কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী আলবদর বাহিনী চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রধান মীর কাশেম আলীর বিচারের রায় ঘোষণা হবে আগামী রবিবার (০২/১১/১৪ ইং)। কিভাবে তার বাহিনীর অপহরণ চেষ্টা থেকে আমি আর আমার বাবা রক্ষা পেয়েছিলাম-তা ভাবতে আজও শিউরে ওঠি ।

সেদিন ছিল ২ ডিসেম্বর । শহরের মাদার বাড়ির সেল্টার থেকে পতেঙ্গার নিজ বাড়িতে এসেছি অনেক পথ ঘুরে-প্রিয় জননীকে দেখতে। অনেক দিন পর বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে দেখা। মা ও আজ ভাল ভাল রান্না করেছে-মাছ,মাংশ আরো কত কি। অনেক দিন পর বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে এক সাথে মায়ের হাতের রান্না তৃপ্তি মিটিয়ে খেলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এক সাথে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের খবর শুণতে বসলাম।

আমার একান্ত ইচ্ছা-আজ মা-বাবার সাথে রাত কাটাব । কিন্তু মা ব্যাপারটি কোন ভাবেই মেনে নিচ্ছে না। অনেকটা আমাদের অজ্ঞাতেই আমাদের পূবের বাড়ির জ্ঞাতি দাদী আমেনা মার ঘরে আমার ও বাবার জন্য বিছানা করে আসল মা। খবর শুণাও শেষ করতে দিল না মা। মায়ের পীড়াপিড়িতে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি ঘর ছাড়লাম বাবাসহ।
আমাদের বাড়ির পেছনে একটি ছোট পুকুর। পুকুরের উত্তর পাড় সংলগ্ন দাদীর বাড়িটি। রাত তখন প্রায় ১০-৩০ ঘটিকা। দাদীর ঘরে আমি, বাবা ও ঐ বাড়ির জেঠাত ভাই পেয়ার আহমদ, এক সাথে বসে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সংবাদ পর্যালোচনা শুণছিলাম। আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায় এর সংবাদ পর্যালোচনা ছিল মূলত মুক্তিযু্দ্ধের সংবাদ নির্ভর ।

হঠাৎ অস্ফুট একটি শব্দ কানে আসল সকলের। মনে হচ্ছে কোন গাড়ীর শব্দ। আবার শব্দটি যখন থেমে গেল, তখন মনে হল গাড়ীটি বুঝি নিকটে কোথাও থেমেছে। রেডিও বন্ধ করে সবাই উৎকর্ণ হলাম-ঘটনা বুঝার জন্য।

জেঠাত ভাই পেয়ার আহমদ গেল খবর আনতে-ঐ বাড়ির ঘাটা দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-‘আর্মি আপনাদের বাড়ী ঘিরে ফেলেছে’। আমি ও বাবা প্রথমত সংবাদটি বিশ্বাস করতে চাইলাম না। কারণ পেয়ার আহমদ ছিল খুব ভীতু প্রকৃতির এবং কোন কথা বাড়িয়ে বলার অভ্যেস ছিল তার।
তবুও তার সংবাদকে অবজ্ঞা না করে আমরা দ্রুত উঠানে নেমে আসলাম। সেদিন ছিল চাঁদিনি রাত। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমার মা, বোন, সবাই পেছনের পুকুর দিয়ে এসে পড়ল-আমাদের দ্রুত সটকে পড়ার জন্য তাগাদা দিতে লাগল মা । তারা জানাল-কাল কাপড়ে মুখ বাঁধা আলবদর বাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে ওঠানে দাঁড়িয়ে প্রথমে আমার ও বাবার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকে এবং কোন সাড়া না পেয়ে আমাদের ঘরের দরজায় সজোরে আঘাত করতে থাকে। আমার মেঝো চাচা দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে মুখ বাঁধা সশস্ত্র কয়েক জন ঘরে ঢুকে পড়ে-আমাকে ও বাবাকে খোঁজাখুঁজি করে- ঘরের জিনিষপত্র তছনছ করে তল্লাসি চালায় ।

খুব দ্রুত তল্লাসি চালিয় তারা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়। আমাদের পাশের ঘরের বৃদ্ধ দাদা-আমার বাবার চাচা-অবসরপ্রাপ্ত নাবিক ফয়েজ আহম্মদকে আমার ও আমার বাবা সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে না পারায় বেদম প্রহার করল । আমার মেঝো চাচা এখলাছুর রহমানকে ঘর থেকে টেনেহিচঁড়ে ওটানে বের করে আমি আর আমার বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করল। তাদের বেদম প্রহার সত্ত্বেও আমার অত্যন্ত নিরীহ ধরনের চাচা মুখ খুলেনি। বাড়ির সামনে রাস্তায় বসিয়ে বার কয়েক তাকে গুলি করার মহড়া দিল। চাচার এক কথা-তারা কোথায় আমি জানি না-পঁচিশে মার্চ থেকে তারা নিখোঁজ । অথচ তিনি জানতেন-পেছনের বাড়িতে আমরা আছি। অবশেষে চোখ বেঁধে তাকে ধরে নিয়ে গেল-সেই হোটেল ডালিমে (আন্দরকিল্লাস্থ জুমা মসজিদের পিছনে) স্থাপিত নির্যাতন ক্যাম্প-যার হোতা ছিল আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের প্রধান মীর কাশেম আলী।
ঐ রাতে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর বাবা বিভিন্ন সেনাক্যাম্প ও বিমান ঘাঁটি দ্বারা অবরুদ্ধ পতেঙ্গা থেকে পালাতে লাগলাম-সে আরেক ভিন্ন কাহিনী।

১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐখানে চাচাকে বন্ধী রেখে আলবদর বাহিনীর তরুণ সদস্যরা তার উপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন। ঐ ডালিম হোটেলে আরো অনেক বন্ধীকে দেখতে পায় চাচা।
সারাদিন পিছমোড়া করে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হত সবাইকে । সময় মত খাবারও দেওয়া হত না। প্রতিদিন কয়েকজনকে নিয়ে যেত অজ্ঞাত স্থানে-যারা আর ফিরত না। কেহ কেহ ঐ নির্যাতন ক্যাম্পেই মারা যেত।

এসব দেখিয়ে চাচাকে হুমকী দিত-তোমার ভাই আর ভাইপোর খবর না দিলে তোমাকেও এভাবে খতম করে ফেলা হবে। চাচা বুঝতে পারে এ আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সবাই তরুণ বাঙ্গালি ছেলে।
প্রতি দিনের নির্মম নির্যাতন-অনাহার-অর্ধাহারে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েও প্রিয় চাচা আমাদের ব্যাপারে মুখ খুলে নি। আর কয়েক দিন ঐ বন্ধীশিবিরে এভাবে থাকলেই চাচা এমনি মারা যেত।

১৬ ডিসেম্বর, ৭১, ভোরের আলো ফুটতেই চচা টের পায়, নির্যাতনকারীরা সবাই হাওয়া হয়ে গেছে। আন্দরকিল্লার কিছু লোক তাকে উদ্ধার করে বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয় । তখন তিনি একটি জীবন্ত নরকঙ্কাল।
মায়ের বুদ্ধিদীপ্ত দূরদর্শিতা ও চাচার এ ত্যাগ সেদিন আমার ও বাবার জীবন বাঁচিয়েছিল।

এ অমানষিক নির্যাতনের ধকল শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারে নি আমার হতভাগ্য চাচা। ফলশ্রুতিতেই স্বাধীনতার কয়েক বছর পর অকালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি

সেই নরঘাতক যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর বিচারের রায় হবে আগামী রোববার। আমার সে নিরীহ চাচা-এখলাছুর রহমান-নিজের জীবনের বিনিময়ে যিনি আমাকে ও বাবাকে মীর কাশেম আলীর আলবদর বাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, তার কথা আজ ভীষণ ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে।

চাচা এখলাছুর রহমান বেঁচে থাকলে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সাক্ষ্য দিতে পারত। আজ অশ্রুসজল নেত্রে তাকে জানাই লাখো সালাম।
আমাদের পরিারের পক্ষ থেকে আমরা মীর কাশেম আলীর ফাঁসি চাই।

* ভ্রম সংশোধন-শুরুতে স্মৃতি বিভ্রমের কারণে ঘটনার তারিখ ৬ ডিসেম্বর উল্লেখ করছিলাম,তারিখটি হবে ২ ডিসেম্বর।