপায় নেই লোকটা ভাল আছেন বলে আল্লাকে শুকর জানাচ্ছেন, না ভাল না থাকার জন্যই জানাচ্ছেন। অর্থাৎ ভালমন্দ যাই থাকুন সবই আল্লার রহমত), তাতে অনার কিলিংএর আইডিয়াটাও একসময় ঢুকে যাবে কিনা আমাদের মধ্যে তার কোনও নিশ্চয়তা নাই। মনুষ্যজাতি অনুকরণপ্রিয় জাতি—-দেখাদেখি কাজ আমরা সবসময়ই পছন্দ করি, কারণ এতে মাথা খাটানোর কোনও প্রয়োজন হয় না, নিজের বিবেকবিবেচনা অনুসারে একটা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার পরিণাম ভোগ করার ঝামেলাও পোহাতে হয়না। সোজা কথায়, আমরা মেষজাতির প্রকৃতি অবলম্বন করে যেদিকে ভিড় সেদিকেই আমাদের যাত্রাপথ চিহ্নিত করে নেয়া নিরাপদ বোধ করি। অতএব আমরা, চিরকালের এই সুবোধ ও সুশীল বাঙালি মুসলমান জাতি যে আমাদের নবাগত আরব প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সহবাঙ্গালির কল্লা কর্তনের জন্য তরবারি ধারণ করব না কে বলবে সেটা।

যাই হোক আপাতত সেলক্ষ্মণ এখনো সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। অন্তত পশ্চিম জগতে এসে যারা মুক্ত জীবনযাপনের বিরল সুখ উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। (তবে অধুনা যেসব ভয়াবহ খবর প্রায়সই শোনা যাচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে তাতে তো দেখা যাচ্ছে যে দেশবিদেশের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অঞ্চল থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের সন্তানদের কেউ কেউ কিসের মোহে যেন সিরিয়া-ইরাকের তথাকথিত ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’বীরদের সাথে যোগ দিয়ে তরবারির সাহায্যে সমস্ত পৃথিবীকে অমুসলমান-মুক্ত করার সঙ্কল্প নিচ্ছে।) আমার একান্ত আশা যে আমাদের বাঙালি ঘরের ছেলেমেয়েরা ওই মধ্যপ্রাচ্যীয় বর্বরতার আকর্ষণে কখনোই প্রলুব্ধ হবে না। তারা বরং ওই হিন্দু-ইহুদী পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের সংস্কারমুক্ত করতে প্রয়াসী হবে, সাথে সাথে তাদের প্রাচীনপন্থী অভিভাবকদেরও নতুন যুগের সাথে পা রেখে চলার প্রেরণা যোগাবে।

জানি, ‘নতুন যুগের সাথে পা ফেলে চলা’ কেবল সুদূর স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয় এ-মুহূর্তে। অন্য জাতি আর অন্য ধর্মের প্রতি আমাদের এই জন্মগত বিদ্বেষ, এই উগ্র অন্ধ অসহিষ্ণুতা, যা স্বীকার করার মত মানসিক উদারতাও নেই আমাদের, সেই অন্ধকার বিবর হতে উদ্ধার পাওয়া কখনোই সম্ভব হবে না যদ্দিন আমরা দেশের চারদেয়ালের অভ্যন্তরে আবদ্ধ হয়ে থাকব। দেশ নিয়ে যতই আবেগ আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনা কেন আমরা, একহিসেবে সেই দেশই আমাদের মনোজগতের জন্যে একপ্রকার বন্দীশালা, যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, যেখানে বিবর্তন আর পরিবর্তন দুটি নিষিদ্ধ শব্দ ছাড়া কিছু নয়। চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি খুঁজতে হলে আমাদের বের হতে হবে সেই মাতৃগর্ভসম উষ্ণতার পরশ দিয়ে আচ্ছাদিত অবরোধের প্রাচীর ভেঙ্গে বাইরের পৃথিবীর মুক্ত পরিবেশে, যেখানে প্রতিদিনই একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়, যেখানে পরিবর্তনই একমাত্র অপরিবর্তনশীল নিয়ম, যেখানে মুক্তি আর স্বাধীনতা কতগুলো গালভরা শব্দ নয় কেবল, রাজপথের সস্তা শ্লোগান নয়, যার সারবস্তু তাদের জাতিসত্ত্বার গভীরতম প্রকোষ্ঠে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত। যেমন বাকস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কতই না অহঙ্কার আমাদের। অথচ ধর্ম নিয়ে সামান্য একটা প্রশ্ন তোলামাত্র চারদিক থেকে রব উঠতে থাকেঃ না না, ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। একবারও তারা ভেবে দেখতে চান না যে এই যে ‘প্রশ্ন তোলা যাবে না’, এইখানেই আমাদের ধর্মের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই দুর্বলতা থেকে পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মই একে একে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, একমাত্র আমাদের ধর্মটি ছাড়া। মধ্যযুগের খৃস্টান সম্প্রদায় যদি তাদের এই অন্ধ প্রশ্নহীনতার হীনমন্যতা থেকে বেরুতে না পারত তাহলে তাদের সেই বর্বর ‘ইঙ্কুইজিশন’ হয়ত আজও অক্ষুন্ন থেকে যেত। মুসলমানরা সেই প্রশ্নের পথ গ্রহণ করতে পারেনি বলে তাদের মধ্যযুগীয় ‘ইঙ্কুইজিশন’ এখনো ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে। তার সুস্পষ্ট প্রমাণ তো অহরহই পাচ্ছি আমরা, ইরাক-সিরিয়ার জিহাদী জোয়ানদের ভিডিওতে প্রেরিত মুণ্ডচ্ছেদের অবিশ্বাস্য দৃশ্যগুলোতে। অবিশ্বাসীদের মুণ্ডচ্ছেদই নয় কেবল, তাদের যুবতী-কিশোরী মেয়েগুলোকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা, তাদের সাথে যদৃচ্ছ যৌনসুখ উপভোগ করা, ঠিক যেমনটি করা হত সপ্তম আর অষ্টম শতাব্দীতে আরব বেদুইনদের বর্বর সমাজে, এসবের মধ্য দিয়ে আমরা বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছি যে আধুনিক যুগের আঙ্গিনাতে প্রবেশাধিকার পেতে হলে নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে হবে, এবং তার প্রধান উপায় সেই বিবরের গুহা থেকে বের হয়ে আসা। আদিম অন্ধকারের পথ বর্জন করে আমাদের খুঁজে নিতে হবে আলোর পথ। এই ‘আলোর পথ’ খোঁজার কাজটি কি কখনো সম্ভব আমাদের দ্বারা? আমরা যে চোখ বুঁজে বসে আছি দেড় হাজার বছর ধরে, পণ করেছি যে সে-চোখ আমরা খুলব না কোনদিন, কোনদিন কেউ পারবে না আমাদের পা থেকে মক্কা আর মদিনার শেকল খুলতে। অন্তত আমার প্রজন্ম বা আমার পরবর্তী দুই প্রজন্মের পক্ষে যে একেবারেই সম্ভব নয় সেটা আমি হলপ করে বলে দিতে পারি।

তাহলে কি আশা নেই কোনও?

অবশ্যই আছে। দেশে নয়, বিদেশে, প্রবাসে। তবে প্রবাস বলতে কি বোঝায় সেটা কিন্তু মনে রাখতে হবে। আজকাল সৌদি আরবও প্রবাস, যেখানে সামান্য চুরির জন্যে হাত কাটা হয়, খুনের জন্যে গলা কাটা হয় প্রকাশ্যে, যেখানে মেয়েরা গাড়ি চালাতে পারে না, ভোট দিতে পারে না, অভিভাবক ছাড়া রাস্তায় বেরুতে পারে না। না, আমি সেই প্রবাসের কথা বলছি না। মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান, কোয়েত আর আরব আমিরাতের কথাও বলছি না। আফ্রিকার নাইজিরিয়া আর সুদানের কথা তো অবশ্যই না, যেখান যুবতী মেয়েদের ক্রয়বিক্রয়ের খবর এখনো শোনা যায় মাঝে মাঝে। আমি বলছি সেই প্রবাসের কথা যেখানে আধুনিক সভ্যতা সমাজের স্তরে স্তরে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে, যেখানে মানবাধিকার আর ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, এগুলো কেবল মুখের বুলি নয়, তাদের সংবিধানের মূল স্তম্ভ। সোজা কথায় পাশ্চাত্য জগত। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যাণ্ড—-যেখানে যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা প্রায় প্রতিটি নাগরিকের অস্থিমজ্জাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ দেশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের সমৃদ্ধির কারণেই চিন্তাধারা উন্নত হয়ে ওঠেনি, বরং উন্নত চিন্তার সুদীর্ঘ চর্চার ফলপ্রসূতেই তাদের জীবনে সমৃদ্ধি এসেছে। প্রবাস বলতে আমি কেবল সেই উন্নতমনা দেশগুলোর কথাই বলছি।

তবে পশ্চিমে এসে বসবাস স্থাপন করলেই যে মানুষ পশ্চিমের মূল্যবোধগুলো ধাতস্ত করে ফেলে চটাপট তাতো নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়না, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে। তারা তাদের প্রাচীন সংস্কৃতিগুলি, দেশজ আচার-আচরণগুলি আঁকড়ে রাখতে চায় আজীবন। দেশের জন্মগত মনমানসিকতাকে বর্জন করে ভিন্ন চিন্তাধারাতে দীক্ষিত হওয়া কারো পক্ষেই সহজ নয়। হাজার মুক্তমনা হয়েও কোথায় যেন একটা বাধা থেকেই যায়। অতএব আশা আমাদের দিয়ে নয়, আমাদের ছেলেমেয়েদের দিয়ে, যাদের ‘দেশ’ বলতে তাদের পূর্বপুরুষের দেশ বোঝায় না। তাদের দেশ তাদের জন্মভূমি, ঠিক যেভাবে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে আমাদের দেশ। এই দেশেরই প্রকৃতির সাথে তারা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত—-এখানকার নদীনালা গাছপালা আকাশ ভূমির সাথে তারা জন্মলগ্ন থেকে আপন হয়ে উঠেছে, গাঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উঠেছে তাদের আবেগ উচ্ছ্বাস। এদেশের শীতঋতুতে আমরা বরফ দেখে ভয় পাই, বাইরে বেরুনো দূরে থাক, হাজারপ্রস্থ কম্বল মুড়ে ঘরের কোণেতে বসে কাঁপতে থাকি সারাক্ষণ, অথচ আমাদের বাচ্চারা শীতের প্রথম তুষার দেখামাত্র আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। তারা বন্ধুবান্ধবদের সাথে বরফের স্তূপের মাঝে খেলা করতে ভালবাসে, স্কি করতে যায় সবাই মিলে, কোথাও বরফের ঢিলা দেখতে পেলে গড়িয়ে পড়তে চায়। বড় কথা তাদের স্কুল, যেখানে তারা দেখে হাজার জাতের হাজার রঙের আর হাজার ভাষার বাচ্চাদের। কালে কালে তারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে, ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতায়ও পৌঁছে যায় কখনো কখনো। কই, তাদের মনে তো একবারও এমন ভাব আসে না যে, না, আমি ওর পাশে বসব না কারণ সে হিন্দু বা শিখ বা ইহুদী। কখনোই তো তার চিন্তায় আসে না যে তার বন্ধুর মা যে খাবার পাঠিয়েছে তার জন্যে সে-খাবার স্পর্শ করা ঠিক হবে না কারণ সেটা হালাল খাদ্য নয়। আমার একান্ত আশা যে ওরাই একদিন আমাদের সংস্কৃতিকে সত্যিকার মানবিক সংস্কৃতিতে পরিণত করবে। প্রশ্ন করে করে শতখণ্ডে ভেঙ্গে দেবে পুরণো বিশ্বাসকে। এমনকি আমাদের ধর্মকে, যে গুহার অন্ধকার থেকে যথার্থ অর্থে কখনোই নিষ্কৃত হতে পারেনি, তারা সেই গুহাজাত ধারাটিকেও আধুনিকতার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে পারবে।

অটোয়া, ৩রা নভেম্বর, ‘১৪
মুক্তিসন ৪৪