বাংলা একাডেমির একটি প্রকল্পে কাজ করি তখন। বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান প্রকল্পে। এসি লাগানো ঠান্ডা ঘরে বসে কাজ করছি আমরা ক’জন মিলে। সময়টা ছিল মধ্য দুপুর। কাঠফাটা রোদ ছিল সেদিন। বাইরে বেরুনোর কোনো উপায় ছিল না কারো। এমন সময় এক কিশোর এসে ঢুকলো আমাদের কক্ষে। ঘেমে একসার অবস্থা। দেখে ভাদ্র মাসের তাল-পাকা রদ্দুরের তৃষার্ত কাক মনে হলো তাকে। ঘরে ঢুকেই কিশোরটি পাশে থাকা জলের গ্লাসটি হাতে নিলো জল খাওয়ার জন্য। আকুতির স্বরে বলল- একটু পানি, একটু পানি খেতে চাই।
ছেলেটিকে দেখে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন আমাদের প্রকল্পের স্থানীয় তত্ত্বাবধায়ক স্বরোচিষ সরকার। চিৎকার করে ওঠেন তিনি- “এই ছেলে, তুমি এই ঘরে ঢুকলে কী করে? বের হও, বের হও এখনি।”
ছেলেটির কণ্ঠে তখনও ছিল জল খাওয়ার তীব্র আকুতি। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না তার তৃষ্ণায়। সেই সাথে জড় হয় ভয়। যেন সে ঘোরতর কোনো অন্যায় করে ফেলেছে। যেন সে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে অমার্জনীয় অপরাধ করতে গিয়ে। একসময় ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে থাকে আমাদের সকলের দিকে। একসময় স্বরোচিষ মহাশয়কে মনে হয় কিশোরটিকে মারতে এগিয়ে আসছেন যেন। কিশোরটি পালিয়ে বাঁচে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরাও বিস্মিত ও ভীত হলাম। তত্ত্ববধায়কের এমন আচরণে আর কারো কথা জানি না, আমার অন্তত একটি জানালা খুলে গেছে সেদিন। মনে মনে স্থির হয়ে গেল, এই স্মৃতি আমি কোনো দিনই ভুলতে পারবো না। আর যাই হোক- ওই স্বরোচিষ সরকারকে আমি সারাজীবনেও ক্ষমা করতে পারবো না। তা তিনি যত ভালো কাজই করুন না কেন।

ওই প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন লন্ডনবাসী ড. গোলাম মুরশিদ। উনি সেখান থেকেই আমাদের তদারকি করতেন। তাই উনার শারীরিক অনুপস্থিতিতে ওই দায়িত্ব পালন করতেন ওই স্বরোচিষ সরকার, যিনি একেধারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও। নামের আগে ডক্টরেট ডিগ্রিও আছে। শুনেছি, তার অধীনে নাকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে পিএইচডি-ও করেন। আমি জানি না, এই অধ্যাপকের তত্ত্বাবধায়নে কাজ করে ছেলেমেয়েরা কী হয়ে বের হয় বা এখনও হচ্ছে। যে লোকটি এত এত ডিগ্রি (?) নিয়ে ন্যূনতম ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারলো না, তার কাছে থেকে মানুষ হতে পারবে কি আমাদের ভবিষ্যৎ ডক্টরেট ডিগ্রিধারীরা? সকলের কাছে এমন প্রশ্নই রইল…
হে কিশোর, নাম না জানা তৃষার্ত কিশোর, আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। সেদিন তোমাকে মন থেকে চেয়েও এক ফোটা জলও খাওয়াতে পারিনি আমি। চাকরি হারানোর ভয়ে আমি সেদিন ওই অধ্যাপকের মুখের ওপর বলতে পারিনি- এই নাও, জল খাও।

হে কিশোর, নাম না জানা তৃষার্ত কিশোর, তোমাকে দেখলে হয়ত আজ আমি চিনতেও পারবো না। তবে যদি কোনোদিন তুমি আমার কাছে আসো, আবার যদি কোনোদিন জলের জন্য প্রার্থনা করো- তাই তোমার জন্য রেখে দিয়েছি এক আকাশ মেঘ। সেদিন তোমাকে তুমুল বৃষ্টিতে ভেজাবো আমি।

বি.দ্র. মন থেকে ওই স্বরোচিষ সরকারকে মেনে নিতে পারিনি বলে একসময় নিশ্চিত বেকারত্বকে মেনে নিয়েই আমি ওই চাকরি থেকে রিজাইন দেই। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, পরিচালক শাহেদা খাতুন, উপ-পরিচালক মুর্শিদ আনোয়ারসহ আরো অনেকের বিশেষ অনুরোধেও আমি সেই রিজাইন লেটার ফিরিয়ে নেইনি।