হিন্দুত্ববাদিদের ঠিকেদারিত্বে ভারতীয় দর্শন এবং অতীত কি নিরাপদ?

হিন্দুত্ববাদিরা যে হিন্দুধর্মের সন্ধানে, তা অস্তিত্বহীন অতীত। বরং তা ইসলাম বা আব্রাহামিক মনোলিথিক ধর্মগুলির ভারতীয় সংস্করন।

একটু উদাহরন দিচ্ছি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের তক্ষশীলার শিক্ষক এবং পরবর্ত্তী জীবনের রাজনৈতিক গুরু বিষ্ণুগুপ্ত ( চানক্য) তৎকালীন ব্রাহ্মণ আচার্য্য। কিন্ত কি আশ্চর্য্য! চন্দ্রগুপ্ত মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে রাজত্ব ত্যাগ করে জৈন ভিক্ষু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন! ভিক্ষু হওয়ার আগে উনি চানক্যর কাছে যান। চানক্য মোটেও অসন্তুষ্ট হন নি যে তার প্রিয়তম ছাত্র ব্রাহ্মন্য ধর্ম না নিয়ে জৈন ভিক্ষু হচ্ছে। তার আক্ষেপ ছিল- এই সব ভাববাদি দর্শনগুলি ভারতের দুর্বল রাজনৈতিক ভিত্তির মূল কারন। চন্দ্রগুপ্তের প্রধান অমর্ত্য ছিলেন রাক্ষস। তিনি আবার বৌদ্ধ। চন্দ্রগুপ্ত পুত্র বিম্বিসার ছিলেন আরেক নাস্তিক দর্শনের অনুগামী-অভাজিকা। যা আজ লুপ্ত। বিম্বিসার পুত্র সম্রাট অশোক আবার বৌদ্ধ ধর্মের জন্য নিজেকে উৎসর্গিত করলেন।

অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই?

প্রথমত একাধিক জীবন দর্শনের সমাহার। সেখানে নাস্তিক, আস্তিক, ভিক্ষু-সব ধরনের আধ্যাত্মিক জীবনের স্বাধীনতা।

দ্বিতীয় এবং গুরুত্বপূর্ন -পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে কিছু ছিল না । চন্দ্রগুপ্ত, বিম্বিসার, অশোক-পিতামহ থেকে দৌহিত্র-সবাই যে যার নিজের ধর্ম বেছেছেন। অর্থাৎ এরা নিজেদের আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে নিজেদের মার্গে এসেছেন। এমন কি স্ত্রীর ধর্মও স্বামীর ধর্ম থেকে আলাদা হত। অর্থাৎ আজকে যে ভেঁড়ার পালের ধর্ম আমরা দেখি-যে সবাইকে এক পথ অনুসরন করতে হবে-প্রাচীন ভারতে এই ধরনের ধর্মীয় অত্যাচারের চিহ্ন এসেছে অনেক পরে। আদিতে সবার মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা ছিল-সবাই নিজের মত করে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিত।

এই আধ্যত্মিক বা ধর্মীয় স্বাধীনতার রাজনৈতিক অধিকার লুপ্ত হতে শুরু করে গণরাজ্য গুলির বিলুপ্তির সাথে সাথে। প্রাচীন ভারতের এই ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে, গণরাজ্যগুলিতে মানুষের স্বাধীনতার বিশেষ সম্পর্ক আছে। ষোলটি আদি জনপদগুলিতে গণতন্ত্রের অস্তিত্বের কারনেই প্রাচীন ভারতে সহস্র দর্শন শতপুষ্পে প্রস্ফুটিত। কিন্ত আস্তে আস্তে গণরাজ্য গুলিতে গণপরিশদ ক্ষমতা হারাতে শুরু করলে সম্রাটের হাতে অধিক ক্ষমতা আসে। রাজধর্ম ক্রমশ প্রজাদের ধর্মে পরিনত করার একটা প্রবণতার জন্ম হয়।

জীবনের কোন পরম উদ্দেশ্য নেই । কোন ধর্ম, বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে “জীবনে কি করিতে হইবে বা করা উচিত” তার উত্তর খোঁজা অসম্ভব। কারন এটি একটি অর্নিয়াক প্রশ্ন। আবার আমরা যা কিছু করছি-প্রতিটা মুহুর্তে আমাদের সিদ্ধান্ত, আমাদের জীবনের “আপাত উদ্দেশ্য”-অর্থাৎ যেটিকে আমরা উদ্দেশ্য বলে মনে করছি-সেটাই আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তর আসল চালক।

এই ধাঁধা বা পারাডক্স মানবজীবনের সব থেকে বড় ট্রাজেডি এবং বৈচিত্রের ও মূল কারন। জীবনের উদ্দেশ্যই আমাদের চালনা করছে-আবার এদিকে জীবনের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত তার কোন উত্তর পাওয়া সম্ভব না ।

ফলে প্রত্যেকের জীবন অজানার উদ্দেশ্যে তার নিজস্ব যাত্রা। প্রাচীন ভারতে এই জন্য প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব আধ্যাত্মিক যাত্রাপথের স্বাধীনতা পেয়েছে।

ইসলাম বা খ্রীষ্ঠান ধর্ম মূলত “সাম্রাজ্য” প্রতিষ্ঠার ধর্ম । যদিও এই দুই ধর্মের শুরু “সাম্রাজ্যর” বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই। ফলে এই দুই ধর্ম মানুষকে তার নিজস্ব পথের স্বাধীনতা দেয় নি-জনগনকে ভেড়ার পাল বানিয়ে, রাজ্য শাসন করাই আব্রাহামিক ধর্মের মূল উদ্দেশ্য।

ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদের উৎস লোকমান্য তিলক এবং বিবেকানন্দের হাত ধরে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু পরিচয়ের ভিত্তিতে গৌরবান্বিত হওয়া-যাতে লোকেরা খ্রীষ্ঠান বা মুসলমান না হয়। এর থেকে যে কাল্পনিক হিন্দু ধর্মের বা সনাতন ধর্মের আমদানী হয়-তার সাথে ইসলাম বা খ্রীষ্ঠান ধর্মের ভেড়াল পালের গোষ্ঠিবাজির মিল আছে। প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় উদারতা বা স্বাধীনতা কোনটাই হিন্দুত্ববাদিদের সনাতন ধর্মে নেই।

বর্তমানে হিন্দুত্ববাদিরা যে সনাতন ধর্মের স্বপ্নে বিভোর-সেরকম কিছু ভারতে ছিল না । যেটি ছিল, তা হচ্ছে নিজস্ব আধ্যত্মিক জীবন নির্বাচনের সম্পূর্ন স্বাধীনতা। হিন্দুত্ববাদিদের সনাতন ধর্ম আসলেই ইসলাম বা খ্রীষ্ঠ ধর্মের আদলে তৈরী অলীক কাল্পনিক এক ধর্ম।