এক। আওয়ামি অনুভুতি

তন্ময় মল্লিককে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।  তিনি নাকি শেখ মুজিব ও তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক একটা গান লিখেছেন।

ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের সময় দেশদ্রোহিতার শাস্তি ছিল সাত বছরের কারাদন্ড। সত্তরে স্বাধীনতার দাবী তোলার অপরাধে কয়েকজন বামপন্থী রাজনীতিককে এই দন্ড দেয়া হয়েছিল।

তন্ময় মল্লিকের ‘অপরাধ’ কি দেশদ্রোহিতার মতোই মারাত্মক?  আওয়মি লিগের শাসন কি বিজাতীয় সামরিক শাসনের চেয়েও স্বৈরাচারী?

তন্ময়ের ব্যাপারে দেশে কোন হৈচৈ, বাদ-প্রতিবাদ হয় নি।  যেন কিছুই হয় নি – এমন একটা ভাব।

মনে পড়ে, কার্টুনিস্ট আরিফকে নিয়ে কিছুটা হলেও প্রতিবাদ হয়েছিল, এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।

হযরত মুহাম্মদের অবমাননা করলে (যদিও আরিফ তা করেন নি) তবু ছাড় দেয়া যায়। কিন্তু জাতির পিতা আর জাতির আপাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করা আওয়ামি লিগ আর তার তাঁবেদারদের পক্ষে অসম্ভব।

কয়েক বছর আগে আবু করিমকে সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল মুজিব ও তার পরিবারকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক লেখা প্রকাশের জন্য।

একজনকে শাস্তি পেতে হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটা ভুল বানানে লেখার জন্য।

এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে দেশছাড়া হতে হয়েছে ফেসবুকে শেখ হাসিনার মৃত্যু কামনার অপরাধে।

এর কোনটাই কিন্তু ‘আইনানুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হওয়ার কথা নয়।  কিন্তু বাংলাদেশে মানুষ অকারণে বা তুচ্ছ কারণে শাস্তি পাচ্ছেন।

আইনের শাসন নাই –  কিন্তু শাসনের আইন আছে।   দু:শাসনের জন্য আইনের অভাব নাই।

পাকিস্তানে আছে ব্লাসফেমি আইন, আর বাংলাদেশে আছে আই সি টি  সাতান্ন ধারা।  কথা ছিল  বাংলাদেশ ডিজিটাল হবে – হয় নি।  বাংলাদেশের মানুষকে বানানো হচ্ছে ভিজাবিড়াল।

কেউ কিছু বলছেন না।  সুশীল, বুদ্ধিজীবি, আইনজীবি, মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যাঁরা জড়িত তাঁরাও না।

একটা কথা মনে রাখা দরকার।  যদিও আমরা প্রায়ই এই বুলিটা আওড়াই।

“তোমার সাথে আমি একমত না হতে পারি।  কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত।”

ইভলিন বিয়েত্রিচ হল-এর (মতান্তরে ভলতেয়ারের) এই কথাটা মুক্তমনাদের কাছে খুবই প্রিয়।  কিন্তু কথাটাকে শুধু ভালোবাসলেইতো হবে না।   প্রয়োগ এবং চর্চা থাকাওতো প্রয়োজন।  কাজে-কর্মেও তো এর প্রতিফলন থাকা দরকার – জীবন দেয়া  পর্যন্ত না হয় নাই গেলাম।

কিছুদিন আগে এ কে খন্দকার-এর বই (একাত্তর – ভেতরে বাইরে) নিয়ে দেশে-বিদেশে হৈ চৈ হয়ে গেল – শাস্তি দেযার কথা উঠলো।  অবশ্য আইনের আওতাও এনে শাস্তি দেয়া হয় নাই তাঁকে – এখনো পর্যন্ত।  বিস্তর  হামলা-মামলার হুমকি-ধামকি দেয়া হয়েছে।  যারা হুমকি-ধামকি দিয়েছেন, অযৌক্তিক ভাবে তাঁর শাস্তি দাবী করেছেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে – আমরা তাদের সমালোচনা করি নাই।  জাতীয়তাবাদী জোশে আমাদের প্রগতিশীলদের মধ্যে অনেকেই বরং তাদের সমর্থন দিয়ে গেছি।

একই ধারা লক্ষ্য করলাম লতিফ সিদ্দিকীর ঘটনায়।  এ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী আর ধর্র্মবাদীরা একাকার হয়ে তার শাস্তি দাবি করেছেন।  কারণ তিনি শুধু ধর্মানুভূতিতে নয় আওয়ামি অনুভূতিতেও আঘাত করেছেন – জাতির ভাগ্নে সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে।

লতিফ সিদ্দিকী যে এতদিন তার অপরাজনীতির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে গেছেন তা নিয়ে কাউকে উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায় নি।  এইতো কিছুদিন আগে তিনি এক প্রকৌশলী কে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলেন।  তার সামনে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য।

প্রকৌশলীর কি অনুভুতি নাই?

নারায়নগন্জের মেধাবী ছাত্র ত্বকীর কি অনুভুতি ছিল না?  তার বাবা-মায়ের কি অনুভূতি নাই?

নারায়নগঞ্জের নিহত সাতজনের কি অনুভুতি ছিল না?  তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের কি অনুভুতি নাই?

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির কি অনুভূতি ছিল না ?  তাঁদের বাচ্চা ছেলে মেঘ-এর কি অনুভূতি নাই?

দুই। ধর্মানুভুতি

সব অনুভূতির সেরা অনুভূতি হলো ধর্মানুভূতি।  এই অনুভূতিটার যে সংজ্ঞা কি কেউই জানে না।  যে যার ইচ্ছামতো এই অনুভূতির ব্যবহার বা অপব্যবহার করে চলেছেন।

ফেসবুকে লাইক দিয়েও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা যায়।  ধর্মানুভূতির রকম-সকম বোঝা দায়।  কখনো ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়, কখনো হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিলেও জেগে ওঠে না।  আরিফ কার্টুন আঁকলে সারা দেশে আগুন জ্বলে ওঠে।  হেফাজতিরা কোরান পোড়ালে কারো ধর্মানুভূতিতে টোকা লাগে না।

আর অনুভুতি জিনিষটা কি?  কিভাবে একে সঙ্গায়িত করবেন?  আমি কিছু বললেই কারো অনুভুতিতে আঘাত লাগবেনা এই  নিশ্চয়তা কোথায় পাওয়া যাবে?

আর অনুভুতিতে আঘাত লাগবে বলে সঠিক, সত্যি আর দরকারী কথাটা বলা যাবে না, এটা কোন ধরনের যুক্তি?

আর সঠিক, সত্যি আর দরকারী কথা বললে যে অনেকের আঁতে ঘা বা অনুভুতিতে আঘাত লাগবে এটাতো  খুবই স্বাভাবিক।   আরে, কথাটা তো বলাই হচ্ছে এ জন্য, ঘা মারার জন্য।  রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’।

“কারো অনুভুতিতে আঘাত করার স্বাধীনতা না থাকলে বাকস্বাধীনতার কোন অর্থ হয় না” –  কথাটা সালমান রুশদীর।  অযৌক্তিক কথা নয়।

“পৃথিবী চ্যাপ্টা না, আর পাহাড়-পর্বত দিয়ে এর ভারসাম্য রক্ষা করা হয় না” – এই কথাটাও তো কারো মনে আঘাত দিতে পারে।  তাই বলে কি এই কথাটা বলা যাবে না?

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া ধর্মানুভূতির আর কোন ব্যবহার নাই।  রাজনীতিতে অসদুদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই অনুভূতি খুব কাজে লাগে।

তাই দেখি, শুধু জামাত-হেফাজত নয়, বিএনপি-আওয়ামি লিগও যখনই সুযোগ পায় এই অনুভুতিটাকে নিয়ে খেলা শুরু করে।

আওয়ামি লিগ সিদ্ধান্ত নিল চট্টগ্রামে বিমানবন্দরের নাম হবে হান্নান বিমানবন্দর।  বিএনপি ক্ষমতায় এসে অত্যন্ত নিচু মনের পরিচয় দিয়ে নাম পরিবর্তন করে রাখলো শাহ আমানত বিমানবন্দর।  এতে বিএনপি যে শাহ আমানতকে খুব শ্রদ্ধা করে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না।  চট্টগ্রামের জনগণের ধর্মানুভূতি যে খুব চাঙ্গা হয়ে উঠলো এতে তারও প্রমাণ পাওয়া যায় না।  আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় এসে বিমানবন্দরটাকে আগের নামে ফিরিয়ে নিতে সাহস পেল না।  কারণ তা করলে বিএনপির হাতে ধর্মানুভুতির অস্ত্র তুলে দেয়া হবে।

পরে আওয়ামি লিগও করলো ঠিক একই কাজ –জাতীয় পর্যায়ে, ঢাকা বিমানবন্দরকে নিয়ে।  ক্ষমতায় এসেই তাদের প্রথম কাজ হলো জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা।  সৎসাহস থাকলে আওয়ামি লিগ সরকার বিমানবন্দরের নাম শেখ মুজিবের নামে করতে পারতো।  কিন্তু না, আওয়ামি লিগ ধর্মানুভূতির রাজনীতির কাছে নতি স্বীকার করে এটাকে বানালো শাহজালাল বিমানবন্দর।  অথচ দেশের জনগণ এমন কি সিলেটের মানুষরাও যে এই ধরনের কোন দাবি জানিয়েছিল তা শোনা যায় না।  কারণটা বোঝা সহজ – বিএনপি যদি কোনদিন ক্ষমতায় আসে, শাহজালাল বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করার সাহস পাবে না।  করলে মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়া হবে আর বিএনপি পড়বে বেকায়দায়।

ধর্মানুভূতির কথা উঠলেই একটা কথা শোনা যায় আর তা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মানুভূতি।  তার মানে কি স্ংখ্যালঘুর ধর্মানুভূতি থাকতে নাই, বা থাকলেও তাতে আঘাত করা চলে?

ভারতে কি তাহলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হলে তা মেনে নেবেন বাংলাদেশের মুসলমানেরা?

সংবিধানে বিসমিল্লা বসিয়ে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বানিয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনুভুতিতে কি আঘাত দেয়া হয় নি?

আমি কোনদিন শুনি নি, বাংলাদেশের মানুষ কখনো দাবি তুলেছিল, সংবিধানে বিসমিল্লা বসাতে হবে  – আমার জানা নাই, কেউ আব্দার করেছেন, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানাতে হবে।  যথাক্রমে জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ এসব করেছেন নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য।  বিএনপি এবং আওয়ামি লিগও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য চরম অবমাননামূলক এই বিধানগুলো অক্ষুন্ন রেখেছেন নিজেদের দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য।