(ডিসক্লেইমার: শিরোনামের মতোই এটি একটি বিক্ষিপ্ত পোস্ট। লেখার বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধন পাঠকের সুবিবেচনার অপেক্ষা রাখে!)

আর্টিকেলটি পড়া শুরু করার আগে নিচের ছবি তিনটি লক্ষ করুন। কোন ছবিটিতে বেশি তথ্য আছে তা ভেবে রাখুন। এই বিষয়ে আমরা পরে আবার ফিরে আসব।

আপনাকে যদি পরপর কয়েকটি সংখ্যা ভাবতে বলা হয় যাদের পরস্পরের সাথে কোনো মিল থাকবে না অর্থাৎ কোনো সূত্র অনুযায়ী সেগুলোকে অনুমান করা যাবে না তাহলে আপনি কী করবেন? আপনি হয়তো একটি করে সংখ্যা বলবেন এবং পরের সংখ্যাটি বলার আগে প্রাণপন চেষ্টা করবেন যেন আগের সংখ্যার সাথে সেটি কোনোভাবেই না মেলে। এবং এটি করতে গিয়ে কিন্তু আপনি নিজের অজান্তেই কিছু ক্লু দিয়ে দিচ্ছেন। সেটি হচ্ছে আপনার একেকটি সংখ্যার সাথে আগের সংখ্যার মিল থাকবে না। এবং আপনি যখন এটি করছেন আপনি আসলে বিক্ষিপ্ত সংখ্যা উৎপাদন করছেন না বরং আপনি মনের অজান্তে একটি সূত্র ধরে নিয়েছেন যে সূত্রটি হচ্ছে “এমন সংখ্যাসমূহ ভাবতে হবে যার একটির সাথে আগের সংখ্যাটির কোনো মিল থাকবে না।” আরেকটু সহজ করা যাক বিষয়টিকে। আমাদের প্রত্যেকেরই চিন্তা-ভাবনার কিছু প্যাটার্ন রয়েছে। কাজেই আমরা যখন চিন্তা-ভাবনা করি তখন সেই প্যাটার্ন অনুযায়ীই করি এবং যতই বিক্ষিপ্তভাবে সেই সংখ্যাগুলো খুঁজে বের করি না কেন তা কোনো না কোনো প্যাটার্ন অনুযায়ীই হাজির হবে।

মানুষের ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি দুঃসাধ্য তা নয়। যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও বিষয়টি তা-ই। আমরা জানি কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজগুলোতে random বা বিক্ষিপ্ত মান নির্ণয়ের জন্য ফাংশন দেওয়া থাকে। আমরা যদি এই ফাংশনটিকে কোনো প্রোগ্রামে ব্যবহার করি তাহলে সে বিক্ষিপ্ত একটি সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য প্রসেসরকে ব্যবহার করবে। কিন্তু প্রসেসর কাজটি করবে কিভাবে? প্রসেসরের কি চিন্তা করার ক্ষমতা আছে যে আমরা তাকে একটি বিক্ষিপ্ত সংখ্যা চিন্তা করতে বললাম আর সে ওমনি তা করে ফেলল? প্রসেসরকে যখন একটি বিক্ষিপ্ত সংখ্যা তৈরি করতে হয় তখনও তাকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাই মেনে চলতে হয়। কম্পিউটারের প্রোগ্রামে বিক্ষিপ্ত সংখ্যা বের করার জন্য কিছু সূত্র দেওয়া হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই ভাবছেন বিক্ষিপ্তই যদি হবে তাহলে সূত্রের কথা আসে কেন? ভাবনারই বিষয়। কম্পিউটার আসলে বিক্ষিপ্ত সংখ্যা হিসেবে যে আউটপুট দেয় সেটি পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত নয় বরং তার মধ্যে যে সূত্রটি দেওয়া হয় সেটি বিভিন্ন সময়ে এমন সব সংখ্যা ফলাফল হিসেবে দেয় যাদেরকে আমাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত বলেই মনে হয়। এই সংখ্যাগুলোকে pseudo-random সংখ্যা বলা হয়। একগুচ্ছ বিভিন্ন সংখ্যা থেকে তাদের মধ্যকার প্যাটার্নের সূত্রটি বের করতে হলে মোটামুটি সংখ্যাগুচ্ছের সমপরিমান তথ্যই যদি উল্লেখ করতে হয় তাহলে আমরা সংখ্যাগুলোকে যথেষ্টই বিক্ষিপ্ত বলতে পারি।

একটি সংখ্যার সজ্জাকে প্রকৃত বিক্ষিপ্ত হতে হলে সেটিকে এমন হতে হবে যাদের মধ্যে কোনো ধরনের লুকানো প্যাটার্ন থাকবে না যাতে করে সংখ্যাগুলোকে অনুমান করা যায়। যদি কোনো প্যাটার্ন থেকে থাকে তাহলে এই প্যাটার্ন খুঁজের পাওয়ার সূত্রটিকেই আমরা তথ্য হিসেবে জানি। অর্থাৎ, একগুচ্ছ আপাত বিক্ষিপ্ত উপাত্তের মধ্য থেকে আমরা যদি একটি প্যাটার্ন তৈরি করতে পারি যার মাধ্যমে আমরা সেই সংখ্যাগুচ্ছকে অনুমান করতে পারি বা নির্ণয় করতে পারি তাহলে সেটিই হচ্ছে তথ্য। একটি ডি.এন.এ. অণুতে নাইট্রোজেন বেসগুলো সুনির্দিষ্ট প্যাটার্নের মাধ্যমে পর পর বসে ডি.এন.এর অণুতে তথ্য সঞ্চয় করে রাখে। কিংবা একটি কম্পিউটারে 0 এবং 1 এর মাধ্যমে তৈরি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্নের মাধ্যমে এই লেখাটি সংরক্ষিত রয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের আলোকে সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী এই লেখার অক্ষরের পিক্সেলগুলোকে পর্দায় দেখা যাচ্ছে।যদি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী পর্দায় পিক্সেলগুলোর রং তৈরি না হতো তাহলে পর্দাটিকে দেখা যেতো নিচের ছবিটির মতো।

টেলিভিশনে যখন কোনো সুনির্দিষ্ট সিগন্যাল থাকে না তখন এই ধরনের বিক্ষিপ্ত নয়েজ দেখা যায়। এই ছবিতে প্রতিটি পিক্সেল বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে এই ছবিতে কোনো তথ্য নেই। তারমানে অদ্যাবধি আলোচনা থেকে আমরা পাচ্ছি তথ্য হলো সু্নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা শৃঙ্খলা যার আলোকে উপাত্তকে ব্যাখ্যা করা যায়।

কিন্তু আসলেই কি তাই?

এর উত্তর পাওয়ার জন্য আমরা ধাপে ধাপে এগোই। প্রথমে নিচের প্যাটার্নটি নিয়ে চিন্তা করি।

এই ছবিতে ১০০০ টির কাছাকাছি অংক থাকলেও তথ্য কিন্তু খুবই সামান্য। “১০০০ টি ১” উল্ল্যেখ করলেই এখানকার যাবতীয় তথ্য পাওয়া হয়ে যায়। এই ধরনের বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়েই কম্পিউটারে কোনো ফাইল ‘জিপ’ করে বা সংকুচিত (COMPRESS) করে রাখা যায়। অর্থাৎ উপাত্তের মধ্যে যদি কোনো প্যাটার্ন থাকে তাহলে তাকে সেই প্যাটার্ন কাজে লাগিয়ে সংকুচিত করে রাখা যাবে। আবার নিচের ছবিতে যদিও অংক মাত্র ১০০ টি কিন্তু তাতে তথ্যের পরিমান আগের ছবিটির চেয়ে কিছুটা বেশি।

এভাবে এগিয়ে গেলে আমরা সম্পূর্ন বিক্ষিপ্ত একটি উপাত্তের গুচ্ছ দেখাতে পারি নিচের ছবির মতো।

এই ছবিতে যে তথ্য আছে তার মধ্যে কোনো প্যাটার্ন নেই। তাই একে সংকুচিত করে রাখা সম্ভব নয়। এই কারনে এটিকে কম্পিউটারে ‘কম্প্রেস করে সেভ’ করে রাখা যাবে না। একে কম্পিউটারে সংরক্ষণ করে রাখতে হলে সবচেয়ে বেশি তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। তার মানে হলো সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যাবে সবচেয়ে বিক্ষিপ্ত উপাত্ত থেকে! (যেহেতু আমার এই লেখাটি একটি বিক্ষিপ্ত লেখা তাই এটি একই সাথে একটি তথ্যবহুল লেখা বলেও প্রমনীত হলো!)

লেখার শুরুতে যে তিনটি ছবি দেখিয়ে আপনাদেরকে সবচেয়ে তথ্যবহুল ছবিটি অনুমান করতে বলা হয়েছিলো সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। (ক) ছবিটির প্রতিটি পিক্সেল বিক্ষিপ্ত, তাই একে কোনো প্যাটার্ন অনুযায়ী সংক্ষেপ করা যাবে না এবং ফলে প্রতিটি পিক্সেলের তথ্যই কম্পিউটারকে সংরক্ষণ করতে হবে। (খ) ছবিটিতে আগের চেয়ে বেশি প্যাটার্ন রয়েছে। এক ধরনের রং পাশাপাশি অনেকগুলো পিক্সেলে রয়েছে, ফলে প্রতিটি পিক্সেলকে আলাদাভাবে সংরক্ষণ না করলেও চলবে। (গ) ছবিতে একটি মাত্র রং পিক্সেলগুলোতে বিস্তৃত তাই একটি মাত্র রং একবার উল্লেখ করলেই সব তথ্য সংরক্ষণ করা হয়ে যাবে। বিষয়টি আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ছবিগুলোকে কম্পিউটারে PAINT প্রোগ্রামের মাধ্যমে BMP ফরম্যাটে সেভ করুন। এতে দেখবেন তিনটি ছবিই কম্পিউটারে একই পরিমান জায়গা নিচ্ছে। BMP ফরম্যাটে ছবিতে সংকোচন করা হয়না তাই একই আকারের সকল ছবির একই পরিমান জায়গা লাগে। এইবার একই ছবিগুলোকে JPEG ফরম্যাটে সেভ করুন। JPEG ফরম্যাটে ছবি সংরক্ষণের জন্য কম্পিউটার সংকোচন কৌশল প্রয়োগ করে। তাই দেখতে পাবেন ডানপাশের ছবিটির জন্য নগন্য পরিমান জায়গা লাগছে, মাঝের ছবিটির জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি জায়গা লাগছে আর বামপাশের ছবিটি পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত হওয়ায় এটি প্রায় BMP ফরম্যাটের ছবিটির কাছাকাছি জায়গা নিচ্ছে।

এখন আমরা সরাসরি এনট্রপিতে আসি।উপাত্তের এই বিক্ষিপ্ততাকেই বলা যায় এনট্রপি। সেই হিসেবে আমরা বলতে পারি (ক) ছবিতে পিক্সেলগুলোর এনট্রপি বেশি, (খ) ছবিতে এনট্রপি মাঝামাঝি ধরনের এবং (গ) ছবিতে কোনো এনট্রপি নেই। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র থেকে আমরা এনট্রপির ধারনা পাই এবং এটিও জানি যে এই মহাবিশ্বের এনট্রপি ক্রমশঃ বেড়েই যাচ্ছে। বিগব্যাং যখন ঘটেছিলো তার পরবর্তী মুহূর্তে তরুন মহাবিশ্ব আরো অনেক বেশি সুসজ্জিত ছিলো এবং তাতে আরো অনেক বেশি প্যাটার্ন ছিলো। ধীরে ধীরে জগতের সবকিছু ক্রমশঃ এলোমেলো হয়ে আসছে এবং বিক্ষিপ্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে তথ্যের পরিমানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বকে পুরোপুরি বর্ণনা করতে হলে আমাদের ক্রমশঃ আরো বেশি বেশি তথ্যের মাধ্যমে তা করতে হবে।

কিন্তু বিক্ষিপ্ত উপাত্তের এই তথ্যের আধিক্য আমাদের কোনো কাজে লাগে না। ভেবে দেখুন আমাদের ডি.এন.এ. তে নাইট্রোজেন বেসগুলো যদি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী না বসে বিক্ষিপ্তভাবে বসত তাহলে তাতে তথ্যের পরিমান বেশি হতো ঠিকই কিন্তু সেই তথ্যে কাজে লাগিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রোটিন তৈরি হতো না। একটি ছবি যার পিক্সেলগুলো সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত এবং যার ফলে তার মধ্যে ধারনকৃত তথ্যও সবচেয়ে বেশি এবং তাই এধরনের একটি ছবিকে কম্পিউটারে ‘কম্প্রেস’ করেও রাখা যায় না। অথচ এই ধরনের অতিতথ্য সম্বলিত উপাত্ত মানুষের কোনো কাজেও লাগে না। আবার একে বারে তথ্যহীন একটি একরঙ্গা ছবিও আমাদের কাজে আসে না। বরং আমরা এই দুই ধরনের অবস্থার মাঝামাঝি বিষয়াবলী নিয়ে কাজ করি। একটি অনিন্দ্যসুন্দর বিমূর্ত তেলচিত্র, কিংবা একটি চমৎকার বিমূর্ত অর্থবহ কবিতা কিংবা জটিল যন্ত্রপাতি; যেসবের মধ্যে একই সঙ্গে থাকবে দুর্বোধ্যতা বা জটিলতা এবং সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে হৃদয়গ্রাহী প্যাটার্ন সেগুলোই আমাদের কাজে লাগে বেশি কিংবা আকৃষ্ট করে থাকে বেশি। আর এটিকেই হয়তোবা আমাদের শিল্পবোধ বলা যেতে পারে (শিল্পবোধের এই ধারনা পুরোপুরি লেখকের নিজস্ব ভাবনা। এর সাথে কারো ভাবনা মিলে গেলে, কিংবা কারো সাথেই না মিললে তা যথাক্রমে অনভিপ্রেত প্যাটার্ন মাত্র কিংবা সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ততা মাত্র! এর জন্য লেখক দায়ী নন। 🙂 ) এবং এই ধরনের সমন্বিত বিষয়েই আমরা আগ্রহবোধ করি বেশি। কোনো কিছুতে বিক্ষিপ্ততা হেতু তথ্যের আধিক্য থাকলে তাতে আমরা আগ্রহ বোধ করি না এবং শিল্পের মর্যাদা দিই না, আবার মাত্রতিরিক্ত সরলতা থাকলেও আমরা সেটিকে শিল্পসম্মত মনে করি না।

অর্থাৎ, আমরা মানব সম্প্রদায়ভুক্তরা জটিল উপাত্ত থেকে প্যাটার্ন খুঁজে বের করে তাকে সরল করতে ভালোবাসি। মোনালিসা ছবির অন্তর্গত মডেলের হাসি ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা কয়েকশ’ বছর ধরে মাথা খাটিয়ে যাচ্ছি। কেননা আমরা এখানে একটি প্যাটার্নের উপস্থিতি বুঝতে পারছি এবং একই সাথে বিষয়টি আমাদের কাছে জটিল ঠেকছে। একই ভাবে সভ্যতার আদিকাল থেকে আমরা এই মহাবিশ্বের মৌলিক সূত্রগুলো বের করার চেষ্টা করছি যেগুলোর মাধ্যমে আমরা এই মহাবিশ্বকে আরো সরলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। যখনই একটি নতুন বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কৃত হয় তার মানে দাঁড়ায় আমরা এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাত্তগুলোর মধ্যে একটি নতুন প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছি যার মাধ্যমে এই মহাবিশ্বকে আরেকটু ‘কম্প্রেস’ করে বা সরল করে ‘কম্পিউটারে সেভ করে’ রাখা যায়। একটি উদাহরন দিয়ে বিষয়টি ব্যখ্যা করা যাক। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম যখন আমরা বিভিন্ন ধরনের মৌলিক পদার্থগুলোকে শনাক্ত করেছিলাম তখন দেখতে পেয়েছিলাম যে একেকটি মৌলিক পদার্থের পারমানবিক ভর একেক রকম। আবার পারামানবিক ভরের ক্রমানুসারে সেগুলোকে সাজালে দেখা যায় সেগুলোর রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে একধরনের পর্যায়বৃত্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই বিষয়টি সেই সময় সরলভাবে ব্যাখ্যা করা গেলো না। কাজেই সেই সময় এই সবগুলো মৌলের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখতে হলে আলাদাভাবে প্রতি মৌলের পরমাণু সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা মনে রাখতে হতো। ক্রমশঃ আমরা পরমাণুর ভেতরটা দেখতে পেলাম এবং পরমাণুর মূল কয়েকটি কণিকা আবিষ্কার করে ফেললাম, যার মাধ্যমে আমরা প্রতিটি মৌলিক পদার্থের মধ্যে সমন্বয় করে ফেললাম এবং এদেরকে একটা প্যাটার্নে ফেলে দিতে পারলাম। এখন আমরা শুধুমাত্র মৌলিক কণিকাগুলোর ধর্ম নিয়ে চিন্তা করে যেকোন মৌলিক এমনকি যৌগিক পদার্থের যাবতীয় ধর্ম ব্যাখ্যা করে ফেলতে পারি।

পরবর্তীতে প্রথমিক মৌলিক কণিকাগুলোর অভ্যন্তরে আরো কিছু মৌলিক কণিকা আবিষ্কৃত হলো এবং দেখা গেলো যে এই জগতে ১২ ধরনের প্রকৃত মৌলিক কণিকা আছে এবং যারা নিজেদের মধ্যে ৪ ধরনের মিথষ্ক্রিয়া দেখায়। এই ১২ ধরনের কণিকা এবং চারধরনের মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে সমগ্র মহাবিশ্ব ব্যাখ্যা করা যায়।

তার মানে কী এই যে, জগতের সবগুলো মৌলিক কণিকার অবস্থান এবং গতিপ্রকৃতি জানা থাকলে আমরা সমগ্র মহাবিশ্বের সব ঘটনা জেনে যেতে পারব? শুধু বর্তমানই নয় এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যতের যেকোনো সময়ে এই মহাবিশ্বের কোন বস্তু কোন অবস্থানে কীভাবে থাকবে সেটিও তাহলে আমাদের জেনে যাওয়ার কথা। যেকোন ঘটনা সম্বন্ধেই আমাদের পক্ষে পুঙ্খনুপুঙ্খরূপে ভবিষ্যৎবানী করতে পারার কথা। যেহেতু এই ১২ টি মৌলিক কণিকা দ্বারাই একজন মানুষের সম্পূর্ন অবয়ব তৈরি হয়েছে তাহলে আমরা একজন মানুষের শরীরের সবগুলো কণিকার তথ্য সংগ্রহ করে এমনকি তার চিন্তা-ভাবনার প্যাটার্নটিও ধরে ফেলতে পারি! সেই মানুষটি ভবিষ্যতে কখন কি করবে তা-ও আগাম জেনে যেতে পারি। সবকিছুকেই যেহেতু প্যাটার্নে আবদ্ধ করে ফেলা যাচ্ছে তাহলে তো এই অবস্থায় জগতের সবরকম বিক্ষিপ্ততার অবসান ঘটার কথা। তাহলে আমরা যে ইতিমধ্যে ঘোষনা দিয়ে রেখেছি এই মহাবিশ্বের এনট্রপি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এই তথ্য নিশ্চয়ই ভুল হওয়ার কথা। এনট্রপি মানে যেহেতু বিক্ষিপ্ততা আর বিক্ষিপ্ততার যেহেতু অবসান ঘটে যাচ্ছে তাহলে নিশ্চয়ই এনট্রপি বলে কিছু থাকার কথা নয়। তারমানে তাপগতি বিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি ভুল!

মূল ব্যাপারটি এত সহজ নয়, বিশেষ করে আমরা যদি কোয়ান্টাম মোকানিক্সের আলোকে চিন্তা করি। সাব-এটমিক পর্যায়ের কণাগুলো স্থুল দৃশ্যমান জগতের বস্তুগুলোর মতো আচরণ করে না। এবং তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট গতিপ্রকৃতি বা অবস্থানও থাকে না। বরং এই পর্যায়ের কণাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হয় সম্ভাব্যতার আলোকে। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব আমাদের অনেকেরই জানা আছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী একই সময় কোনো কণিকার গতি এবং অবস্থান যথার্থভাবে নির্ণয় করা যাবে না। যদি আমরা কোনো কণার অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হই তাহলে তার গতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে ফলে আমরা কণাটির পরবর্তী অবস্থান সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হতে পারব না আবার আমরা যদি কণাটির গতি যথার্থভাবে নির্ণয় করে ফেলতে পারি তাহলে কণাটির সেই মুহূর্তের অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

একটি কণা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন অবস্থানে থাকবে সেটি সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করা যাবে না বরং একটি নির্দিষ্ট স্থান জুড়ে কণাটির অবস্থানের একটি সম্ভাব্যতা থাকবে এবং এই স্থানের কোথাও কণাটি থাকার সম্ভাবনা কতটুকু থাকবে তা আমরা হিসেব করতে পারি কিন্তু সেটি সেখানে সুনিশ্চিতভাবে থাকবে কিনা তা আমরা কোনো ভাবেই আগে থেকে পরিমাপ করতে পারি না। আমরা পরিমাপ করতে পারি কেবল মাত্র তখনই যখন আমরা কণাটিকে সেই অবস্থানে পর্যবেক্ষণ করব এবং আরো অদ্ভুৎ ভাবে আমরা কণাটিকে পর্যবেক্ষন না করা পর্যন্ত একই সময় সেটি তার সম্ভাবনা অনুযায়ী সব জায়গাতেই অবস্থান করবে। বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়ে যদি আমরা কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের কথা চিন্তা করি। কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট তত্ত্ব অনুযায়ী এন্টেঙ্গেলড দু’টি কণিকার একটি আরেকটির অবস্থা নির্ধারণ করে। দুটি কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলড ইলেক্ট্রন পরস্পরের বিপরীত ঘূর্ণনে বিদ্যমান থাকে কিন্তু এটি সাধারণ অবস্থায় সুনির্দিষ্ট করা যায় না। অর্থাৎ প্রতিটি ইলেক্ট্রন স্বাভাবিক অবস্থায় ৫০% ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ৫০% ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুর্ণনের সম্ভাবনায় থাকে। আমরা যদি এই দুটি ইলেক্ট্রনকে অনেক দূরে নিয়ে যাই তারপরও এরা একই বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করবে এবং উভয়ে ঘুর্ণনের ৫০% সম্ভাব্যতায় থাকবে। এবং এই সময় প্রতিটি ইলেক্ট্রনের উভয় বৈশিষ্ট্যই আমরা উপলব্ধি করব। কিন্তু আমরা যদি একটি ইলেক্ট্রনের ঘুর্ণন সুনির্দিষ্ট করে পর্যবেক্ষন করার প্রস্তুতি নিই এবং একে সুনির্দিষ্ট ভাবে পর্যবেক্ষন করি তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে অপর ইলেক্ট্রনটির ঘূর্ণন সুনির্দিষ্ট হয়ে যায় সেটিকে প্রথমটি থেকে যতদূরের স্থাপন করা হোক না কেন(কেননা একটি ইলেক্ট্রনের ঘুর্ণন অপরটির বিপরীত, তাই একটির ঘুর্নন নিশ্চিত হওয়া গেলে অপরটির ঘুর্ননও সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়), যদিও দ্বিতীয় ইলেক্ট্রনটির ঘুর্নন আমরা সূক্ষভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করি নি! আইনস্টাইন জীবদ্দশায় এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারনা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি মনে করতেন প্রকৃতি অনিশ্চয়তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না বরং প্রকৃতির একেবার মৌলিক বিষয়গুলোকে অবশ্যই যথার্থভাবে সুস্পষ্ট হতে হবে। এই প্রেক্ষিতেই তিনি তাঁর সুবিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন; “ঈশ্বর পাশা খেলেন না”।তাছাড়া আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোনো সত্ত্বাই আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমন করতে পারে না। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী দুটি এন্টেঙ্গেলড কণা যতো দূরেই থাকুক না কেন তারা যেনো তাৎক্ষণিক ভাবে পরস্পরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থা সুস্পষ্ট করে। শ্রডিঞ্জার তাঁর বিখ্যাত বিড়ালের মাধ্যমে এই ঘটনাটিই সহজবোধ্যভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন। অর্থাৎ কোয়ান্টাম লেভেলের কোনো কণার অবস্থান নির্ভর করছে আমাদের পর্যবেক্ষনের উপরে। আমাদের পর্যবেক্ষন না করা পর্যন্ত বিড়ালটি একই সাথে জীবিত ও মৃত।

কাজেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা এই মহাবিশ্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ ভবিষ্যৎবানী করতে সক্ষম নই, একই কারনে একজন মানুষের চিন্তা-চেতনার প্যাটার্নটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপন করে তার ভবিষ্যৎ কর্মধারা নির্ধারণ করাও দুষ্কর। বরং যেসব ক্ষেত্রে আমাদের বিক্ষিপ্ততা দরকার আমরা সেসব ক্ষেত্রে কোয়ান্টম তত্ত্ব ব্যাবহার করতে পারি। এই লেখার শুরুতে আমরা একটি বিক্ষিপ্ত সংখ্যা নির্নয় করার জটিলতা দেখেছি। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা সম্পূর্ন বিক্ষিপ্ত সংখ্যা উৎপাদন করার যন্ত্র তৈরি করতে পারি। একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থের টুকরা থেকে প্রতিনিয়ত তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ঘটে। এই বিকিরণের মাত্রা গাইগার কাউন্টার (GEIGER COUNTER) এর মাধ্যমে নির্নয় করা যায়। তেজষ্ক্রিয় বস্তুটি থেকে কি হারে তেজষ্ক্রিয় কণা নির্গত হবে তার একটি সম্ভাব্যতা থাকে কিন্তু প্রতি মুহূর্তে ঠিক কতগুলো তেজষ্ক্রিয় পরমাণুর বিভাজন হবে তার সুনির্দিষ্ট পরিমান জানার কোনো উপায় নেই। কাজেই একটি তেজষ্ক্রিয় উৎস থেকে যে বিক্ষিপ্ত কণাগুলো নির্গত হবে সেগুলোর মাত্রা হবে বিক্ষিপ্ত এবং আমরা নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি গাইগার কাউন্টার থেকে সেই তেজষ্ক্রিয়তার পাঠ নিতে থাকলেই একটি বিক্ষিপ্ত সংখ্যার তালিকা পাব।