[পারভেজ আলম, অভিজিৎ রায়। দুজনেই আমার পরম শ্রদ্ধার। মুক্তচিন্তা প্রসারে দুজনের অবদানই আমি স্বীকার করি। অসংখ্য বিষয়ে তাদের চিন্তা- দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে মিললেও, দুজনের সাথেই আবার আমার অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। সেটাই স্বাভাবিক। মতপার্থক্য কখনোই অশ্রদ্ধার জায়গায় ঠেকেনি। কোন একটা বিষয়ে কাউকে আমি প্রচন্ড রকম ভুল মনে করলেই যে তার আর সমস্ত অবদানের কথা ভুলে যাবো, অশ্রদ্ধা করবো- এমনটা আমি কল্পনাও করিনা। সম্প্রতি, বাংলাভাষী অনলাইন দুনিয়ার এই দুই শক্ত দিকপালের মাঝে ডিবেট শুরু হয়েছে (এখন কিছুটা স্তিমিত) … একটু দেরি করে হলেও- সেই ডিবেট এ অংশ নিতেই এই লেখার অবতারণা। এই ডিবেটে দুজনের কিছু আচরণ আমার ভালো লাগেনি, সেটাও খোলামেলা এখানে বলেছি। সাথে ডিবেট এর জায়গাগুলোতে আমার চিন্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার যুক্তি বুদ্ধিতে যেটা ঠিক মনে করেছি তাই বলেছি, ফলে সমস্ত বক্তব্যের দায় একান্ত আমার। দুজনেই আমার শ্রদ্ধার, দুজনকেই কাছের বন্ধু মনে করি। আশা করি, আমার এই আলোচনাকে তারা চিন্তার জায়গা থেকেই গ্রহণ করবেন। দ্বিমতের জায়গা, আমার ভুল ভ্রান্তি, আমার ভুল বুঝা- এসব নিয়ে যেকেউই কথা বলতে পারেন।]

সালাফি সেক্যুলার?
কিছুদিন আগে ইস্টিশন ব্লগে লেখা পারভেজ আলমের পোস্ট থেকে একটা ডিবেট শুরু হয়। ফেসবুকে পারভেজ আলমের ঐ পোস্ট শেয়ার করা স্ট্যাটাসটা চোখে পড়েছিল আগে। স্ট্যাটাসে শেয়ার করা অংশটুকু এবং ইস্টিশন ব্লগে প্রকাশিত পোস্টের শিরোনামটা দেখে স্বভাবতই পারভেজ আলমের সাথে একমত হতে পারিনি। ইস্টিশন ব্লগে লেখাটির শিরোনাম- “অভিজিৎ রায় কেন সালাফি সেক্যুলার হইলেন?” (http://istishon.com/node/9608) নাস্তিক- সেক্যুলার- মুক্তমনাদের নানারকম অভিধায় অভিষিক্ত করা ইদানিংকালের একটা ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে, যেমনটি বামদেরকেও নানা ট্যাগ, বিশেষণে বিশেষায়িত করাটাও অনেকে স্মার্টনেস প্রকাশের উপায় হিসেবে দেখেন। যাহোক, পারভেজ আলমের এই “সালাফি সেক্যুলার” অভিধাটি একদম নতুন মনে হওয়ায়- ‘সালাফি সেক্যুলার’ বস্তুটি যে আসলে কি (তাহা মাথায় দেয় না, গায়ে পরে)- জানার বিশেষ আগ্রহবোধ করি। তা জানার জন্যে ঐ পোস্টে ঢু মারতে হয়না- ঐ স্ট্যাটাসেই একটা সংজ্ঞা পেয়ে যাই। পারভেজ আলম লিখেছেনঃ “সালাফিরা কুরানের কট্টর লিটারাল ইন্টারপ্রিটেশনে বিশ্বাস করে, আইনের ক্ষেত্রে তারা মূলত হাম্বলি মাজহাবপন্থী হওয়ায় দুনিয়ার অন্য মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ হাদিসকে তারা সহিহ বলে গন্য করে (প্রায় ৫০ হাজার)। এবং তারা কুরান হাদিসের বাইরে অন্য কিছুকে আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করে না। দুনিয়ার অধিকাংশ মুসলমানই ইসলাম সম্বন্ধে সালাফিদের সাথে একমত না। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের মতো একজন সেকুলার ব্যক্তি ইসলাম বিষয়ে সালাফিদের সাথে পুরাপুরি একমত। অভিজিৎ রায় কেনো ইসলাম বিষয়ে একজন সালাফি সেকুলার হইলেন তা আমার প্রধান প্রশ্ন”।

শেষ বাক্যদুটোর আগ পর্যন্ত বাক্যগুলোর সাথে প্রায় পুরোমাত্রায় একমত, এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে নিয়ে আসা আলোচনাটা দারুণ- যেমনটা পারভেজ আলমের অসংখ্য লেখাতেই আমরা পাই। পারভেজ আলমের কাছ থেকে সালাফিদের সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহ পাই। কিন্তু, ঠিক তারপরেই “কিন্তু” বলে পারভেজ আলম যেভাবে অভিজিৎ রায়কে ইসলাম বিষয়ে সালাফিদের সাথে “একমত” বলে দাবী করলেন এবং “সালাফি সেক্যুলার” এর সংজ্ঞা দাঁড় করলেন- সেটায় অবাকই হলাম। পারভেজ আলমের মূল পোস্টে ঢুকার আগেই, তার স্ট্যাটাস অতটুকু পড়ে মনে হয়েছিল- ইসলাম বিষয়ে সালাফিদের দাবীকৃত “সহি ইসলাম”কে কোন সেক্যুলার/ মুক্তমনা ব্যক্তি যদি কাউন্টার করতে যায়- তবে তাদেরকে “সালাফি”দের সাথে “একমত” বলা যায় কিনা, এবং এই “একমত” দেখিয়ে তাদেরকে একেবারে “সালাফি সেক্যুলার” বলে অভিহিত করা যায় কিনা! যাহোক পারভেজ আলম যে যুক্তিতে “সালাফি সেক্যুলার” অভিধা দিলেন, তার সাথে একমত হওয়ার কোন কারণ দেখিনা- কিন্তু তিনি যখন এই টার্মলজি আমদানি করেই ফেললেন, তখন তার সংজ্ঞা মোতাবেক নিজেকে “সালাফি সেক্যুলার” বলেই মনে হলো। মুশকিলটা হচ্ছে- আমার বিভিন্ন লেখায় কোরআনকে বাই টেক্সট যেমন ব্যবচ্ছেদ করেছি – তেমনি জাকির নায়েক, রাশাদ খলীফা, হারুন ইয়াহিয়া এমন অনেকের ব্যাখ্যারো সমালোচনা করে বিভিন্ন সময়ে লিখেছি- ফলে আমাকে সম্ভবত “সালাফি সেক্যুলার” এর সাথে সাথে ‘নায়েকি সেক্যুলার’, ‘রাশাদি সেক্যুলার’, ‘ইয়াহী সেক্যুলার’ এমন নানা বিশেষণে ডাকা যেতে পারে। তো, আর সব বিশেষণকে দূরে ঠেলে কেন আমি এমন ‘সালাফি সেক্যুলার’ হইলাম- তার জবাবটি দেয়ার জন্যেই আগ্রহ বেশি বোধ করি। মোটাদাগে এবং সংক্ষেপে কারণসমূহ হচ্ছেঃ
১) কোরআনকে কনটেক্সটচুয়ালি বুঝতে গেলেও লিটারেলি বুঝা দরকার বলে মনে করি। কোরআন লিখিত হওয়ার আমলটি ধরতে গেলে কোরআনের লিটারেল ইন্টারপ্রিটেশন সবচেয়ে বেশি কাজের। পরবর্তী যুগের নানা ইন্টারপ্রিটেশন- পরবর্তী সময়ের ইতিহাস- রাজনীতিকে ধরতে পারার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক। কিন্তু মুহম্মদ (সাঃ)কে বুঝতে, সেই সময়ের আরবের ঘটনা প্রবাহকে বুঝতে গেলে কোরআনের লিটারাল ইন্টারপ্রিটেশন এবং সে সময়কার সাহাবিদের করা নানা ইন্টারপ্রিটেশন (হাদীস সমূহ) সবচেয়ে বড় অবলম্বন মনে করি।
২) সহি ইসলাম নিয়ে মুসলমানদের নানা মত থাকলেও- একটা বিষয়ে সকলেই একমত যে, কোরআন সবার ভিত্তি- মুহম্মদের জীবনী সবার জন্যে অনুকরণীয়। ফলে সালাফি বলি আর নন সালাফি বলি- ডিবেট এ শেষ পর্যন্ত ঐ কোরআনেই ফিরতে হয়, মুহম্মদ (সাঃ) এর জীবনীতেই ফিরতে হয়। কোরআন লিখিত হওয়ার ৫০০- ১০০০ বছর পরের নানাজনের নানা সুবিধাবাদী ও প্রয়োজনবাদী তথা পরিবর্তিত নৈতিকতা ও জ্ঞানের সাথে সমন্বয়কারী ইন্টারপ্রিটেশনের গলদ দেখানোটা তাই আমার কাছে যথেষ্ট জরুরীই মনে হয়।
৩) কাদের সাথে ডিবেট করছি, কোন উদ্দেশ্যে করছি- সেটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় অংশ মডারেট মুসলমান, ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে যাই হোক- অন্তত পালনের দিক থেকে। অনলাইন দুনিয়ায় এখনো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশই প্রধান, যারা ইসলাম- কোরআন- আল্লাহ মানে, বলতে গেলে সেভাবে না জেনেই। এবং এদের নৈতিকতাবোধ ১৪০০ বছর আগের আরব নৈতিকতা থেকে কিছুটা অগ্রসর বলেই মনে করি। ফলে, বহুবিবাহ- খুন খারাবি- যুদ্ধ- ধর্ষণ এসবকে তারা ভালো চোখে দেখে না, বর্তমানের নৈতিকতা থেকেই। তারা আজকের নৈতিকতার সাথে ধর্মবিশ্বাসকেন্দ্রিক নৈতিকতার একটা সমন্বয় করে চলে, মানে- কোরআনকে না লিটারালি- না কন্টেক্সটচুয়ালি পাঠ করে; পাঠ করে অনেকটা হিজিবিজি মন্ত্র পাঠের মত করেই, ভাসাভাসা জ্ঞানে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকৃত বর্তমান নৈতিকতাই ইসলামিক নৈতিকতা। বরং অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামিস্টদের যে নৈতিকতা তার বর্তমানের নৈতিকতার সাথে মিলে না- তাকে কিছু না জেনে, না বুঝেই রায় দিয়ে ফেলে যে- ওটা ‘আসল বা সহি ইসলাম’ নয় (যেমনঃ ৭১ এ বেশিরভাগ মুসলমান বাঙালি জামাতি ফতোয়াকে গ্রহণ করেনি- তাদের ইসলামকে আসল ইসলাম না বলতে কাউকে কোরআন ঘাটতে হয়নি)। এদেরকে ‘আসল ইসলাম বা সহি ইসলাম’ দেখিয়ে দিয়ে ঐসব উগ্র ইসলামিস্টদের প্রচারিত নৈতিকতাকে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়- এমনটা আমি মনে করি না। বরং, ‘সহি ইসলাম’ দেখানোর মধ্য দিয়ে তার পালনকৃত নৈতিকতার সাথে ধর্মবিশ্বাসের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করা খুব সম্ভব বলেই মনে করি। আমাদের বেশিরভাগ নাস্তিকদের নাস্তিক হওয়ার ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে। ধর্ম বিশ্বাসের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে এটি খুব কাজের। সেই সাথে এমনটা মনে করি যে, নাস্তিক/ মুক্তমনাদের এ ধরণের লেখা পড়ে- সহি ইসলামের ব্যাখ্যা পড়ে একজন আস্তিক ব্যক্তি তার প্রচলিত নৈতিকতা বনাম ধর্মবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে প্রচলিত নৈতিকতাকে ত্যাগ করে নাস্তিকদের কথিত ‘সহি ইসলাম’-এর নৈতিকতাকে গ্রহণ করবে; এমন সম্ভাবনা একেবারেই কম।

যাহোক, এ গেল আমার মোটের উপরে “সালাফি সেক্যুলার” হওয়ার কারণ। কিন্তু “সালাফি সেক্যুলার” হলেও আমি যে সালাফিদের সাথে মোটেও একমত নই- তা আলবৎ বলতে পারি। আল্লাহ বলে কোন কিছুর অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস নাই, কোরআনকে মুহম্মদ (সাঃ) ও তার সময়ের সাহাবীদের লেখা এবং ওসমান (রাঃ) এর হাতে সংকলিত একটা গ্রন্থ মনে করি এবং তার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে- কোরআনকে মুহম্মদ (সাঃ) এর এবং ওসমান (রাঃ) এর প্রেক্ষিতে কনটেক্সটচুয়াল একটা গ্রন্থ হিসেবেই দেখি। (আমার জানামতে অভিজিৎ রায় সহ সমস্ত নাস্তিক এমনই মনে করে)। আয়েশা (রাঃ) এর টপাটপ আয়াত নাযিল করা সংক্রান্ত হাদীসটা বেশিরভাগ নাস্তিকের মত অভিজিৎ রায়েরও যথেষ্ট প্রিয় বলেই জানি (তার লেখাতেও এর উল্লেখ দেখেছি) … সুতরাং সালাফিদের সাথে “সালাফি সেক্যুলার”দের একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে- সালাফিরা কোরআনকে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরণকৃত ও সংরক্ষণকৃত অপরিবর্তনীয়- অলংঘ্যনীয় মহাপবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে একে লিটারালি দেখে। আর আমরা “সালাফি সেক্যুলার”রা মুহম্মদ (সাঃ) ও সাহাবীদের ভূমিকা, তাদের হাতে ইসলামের উদ্ভব, ঐ সময়ের আরব সমাজ- রাজনীতি- অর্থনীতি- ইতিহাস পরম্পরা বুঝার জন্যে কোরআনের লিটারাল ও হাদীসসমূহ নির্ভর ব্যাখ্যা এবং সমসাময়িক ও সাহাবীদের মাধ্যমে (সরাসরি সাহাবীদের দ্বারা কিংবা সাহাবী থেকে পরবর্তী আরো কয়েক প্রজন্মে) প্রচারিত আলোচনা, ইতিহাস, জীবনী বা সিরাত এর উপর নির্ভর করি! ইতিহাসের এমন পাঠের কোন কোন বিষয় সালাফিদের সাথে “সালাফি সেক্যুলার”দের মিলে গেলেও- তাকে একমত বলা যাবে কিনা ভেবে দেখতে বলি। সেদিন এক দলান্ধ আওয়ামীলীগারকে পেলাম- যিনি দাবী করছিলেন জিয়া নাকি কোনদিনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাননি, ঘোষণা-টোষণা দেয়া দূরের কথা। আমি বললাম- ভাই, অস্বীকার করে লাভ নেই, এটা প্রমানিত সত্য যে জিয়া গিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার একটা ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন- কিন্তু সেটা ২৬ তারিখে না, ২৭ তারিখে- তিনিই প্রথম নন, ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে আরো কয়েকজন ২৬ তারিখ থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন, এবং অন্যান্যদের মত জিয়ার ঘোষণাতেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা পাঠ হয়। এটি শুনে ঐ দলান্ধের মনে হলো- আমি নাকি বিএনপির সাথে একমত! “মেজর জিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলেন” – কেবল এতটুকু বয়ানের মিলকে যদি “একমত” বলা হয়, তবে কি বলা যাবে তাকে? বিএনপির মত আমি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক মনে করি না, মনে করি স্বাধীনতার ঘোষণার অন্যতম পাঠক এবং সামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম পাঠক, তারপরেও কি একমত বলা যাবে?

ফারাবীকে উদ্ধারে ফারাবী-আত্মীয়ের মিশন?
“সালাফি সেক্যুলার” নিয়ে হয়তো ফেসবুকে ঐ স্ট্যাটাসেই একটা আলোচনা করা যেত, কিন্তু কিছুটা সমায়াভাব, কিছুটা আলসেমি আর বাকিটা পারভেজ আলমের পুরা পোস্ট পড়ে মনে হলো- পারভেজ আলমের পোস্টের শিরোনাম এবং ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করা এই অংশটুকু খুব গৌন বিষয় (এবং সবচেয়ে দুর্বল অংশ) হলেও পোস্টের মূল আলোচ্য বিষয় বেশ আগ্রহোদ্দীপক। আসলে এই পোস্টটি অভিজিৎ রায়ের আরেকটি লেখার প্রতিক্রিয়ায় লেখা, এবং একটি সমালোচনামূলক লেখা যা পোস্টের শুরুতেই পারভেজ আলম সরল স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন। অভিজিৎ রায়ের লেখাটিও পড়া হয়ে যায় (‘From Farabi to ISIS: The Virus of Faith is Indeed Real : www.mukto-mona.com/wordpress/?p=3167)। পাশাপাশি দুটো লেখা পড়তে বেশ লাগলো, অভিজিৎ রায়ের প্রতি করা পারভেজ আলমের প্রধান প্রশ্নটি বাদে। আমার কাছে বরং এই প্রশ্নটিই গৌন মনে হয়েছে- তার চাইতেও প্রধান ও জরুরি প্রশ্ন একই পোস্টে বর্তমান, বর্তমান সময়ে সাড়া জাগানো মিমতত্ত্ব, বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে করা প্রশ্নসমূহ, বর্তমান সময়ে ইসলামি জঙ্গীবাদের উত্থানের কারণ হিসেবে ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে কেবল “সহি ইসলাম”কেই একমাত্র জ্ঞান করা নিয়ে প্রশ্নসমূহ প্রভৃতি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, যৌক্তিক তো বটেই। পারভেজ আলমের সেই পোস্টের অনেক কিছুর সাথেই একমত পোষণ করি। ফলে আশা করেছিলাম দারুণ এক বিতর্কের। আগ্রহ ভরে অপেক্ষাতেও ছিলাম, অভিজিৎ রায় কি জবাব দেন তা দেখার জন্যে।

অভিজিৎ রায় ৪ দিন পরে ফেসবুকের স্টাটাসে (https://www.facebook.com/Avijit.Roy.MuktoMona/posts/768728793183393) যে জবাবটি দিলেন, সেটি পুরোমাত্রায় হতাশ করলো! সত্যি বলতে কি, খুব অবাক হয়েছি- কিছুটা কষ্টও পেয়েছি, কেননা তাঁর কাছে এমন জবাব একেবারেই আশা করিনি। প্রায় ২২শ শব্দের এই স্ট্যাটাসের অন্তত প্রথম এক তৃতীয়াংশ পড়তে গিয়ে আমি বারেবারেই হোচট খাচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম- এই কি আমাদের তরুণ মুক্তমনাদের পরম ভরসার অভিজিৎ রায়ের লেখা? পারভেজ কিছু প্রশ্ন তুলেছে, অভিজিৎ রায়ের সমালোচনা করেছে, ফারাবী থেকে আইসিস শিরোনামের একটি লেখাকে কেন্দ্র করেই পারভেজের সেসমস্ত সমালোচনা- হতে পারে একেবারেই ভুল, একদম বালকসুলভ-কিন্তু সেই লেখাটিকে ফারাবীর পক্ষে, ফারাবীকে রক্ষার জন্যে কেউ বলতে পারে, ফারাবীকে নিয়ে অভিজিতের লেখাটির কারণেই পারভেজ আলম ঝাঁপিয়ে পড়েছে- এমনভাবে কেউ আলোচনাটা শুরু করতে পারে- তা কল্পনাও করতে পারি না। ফারাবীর পক্ষে যায় এমন একটি বাক্য কি পারভেজ আলমের লেখায় পাওয়া কি যায়? তাছাড়া, পারভেজ আলম তার পোস্টে শুরুতে জানাচ্ছেনঃ “পুরো লেখাটি আমার আলোচনার বিষয়বস্তুও না। লেখাটিতে ফারাবির ফতোয়াবাজি, বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের উপর মৌলবাদীদের হামলা, সরকারি নির্যাতন, বাক স্বাধীনতা প্রসঙ্গ, অভিজিৎ রায়ের বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও রকমারিডটকম প্রসঙ্গসহ বিভিন্ন বিষয় এসেছে যা নিয়ে আমার এই লেখায় কিছু বলার নাই। আগ্রহী পাঠকরা মূল লেখাটি পড়ে নেবেন। আমি শুধু অভিজিৎ রায় তার এই লেখায় ধর্ম ও টেরোরিজম বিষয়ে যে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং টেরোরিজম সমস্যা সমাধানের যেধরনের আভাস দিয়েছেন তা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই”। অভিজিৎ রায় কিভাবে বলতে পারেনঃ “নিধিরাম সর্দার সাহেব যথারীতি তার ঢাল তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ালেন ফারাবীর সমর্থনে”? এক “সালাফি সেক্যুলার” বলাতেই এমন তীব্র রাগঃ “ভাসুরের নাম নেয়া যেহেতু বারণ, তাই ফারাবীকে সোজাসুজি সমর্থন না জানিয়ে আমাকে বানালেন, ‘সালাফি সেক্যুলার’”?

পারভেজ আলমের প্রতি ফারাবীকে সমর্থনের অভিযোগ শুধু নয়, একেবারে বড়সড় একটা ইতিহাসও রচিত হলো! ফারাবীর হুমকিতে ভয় পেয়ে “ফারাবীকে নিয়ে কেউ কিছু লিখলেই তিনি নিধিরাম সর্দারের মতো অদৃশ্য ঢাল তলোয়ার নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান”– এমন ইতিহাসের সাথে সাথে অভিজিৎ রায় ফারাবীর সাথে দুঃসম্পর্কিত আত্মীয়তার সম্পর্কও খুঁজে পেয়েছেন! বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো লেখার কোন লিংক বা সন্ধান না দিয়ে এমন কথা বলাটা অভিজিৎ রায়ের কাছে কাম্য নয়। ফারাবীর হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারভেজ আলমকে কখনো দেখিনি, বরং দীর্ঘদিন ধরেই স্বনামে প্রকাশ্যে ইসলাম, ধর্মতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে ধারাবাহিক লিখে যাচ্ছেন- এমনকি তার আরজ আলী মাতুব্বর পাঠাগারের প্রকাশনায় নাস্তিক্যবাদী প্রবন্ধ প্রকাশ করে লোকজনের হাতে হাতে বিক্রি করতে দেখেছি। আমার “জাকির নায়েক, কোরআন ও নারী” সংক্রান্ত লেখাটি (মুক্তমনা ব্লগের ডানদিকে “সর্বোচ্চ পঠিত” অংশে উপর থেকে তিন নম্বর পোস্ট) তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করার দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন (আমার যাবতীয় লেখার মধ্যে যেকটির কারণে মেসেজে ও পোস্টে সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম সেগুলোর মধ্যে এটি ও মুহম্মদ সাঃ এর বিয়ে লেখাটি শীর্ষে থাকবে)। “কে জানে!” বলে অর্থাৎ নিশ্চিত না হয়ে আত্মীয়তার সূত্র আবিস্কার করা আদৌ কতখানি রুচিকর,- তা অভিজিৎ রায়কে আরেকটু ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাই। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই এ সমস্ত ইতিহাস সত্য (মানে ফারাবীর হুমকিতে পারভেজ আলম ভয় পেয়েছে বা কোনরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে- যদিও অভিজিৎ রায় তার লেখায় এসমস্ত অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ হাজির করেন নি)- তদুপরি একটা সমালোচনার জবাবে লিখিত স্ট্যাটাসে/ পোস্টে এসব কতখানি অপরিহার্য, কতখানি প্রাসঙ্গিক? আমার কেন জানি লালসালুর মজিদের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ে যায়ঃ “মিঞা, তোমার দাড়ি কোথায়?”

কেবল অভিজিৎ রায় যে “মিঞা তোমার দাড়ি কোথায়?” প্রশ্নটি করেছেন তা নয়, একই কাজ করতে দেখি আসিফ মহিউদ্দিনকে, দেখি মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ারকেও। আসিফ মহিউদ্দিন পারভেজ আলমকে জাকির নায়েকের সাথে তুলনা করে বসেন। আর গোলাম সারওয়ার পারভেজ আলমকে ভাইরাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান আহরণের পরামর্শ দেন, পারভেজ আলমের বিরুদ্ধে অভিজিৎ রায়কে মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর অভিযোগ আনেন- যার প্রমাণ হিসেবে পারভেজের সর্বশেষ পাচটি ব্লগের স্ক্রিনশট উত্থাপিত হয়! পারভেজ আলমের লেখাটিতে ভাইরাস সংক্রান্ত জ্ঞানের কোথায় ঘাটতি বা ভুল আছে তা কয়েকবার পড়েও খুঁজে পাইনি, এমনকি গোলাম সারওয়ার প্রদত্ত ভাইরাসের সংজ্ঞাটি পড়ার পরেও পারভেজের পোস্টে এই ঘাটতি খুঁজে পেলাম না (আফসোস), ফলে মনেই হয়েছে পারভেজকে এইসমস্ত পরামর্শ দেয়ার চাইতে পারভেজের লেখা ধরে দেখানো দরকার ছিল, কোন জায়গায় ‘ভাইরাস’ সম্পর্কে পারভেজ আলমের জানা বোঝার ঘাটতি আছে! অভিজিৎ রায়কে পারভেজ আলমের মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে দাঁড় করার অভিযোগটিও সেইরকম, অভিজিৎ সহ বাংলাদেশের নাস্তিক মুক্তমনারা কবে সেই মোল্লা- মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল না? পারভেজ নিজেও কি নেই? আর, পারভেজের কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে ইতোমধ্যেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হিসেবে এই দেশের মোল্লা-মুসলিমদের কাছে পরিচিত একজনকে নতুন করে অমন দাঁড় করানোর (অভিজিৎ রায়ের মত গোলাম সারওয়ারও কি মনে করেন- ফারাবীর ভয়ে ভীত হয়েই একাজ করছেন?)? আর, পাঁচটি ব্লগ পোস্টের স্ক্রিনশট দিয়ে এমন দাবি দেখে অবাকই হলাম। একটা ডিবেট শুরু হওয়ার পরে কাউন্টার- কাউন্টারের কাউন্টার … এমন করে চললে একাধিক লেখা ধারাবাহিকভাবে তো আসতেই পারে, এক পারভেজ আলমের লেখার জবাবে অভিজিৎ রায় ফেসবুকে বড় বড় দুটো লেখা দিয়েছেন, গোলাম সারওয়ার মুক্তমনায় দু দুটো পোস্ট দিয়েছেন, আসিফ মহিউদ্দিনও বড় স্ট্যাটাস দিয়েছেন … তাহলে পারভেজ আলম কেন ৫ টি পোস্ট লিখতে পারবেন না- সেটাই বোধগম্য হলো না। অন্তত এই ব্যাপারে কি বরং সাধুবাদ জানানো উচিৎ না যে, তিনি ডিবেটে থাকতে চান বলেই ধৈর্য ধরে এতগুলো লিখেছেন, লিখছেন?

উল্টোদিকে পারভেজ আলমও যে সেই একই কাজ করেছেন, সেটিও এখানে বলে যাই। “অভিজিৎ রায়ের সমালোচনা করেছি বাংলাদেশের স্বার্থে” শিরোনামে পারভেজ আলমের ৩য় পোস্টের শেষ প্যারাঃ “যাই হউক, আমি অভিজিৎ রায়ের সমালোচনা আসলে ভয়ের চোটেই করেছিলাম। তবে সেটা আমার একার অস্তিত্বের জন্যে নয়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যে ভয়”। এই যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব কোথায় কিভাবে বিপন্ন হলো, আর কেনইবা তার জন্যে ভয় পেয়ে অভিজিৎ রায়ের সমালোচনা এত অপরিহার্য মনে হলো- লাখ টাকার প্রশ্ন! অভিজিৎ রায় বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যে কতটুকু হুমকি, কিংবা ভয়ে কম্পমান পারভেজ আলমের এহেন সমালোচনার আউটপুটটাই বা কি- তথা সমালোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অস্তিত্ব কতটুকু রক্ষা পেল- বুঝা ভার! বাস্তবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার কথিত সব দায়দায়িত্ব এককভাবে নিজের ঘাড়ে টেনে নেওয়ার কোন মানে দেখিনা, আর অভিজিৎ রায় সহ যারা ধর্ম বিশ্বাসকে বিশ্বাসের ভাইরাস দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন, ইসলামিক জঙ্গীদের উত্থানের পেছনে লিটারাল কোরআনের ইন্টারপ্রিটেশন তথা সহি ইসলামকে দায়ী করছেন- তাদের এইসব কিছু আলোচনা, যুক্তি তর্কেই যদি বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে করে কেউ, তবে মনে করি- অভিজিৎ রায়দের সমালোচনার চাইতে আরো অনেক বেশি জরুরি, যে প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি এই সমস্ত আলাপ- বক্তব্যের অযুহাতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে উদ্যত হচ্ছে- সেই প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির মোকাবেলা করা।

যাহোক, পারভেজ আলম- অভিজিৎ রায়- গোলাম সারওয়ার প্রমুখের এই সমস্ত “লুজ টক” (যা তাদের নাম ও কাজের সাথে মানানসই বলে আমি মনে করি না) আলোচ্য মূল ডিবেটকে কিছুটা খাটো করেছে, তাদের অসহিষ্ণু ও শিশুসুলভ আচরণ বিতর্কের মেজাজকেও অনেক সময় নষ্ট করেছে বলে মনে হয়েছে বলেই- মূল ডিবেটের চাইতে এতক্ষণ এইসব লুজ টক নিয়ে কথা বলা। আশা করছি, তাদের সমালোচনা করার ধরণটি নিয়ে আমার সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিবেন। এবারে অল্প করে মূল ডিবেট প্রসঙ্গে ঢু মারা যাক তাহলে …

কি নিয়ে ডিবেট তবে?
আমার মনে হয়েছে মূল ডিবেটের বিষয়গুলো হচ্ছে, মিমতত্ত্ব – বিশ্বাসের ভাইরাস-সহি ইসলাম – কোরআনের লিটারাল ইন্টারপ্রিটেশন ও কনটেক্সটচুয়াল ইন্টারপ্রিটেশন – বর্তমানের ও যুগে যুগে সংঘটিত নানা ধরণের ধর্মীয় জঙ্গীবাদ, সহিংসতা, ঘৃণা প্রভৃতির মূল উৎস ও কারণ। এসমস্ত বিষয়ই ডিবেটে আসলেও আমার কাছে মনে হয়েছে এই ডিবেটের মূল ভারকেন্দ্র হচ্ছে এই প্রশ্নটি যে- যুগে যুগে সংঘটিত, বিশেষ করে বর্তমানের নানা ধরণের ধর্মীয় জঙ্গীবাদ, স্পেসিফিকালি বললে ইসলামিক জঙ্গীবাদ, সহিংসতা, ঘৃণা প্রভৃতির মূল উৎস ও কারণ কোনটি? সহি ইসলাম, কোরআন ও ধর্মকেন্দ্রিক মতাদর্শ তথা ধর্মান্ধতা? নাকি, জিও পলিটিকস, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তার, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রভৃতি? অন্য বিষয়গুলোতে ধীরে ধীরে আমার চিন্তা তুলে ধরার আগে এই মূল ভারকেন্দ্রের ডিবেটটির ব্যাপারে আমার মতটি দেয়া যাক।
আমার মতে- উৎস বলি, কারণ বলি- উপরে উল্লেখিত দুটো বিষয়কেই সামনে আনতে হবে। কোনটিকে বাদ দিতে চাই না। কোনটি প্রায়োর এই ডিবেট হতেই পারে, কিন্তু আমার কাছে দুই কারণই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাটিতেই এই ডিবেটে দুই পক্ষকে আমার দুই মেরুতে অবস্থানকারী মনে হয়েছে। একপক্ষের কাছে একটি কারণের গুরুত্ব আকাশসম তো অপরটি মাইক্রোস্কোপিক! ফলে এখান থেকে যে দ্বিমত বা দূরত্ব তার ব্যপ্তিও হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় অসীম, ফলে সেই ঝাঁজ প্রতিটি বিতর্কেই ফোয়ারা হয়ে উপচে পড়েছে। যাহোক, আমি আমার মতে উভয় বিষয়ের গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করি।

ছোট দুটো গ্রাম্য চুটকি বলি। প্রথমটাঃ “বাপ বেটা নদীর ঐ পাড়ে ওয়াজ শুনতে গেছে। সারারাত ওয়াজ শুনে ভোররাতের দিকে বাড়ী ফিরতে নদী পার হচ্ছে। হাটু পানি, কিন্তু কিছুটা স্রোত আছে। বাপ খেয়াল করলো- পোলা বারেবারে পিছিয়ে পড়ছে। শেষে বাপ হাক দেয় পোলাকে- কিরে হাসু কি হলো তর? খালি পেছায় পড়স ক্যান? পোলায় বলে- ক্যান, বড় হুজুরে যে কইলো হাটুর উপরে কাপড় তোলা হারাম! বাপে গালি দিয়া পোলারে জবাব দেয়- ঐ হারামজাদা, নদীর ঐ পাড়ের ওয়াজ এই পাড়ে আনতে গেছোস ক্যান?” দ্বিতীয়টাঃ “দূরদেশ থেকে হুজুর গ্রামে আসছে- ওয়াজ হবে,মাহফিল হবে, দোয়া দরুদ হবে। হুজুরের থাকার ব্যবস্থা হইছে গ্রামের মাতবরের বাড়িতে। শীতের রাত হইলেও- অনেক রাত পর্যন্ত মেলা মানুষ হুজুরের ওয়াজ মনোযোগ দিয়া শুনছে- হুজুরের সাথে আল্লার ইবাদত বন্দিগী মেলা করছে! গ্রামের মেয়েদেরও ওয়াজ শোনার আলাদা পর্দা ঘেরা ব্যবস্থা ছিল। তো ওয়াজ শেষে মাতব্বরের বাড়িতে ভালো খাওয়া দাওয়া শেষে মাতব্বর হুজুর আর তার চেলার ঘর দেখিয়ে দিল। শুতে গিয়ে দেখে- বিছানা বালিশ সব আছে, খালি কাঁথা- লেপ- কম্বল কিছুই নাই। এইদিকে শীতকাল, সেইরকম ঠান্ডা। দুজনেই কাঁপতে লাগছে। হুজুর শেষে না পেরে চেলাকে বাড়ির ভিতরে পাঠালো কাঁথা- কম্বল কিছু পাওয়া যায় কিনা। চেলা খালি হাতে ফিরে এসে বলে- হুজুর সর্বনাশ হইছে- আপনি ওয়াজে যে বলছেন, মহিলাদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র ব্যাটাছেলের ব্যবহার করা হারাম! ঐটা শুনে আমাগো ঘর থেকে সব কাঁথা সরায় নিছে, কেননা সবই মহিলাদের শাড়ি দিয়ে তৈরি। হুজুর আবার চেলাকে পাঠালো এই বলতে যে, এই ফতোয়া হচ্ছে গরমকালের জন্যে, শীতকালের জন্যে না। চেলা আবার খালি ফিরে এসে বলে- তারে নাকি জিজ্ঞেস করেছে- গরমকালের ওয়াজ শীতকালে শুনান ক্যান? হুজুর আবার চেলাকে বলতে পাঠালো- হুজুর তো সব ঋতুতে, সব কালে আসতে পারবে না- তাই অগ্রিম গরমকালের ওয়াজও এই শীতকালে করে ফেলেছে”।

চুটকি দুটি সাদামাটা, তেমন হাসি আসেনা- কিন্তু আমার কাছে খুব সিগনিফিকেন্ট মনে হয়। অনেক আগে গ্রামের বাড়িতে এই চুটকি শোনা, আস্তিক ব্যক্তির কাছে শোনা- আমি ছাড়া বাকি শ্রোতারাও ছিল আস্তিক। বুঝতে পারি, এরকম চুটকি সম্ভবত বাস্তব অভিজ্ঞতাজাত। আর এ কারণেই এগুলো আমার কাছে খুব সিগনিফিকেন্ট মনে হয়, আমাদের ধর্ম বিশ্বাস আর ধর্মাচরণ- আমাদের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী আবর্তিত হয়- সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পারিপার্শিক নানা কিছুর সাথে একরকম সমন্বয় সাধন করেই এগুলো চলে। ফলে, এগুলো পরিবর্তিতও হয়। ধর্ম জিনিসটাই লৌকিক, একেবারে মানুষের হাতে গড়া। ফলে, এখানে কোন ধর্মের পক্ষেই একেবারে উৎসকালীন বিশুদ্ধতা নিয়ে সর্বসময়ে সর্বদেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, ধর্মের ঐশ্বরিক বিশুদ্ধতার দাবি- সমাজ সংস্কৃতি নৈতিকতার পরিবর্তনকে মন্থর করে দেয় ঠিকই, কিন্তু একেবারে বন্ধ করতে পারে না। এবং আজ পর্যন্ত কোন ধর্মই কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়া, অন্য সংস্কৃতি- নৈতিকতা- আচার- কায়দা কানুনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ছাড়া দেশ-কাল পাড়ি দিতে পারেনি। একইভাবে ১৪০০ বছর আগের আরব সমাজের প্রেক্ষাপটে, সেখানকার রীতি নীতি, আচার, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতার সাথে সমন্বয় করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে দ্বন্দ্ব করেই যেমন ইসলামের উদ্ভব হয়েছিল, ঠিক তেমনি সেই একই ইসলাম যখন আরব পার হয়ে আফ্রিকায় গিয়েছে, ইউরোপে গিয়েছে, এই ভারত মহাদেশে এসেছে- তার অনেক কিছুই পাল্টাতে হয়েছে। আবার সময়ের সাথে সমাজের আর্থ সামাজিক নানা প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনেও ইসলামকে অনেক কিছু পাল্টে নিতে হয়েছে। খোদ সৌদি আরবেই সেই মুহম্মদ সাঃ এর সম সাময়িক অনেক ইসলামিক রীতি নীতি আজ আর পাওয়া যাবে না। যুদ্ধ বিগ্রহ- লুন্ঠন- ডাকাতি নির্ভর আরব সমাজে আয় রোজগারের জন্যে যতই কোরআনে ‘গনীমতের মাল’ এর বিধান থাকুক না কেন, পরিবর্তিত আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজ আরব দেশে এই গনীমতের মালের উপর নির্ভর করে অর্থনীতি চালাতে হয় না। জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত উন্মেষ ও প্রসার ঘটেছে ধর্মীয় যাদু টোনা তুক তাকের উপর নির্ভরতা ততই কমেছে, কমছে এবং আরো কমবে- যতই খোদ নবী মুহম্মদ সাঃ নিজেই যাদু টোনার শিকার হয়ে তা থেকে মুক্ত হতে কোরআনের আয়াত/ সুরা নাযিল হোক না কেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীদের যতবেশি যুক্ত হওয়ার প্রয়োজনিয়তা অনুভূত হবে, তত বেশি তাদের শিক্ষায় আসতে হবে, যতবেশি তারা অর্থনৈতিক কাজে কর্মে যুক্ত হবে- সমাজে তাদেরকে ঘরে আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে- এটাই হচ্ছে আজকের বাস্তবতা। ফলে, হেফাজত তান্ডব চালিয়ে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে তুলকালাম করে ফেললেও গার্মেন্টস সেক্টরে নারীদের আগমন কমাতে পারেনি এতখানি, এমনকি গার্মেন্টসের বিশ্বাসী নারীদের গায়ে বোরখাও চাপাতে পারেনি। এতসব আলোচনার আসলে উদ্দেশ্য এটাই যে, আমি মনে করি যে- আজকের ধার্মিক বা আস্তিকদের সমস্ত ধর্মীয় আচার আচরণ, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাস একেবারে উৎপত্তিকালের ধর্মীয় আচার- আচরণ- বিশ্বাস- নীতি- নৈতিকতা দিয়ে বুঝতে যাওয়াটা ভুল, বরং আজকের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি, আজকের আচার আচরণ, নীতি নৈতিকতার ধারণা, বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এসব দিয়ে বুঝাটা খুব জরুরি। এ অর্থে আমিও পারভেজ আলমের মত মনে করি- ফারাবি, হেফাজত থেকে শুরু করে তালিবান- আইসিস সমস্তকে আজকের প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে ১৪০০ বছর আগের মুহম্মদ সাঃ প্রবর্তিত ইসলাম দিয়ে বুঝতে চাইলে আংশিক একটা দিকই বুঝতে পারবো। ফারাবির ফারাবি হওয়া, হেফাজতের হেফাজত হওয়া, তালিবানের তালিবান হওয়া কিংবা আইসিসের আইসিস হওয়ার পেছনে কেবল যদি আমরা মুহম্মদ সাঃ প্রবর্তিত সহি ইসলাম আর বাই টেক্সট কোরআনকে দেখি, তাহলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মুহম্মদ সাঃ উম্মত- সহি ইসলামে বিশ্বাসী মুসলিম আরো অনেক আগে ফারাবি হয়ে বসে থাকতো, হেফাজত হয়ে সেই পাক পাকিস্তান রক্ষার লড়াইয়ে ৭১ এ ইসলামী বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলত! খেলাফত ঘোষণার জন্যে আইসিসকে ২০১৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না, কিংবা খেলাফত ঘোষণার সাথে সাথে দুনিয়ার শত কোটি মুমিন বান্দা অস্ত্র সস্ত্র হাতে নিয়ে সেই খেলাফতকে দুনিয়াব্যাপি ছড়িয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ত! কিন্তু এসবের কিছু ঘটেনি, ঘটছে না, কেননা দুনিয়াজুড়ে সমস্ত উম্মত মুমিন মুসলিম বান্দারা একইভাবে ক্রিয়া করছে না, এমনকি বিশ্বাসের জায়গা থেকে সহমর্মী হলেও সমর্থন করলেও- একই কাজে একইভাবে নামছে না। কেন? হেফাজতের বড় সোর্স আমাদের মাদ্রাসা- স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪০ বছরে যেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার হয়েছে, যেভাবে লুটপাটের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানহীন একটা সমাজ ব্যবস্থাতে আনাচে কানাচে মাদ্রাসা- মসজিদ অন্যান্য সামাজিক- সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জায়গা দখল করেছে- তা নাহলে কি হেফাজতের বাস্তবতা আমাদের দেখতে হতো? আমি এমনটা মনে করি না। তালেবান- আইসিস নিয়েও বলা যায়, কেন এইসব জঙ্গী ঐ মধ্যপ্রাচ্যেই তৈরি হচ্ছে? কেন পাকিস্তানেই তৈরি হচ্ছে? কেন মালয়েশিয়ায় হচ্ছে না? কেন ইন্দোনেশিয়ায় তৈরি হচ্ছে না? বাংলাদেশে হচ্ছে না? কিংবা আজকে যেভাবে দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে- সেটা ৫০-৬০ বছর আগেও ছিল না কেন? ৫০-৬০ বছর আগে সহি ইসলাম কি অন্যরকম ছিল?

ফলে, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের মাঝে কেউ যদি ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দেখতে চায়, পাওয়ার নিয়ে দুনিয়ার মোড়লদের পলিটিকসকে দেখতে চায়- তাকে কি খুব ভুল বলা চলে? এই অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো, জাতিসংঘের নানা হস্তক্ষেপের কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? বড় বড় তেল কোম্পানির উদ্যোগ, পরিকল্পনা, পাইপ লাইন বসিয়ে তেলের নানা রুট তৈরি করা, ডলারের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা- এসব কি অস্বীকার করা যাবে? এবং এইসব আইসিস বলি, তালেবান বলি, হিজবুল্লাহ বলি- তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র কি তারা তৈরি করেছে? কোথায় পেয়েছে অস্ত্র? কে দিয়েছে ট্রেইনিং? এমনকি ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া সহ বিভিন্ন দেশে এত এত অস্ত্র কিভাবে ঢুকেছে? সিরিয়ার বাশার সরকারকে উৎখাত করতে আইসিসকে অস্ত্র- প্রশিক্ষণ দেয়ার যে খবর এসেছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন আবার আইসিসকে শায়েস্তা করতে সিরিয়ার আরেক বিদ্রোহী গ্রুপকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এরা আবার যখন কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে, তাদের শায়েস্তা করতে আরেক গ্রুপকে দিবে? আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব নষ্ট করতে তালেবানকে যে যুক্তরাষ্ট্র পয়দা করলো, সেটাকেই ধ্বংস করতে দুনিয়াজুড়ে ওয়ার অন টেরর পরিচালনা করলো- এই ইতিহাস কি অস্বীকার করা যাবে? সেটা যদি অস্বীকার না করি, তাহলে কিভাবে কেবল ‘সহি ইসলাম’কে দোষারোপ করতে পারি? ফলে, এই জায়গাটিতে আমি স্পষ্টতই পারভেজ আলমের অবস্থানকে সঠিক মনে করি, অভিজিৎ রায়ের সাথে দ্বিমত করি।

কিন্তু, পারভেজ আলমের পুরো অবস্থানকে, সমস্ত বক্তব্য, বক্তব্য উপস্থাপনের ঢং এর সাথে দ্বিমত করি। এ কি অস্বীকার করার কোন জো আছে যে, এই যে ধর্ম আছে বলেই, অযৌক্তিক- কুপমন্ডুক ধর্মীয় বিশ্বাস আছে বলেই- একে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে, যুগে যুগে একে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিভেদ, হিংসা, দ্বেষ ছড়ানো হয়েছে? কেউ কি অস্বীকার করতে পারবে যে, ধর্ম- জাত পাত- প্রথা- বর্ণ ভেদ আছে বলেই- মানুষকে এত বিভক্ত করা সহজ হয়েছে? কেউ কি অস্বীকার করতে পারবে যে, ধর্ম আছে বলেই এককালে রাজা বাদশারা পুরোহিততন্ত্রকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজত্ব কায়েমে প্রজাকে অনুগত করতো, ধর্ম আছে বলেই ধর্মীয় বিভেদকে উসকে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব টিকে রাখার সুযোগ পেয়েছে, ধর্ম আছে বলেই হিটলার ইহুদি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দুনিয়ার নৃশংসতম হত্যাকান্ড চালাতে পেরেছিল? কেউ কি অস্বীকার করতে পারবে যে, ধর্ম আছে বলেই আজকের সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের লুন্ঠনকে আড়াল করতে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডকে সামনে আনতে পারছে? পারভেজ আলমকে জিজ্ঞেস করি- ইসলাম না থাকলে, কোরআন না থাকলে, মুহম্মদ সাঃ আরব দেশে যে উপায়ে ইসলাম কায়েম করেছেন তা না করলে- কি আদৌ ফারাবি- হেফাজত- তালেবান- আইসিসকে আমরা দেখতাম? কোরআনে যদি সেই হিংসার কথা না থাকতো, মুহম্মদ সাঃ ও তার সাহাবীরা যদি একের পর এক যুদ্ধগুলোর মাধ্যমে (আদতে এগুলোর একটা বড় অংশ ডাকাতি, লুন্ঠন ছাড়া কিছুই ছিল না, বিশেষত মদীনার ইহুদী গোষ্ঠীগুলোকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল) ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করলে কি তালেবান, আইসিস, হেফাজতরা ইসলামী বিপ্লবের লাইন খুঁজে পেত? আমাদের এখানে হিন্দু মুসলিমরা কেউ না থাকলে কি বৃটিশরা ধর্মীয় দাঙ্গা লাগাতে পারতো? তেমনি, চাইলেই কি আমেরিকা হাজার চেষ্টা করেও কি তালেবান, আইসিসকে গড়ে তুলতে পারতো?

ফলে, যে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে জেহাদি জোস অর্জিত হচ্ছে, ধর্মীয় যে ঘৃণার বানী থেকে আজকেও ঘৃণার প্রচার- প্রসার, সেটাকে যারা ধরিয়ে দেয়, সেটাকে যারা সামনে আনে- তাদের কাজটাকে আমি এতটুকু কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না; যেমন কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না- যারা আজকের প্রেক্ষাপটে জঙ্গীদের উত্থানে ভূ-রাজনৈতিক কারণকে সামনে এনে লিখছেন কথা বলছেন। পারভেজ আলম যখন সালাফি আইসিসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মুক্তমনাদের ‘সালাফি সেক্যুলার’ আখ্যা দেন- কেবল সালাফি আইসিসের রুট হিসেবে তাদের দাবী করা কোরআন- ইসলামকে সামনে আনার অপরাধে, তখন মনে হয়- এই অশ্রদ্ধা মুক্তমনারা নাও পেতে পারতো!

এই হচ্ছে মূল ডিবেটের বিষয়ে আমার বক্তব্য বা অবস্থান। এবার ডালপালা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে শেষ করছি। প্রথমে সহি ইসলাম প্রসঙ্গ, তারপরে বিশ্বাসের ভাইরাস প্রসঙ্গ।

‘সহি ইসলাম’ জিনিসটা কি? এই ভেজাল দুনিয়ায় ‘সহি’ বলিয়া কি কিছু আছে নাকি মশাই?
অভিজিৎ রায়, আসিফ মহিউদ্দিন যখন ইসলামিক নানা ঘটনা উল্লেখ করে জানান দেন- এটাই সহি ইসলাম, তখন ঠিক একমত পোষণ করতে পারি না। বাস্তবে, আমার মতে ‘সহি ইসলাম’ বলে কিছুই নেই। কোন ‘সহি’ ই আসলে সহি নয়। সহি হিন্দুইজম, সহি ইহুদি, সহি খ্রিস্টানিজম- এসব বলে কিছুই নাই। কেননা, সমস্তই মানুষের তৈরি, একটা নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ভূখন্ডে- মানুষের হাত ধরে এসব ধর্মের উতপত্তি, আরো অসংখ্য মানুষের হাত ধরে এসব ধর্মের দেশ কালের সীমা পাড়ি দেয়া … সুতরাং প্রতিটা পর্যায়েই এগুলোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটেছে- এমনকি অনেক ধর্মের উৎপত্তিকালকেও যদি ধরি- সেখানে এক বা একাধিক মানুষের আস্ত জীবনকালে নানা ঘটনা, নানা পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ, বক্তব্য দেখা যায়- যেগুলো ধর্ম হিসেবে স্থান পেলে- সেসবের মধ্যে ঠিক কোনটি সহি- কোনটি অসহি এমন বিপাকে পড়তে হয়! হিন্দুরা এককালে গরু খেলেও, ইন্দোনেশিয়ার বালির হিন্দুরা আজকেও গরু খেলেও- বলতে পারি না যে, বালির হিন্দুদের গরু খাওয়াই সহি বা ভারতের হিন্দুদের গরু মাতাকে না হত্যা করাই সহি। ইসলামের কোরআন এর লিটারাল ব্যাখ্যাকেও সহি বলতে পারি না, কেননা ওসমান আমলে এরকম আরো অনেক খন্ড কোরআন পুড়ে ধ্বংস করা হয়েছে। নবীর জীবনকেও সহি ইসলাম বলতে পারি না, কেননা তিনি নিজেই তো একেক সময়ে একেক আচরণ করেছেন। মক্কায় থাকা অবস্থায় যখন চাপে ছিলেন- তখন আল্লাহ প্রেম, মানব প্রেম এর বানী ছেড়েছেন- যার যার ধর্ম তার তার- এসব ভালো ভালো কথা বলেছেন, আবার যখন মদীনায় গিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি গেলেন- আরো ক্ষমতা করায়ত্ত্ব করতে গিয়ে ঠিক উল্টো কাজ করেছেন- রাজনীতির প্রয়োজনে হিংসার বানী ছড়িয়েছেন। নিজের প্রয়োজনমত, সুবিধামত আল্লাহর বানী পয়দা করেছেন- কোনটাকে সহি বলবো? নবী মারা যাবার পর পরেই তার সাহাবীদের মধ্যে, আত্মীয়দের মধ্যে খেলাফত নিয়ে ক্যাচাল হয়েছে। সাহাবীদের মধ্যেই কোরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে, হাদীস নিয়ে মতপার্থক্য হয়েছে, কোরআন সংকলন নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য হয়েছে; ক্ষমতায় থাকা খলিফাদের রাজনীতির স্বার্থেই যেসব কোরআন হাদীস টিকেছে- সেগুলো পরবর্তী আমলে যেতে পেরেছে! খলিফাদের বেশিরভাগই মুসলমানের হাতে খুন হয়েছেন। কারবালায় দুই গ্রুপ মুসলিমের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছে। এইসব সাহাবীরাই তো মুহম্মদ সাঃ পরবর্তী ইসলামকে পরবর্তী যুগে নিয়ে গিয়েছে। ফলে, কোনটা সহি- কিভাবে সিদ্ধান্ত নেই? ফলে, আমার মতে যার কাছে যেভাবে ইসলাম গিয়েছে- সেটাকেই সে সহি ভাবতেই পারে!

তবে হ্যাঁ, আমার কাছে সহি ইসলাম বলে কিছু নেই, কিন্তু যে মোমিন ব্যক্তি এই সহি ইসলামে বিশ্বাস করে, যার কাছে কোরআন মুহম্মদ সাঃ ও তার সাহাবীদের লেখা না- স্বয়ং আল্লাহ এটা লিখে পৃথিবীতে মানব কল্যাণে পাঠিয়েছে- তাদেরকে সেই সহি ইসলামের লিটারাল ব্যাখ্যা- আলোচনা তুলে দেখানোটা খুব জরুরি মনে করি। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে- তার ইসলাম উৎপত্তির সময় থেকেই খুব শান্তির ধর্ম- কোরআনে কোন ঘৃণার বাণী নেই- তাদের ভুল ভেঙ্গে দেয়ার কাজটি কম জরুরি না, সে জায়গা থেকেই তাদের সহি ইসলামের আসল অবস্থা তুলে ধরাটা দরকার। আরেক কারণে এই লিটারাল ব্যাখ্যা দেখানো দরকার। জাকির নায়েক- হারুন ইয়াহিয়া – বুকাইলি সহ অনেক মোমিন মনে করে এই কোরআন হচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞানের আকড়। তারা যখন কোরআনের অনুবাদ- ব্যাখ্যা থেকেই মহা বিজ্ঞান আবিস্কার করে ফেলছেন, তখন মুহম্মদ সাঃ (তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ) যে কত বড় মুর্খ ছিলেন তা দেখিয়ে দেয়া খুব আবশ্যক মনে করি।

বিশ্বাসের ভাইরাস? বাপরে বাপ- ডরাইছি …
এবারে, শেষ প্রসঙ্গ- বিশ্বাসের ভাইরাস। মুক্তমনাতেই এ সম্পর্কে প্রথম জানতে পেরেছি। দিগন্ত সরকার রিচার্ড ডকিন্সের একটা প্রবন্ধ অনুবাদ করেছিলেন- সেখানে তার নিজের বক্তব্যও যুক্ত করেছিলেন- সেটা প্রথম পড়া। এরপরে অভিজিৎ রায়ের অল্প সল্প কিছু লেখা পড়েছি। কেন জানি, এটা আমাকে টানতে পারেনি। ফলে, এ নিয়ে খুব বেশি পড়া হয়নি। অভিজিৎ রায়ের বইটি তাই আমার পড়া হয়নি। অভিজিৎ রায়ের বই না পড়েই পারভেজ আলম বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে কেন কথা বলতে গিয়েছেন এটা এক অভিযোগ, এমনকি ভাইরাস সম্পর্কে সাধারণ বিজ্ঞানের বই পারভেজের পড়া নেই- এটা আরেক অভিযোগ! দুই অভিযোগই আমার কাছে দুর্বল মনে হয়েছে। পারভেজ যতটুকু আলোচনা করেছে, যুক্তি উপস্থাপন করেছে- সেটায় ভুল থাকলে ধরিয়ে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু, আমি সেই জবাবগুলোয় সন্তুষ্ট হইনি। পারভেজের তোলা প্রশ্নগুলোর গোলাম সারওয়ার বা অভিজিৎ রায় কি পরিস্কার করতে পেরেছেন? আমার মনে হয়, না। এই সংক্রান্ত আলোচনায় আমার কম বুঝ থেকেই দু চারটি কথা ভয়ে ভয়ে বলি। ভয়ে ভয়ে বলছি কারণ পারভেজ আলমের মত আমারো বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে কম পড়াশুনা, আমার হয়তো একেবারেই কম পড়া। সেই কম পড়া থেকেই এই ডিবেটে পারভেজ আলম- অভিজিৎ রায়- গোলাম সারওয়ারের আলোচনাগুলো পড়েছি- সেই যুক্তি তর্ক টুকু নিয়েও আমার মধ্যে চিন্তা তৈরি হতে পারে, মত তৈরি হতে পারে- অনেক প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। ফলে সেসব আমি উপস্থাপন করতেই পারি। আমার এই চিন্তা, মত, প্রশ্ন প্রচন্ড ভুল হতে পারে, অযৌক্তিকও মনে হতে পারে- আশা করি, এমন মনে হবে যার, তিনি তা ধরিয়ে দিবেন- কিন্তু কেন আমি অভিজিৎ রায়ের বইটা না পড়েই, বা এ সংক্রান্ত গাদা গাদা বই পড়ে গাদা গাদা জ্ঞান অর্জন না করেই আলোচনা করতে যাচ্ছি- সেই কৈফিয়ত চাবেন না।

শুরুতেই বলে নেই- কেন আমি মিমতত্ত্ব, বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে আগ্রহবোধ করিনি। কারণ, মানব সমাজ- মানব প্রকৃতি- মানব ইতিহাসকে বুঝতে এইসব তত্ত্বকে আমার আবশ্যক মনে হয়নি। এর চাইতেও অন্য আরো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমাকে অধিক সন্তুষ্ট করে বলেই- এতে আগ্রহ পাইনি। এখানেই পারভেজ আলমের একটা প্রশ্ন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছেঃ “কারন দিনশেষে মিমতত্ত্ব এখন পর্যন্ত অবশ্যই একটি তত্ত্ব। কোন প্রমানিত বৈজ্ঞানিক সত্য না”। একইভাবে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ও কি বৈজ্ঞানিক প্রমানিত সত্য? সমাজ বিজ্ঞান, তথা মানব সমাজ- তার গতি প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি- এসব ব্যাখ্যায় মিমতত্ত্ব বা বিশ্বাসের ভাইরাস ছাড়া প্রকৃত সত্য আমরা বুঝতে পারবো না, এমন কি? এমন যদি না হয়, তাহলে আমি একে বাদ দিয়ে চলার তো স্বাধীনতা দাবী করতেই পারি, না কি? গোলাম সারওয়ার পারভেজ আলমের জবাবে লিখেছেনঃ “অভিজিৎ বা ডকিন্স বা এ বিষয়ে আরও হাজারো আগ্রহী মানুষের কেউ কি দাবী করেছেন যে “মিম” বিষয়ক আলোচনা গুলো “বৈজ্ঞানিক সত্য”?”– অর্থাৎ কেউ দাবী করেননি, যে এই আলোচনাগুলো ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’, কিন্তু তিনি ঠিক তার পরেই লিখেছেন- এই আলোচনাগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য। ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’ বিষয়টা আসলে কি- সারওয়ার সাহেবের এমন প্রশ্নের মত আমারো মাথায় প্রশ্ন এসেছে- ‘বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ বিষয়টাই বা কি? বিষয় যাই হোক, এ সমস্ত আলোচনাগুলোর বৈজ্ঞানিক সত্যতা বা গ্রহণযোগ্যতার দাবী কতখানি সঠিক সে বিষয়ে আমার প্রশ্ন আছে, সেই সাথে বলে রাখি- বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য বা সত্য ধরিয়ে দিতে পারলে নিশ্চয়ই একটু আগে যে এই ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে মানব সমাজ- ইতিহাস- সংস্কৃতিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতার কথা বলেছিলাম, সেটা ফিরিয়ে নিতে হবে বলে মনে করি। কেননা, সুনির্দিষ্ট রোগ বালাই এর আলোচনায় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার কথা বাদ দিয়ে কথা বলা যেমন যায় না, জীবজগতের বৈচিত্রের ইতিহাস যেমন বিবর্তনবাদকে বাদ দিয়ে হয় না, বংশগতির আলোচনায় জিনতত্ত্বকে বাদ দেয়া যেমন সম্ভব না- তেমনি কি মানব ইতিহাস, সমাজ- সংস্কৃতির বিবর্তন, ধর্মের উৎপত্তি, টিকে থাকা ও বিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনায় মিমতত্ত্ব- বিশ্বাসের ভাইরাস সংক্রান্ত আলোচনা কি একই রকম আবশ্যক, একইরকম বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য? বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? গবেষণাপত্র কি বের হয়েছে? প্রচুর গবেষণা কি হচ্ছে? বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জনপ্রিয় প্রবন্ধ, বই- আর গবেষণাপত্র এক নয় বলেই জানি; একজন বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের বিষয়েও প্রবন্ধ, বই লিখতে পারেন- সেসবকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে- কারণ একজন বিজ্ঞানী এই প্রবন্ধ বা বই লিখেছেন তা নয়- বরং তার চাইতেও বেশি কারণ হচ্ছে যে, যে বিষয়ে তিনি বই লিখেছেন সেই বিষয়টি নিয়ে তার বা অন্যের স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আছে। ফলে, একজন বিজ্ঞানী একটা বিষয়ে বই বা প্রবন্ধ লিখলেই- জনপ্রিয় কোন আলোচনা করলেই সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না- আইনস্টাইনও ‘কেন সমাজতন্ত্র’ নামে প্রবন্ধ লিখেছিলেন- তার মানে এই না যে, এই প্রবন্ধকে বা সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলতে হবে! সুতরাং, রিচার্ড ডকিন্সের বেস্ট সেলার বই থেকে রেফারেন্সের চাইতে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র, যা বৈজ্ঞানিক মহলে স্বীকৃত, এমন কিছু নমুনা আমি প্রত্যাশা করি। একইভাবে, বৈজ্ঞানিক সত্য বা গ্রহণযোগ্য হওয়ার আরেকটা ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে- তার প্রমাণযোগ্যতা, এবং নানা প্রশ্নের জবাব দিতে পারার সামর্থ্য। মিম কিংবা বিশ্বাসের ভাইরাস কি প্রমাণিত? এসব বাদ দিয়ে, এই আলোচনাগুলোকে আমার বিজ্ঞানের বিষয় বলে মানতেই কিছুটা আপত্তি আছে, সমাজ- সংস্কৃতি- ইতিহাস প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হবে, আর সেখানে রাজনীতির কথা জিজ্ঞেস করলে সেটাকে অবৈজ্ঞানিক হিসাবে আখ্যা দেয়া হবে- তখন সেটাকেই বরং খুব ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে মনে হয়।

দাবী বিজ্ঞানের, উপস্থাপনের ঢংটাও বিজ্ঞানের। স্কুলবেলায় পরীক্ষায় আসতো- মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে শক্তির নিত্যতা সূত্র প্রতিপাদন করো! বিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা- অমুক মডেলে বা ঘটনায় তমুক সূত্রের খাপ খাওয়ানো। ঠিক একই রকম কায়দায় যেন, গোলাম সারওয়ার পারভেজ আলমের বলা ইতিহাসের একটা ঘটনার ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ তত্ত্বের খাপ খাওয়াতে গেলেন! সেটা খাওয়াতে গিয়ে কি বললেন? “আপনার এই গল্পটি হচ্ছে একটি আদর্শ উদাহরন যে কুরআন বা যেকোনো গ্রন্থ হচ্ছে এক রকমের নিরেট নির্জীব পদার্থ, যার নিজের কোনও স্বাধীন কার্যক্ষমতা নেই, যার সক্রিয় হবার জন্যে অন্যের কাঁধে সওয়ার হতে হয়, অর্থাৎ যার সক্রিয় হবার জন্যে অবশ্যই একজন হোস্ট দরকার হয়, ঠিক যেমনটা দরকার হয় ভাইরাসের”। কোথায় কি আলী, আর কোথায় খারেজিরা- আর কোথায় পারভেজের গল্পের সেই কোরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে বাহাস! এমন খাপ খাওয়াটা আমার কাছে বেশ চমকপ্রদই মনে হয়েছে। গোলাম সারওয়ারের যে কথাটা এখানে উদ্ধৃত করেছি সেটি গোটা দুনিয়ার যেকোন জায়গার যেকোন সময়ের যেকোন মুসলমানদের কাজ কর্মের পরে এই বক্তব্যটি তুলে ধরে বিশ্বাসের ভাইরাস তত্ত্বকে প্রমাণ করা যাবে বোধ হয়। অন্য ধর্মের আচার আচরণের প্রেক্ষাপটে কেবল কোরআনের বদলে ঐ ধর্মের ধর্মগ্রন্থকে প্রতিস্থাপন করলেও চলে। একেবারে ভাইরাসের চরম প্রমাণ বলতে হবে বৈকি। যাকে বলে সর্বরোগের একই মহৌষধ! আমি খালি ভাবি, আচ্ছা- কেউ তো দাবী করছে না যে, কোরআন একটা নিরেট নির্জীব পদার্থ না। আদতে মনুষ্য সৃষ্ট সমস্ত বই পত্র, এমনকি জ্ঞানও তো একই রকম নির্জীব! আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ বলেন আর ডকিন্সের ‘গড ইলুশন’ বলেন- কিংবা অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’- গাদা গাদা বই লিখে ফেলে রাখলে কি সেই বই এর নিজস্ব কোন ক্ষমতা আছে সক্রিয় হওয়ার? ফলে এ সমস্ত জ্ঞানের জন্যেও তো মানুষের কাঁধে সওয়ার না হয়ে উপায় দেখছি না! মানুষ বিনা জ্ঞানের কোন মূল্য কি আছে? এ সব কিছুই কি তবে ভাইরাস? জন্মের পরে পরেই আমরা ভাষা শিখি। সেই ভাষার উপর ভর করে আরো কোন কিছু শিখি। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চারপাশের অনেক কিছু অভিজ্ঞতা হয়ে মস্তিস্কে জমা হতে থাকে। আমরা চিন্তা করতে শিখি। যুক্তি করতে শিখি। সিদ্ধান্ত নিতে শিখি। এ সব কিছুই- সেই ভাষা থেকে শুরু করে, অভিজ্ঞতা, চিন্তা, সিদ্ধান্ত, যুক্তি এ সমস্তই তো মানব মস্তিস্কের উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে চলে, পারস্পরিক আদান প্রদান হয়, টিকে থাকে, বিবর্তিত হয়। তাহলে মানব চিন্তাকেই কেন ভাইরাস বলা যাবে না- সেটাও একটা প্রশ্ন বটে!

পারভেজের এই আলোচনারও কোন জবাব পাইনিঃ “জৈবিক বিবর্তনে জিন যেই ভুমিকা পালন করে, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিবর্তনে সেই ভুমিকা পালন করে ‘মিম’, এই হলো মিমতত্ত্বের সার কথা। অর্থাৎ, কালচারাল ইভোলুশনও ডারউইনিয় ‘সিলেকশন’ পদ্ধতি অনুসরণ করে … জিনের যেমন ডিএনএর মতো কোড স্ক্রিপ্ট আছে, মিমএর ক্ষেত্রে তেমন কিছু কিছুর অস্তিত্ব আমরা জানি না”। একইভাবে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট- এসবের উপস্থিতির প্রমাণ আমরা জানি, অণুবীক্ষণ যন্ত্রে আমরা দেখতেও পারি, এদের গঠন শুধু না- এদেরকে ব্যবচ্ছেদ পর্যন্ত করতে পারি, সেখানে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কথিত ধার্মিক ব্যক্তির মস্তিস্কে থাকা সেই ভাইরাসের এধরণের কোন প্রমানাদি কি আছে? এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবে গোলাম সারওয়ার ভাইরাস সম্পর্কে আরো পড়াশুনার উপদেশ দিয়ে বিস্তারিত জ্ঞানও দান করলেন, কিন্তু যে ভাইরাস সম্পর্কে জ্ঞান দিলেন- সেটা তো আসল ভাইরাস-ই, মানব মস্তিস্কের কথিত সেই ভাইরাস নয়! অভিজিৎ রায় যেমন মনোবিজ্ঞানী ডেরেল রে’র বরাতে ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামের প্যারাসাইটের কথা বললেন, কিন্তু মানব বোমা বুকে নিয়ে আত্মহত্যা ও মানবহত্যায় প্ররোচিত করা কোন ভাইরাসের কথা, নাম কি জানাতে পারলেন? আমি বিজ্ঞানের খুব দুর্বল ছাত্র (ব্যাকবেঞ্চার) হিসেবে এমনটাই জানি যে, ঘাস ফড়িং এড় আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা প্যারাসাইট এর প্রমাণ ঐ ঘাস ফড়ীং বা নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম এর জন্যে প্রযোজ্য, তাকে মানব মস্তিস্কের ভাইরাসের প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যায় না! হ্যাঁ, তুলনা আপনি দিতে পারেন। তুলনা, রূপক, উপমা- এসব ভালো সাহিত্যের বড় গুন, অলংকার- কিন্তু বিজ্ঞানের শাখায় তুলনা দিয়ে কিছু প্রমাণ করা যায় না বলেই আমি জানি (আমার জানা ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন, তখন বলবো- ‘জানতাম’)।

এই তুলনা নিয়েই নাহয় একটু গল্প করি। আমার ছোট বাচ্চার মারাত্মক জেদ, মাঝে মধ্যে এমন ম্যারাথন কান্না কাটি- চিৎকার করে যে কি বলবো! তো, একদিন ওরকম আমি মজা করে বললাম- ওর মাথায় না একটা পোকা থাকে, ঐ পোকাটা যখনই বিগড়ে যায়- কামড় দেয়, তখনই ও এমন চিৎকার চেচামেচি কান্না কাটি করে। আমার বড় বাচ্চা অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করলো- ইস, মাথায় পোকা থাকবে কি করে, ওর রাগ হয়েছে সেজন্যে এমন করছে! আমি মজা করে যুক্তি দিলাম- ছোট ছোট পোকা যখন তোমাকে কামড় দেয় তখন কেমন করো? এই কামড় যদি বেশি তীব্র হয়, তখন কি করো … ইত্যাদি। এমন বাচ্চাদের সাথে মজা করে কথা বললেও মনে করি- মাথার পোকার প্রমাণ কখনো বাইরের পোকার সংজ্ঞা, কাজ কারবার দিয়ে করা যায় না। ঠিক একইরকম যুক্তি ধর্মবাদীরা, ইশ্বরবাদীরা দেয়! আমাদের ক্লাসের ইসলাম শিক্ষায়- ইশ্বরের প্রমাণ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছিল- এই দুনিয়া জগত কত সুশৃঙ্খলভাবে চলে। তখনো যুক্তি করে বলেছিলাম, তুলনা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ হতে পারে, সাহিত্য হতে পারে- কিন্তু প্রমাণ হয়না। মানুষের হাতে তৈরি জিনিসপত্রের উদাহরণ দিয়ে মানুষের এসব জিনিসপত্র তৈরির সামর্থের প্রমাণ হতে পারে- তার সাথে তুলনা করে ইশ্বরের জগতসৃষ্টির প্রমাণ করা যায় না।
একই রকম যুক্তি আমরা মুক্তমনারা কি করছি না?

‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন ছিল। পারভেজ আলমও করেছিলেন। ধর্মীয় বিশ্বাসই কি কেবল ভাইরাস? নাকি কেবল, যে ধর্মীয় বিশ্বাস ঘৃণা ছড়ায় তাও ভাইরাস? জাতীয়তাবাদ কি ভাইরাস? যে জাতীয়তাবাদ আত্মহত্যা ও অন্যকে হত্যা করায় কেবল তাই কি ভাইরাস? অভিজিৎ রায় ও গোলাম সারওয়ার জবাব দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদও ভাইরাস। ধর্মীয় বিশ্বাস মাত্রই ভাইরাস, ভাইরাস মাত্রই তো আর মারাত্মক না, সুপ্ত অবস্থায়ও থাকতে পারে। তারপরেও মনে হয়- ভাইরাস যেমন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে- কিছু কিছু ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া উপকারও করে, প্রাণিদেহে অসংখ্য ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া জীবাণু আছে যা কোন ক্ষতি তো করেই না, বরং প্রাণির জন্যে অপরিহার্য! তাহলে, সে হিসেবে যেকোন উপকারী টাইপের বিশ্বাসের ভাইরাসও থাকতে পারে? অভিজিৎ রায় মেইল থেকে মেইলের মাধ্যমে তথ্য ছড়ানোর একটা উদাহরণ দিয়েছেন। বাস্তবে, দুনিয়ায় অধিকাংশ তথ্য এভাবেই প্রবাহিত হয়, ছড়িয়ে পড়ে, টিকে থাকে বা হারিয়ে যায়! খুব অল্প মানুষই সুযোগ পান সমস্ত তথ্য যাচাই বাছাই করে গ্রহণ করার। পত্র পত্রিকা, মিডিয়া ইত্যাদি শক্তিশালী মাধ্যমে প্রচারিত, গুরুজন-শিক্ষক- বন্ধু- আত্মীয় স্বজন প্রভৃতির মাধ্যমে তথ্য পরিভ্রমণ করে। ভালো, উপকারী তথ্যের মত ক্ষতিকর তথ্যও পরিভ্রমণ করে। মানব মস্তিস্ক ভাইরাসের পোষক দেহের বা হোস্ট দেহের মত করে এসমস্ত ভালো/ উপকারী বা ক্ষতিকর তথ্যের হোস্ট হিসেবে কি কাজ করছে? তাহলে সমস্ত মানুষের মাথায় এই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কিলবিল করছে- এমনটা বলা কি যাবে? রিচার্ড ডকিন্স, … প্রমুখরা মিমতত্ত্ব, বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে বলার সাথে সাথে যারা এই মিমতত্ত্ব, বিশ্বাসের ভাইরাসের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে এই যে এত কথা বলছেন- তার পেছনেও কি কোন ভাইরাসের অবদান নাই?

এ বিষয়ে আমার জানাবোঝা কম, আশা করি আমার এই আশংকা ভুল প্রমানিত হবে যে, এটা ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ -এ বিশ্বাস আনয়নের লক্ষে কোন ভাইরাসের কাজ কারবার না!

পরিশিষ্টঃ
আরেকটা বিশেষণ চোখে পড়লো- সুন্নতি সেক্যুলার! সালাফির দিন কি শেষ তবে? এখন থেকে আমি নাহয় সুন্নতিই হলাম …