নারীকে পরিত্যাজ্য ভাবার পরও পুরুষ তাকে সর্বাংশে অস্বীকার করতে পারে নি। ঘুরেফিরে নারীর চারপাশে পুরুষ তৈরি করেছে নিজের আবর্ত। আবার পুরুষের প্রয়োজন শেষ হলে নারীকে ছুড়ে ফেলে দিতেও কার্পণ্য না করার দৃষ্টান্ত জাতকগুলোতে পাওয়া যায়। এখন আমরা একটি বিখ্যাত জাতক নিয়ে আলোচনা করবো যার নাম অলম্বুষা জাতক। এই জাতকে বিখ্যাত ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান বর্ণীত রয়েছে। সংস্কৃত বা বাংলায় আমরা তাকে ঋষ্যশৃঙ্গ নামে চিনলেও পালি ভাষায় তিনি ইসিসিঙ্গ (Isisinga) নামেই সমাধিক পরিচিত। আমি আমার লেখায় ঋষ্যশৃঙ্গ নামটাই ব্যবহার করলাম।

অলম্বুষা জাতক ত্রিপিটকের সূত্র পিটকের খুদ্দক নিকয়ের জাতকের অন্তর্গত জাতক কাহিনীর ৫২৩ নম্বর জাতক। এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে কোন এক ভিক্ষু তার স্ত্রীর প্রলোভনে ধর্মকর্ম বাদ দিয়ে গৃহস্থের জীবন শুরু করেছিলো। তখন বোধিসত্ত্ব ঐ ভিক্ষুকে উপদেশ দেন এই বলে যে,

“দেখো এই রমণী তোমার অনর্থকারিণী, ইহারই জন্য তুমি ধ্যানভ্রংশবশত তিন বৎসর মূঢ় ও বিধ্বংস হইয়া পড়িয়াছিলে। অতঃপর সংজ্ঞা লাভ করিয়া অতি দুঃখে পরিবেদন করিয়া বেড়াইয়াছিলে।”

এই জাতকের অতীতবস্তুতে জানা যায়, বোধিসত্ত্ব পুরাকালে কাশীরাজ্যের কোন এক ব্রাহ্মণকুলে জন্ম নিয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অরণ্যবাসী হন। অরণ্যে কোন এক মৃগী বোধিসত্ত্বের বীর্যমিশ্রিত তৃণ ভক্ষণ করে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। এরপরে বোধিসত্ত্বের আশ্রমের চারপাশে সেই মৃগী বিচরণ করতে থাকেন। অবশেষে ঐ মৃগী একটি মানবশিশু প্রসব করেন আর সেই মানবশিশুকে বড় করে তুলেন তার পিতা বোধিসত্ত্ব। এই শিশুর নাম হলো ঋষ্যশৃঙ্গ। শিশুটি বড় হলে বোধিসত্ত্ব তাকে প্রব্রজ্যা দিলেন এবং এর সাথে সাথে নারীর স্বভাব সম্পর্কে জ্ঞানদান করতে লাগলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ঋষ্যশৃঙ্গ কখনোই নারী দেখেন নি, তার পিতার মুখ থেকেই নারী সম্পর্কে যা জানার জেনেছেন।

এরপর ঋষ্যশৃঙ্গ ধ্যানমগ্ন হয়ে হিমালয়ে বসবাস করতে লাগলেন। ঋষ্যশৃঙ্গের কঠোর সাধনা দেখে অন্য সাধুরা হিংসায় জ্বলে গিয়ে পরিকল্পনা করলেন ধ্যান ভঙ্গের। তারা অতীব রূপসী অলম্বুষাকে পাঠালেন ঋষ্যশৃঙ্গের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য। অপ্সরা অলম্বুষা ভয়ে ভয়ে শেষপর্যন্ত তাপস সন্নিধানে উপনীত হলেন। অলম্বুষার রূপ দেখে বিস্মিত হলেন তাপস ঋষ্যশৃঙ্গ। তিনি অলম্বুষাকে প্রশ্ন করেন –

কে তুমি তড়িৎকান্তি
দাড়ায়ে ওখানে,
পূর্বাকাশে শুকতারা প্রভাতে যেমন?

অলম্বুষা নিজের পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য গোপন করে ঋষ্যশৃঙ্গকে আমন্ত্রণ জানান এই বলে যে,

এস মোরা রতিসুখে ভুঞ্জি এ আশ্রমে
এস প্রিয়, আলিঙ্গনে বদ্ধ হই মোরা
নানাবিধ রতিসুখ করি আস্বাদন।

ঋষ্যশৃঙ্গ তার পিতার মতো বনের এখানে ওখানে নিজ প্রচেষ্টায় বীর্যপাত করলেও রতিসুখ কি জিনিষ তা তিনি জানতেনই না। রতিসুখ তো দুরের কথা অলম্বুষার পূর্বে তিনি জীবনে কখনো নারীই দেখেন নি। কিন্তু অলম্বুষা রমণীজনোচিত মায়ামোহে আবদ্ধ করে ঋষ্যশৃঙ্গকে শয্যায় গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে রতিরঙ্গে তিনটি বছর কেটে যায়। এরপর ঋষ্যশৃঙ্গের তপস্যাহীন সময় পার করার জ্ঞান হয়। তখন অলম্বুষার প্রতি ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিশাপ দিতে চাইলে অলম্বুষা অভিশাপের ভয়ে তাকে সবকিছু খুলে বলে।

অলম্বুষা জানায়, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসলেও এখন সে ঋষ্যশৃঙ্গকে ভালোবেসে ফেলেছে। সে ঋষ্যশৃঙ্গকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাও করতে পারে না, এইভাবে অনন্ত জীবন যদি পার হতো, আহ কি ভালোই না হতো। কিন্তু ঋষ্যশৃঙ্গ আর নারীমোহে তার জীবন অপচয় করতে চাইলেন না। তার মনে পড়ে গেলো পিতার উপদেশবানী –

নারীগণ ফুল্ল কমলের মতো
হরে মন, লয় বিপদে টানিয়া
জানে যেন ইহা পুরুষে সতত
বক্ষে রমণীর আছে গণ্ডদ্বয়
থাকে যেন ইহা মনেতে তোমার।

অবশেষে ঋষ্যশৃঙ্গ অলম্বুষার ভালোবাসার কানাকড়ি মূল্যায়ন না করেই তাকে ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ঋষ্যশৃঙ্গ সারাজীবন ধরে কঠোর তপস্যা করেন আর দুঃখ করেন তার তিনটি বছর নারীঘটিত দুর্মতিতে অতিবাহিত করার জন্য। পুরুষ নারীকে প্রয়োজন শেষে ত্যাগ করার অনেক দৃষ্টান্ত সেই প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। এমনকি পুরুষ তার প্রয়োজন মিটিয়ে নিজের ভুলের জন্য আজীবন আপসুস করতে পারলেও যে রমণী তাকে ভালোবাসে তার কথা একবারও চিন্তা করতে চায় না। এরপরও তারাই মহাপুরুষ হয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়।

আরেকটা ব্যপার এখানে লক্ষণীয় যে, হিন্দু সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে বৌদ্ধভিক্ষু প্রব্রজ্যা গ্রহণকারী বা মুসলিম সূফীদের মধ্যে যারা নারীদেরকে তাদের সাধনার প্রতিবন্ধকতা মনে করতো তারা নারীর বিকল্প হিসেবে হস্তের দ্বারস্থ হতে কুণ্ঠিত হতো না। জনৈক এক সাধুর জনপ্রিয় একটি উক্তি ছিলো,

থাকিতে নিজ হস্ত কেন হবো অন্যের দ্বারস্থ?

এই জন্যই বনে সাধনা করতে গেলেও বনের এখানে ওখানে তাদের বীর্য পাওয়ার গল্প শোনা যেত। এগুলো আবার পশুপাখি তাদের খাদ্যের সাথে খেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ার গল্পও আমরা পেয়ে থাকি বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে।

বৌদ্ধধর্মানুযায়ী নারীগণ শুধু সাধনার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীই নয় তারা সামগ্রিক অশুদ্ধতার প্রতিমূর্তিও। এই বিষয়ে আমরা এখন আলোচনা করবো মহাহংস জাতক নিয়ে। মহাহংস জাতক ত্রিপিটকের জাতক কাহিনীর ৫৩৪ নম্বর জাতকের অন্তর্গত। এই জাতকের কাহিনীতে বর্ণীত আছে – পুরাকালে বারাণসীরাজের ক্ষেমা নামে একজন অগ্রমহিষী (অনেকগুলো স্ত্রীর মধ্যে প্রধান স্ত্রী) ছিলেন। তার হংসের মুখে ধর্মকথা শোনার আকাঙ্ক্ষা ছিলো, যদিও তার স্বামী তার আকাঙ্ক্ষার মূল্যায়ন করতে চায় নি।

কিন্তু ক্ষেমা তার দোহদের সময় আবার সুবর্ণহংসমুখে ধর্মকথা শুনতে চাইলো। যারা দোহদের অর্থ জানেন না তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, দোহদ হচ্ছে গর্ভকালীন ইচ্ছা। বোঝা যায় সন্তান জন্মানোর সময় নারী তার ইচ্ছাপূরণের সুযোগ পেতো। পুরুষ সম্ভবত দয়া করেই এই ইচ্ছাটা পূরণ করতো কারণ তৎকালীন সময়ে সন্তান জন্ম দেয়া মানে মৃত্যুকে দর্শন করার মতো ছিলো। তাছাড়া বিশেষ করে যে পুত্রসন্তানটি জন্মাবে সেটি তো পুরুষের, নারী তো শুধু পুত্রসন্তান জন্মানোর আধার মাত্র।

দোহাদ বলেই রাজা অবশেষে সুবর্ণহংস এনে দিতে রাজি হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে ২ টি হংস পাওয়া গেলো, এদের একটির নাম হচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র এবং আরেকটির নাম হচ্ছে সুমুখ। ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের স্ত্রীর জন্য বিলাপ করতে থাকলে সুমুখ তাকে স্ত্রীজাতি সম্পর্কে উপদেশ দেন এভাবে –

রমণী যে শ্রেষ্ঠরত্ন, এ প্রলাপ করো তুমি
অর্ধ উন্মক্ত হইয়া নিশ্চয়।
সাধারণ ভোগ্যা তারা, শৌণ্ডিকের পানাগার
যথা সর্ব অধিগম্য হয়।
মায়া তারা মরীচিকা, রোগ-শোক-উপদ্রব
সর্ববিধ অশান্তিনিধান।
প্রখরা পাপের পঙ্কে, বান্ধে তারা জীবগণে
তাহা হতে নাই পরিত্রাণ।
দেহরূপ গুহামধ্যে, মৃত্যুপাশসমা তারা
পদে পদে বিপদ ঘটায়।
এহেন রমণীগণে, যে জন বিশ্বাস করে
নরকূল অধম সে নিশ্চয়।

এভাবে সুমুখের উপদেশ থেকেই জাতকটিতে বুঝানো হলো যারা এতো অনাসৃষ্টির মূল নারীকে বিশ্বাস করে তারা মানুষেরও অধম। এই পিতৃতান্ত্রিক ধর্মকথা আবার একজন নারীই ভক্তিভরে শ্রবণের জন্য বায়না ধরে তার পতির কাছে! সত্যিই প্রতিটি ধর্মে নারী নিষ্পেষিত হলেও নারীবিরোধী ধর্মকথা শোনার আগ্রহ নারীদেরই কেন বেশী তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলুম না!

আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন Alambusā-JātakaMAHĀHAṀSA-JĀTAKA

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

(চলবে)