(১)
গত কয়েকদিন ধরে কালীর নগ্নতা নিয়ে কিছু পোষ্ট দিলে হয় ফেসবুক ওড়াচ্ছে-নইলে গ্রুপ এডমিনরা ডিলিট করছে। সাথে সাথে হিন্দুত্ববাদিদের চূরান্ত অসভ্যতা, গালিগালাজ সবই আছে!

আমি বুঝতে পারছি না কালী সহ দেবীদের এরোটিসিজম নিয়ে থ্রেড ফেসবুক ওড়াচ্ছে কেন-লোকে কেনই বা অসন্তুষ্ঠ এই ধরনের পোষ্টে। সমস্ত দেবীদের কল্পনার পেছনে একটাই দর্শন -প্রজননে সক্ষম নারী সৃষ্টির উৎস। তাই নারীই প্রকৃতি। কালী নারী হিসাবে প্রকৃতির প্রকাশ-তাই নগ্নিকা। কারন যুগে যুগে প্যাগানদের মধ্যে নারীর নগ্ন দেহ বা যোনি প্রজনন শক্তি এবং তার থেজে প্রকৃতির রূপক হিসাবে পূজিত। সুমেরু সভ্যতা থেকে গ্রীস, রোম থেকে ভারত- সর্বত্রই দেবীরা যৌন শক্তির রূপক। তাদের এরোটিসিজম নিয়েই গ্রীক বা ভারতের পুরান। সরস্বতী দেবীকুলে গণিকা, নারায়নের রক্ষিতা-এত ভারতের পুরানেই বলে।

তাহলে কি দেখছি? আসলে প্রাচীন কালে ভারতবাসীদের যৌনতা নিয়ে শুচিবাই ছিল না। দেবীদের তারা যৌনতার দেবী হিসাবেই পূজা করত। হ্যা, যৌনতা সুন্দর-তাই তারও পূজাতে অভ্যস্ত ছিল ভারতীয় সহ সব প্যাগান সভ্যতা। কিন্ত বর্তমানের হিন্দুত্ববাদিরা যৌনতাকে খারাপ মনে করে। তাই ফেসবুকে এর বিরুদ্ধে ফ্ল্যাগ করছে। এটার কারন সেই হিন্দু ধর্মকে ইসলাম বা খৃষ্টান বানানোর চেষ্টা। কারন যৌনতার বিরুদ্ধে শুচিবাই আছে আব্রাহামিক ধর্মগুলিতে-যথা ইসলাম বা খ্রীষ্ট ধর্মে। ভারতীয়রা যৌনতার পূজা করে-তারা কেন মুসলিমদের হনুকরন করছে?

সাধে আমি লিখে চলেছি-যে ভারতের হিন্দুত্ববাদি আন্দোলন হল, হিন্দু ধর্মকে ইসলাম বানানোর অপচেষ্টা।

(২)
কালীর মধ্যে সানি লিওন খুজে পেয়ে কেও একজন প্যারোডি পোষ্ট করে ।
সঙ্গে সঙ্গে তেড়েমেরে রে রে করে ধর্মানুভূতিতে আঘাত বলে ফেসবুকে ভ্যান্ডালিজম শুরু করে হিন্দুত্ববাদিরা।

কালীর সাথে সানি লিওনের তুলনা করলে ধর্মানুভূতিতে লাগবে?
কেন ?

প্রথমত দুজনেই নগ্নিকা। ভুষনহীনতাই তাদের পছন্দ।

দ্বিতীয়ত কালী নারী দেহের মাধ্যমে প্রকৃতির প্রকাশ। তাহলে সানি লিওনের দেহতে প্রকৃতির প্রকাশ নেই ?

তৃতীয়ত হেমা মালিনী মুখের ছাঁচে দেবী দূর্গা কত দেখেছি। হেমা মালিনীকে আমরা গ্রহন করেছি দূর্গা রূপে-তাহলে সানি লিওনকে কালী রূপে কেন না ? দুজনেই ত অভিনেত্রী। কে কতটা কাপড় খোলেন, তা রিলেটিভিটির প্রশ্ন। তাতে ত বেসিক চেঞ্জ হয় না ।

চতুর্থত, ধর্মানুভূতিটি কি জিনিস? ওটি আসলে ছোট বেলায় ব্রেইন ওয়াশ করে ঢোকানো ধর্মীয় ভীতি। এবং একটি অহেতুক ভীতি যার জন্য ভারতের প্রগতি আটকে আছে। একটি অহেতুক ভীতি যা দাঙ্গা লাগায়, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে-সেই অহেতুক ভীতিকে কেন সন্মান করব ? সেই ভীতিকে দূর করার চেষ্টা করাটাই ভাল কাজ নয় কি?

পঞ্চমত ভারতীয় দর্শন এব্যপারে কি বলে? কোন উপনিষদে লেখা আছে ধর্ম ভীতি থেকে শুরু হয়? ওগুলো অনুন্নত ইসলাম , খীষ্ঠানদের ব্যপার। উপনিষদ বলছে ভয় থেকে না, ভয়কে জয় করা থেকেই সত্যর সন্ধান শুরু হয়। আসল ধার্মিক জীবন শুরু হয়। আসল ধার্মিকের ধর্মানুভূতি কি? তার ধর্মত সাহসের সাথে সততার সাথে কর্তব্য পালনের মাধ্যমে। তার সাথে কালীর সাথে সানি লিওয়নের তুলনার কি সম্পর্ক?

আর কালী পূজোর সাথে ধর্মের সম্পর্কটাই বা কি? জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ বা কর্মযোগের মধ্যে পূজো অর্চনা কোথায়? আর ভীতিযোগ বলে কিছু আছে ভারতীয় দর্শনে ? পূজো অর্চনা শ্রেফ প্যাগান সেলিব্রেশন।

(৩)
সেকন্ড পোষ্টটা ফেসবুকের গ্রুপে ফেলতেই প্রতি মিনিটে ১০ টা করে বাপ মা তুলে গালি আসা শুরু হল হিন্দু ধর্মের স্বগোষিত রক্ষকদের কাছ থেকে।

কালিকা তাদের কাছে “মা”। মায়ের সাথে পর্নস্টার সানি লিওনের তুলনা ? “ধর্মানুভূতিতে” বিশাল আঘাত!!

আমার মনে পড়ল পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত–

“মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা…
জনমের সাধ ডাকি গো মা তোরে
কোলে তুলে নিতে আয় মা…..
সকলই ফুরায়ে যায় মা।।
মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা।।
পৃথিবীর কেউ ভালতো বাসেনা
এ পৃথিবী ভাল বাসিতে জানেনা
যেথা আছে শুধু ভাল বাসাবাসি
সেথা যেতে প্রাণ চায় মা
সকলই ফুরায়ে যায় মা।।
মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা…
বড় দাগা পেয়ে বাসনা তেজেছি
বড় জ্বালা সয়ে কামনা ভুলেছি
অনেক কেদেছি কাঁদিতে পারিনা
বুক ফেটে ভেঙ্গে যায় মা….
সকলই ফুরায়ে যায় মা…
মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল
সকলই ফুরায়ে যায় মা.”

পান্নালালের ওই জনপ্রিয় গানটা কার অসাধারন লাগে নি? কেন না ওটা একটা রিয়ালাইজেশন । উপলদ্ধি। বোধ।

অপূর্ন জীবনের বেদনা , ব্যর্থ জীবনের বেদনা, এক সন্তান তার মার কাছে গাইছে। কারুর না কারুর কাছে ব্যর্থ জীবনের বেদনা শোনাতে পারলে মন অনেক হালকা হয় । সন্তানের বেদনা মায়ের থেকে বেশী আর কে বোঝে?

কিন্ত একোন “মা”? এই মায়ের সাথে সন্তানের গোপন বোঝাপড়া। সবটাই মিস্টিক সাধনা তা বলবো না -জীবনের গূঢ় উপলদ্ধি গুলো, যা সাফল্য, ব্যার্থতার ধাক্কা খেতে খেতে তৈরী হয়-তার কাব্যিক, আত্মোপলদ্ধির জন্য এই “মায়ের” কল্পনা। এই মা আমাদের নিজেদের চেতনার এক স্তর ।

এবার তাহলে আপনারাই বুঝুন। যেসব হিন্দুরা সানি লিওয়নের সাথে কালীর তুলনায় আপসেট হচ্ছেন, গালাগাল দিচ্ছেন, উত্তেজিত হচ্ছেন-তারা নিজেদের ধর্ম নিয়েই কতটা অশিক্ষিত।

দেখে শুনে মনে হচ্ছে নগ্ন কালীমাতাকে বোরখা পরাতে পারলে হিন্দুধর্মের ইসলামায়ন সম্পূর্ন হয়।