বেলা আর বাবলার বিয়ের সাত বছর হলো। প্রেমের বিয়ে ওদের। ওদের বিয়েতে দুই পরিবারের কেউই রাজি ছিল না। বেলা বলেছিল, বাবলাকে না পেলে বিষ খাবো। বাবলা বলেছিল, বেলাকে না পেলে নদীতে ঝাঁপ দেবো। পরে রাজি হতেই হলো সবাইকে বাধ্য হয়ে।
দু’জনের ছোট্ট সংসার ওদের। এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। ওদের মধ্যে ভালোবাসার যেমন বন্যা বয়ে যায়, তেমনি বয়ে যায় ঝগড়ার ঝড়। কারণ ছাড়াই আকাশ-পাতাল ঝগড়ার ঝড় তুফান অগ্নুৎপাত। আবার ক্ষণিকের মধ্যেই ভালবাসার উথালি পাথালি।

আজ তাদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী। বাবলার সব প্রিয় খাবারগুলি অতি যত্নে রান্না করেছে বেলা। প্রতি বছর এই দিনটা ওরা নিজেদের মতো করে কাটায়। কোথাও বেড়াতে যায়, বাইরে খেতে যায়, কিংবা বাসায় রান্না করে। অন্য কারুকে নিমন্ত্রণ করে না। বেলা সাজে খুব সুন্দর করে। সুন্দর একটা শাড়ি পরে, কপালে টিপ পরে, তার খোঁপায় ফুল গুঁজে দেয় বাবলা। এবারের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাবলা বেলাকে একটা নীল বেনারসি উপহার দিয়েছে। বেলা বাবলাকে দিয়েছে একটা ঘড়ি। বেলা রান্না সেরে সাজগোজ করে নিলো। বাবলা এলো বাইরে থেকে। বেলা তাকে ঘড়িটা পরিয়ে দিল। বাবলা বললো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন, পাখি? বেলা বললো, আমি না, তুমিই আমাকে বেশি ভালোবাসো। বাবলা বললো, না না, তুমি। বেলা ধমকের সাথে বললো, না তুমি। বাবলা নত মাথায় তা স্বীকার করে নিয়ে বললো, আচ্ছা আমিই বেশি ভালবাসি, তুমি কম বাসো।
-কী বললে তুমি! আমি তোমাকে কম ভালোবাসি! এমন অপবাদ তুমি আমাকে দিতে পারলে? তাও আজ, এই বিশেষ দিনে! এই ছিল আমার ভাগ্যে।
-আরে আমি তা-ই বলেছি নাকি? তুমিই তো মানতে চাইছিলে না যে তুমিই আমাকে বেশি ভালোবাসো। তাই তোমাকে মানানর জন্য বললাল আরকি।
-আমাকে মানানর জন্যে বললে? আমাকে মানানর জন্যেই বললে, তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো? তার মানে প্রকৃতপক্ষে বাসো না। হায় কপাল, কার জন্য আমি বিষ খেতে চেয়েছিলাম। সব ছেড়ে আমি এ কার কাছে এলাম। আমি কার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বসে আছি। যে লোকের আমার জন্য কোনো ভালোবাসাই নেই। যে আমাকে মানানর জন্য বলে, ভালোবাসে। একটা হিপোক্রেট তুমি। একটা ঠকবাজ তুমি। একটা মিথ্যুক তুমি।
-আরে বাজে বকছো কেন? আজকের দিনটা মাটি করবে নাকি?
-ওহ, আমি তো সবকিছু মাটি করি। আমি তোমার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছি, তাই না?
ব্যস শুরু হয়ে গেল গৃহযুদ্ধ। দুপক্ষ থেকেই শুরু কামান দাগা, গুলি বর্ষণ, বোমা বর্ষণ প্রবল থেকে প্রবলতর বেগে। কোন পক্ষ থেকেই কোনো ছাড় নেই। সুদীর্ঘ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর দুই পক্ষই শ্রান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিলো। সারাদিন অতি যত্ন করে, কষ্ট করে রান্না করা খাবারগুলি সব পড়ে রইলো। দুই যুদ্ধশ্রান্ত সৈনিক দুই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো কিছু না খেয়ে। মিলন-সাজ ও সাঁঝ সবই বিফলে গেলো। দু’দিন ধরে তাদের কথা বন্ধ। দু’জন ঘুমুচ্ছে দুই রুমে। তবে বেলার একটা অসাধারণ গুণ আছে। তাদের যখন কথা বন্ধ থাকে তখনও সে বাবলার খাওয়াদাওয়ার প্রতি খুব যত্ন নেয়। বাবলার পছন্দের খাবার রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়, প্লেটে ভাত বেড়ে দেয়। চা-কফি, লেবুর শরবত বানিয়ে টেবিলে এনে ঢেকে রাখে। গেলাসে বরফ মেশান ঠাণ্ডা পানি রেখে দেয়। বাবলার খুব অস্থির লাগছে, বেলার সাথে কথা নেই ব’লে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। আহা, কতো ভালোবাসে বেলা তাকে। ঝগড়ার মধ্যেও কতো যত্ন করে। কেন যে মাঝেমাঝে মেজাজ চড়ে যায়। আসলেই সে অনেক ভাগ্যবান। কারুর এতো ভালোবাসা পাওয়া কি সোজা কথা। তার মন আকুলিবিকুলি করছে বেলার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কেমন শূন্য শূন্য লাগে চারদিক বেলার সঙ্গে কথা না বলতে পারলে। মনে মনে সে কথা বলার উপলক্ষ্য খোঁজে, কী বলবে, কীভাবে বলবে, কখন বলবে তার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করতে থাকে। আবার ভয়ও হয়, বেলা যদি রাগারাগি শুরু করে দেয় কথা বলতে চাইলে। দুইদিন ধরে অনেক সাহস সঞ্চয় করে আজ বিকেলে কাজ থেকে ফিরে এসে বাবলা দুরুদুরু বক্ষে বলেই ফেললো, আজ যা গরম পড়েছে না, পাখি। গলাটা তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটু পানি খাওয়াও না গো। বেলা দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে তাতে বরফকুচি মিশিয়ে বাবলাকে এনে দিলো। আদর করে বললো, আমি খাইয়ে দিই, জানু? বাবলা গদগদ হয়ে বললো, দাও না, জানু। বেলা নিজের হাতে বাবলাকে পানি খাইয়ে দিলো।
প্রাণটা জুড়িয়ে গেল, পাখি। আচ্ছা, বলো তো, তোমার হাতের পরশ লাগা পানি এতো মজা কেন? আমি নিজে নিয়ে খেলে তো এতো মজা লাগে না। যেকোনো কিছুতে তুমি যখন হাত ছুঁইয়ে দাও তা এতো অপূর্ব হয়ে যায় কেন? সবই তোমার ভালোবাসা, তাই না গো পাখি? তোমার সাথে এ ক’দিন কথা হয়নি। আমার কেমন অস্থির লাগছিল, কতো কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি। তোমার হাতে পানি খেয়ে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে। বেলা বললো, আমারও মন কেমন কেমন করে তোমার সঙ্গে কথা না বললে।
আহা, পৃথিবীতে এতো আনন্দও আছে! দু’জনে যখন ভালোবাসার কথা বলে, পরস্পরের প্রতি অনুভূতির কথা বলে, মনে হয় পৃথিবীতে মধুরতা ছাড়া আর কিছুই নেই। সবকিছু কেবলই মধুময়।
– এই পানিটা একটু বেশি বেশি মজা ছিল না, বাবলা জানু?
– হুঁ। একটু না। অনেক বেশি বেশি মজা ছিল, বেলা জানু। তোমার ছোঁয়ায় কী যে জাদু আছে। রহস্যটা কী, বলো না। তোমার ভালোবাসা, তাই না?
– হুঁ। আরো কিছুও আছে।
– কী সেটা?
– পানিতে একটু থুতু মিশিয়ে দিয়েছিলাম।
বাবলার গা গুলিয়ে উঠলো। চোখ স্থির হয়ে গেল। কিন্তু মুখে বললো, তাই তো পানি এতো মজা। তোমার থুতু তো আমার কাছে মধু। সেই মধু যে আমি সব সময়ই খাই তোমাকে চুমু খাবার সময়। বেলা বললো, তাই তো আমি এই মধু তোমার সকল খাবারে মিশিয়ে দেই যখন তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করো। ঝগড়া করার পর এতো যে রান্না করি, প্লেটে ভাত বেড়ে দিই, চা-কফি-শরবত বানিয়ে দিই, পানি ঢেলে দিই সবকিছুতেই একটু একটু থুতু দিয়ে দিই।
বাবলা বললো, তোমার থুতু আমার কাছে অমৃত। মনে মনে বললো, এই দুষ্ট মহিলা তো আমার প্রাণের শত্রু। এর মুখে থুতু অন্তরে বিষ। আমাকে এই সাত বছর কতো না রোগ-জীবাণু খাইয়েছে। কী সাংঘাতিক বিভীষণ। এত প্রতিশোধ আমি নেবোই নেবো।
বেলা বললো, আমি জানি, জানু। তাই তো আমাদের কথা বন্ধ হলেও আমার মুখের অমৃতের স্বাদ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করে রাখি না। গত সপ্তাহে ঝগড়া হবার পর যে পায়েশ রান্না করেছিলাম, সেটা তোমাকে বেড়ে দেবার সময় বাটিতে একটু থুতু দিয়ে দিয়েছিলাম। তার আগের সপ্তাহে রসগোল্লার সাথে, তার আগের সপ্তাহে হালিমের সাথে, তার আগের সপ্তাহে মুরগির রোস্টের সাথে, তার আগের সপ্তাহে ডিমের পুডিঙের সাথে।
বাবলার গা গুলিয়ে গুলিয়ে আসছে। রাগে অভিমানে দুঃখে কষ্টে চোখ ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। সে ভাবছে, এই মহিলা আমার এতো বড় শত্রু! আর আমি কিছুই বুঝিনি এতদিন! এ আমি কার সাথে বাস করেছি এতদিন। আমার জীবনটা যে থুতুময় করে রেখেছে, যে আমাকে খাবারের নামে জীবাণু খাইয়েছে! এর প্রতিশোধ আমি নেবোই, কঠিন প্রতিশোধ। কিন্তু কিছু প্রকাশ করা যাবে না। সব পরিকল্পনা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে নীরবে নিঃশব্দে। মুখে তার ছায়াও যেন না ফোটে।
প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা চলতে লাগলো মনে মনে। কিন্তু সাবধান! আলামত কিছু প্রকাশ করা যাবে না একেবারেই। মুখটা থাকবে সব সময় হাসি হাসি, প্রেমিক প্রেমিক।
বাবলা বললো, তুমি আমার থুতুপাখি, আমার লক্ষ্মীবৌ।
বেলা বললো, হুঁ।
এক সপ্তাহ গভীরভাবে চিন্তা করে বাবলা একটা চমৎকার প্রতিশোধের উপায় পেয়ে গেল। বেলার টুথব্রাশ দিয়ে সে বাথরুমের বেসিনটা ভাল করে মেজে দেবে। বেলা সেই জীবাণুযুক্ত টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজবে। জীবাণু সব যাবে ওর মুখের ভেতর ঢুকে, সেখান থেকে সারা শরীরে। বাঃ, অসাধারণ আইডিয়া তো! বাবলা গোসল করতে গিয়ে বেলার টুথব্রাশটা দিয়ে ভালোভাবে বেসিনটাকে মাজলো অনেকক্ষণ ধরে। যত মাজছে তত ওর এতদিনের থুতু খাওয়ার রাগ কষ্ট দুঃখ ক্ষোভ গা গুলানো সব মিটে যাচ্ছে। আঃ, কী যে ভালো লাগছে প্রতিশোধ নিতে। বেলা রাতে ঘুমুতে যাবার আগে দাঁত ব্রাশ করে এলো। বাবলা বেলাকে অনেক আদর করলো আজ। বেলাও করলো বাবলাকে। বেলা বললো, আজ আমাকে এতো ভালোবাসছো কেন গো?
– আজ আমার মনে অনেক আনন্দ, অনেক সুখ।
– কেন? বিশেষ আনন্দের কারণ কি?
– আজ আমি তোমার টুথব্রাশ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাল করে বেসিনটাকে মেজে মেজ সাফ করেছি। তুমি সেই ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজেছ। এতকাল ধরে আমাকে থুতু খাওয়ানর প্রতিশোধ আমি একবারেই নিয়ে নিলাম। আমার মনে আর কোনো দুঃখ নেই।
বেলার বমি আসছে। ছিঃ কী জঘন্য! বেসিনের জীবাণু সব আমাকে খাওয়ালো লোকটা? এত বড় শত্রু! এই পৃথিবীতে এত বড় শত্রু তো আর কেউ নেই। এর প্রতিশোধ আমি নেবোই নেবো। কিন্তু প্রকাশ করা যাবে না সেই জ্বালাময় অভিব্যক্তি। ওর মতো নীরবে ঠাণ্ডাভাবে পরিকল্পনা করে চাল চেলে দেবো। টেরই পাবে না।
মুখে বললো, তাতে কী, জানু? বেসিনে তো শুধু আমাদের দু’জনের থুতুই পড়ে। আমাদের একজনের থুতু তো অন্যজনের মুখে এমনিতেই সব সময় যায় চুমু খাওয়ার সময়। ওটা কোনো ব্যাপারই না। তোমার থুতু আমার কাছে মধু। মনে মনে প্রতিশোধ-পরিকল্পনা চলছে, জ্বলছে আগুন। কী করা যায়? কী করা যায়? বাথরুমে গিয়ে চারদিকে দেখছে বালা। সাবান, শ্যাম্পু, হারপিক, শেভিংক্রিম, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ ইত্যাদি সবকিছুর ওপর বারবার চোখ বুলাচ্ছে বেলা। কী দিয়ে কী করা যায়। পেয়ে গেল অবশেষে। বাবলা তার টুথব্রাশ দিয়ে বেসিন মেজেছে না! সে বাবলার টুথব্রাশ টয়লেটে চুবিয়ে দেবে। বাবলার টুথব্রাশটা নিয়ে বেলা বেশ অনেকক্ষণ ধরে সেটাকে টয়লেটে চুবিয়ে রাখলো। তারপর রেখে দিলো জায়গা মতো। বাবলা রাতে ঘুমুতে যাবার আগে দাঁত মেজে এলো। আজ বেলার মন অনেক ফুরফুরে। তার সব রাগ ক্ষোভ মুছে গেছে। সে প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। বাবলাকে অনেক আদর করছে সে। বাবলা আদরে গলে যেতে যেতে বললো, আজ এতো আদর করছ কেন, জানু?
– আজ আমার মনটা অনেক ভালো, বাবলা জানু।অনেকদিন পর আমার মনে অনেক আনন্দ হচ্ছে। খুশিতে আমার ময়ূরের মত নাচতে ইচ্ছে করছে।
– কেন, জানু? আমাকে বলবে না?
– আমি তোমার টুথব্রাশটা আজ অনেকক্ষণ টয়লেটে চুবিয়ে রেখেছিলাম।
বাবলা ওয়াক করে বমি করে দিলো সাথে সাথে। বমি করে বললো, তুমি আমাকে গু খাওয়ালে শেষ পর্যন্ত! কিন্তু সেই গু যে তুমিও খেলে তা ভেবে গু খেয়েও আমার অপার আনন্দ হচ্ছে। বেলা জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে আমিও গু খেলাম? ববলা বললো, এতক্ষণ যে আমাকে চুমু খেলে আমার মুখের ভেতরের সব জীবাণু তোমার মুখে চলে গেল না! বেলাও বমি করে দিলো সঙ্গে সঙ্গে। বললো, ওটা ত আগে মাথায় আসেনি।