মসজিদ দেখে তো মকবুল হতাশ। মসজিদ কোথায়? বাজারের মধ্যে আলু-পটলের স্তুপ! এর মধ্যে কোথায় সে নামাজ পড়াবে?

সকালবেলা আসার পর এখন সন্ধ্যা। জোহরের সময় একটা ফাঁকা জায়গায় তাকে ইমামতি করতে হলো। মকবুল পাগরী মাথায় নামাজে দাঁড়ায়। পিছনে জনা দশ-বারো লোক। সবই বাজারের দোকানদার। আসরের নামাজের পর বাজারের মালিক সমিতির সভাপতি ডেকে বললেন, মাসে পনেরোশ টাকা আপাতত আর তিনবেলা খাওয়া। রাতে সমিতির অফিসের চালাঘরে একটা চৌকি পাতা আছে, সেখানেই আপাতত ঘুমাবেন…।

মকবুল হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললেও মনে মনে বলে, শুকুর আলহামদুরিল্লাহ…।

সভাপতি নুরুল আমীন সাহেব মকবুলকে চা খাওয়ান। চা শেষে জানতেন চান হুজুর পান খাবেন কিনা। মকবুল লাজুক হাসে। এক খিলি পান আসে। মকবুল পান চিবুতে থাকে। সভাপতি সাহেব ভাল করে মকবুলকে দেখেন। সদ্য মাদ্রাসা থেকে বের হয়েছে দেখলেই বুঝা যায়। এখনো গায়ে মাংস লাগেনি। পান চিবুলে মুখের সমস্ত পেশি, ভাঙ্গা চোয়াল ফুটে উঠে। থুতনির নিচের পাতলা একগোছা দাড়ি নড়তে থাকে। এই হুজুরকে এনে দিয়েছে আমজাদ। সে হচ্ছে সমিতির সেক্রেটারি। গ্রামে তার বাবার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা আছে। মকবুল সেই মাদ্রাসাতেই পড়তো। বেকার বসে আছে। একদিন হুজুর ডেকে বলল, আমজাদ সাহেবের ঠিকানায় যাও, কাজ হবে…।

একটা মসজিদ করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। যদিও কাছেই একটা পাকা মেঝের বেশ ভাল মসজিদ আছে। সেই মসজিদও জুম্মা ছাড়া খালিই পড়ে থাকে। জোহরে তিন কাতার, আসরে কখনো কখনো এক কাতার করাই কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় নতুন একটা মসজিদ খামখাই। কিন্তু সভাপতি নুরুল আমীন বুঝেছিলেন মসজিদ একটা দরকারই এবং সেটা বাজারের মধ্যেই!

নুরুল আমীন বলতে গেলে একাই বাজারটাকে গড়ে তুলেছেন। খুব বুদ্ধি খাটিয়ে বাজারের নাম দিলেন “মুক্তিযোদ্ধা বাজার”। নুরুল আমীনের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আছে। এরকম আরো দুজন সার্টিফিকেটধারীকে সঙ্গে নিলেন। আমজাদও একটা জোগার করতে চেয়েছিল কিন্তু তার ভোটার আইডি কার্ডের বয়স হিসাব করলে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স হয় চার বছর! নুরুল আমীন ধমক দিয়ে তাকে নিবৃত করেছে। নুরুল আমীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণবাসন লক্ষ্যে এই বাজার গড়ে তুলেছে। সরকারকে বুঝাতে চেয়েছে গরীব মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি করার জন্যই এই বাজার। সরকার তার জমিকে এরকম মানব কল্যাণে মানবিক দিক বিবেচনা করবেন নিশ্চয়…। নুরুল আমীন পরে দেখলেন বিড়াট ভুল হয়ে গেছে। লোকজন মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে উল্টো ভুরু কুঁচকে তাকায়। সে নিজে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেই তার দিকে এমনভাবে সরকারি অফিসের লোকজন তাকায় যেন একটা জোচ্চর সামনে দাঁড়িয়ে আছে!

নুরুল আমীন মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এই সব স্বাধীনতার চেতনাফেতনাও তার মধ্যে ছিঁটেফোটা নেই। তার ধারনা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে সরকার খুশি হবে। কিন্তু যতদিন যেতে লাগলো বুঝতে পারলো মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে চিড়ে ভিজবে না। নুরুল আমীন দ্রুত পরিস্থিতি বুঝতে পারে। সে বুঝলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিন শেষ…।

পাঞ্জাগানা নামাজী নুরুল আমীন কোনদিনই ছিল না। জুম্মার নামাজ আর ঈদের নামাজ ছাড়া পশ্চিম দিকে মাথা ঝুঁকতো না। শবে বরাতের রাতে অবশ্য সারা রাত নামাজ পড়ে ভোরবেলা আখেরি মোনাজাতে আল্লার কাছে প্রচুর কান্নাকাটি করতো ফি-বছর। তার ঘরের বসবার ঘরে একটা মক্বা শরীফের ছবি আছে। মোবাইলের ওয়েলকাম টুনে সুরা কাওসার সেটিং করা। এই হচ্ছে তার ধার্মীকতা। তবে দ্রুত নুরুল আমীন পাঞ্জাগানা নামাজ ধরে ফেললেন। সব সময় মাথায় টুপি। বাজারের যারা নামাজি দোকানদার তাদের সঙ্গে কাছের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করলো। মনে মনে নিয়ত করেছে, এই ঝামেলা মিটলে এ বছর হজটাও সেরে আসবে। জীবন কয়দিনের? মরতে হবে না!

নুরুল আমীন একলা সময় বসে ভাবে, কি জায়গা ছিল! এখন এক বছরে পঁচিশটা দোকান উঠেছে। মুদি, কনফেকশনারি, একটা নাস্তার দোকান, ভাতের হোটেল…। সকাল-সন্ধ্যা মাছ বাজার তো বসছেই। কিন্তু এত সোজা ছিল না সব কিছু। সরকারী পার্টির লোকজন সঙ্গে থাকলেও একদম পাকা ব্যবস্থায় না গেলে ভবিষ্যতে বাজার উঠিয়ে দিবে যে কেউ। কোনদিন পৌরসভা এসে সব তছনছ করে ফেলবে। সরকারি জমি উদ্ধার করতে তো দেশপ্রেমির অভাব হবে না। আসলে নুরুল আমীন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে বাজারটা করেছে সেটা কেউ দেখছে না- দেখছে শুধু বাজারটা। সে নিজে পার্টির কর্মী অথচ নিজের পার্টির লোকজনই এখন পিছনে লেগেছে। স্থানীয় একটা কাগজে খবর ছেপেছে- “সরকারি জমি দখল করে অবৈধ বাজার”! নুরুল আমীন জানে কে বা কারা এটা করেছে। সে উচ্চবাচ্চ করেনি। নুরুল আমীনের স্বভাব হচ্ছে নি:শব্দে কাজ করা। সে সেটাই করে যাচ্ছে।

বাজারে জব্বর মিয়ার মুদির দোকানকে “মুন্সির দোকান” নামে ডাকে সবাই। জব্বার মিয়া মাথায় পাগরী বাধে। নামাজ পড়ে কপালে কড় ফেলে দিয়েছে। নুরুল আমীন একদিন জব্বার মিয়াকে বলে, মুরব্বি লন, নামাজটা এহানেই পইড়া লই। আপনে ইমামতি করবেন…।

আগে থেকে ফাঁকা একটা জায়গা পড়ে ছিল, সেখানের দেয়ালে রঙ দিয়ে লেখা হলো, “নামাজের স্থান”। জব্বর মিয়ার ইমামতিতে নামাজ চলতে লাগলো। না হয়ে উপায় নেই। নুরুল আমীন জোহর ওয়াক্তে সর্বদা বাজারে উপস্থিত, তার জোহর এখন মিস হয় না। জব্বার মিয়া প্রথম দিকে অস্বস্তিতে পড়লেও এ্রখন বেশ ইমাম সুলভ কন্ঠে সুরা আওড়ায়। তাকবির দেয়। মাসিক মিটিংয়ে একদিন নুরুল আমীন প্রস্তাব তুললো বাজারের মুসল্লিদের জন্য একটা মসজিদ দরকার। আমাদের নামাজী ভাইদের দোকান ফেলে এতদূরে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া সব সময় সম্ভব হয় না। নামাজ কাজা হয়ে পড়ে। কাজেই বাজারের নিজস্ব একটা মসজিদ জরুরী হয়ে পড়েছে…।

মিটিংয়ে সর্বসম্মতি ক্রমে মসজিদ তৈরি বিষয়ে একমত হয়। অতি দ্রুত একজন ইমাম কাম মুয়াজ্জিন প্রয়োজন। আমজাদকে বলতেই সে গ্রামে ফোন লাগালো। সেই সূত্রেই নুরুল আমীনের মাথায় একটা বুদ্ধি এসে যায়। ভূঁইগড় মাদ্রাসার পিন্সিপাল হযরত মাওলানা একরাম উদ্দিন মাদানী সাহেবের অত্যন্ত কাছের মানুষ আমজাদের আব্বা। একরাম উদ্দিন আওলাদে রাসূল। মদীনা শরীফ থেকে একশোতো সত্তর বৎসর পূর্বে তার পূর্ব পুরুষ এই দেশে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন। কাফির দেশে ইসলাম প্রচার করতে এসে এখানেই শেষপর্যন্ত থেকে গিয়েছিলেন। তাদেরই সুযোগ্য উত্তরপুরুষ একরাম উদ্দিন মাদানী। তিনিও ইসলাম প্রচারে নিরলসভাবে নিয়োজিত। গ্রামের মানুষ তাকে “বড় হুজুর” নামে ডাকে। আল্লামা আহমদ শফীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন এমরাম উদ্দিন। অত্র অঞ্চলে “বড় হুজুরের” কথার উপর কারুর কথা চলে না। তিনি রসূলের বংশধর, সাধারণ গ্রামবাসী তাকে দেখাও সোয়াবের কাজ মনে করে। সেভেনটি ওয়ানে অবশ্য তিনি শান্তি কমিটির মেম্বার ছিলেন। লোকজন এসব এখন ভুলে গেছে। সবাই বলেন, হুজুর ইসলামের পক্ষে ছিলেন সব সময়। তার প্রভাব গ্রাম থেকে সদর পর্যন্ত। তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় পড়া ছাত্ররা অত্র অঞ্চলের এমন কোন মসজিদ নাই, মাদ্রাসা নাই যেখানে ইমামতী আর শিক্ষকতা করছে না। ।বিগত বছরগুলোতে ইসলাম বিবোধী যে কোন চক্রান্তে, গ্রামের মধ্যে ইহুদীনাসারাদের অর্থায়নে চালিত ইসলাম বিরোধী এননজিও কার্যক্রম বন্ধের আন্দোলনে “বড় হুজুর” যে ভূমিকা রেখেছেন তাতে দশ গ্রামের মানুষের কাছে তিনি মুরুব্বি-অভিভাবক হিসেবে গণ্য হন। এমনকি এই জেলা শহরেও তাকে চেনে না, সম্মান করে না, তার ওয়াজ শুনেনি এমন লোক নেই। অতি সাম্প্রতিককালে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকদের ফাঁসির দাবীতে আল্লামা শফি হুজুরের আন্দোলনে বড় হুজুর ঢাকার জনসভায় ভাষণ দিয়ে জাতীয়ভাবে পরিচিত হয়েছেন। কাগজে হুজুরের ছবি ছাপা হয়েছে। নুরুল আমীন সেই বড় হুজুরকেই একদিন দাওয়াত দিয়ে বাজারে নিয়ে আসলেন। হুজুর তো এমনি এমনি আসবেন না। একটা মাহফিল, ইসলামী জলসার আয়াজন করতে হবে। বাজার মালিক সমিতি ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করলেন। রাস্তা আটকে সারারাত ওয়াজ চললো। গরু জবাই করে তোবারক তৈরি হলো। হুজুরের ওয়াজ শুনতে পাবলিকের ঢল নামলো। হুজুরকে বিশেষভাবে আনাই হয়েছে বাজারের মসজিদ বিষয়ে কিছু বলার জন্য। হুজুর ওয়াজে বললেন, সমস্ত দুনিয়াকে আল্লাপাক তার সেজদার জন্য কবুল করে নিয়েছেন। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাপাক সুরা তওবায় বলেছেন, তারাই তো আল্লাহর মসজিদ আবাদ করে, যারা ঈমান আনে, আল্লাহ ও আখেরাতে এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না। …হুজুর আবেগ কন্ঠে বলেন, হে আল্লার বান্দারা! মসজিদের সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়!কিয়ামতের দিন এই মসজিদ ভিন্ন আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। আপনারা জানেন একটা মসজিদ তৈরি ফজিলত কতখানি? তিরমিযী শরীফে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে আল্লার সন্তুষ্টির উদ্দেশে মসজিদ তৈরি করলো আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে মসজিদের মত একটি ঘর তৈরি করে দিবেন।…

হুজুরের ওয়াজের পর এক শুক্রবার মকবুল একটা নড়বড়ে টেবিল নিয়ে বাজারের সামনের রাস্তার পাশে বসে যায়। মাইকে মুকবুলের কন্ঠ শোনা যায়, দিয়া যান ভাই, দিয়া যান, আল্লার ঘরে দিয়া যায়। …মসজিদের কাজ চলছে, যে যা পারেন দিয়া যান… সব কিছু বিফলে যাবে ভাই, এই মসজিদের দানই রোজ হাশরের ময়দানে আপনের হয়ে কথা কবে… দিয়া যান ভাই, দিয়া না…মাশাল্লাহ…মাশাল্লাহ…।

পথ চলতি মানুষ, রিকশা থামিয়ে টাকা-পয়সা দিয়ে যায়। মসজিদ আসলে পাবলিকের পাঁচ-দশ টাকায় উঠবে না, টিনের চাল আর পাকা ভিটির একটা মসজিদ মাস খানেকের মধ্যে খাড়া হয়ে যাবে। সেই বন্দবস্ত কমিটি আগেই করে রেখেছে। মকবুল জানে মসজিদ তৈরি না হলে তার নিজের অবস্থা শ্যাওলার মত। মসজিদই নাই মকবুল থাকে কিভাবে? সে কানাঘুষায় শুনেছে পৌরসভার চেয়ারম্যানের সঙ্গে সভাপতি সাহেবের সম্পর্ক ভাল না। পৌরসভার জায়গা দখল করে বাজার করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে। কেউ কেউ বলছে বাজার উঠিয়ে দিবে পৌরসভা। সভাপতি সাহেব অবশ্য উকিল ধরেছে, হাইকোর্টে গিয়ে রিট করবে…।

কিন্তু একদিন নোটিশ পাবার কথা জানা গেলো। মকবুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। সাতদিনের মধ্যে খালি করে দিতে হবে সরকারী জমিকে। মকবুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাদের কয়েক পুরুষের পেশা। তার দুই চাচাতো ভাইও এই লাইনে ছিল। দুজনই এখন ঢাকার ফুটপাথে গেঞ্জির দোকান দিয়েছে। সে নিজে কয়েকবার ভেবেছে ব্যবসায় নামবে কিনা। ভাইদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য নিরাশ হতে হয়। তারা হতাশ হয়ে বলে আমরা নিজেরাই ব্যবসা ছাইড়া দিমু ভাবতাছি, তুই আবার আসতে চাস? দুই দিন পর পর পুলিশ আহে দোকান ভাঙ্গতে। চান্দা দিতে দিতে এখন পুজি ভাইঙ্গা খাইতাছি।…

গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবে মুকবুল অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখে না। জমিজিরাত নাই। ছোটভাইটা মাদ্রাসায় পড়ে যা হোক একটা পেট চলে যায়। বাড়িতে শুধু মা। মা যে কি করে চলে, কি খায় তা এক আল্লা জানে! মকবুল বেতন পেয়ে মোবাইল ফোনের দোকানে যায়। এক হাজার টাকা বিকাশ করে। ছোট ভাইকে ফোন করে বলে, শোন বাজারে গিয়া টাকাটা গিয়া তুলগা। মারে কইছ, এক হাজার ট্যাকা পাঠাইলাম…।

হুজুরের কাছে দোকানদার কমিশন রাখে না। বলে, আচ্ছাই থাউক, আপনে পরের বার দিয়েন। ছোকরা হুজুর বলে সবাই খাতির করে। বাজারের চায়ের দোকানে বিকেলে চাটা তার জন্য ফ্রি। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এক খিলি পান জব্বর মিয়া মাগনাই খাওয়ায়। মকবুল পান চিবুতে চিবুতে ভাবে, এরা লোক বড় ভাল। আল্লায় কতদিন এইখানে রিজিক রাখছে কে জানে…।

কিন্তু এক রবিবার সকালে মকবুলের চোখের সমানে সব কিছু ভেঙ্গে যেতে থাকে। টিনের চালা, বেড়ার দেয়াল, সিমেন্টের বাউন্ডারী… মাথায় লাল পট্টি বাধা পোলাপান এসে গুড়িয়ে দিতে থাকে। পৌরসভার গাড়ি এসছে। মকবুল তার বোচকাটা কমিটির অফিস ঘর থেকে বের করে এনে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। ধূলোর ঝড় বইছে। কমিটির লোকজন কাউকেই সে দেখতে পায় না। দোকানদাররা তাদের মাল সামান সরাতে ব্যস্ত। মকবুল এসব কিছুই যেন দেখতে পায় না। সে শুধু ভাবে, এখন সে কোথায় যাবে? …

এক ঘন্টায় সব সাফসুতেরো। শুইয়ে দিয়েছে বাজারকে। মকবুল তবু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে কিছু দেখে না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে…। কিন্তু একটু পরেই আগুন লাগছে বলে চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে পুরো জায়গাটায়। লোকজন হঠাৎ আতংকে ছোটাছুটি করতে থাকে। সরকারী লোকজন কেমন যেন একটা বিদিশার মধ্যে পড়ে যায়। ভাঙ্গাভাঙ্গি থামিয়ে বুঝার চেষ্টা করে কিসের আগুন, কার আগুন?… মুকবুলের চিন্তার পানা পুকুরে ঢিল পড়ে। সে সম্বিত ফিরে বুঝে উঠার আগেই চিৎকারটা তখন অন্য মাত্রায় গিয়ে পৌঁছায়- “মসজিদে আগুন দিছে!” …

কোথায় মসজিদ! এখানে কে কবে মসজিদ দেখেছিল? জোহরের সময় জনা পনেরো লোক নামাজ পড়তো। পথ চলতি মানুষ রোজ দেখেছে। নতুন একটা হুজুরকেও তারা চেনে। খালি গলায় তাকে আজান দিতে অনেকেই শুনেছে। পাবলিকের কাছে এটাই মসজিদ! মুহূর্তে রঙ বদলাতে থাকে ঘটনার।… কে নাকি মসজিদে রাখা পবিত্র কোরআনপাককে বাঁচাতে গিয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে ফেলেছে।! সেই লোকটি কোথায়? কে দেখেছে ঘটনাটা? লোকটি বেঁচে আছে? কে রে সেই আল্লার বান্দা যে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে নিশ্চিত প্রাণ দিতে চায়? শেষের এই কৌতুহলই মানুষকে মগজে বিবেচনার সংকেত পাঠায়- হোক সরকারী জায়গা, হোক দখল, তাই বলে আল্লার ঘরে আগুন দিবে সরকার! আল্লার কালাম যদি পুড়ে যায়! কোত্থেকে কতগুলো চ্যাংড়া মত পোলাপান হরতালের মত ঢিল ছুড়তে শুরু করে পৌরসভার লোকজনের উপর। পুলিশ আগেই দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি নিয়ে। তাদের উপরও চওড়া হয় পাবলিক। হ্যা, কখন যে পুরো ঘটনাটা “পাবলিক বনাম সরকার” হয়ে শেষে জোহরের ওয়াক্তে “মুসল্লি বনাম মসজিদ ভাঙ্গতে আসা লোকজন” রূপ নেয় বুঝা যায় না। মানুষের সেন্টিমেন্ট মসজিদ রক্ষার পক্ষে। সভাপতি সাহবেকে এ সময় দেখা যায়। কমিটির লোকজন সবাই উপস্থিত হয়। তারাও আল্লার ঘর রক্ষা করতে এসেছে। জোহরের ওয়াক্ত পেরিয়ে যায়। মকবুলকে একজন ধাক্কা দিয়ে সামনে নিয়ে যায়। …মিয়া ওয়াক্ত যে যায় সেই খবর আছে? আল্লার ঘরে নামাজ পড়বো কেডা? ভাঙ্গাচোরা বাজারের মধ্যেখানে মকবুল আজান দেয়। টেলিভিশনের মক্কা শরীফের হুজুরের যে আজান বাজে, মকবুল সেটাই অনেকদিন ধরে নকল করার চেষ্টা করছিল। আজ তার নিজের কাছেই মনে হয় আজকের আজানটা আবেগে সেই আজানের মতই হয়েছে! কাতার ফেলে নামাজ হয়। আল্লার দুনিয়ায় একজন মুসলমান জিন্দা থাকতে আল্লার ঘর হেফাজত হবে না- এটা আল্লার দুশমনদের জানা নেই! আল্লাপাক যে জমিনকে তার ঘরের জন্য কবুল করে নিয়েছেন দুনিয়ার কোন কাফের, দুশমনের ক্ষমতা নেই সে জায়গাকে নাপাক করে।… মকবু্লের মুখ দিয়ে যেন অন্য কেউ কথা বলে। সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায় নিজের কথা শুনে। দীর্ঘ মোনাজাত হয়। সভাপতি সাহেব খুশি হন। তার মুখ দেখে বুঝা যায়, হুজুরকে তার পছন্দ হয়েছে।…

সবে শীত পড়তে শুরু করেছে। পোলাপানের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। সকালবেলা তারা এখন মসজিদে কায়দা পড়তে আসে। শীতের মিষ্টি রোদের এক ফালি এসে মসজিদের বারান্দায় পড়ে। হোগলার উপর বসে মকবুলের ঝিঁমুনি আসে। পোলাপান চেঁচিয়ে কায়দা পড়তে থাকে। দু’বছর আগের কথা মকবুলের হঠাৎ মনে পড়ে। কোথায় ছিল এই মসজিদ, এখন ঐ যে অজুখানা, এই প্রশস্থ বারান্দা, মকবুলের থাকার ঘর…। টিউবয়েল চেপে গোসল, পাকা বাথরুম। এইসব মিলে যে আজকের মকবুল, এসব মিলেই আসলে ইমাম সাহেব গাজী মুকবুল হোসেন…। এই চৌহদ্দির মধ্যে যা কিছু সব মকবুলের জিম্বায়। এই আল্লাহ ঘর মুকবুলের নিজের ভিতরে মানুষের আজন্ম স্বত্ত্বাধীকারীর উল্লাস চাপা স্বরে নিজের অজান্তে বাজে। মুকবুল ধুয়েমুছে রাখে এই ঘর। যত্ন করে গুছিয়ে রাখে কুটোটি। শীতের মিষ্টি রোদের আমেজে তার একটু তন্দ্রার মত হয়। সে ঘড়ঘড় একটা শব্দ শুনতে পায়। দু’বছর আগের বুলডোজারের সেই শব্দের মত কিছু একটা শুনতে পায় সে। কেঁপে উঠে জেগে যায় মকবুল। চেয়ে দেখে সোনামাখা রোদে ভেসে যাচ্ছে সকাল। পোলাপান সুর করে পড়ছে, আলিফ জবর আ…বা জবর বা…। মকবুল নিশ্চিন্ত হয়। তার খুশি খুশি লাগে। সে স্বপ্ন দেখছিল, সত্যি নয়…।