Let the future tell the truth, and evaluate each one according to his work and accomplishments.

— Nikola Tesla

বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এসূত্রে উক্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়সীমা হিসেবে ২০২১ সালের কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। কীভাবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায় তার একাধিক সূচক আছে – অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও তদনুযায়ী জিডিপির নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অন্যতম টার্গেট হিসেবে গণ্য হতে পারে। দেশীয় জনসম্পদকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলতে, শিল্পোৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে কিংবা কৃষিতে উচ্চফলনশীলতা অর্জনে এবং অন্য বহুবিধ কারণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত একটি সম্ভাবনাময় এবং গুরুত্বপূর্ণ খাত। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এ কারণে যে আমাদের যে মেধাসম্পদ আছে তার একটি সুনির্দিষ্ট চাহিদা আমরা দেখি আন্তর্জাতিক জ্ঞান-বাজারে। প্রতি বছর আমাদের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে (প্রধানত উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, জাপান) পাড়ি জমাচ্ছে। এদের একটা বড় অংশ বিদেশেই থেকে যায়। মেধা-পাচারের এই একমুখী স্রোত অন্তত এটুকু তথ্য দেয় যে আমাদের মেধা-সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে সেটা জাতীয়-সম্পদে পরিণত হতে পারে। কারণ বিদেশের মাটিতে প্রতিকূল অবস্থাতেও আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা শক্ত জায়গা করে নিতে পেরেছে। এটা তাদের একটা যোগ্যতার বিষয় যেমন, আমাদেরও গর্বের বিষয় তেমন। তাদের সাফল্যের একটি বিশেষ খাত আমরা দেখি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। বিদেশে থিতু হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে পেশাদারিত্বে এবং গবেষণার অবদানের দিক দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই মেধা-সম্পদ দেশের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দেশের খেয়ে, দেশেই পড়ে যখন তারা পরিপক্ক হয়ে উঠল, তখনই তাদের সকল সেবা শুষে নিচ্ছে বিদেশী রাষ্ট্র। কারণ ঐসব রাষ্ট্র যা দিতে পারছে আমরা সেটা দিতে পারছি না। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা।আমাদের সাফল্য এটুকুই যে আমরা লোভনীয় মেধা-সম্পদ তৈরি করতে পারছি। কিন্তু এই সাফল্যকে আমরা আরো খানিকটা এগিয়ে নিতে পারি। যদি আমরা দেশেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খাতকে উন্নত করতে পারি, তাহলে এই মেধা-সম্পদকে দেশে রেখেই জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু সাফল্য অর্জনের জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন এবং দরকার হয় অগ্রগতির সালতামামি গ্রহণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি, কিংবা সামনে আরো কতখানি এগুতে পারব সেটা জানা দরকার।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি, কিংবা কতটুকু পথ এগুনো যাবে ভবিষ্যতে, এবং সেটা কীভাবে জানা যাবে, জানার উপায়গুলো কী হতে পারে সেটা নিয়েই বর্তমান অবতারণা। পেছন দিকে তাকালে, গত ৪৩ বছরে আমাদের অর্জন কী হয়েছে, আমাদের কী ধরনের স্বপ্ন দেখা উচিত, আমাদের কী আছে আর কী নেই, সেটার ওপর একটা নাতিদীর্ঘ সাধারণ আলোচনা পূর্বতন একটি লেখায় আমি বলেছি (ডেইলি স্টার, মার্চ ১৭,২০১৪, পৃ.৫০)। বর্তমান লেখায় আমি নজর দিতে চাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খাতে আমাদের অগ্রগতিগুলো কীভাবে মাপা যায়, কোন বিষয়গুলো দেখতে হবে, কীভাবে দেখতে হবে, মেথডোলজি বা প্রক্রিয়া-পদ্ধতিটি কী হবে ইত্যাদি।
স্বাধীনতার আগেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা-চর্যা ছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পঠন-পাঠন, একাডেমিক গবেষণা, প্রাতিষ্ঠনিক গবেষণা (যেমন এটমিক এনার্জি কমিশন) এবং সৌখিন জনপ্রিয়তামূলক কর্মকান্ড (বিজ্ঞান-ক্লাব, ছোটখাট বিজ্ঞান-বক্তৃতা ইত্যাদি) পরিচালিত হতো। স্বাধীনতার পরেও সেই একই ধারা বজায় আছে। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও নতুন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেটা কিছুটা বেগবান হয় এবং পূর্ব-বাঙলায় সুনির্দিষ্ট অবদান রাখতে শুরু করে। যেমন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ (BARC) প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রত্যক্ষ গবেষণায় আজ খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে। তারও আগে ১৯৫৫ সালে ভিন্ন নামে আজকের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (BCSIR) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই এসব প্রতিষ্ঠান গতি পায়, অন্তত স্থানীয় অবদানের ক্ষেত্র বিবেচনা করলে। একুশ শতকে প্রবেশের আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা, একাডেমিক পঠন-পাঠন, চর্চা-চর্যা একই নির্দিষ্ট ধারায় চলেছে। এই ভরবেগ ছিল সেই পাকিস্তান যুগেরই ভরবেগ – সেই অভিন্ন তাড়না, সেই অভিন্ন গতিবেগ। সত্য বটে চরিত্রগত দিক দিয়ে ১৯৭০ এবং ১৯৮০’র দশকের এই পথচলা কিছুটা আলাদা, কিন্তু পরিবর্তনের হার বিবেচনা করলে এটা ধ্রুপদী যুগ। ইত্যবসরে ঘরে-বাইরে তথ্যের আদান-প্রদান বেড়ে যাওয়ায়, ইন্টারনেট ঘরের মধ্যে বিশ্বকে নিয়ে আসায়, রিসার্চ পেপার ডিজিটাইজড হয়ে যাওয়ায় একুশ শতকের প্রারম্ভে এই ধ্রুপদী যুগের অবসান হলো এবং শুরু হলো এক নতুন সম্ভাবনার যা ইন্টারনেট বিস্তারের এক প্রত্যক্ষ ফলাফল। বিদেশের গবেষণার ফল তখন দ্রুততার সাথে জানা যেতে শুরু করে, মানুষের চিন্তায় প্রতিঘাত সৃষ্টি করে দ্রুত, বেসামরিক ও বেসরকারি ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত হতে শুরু করে। এক অর্থে, দেশে এবং সমাজে গণতান্ত্রিক কাঠামো যতো চেপে বসতে থাকে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারও ততই বাড়তে থাকে। একইসাথে বাড়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও।
শূন্যদশকে শুরু হওয়া এই ‘নবধারা’কে আমরা কোয়ান্টিফাই বা সূচকবদ্ধ করব কীভাবে আর কখনই বা সেটা আমরা [১] করব? আমাদের বক্তব্য হলো অন্তত চারটি দিকে অবদান বিবেচনা করে তবেই আমরা এই বিষয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে আসতে পারি। এবং সেটাও যুক্তিসঙ্গত হবে যদি আমরা অন্তত কয়েকটি দশক পর এই সালতামামি গ্রহণ করি। আমাদের বক্তব্য হবে, এই অবদান ও অগ্রগতি মাপতে হবে ২০৫০’র দশকে। এই নবধারাকে পাঁচটি দশকের সময় দিতে হবে এবং তারপর তাকে হালনাগাদ করা যাবে। এবং সেটাও করবে বাংলাদেশী ও বাংলাভাষী কোনো বিজ্ঞানী। আর সেটাই হবে আমাদের সাফল্য। যদি পঞ্চাশ বছর পর এই অবদান বিচার করতে বসেন কোনো অ-বিজ্ঞানী, তাহলে ধরে নিতে হবে অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে অথবা কাঙ্খিত মাত্রায় হয়নি এবং সেক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো কিছু বেশী সময় অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের বক্তব্য হলো- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একটি পৃথক এবং গুরুত্বপূর্ণ খাত (sector) এবং এই খাতের অগ্রগতি ও অবদানের খতিয়ান নিতে হবে অন্তত চারটি বিষয়কে মাথায় রেখে। অগ্রগতির এই চতুর্মাত্রিক খতিয়ান ব্যতিরেকে এই ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের অবদানের সঠিক খতিয়ান অসম্পূর্ণ এবং দিকভ্রান্ত হতে বাধ্য। আমাদের মতে এই চারটি বিষয় হলো:
• একাডেমিক অবদান
• প্রতিষ্ঠানিক অবদান
• সচেতনতামূলক/জনপ্রিয় গ্রন্থ- প্রণয়ন, লেখালেখি, ব্লগিং, পত্রিকা-প্রকাশ
• সাংগাঠনিক কার্যক্রম

১. একাডেমিক অবদান (academic contribution):
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে উন্নয়নের একটি প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো ‘একাডেমিক এক্সেলেন্স’। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘আন্তর্জাতিক’ মানসম্পন্ন পাঠ্যক্রম অনুসৃত না হলে মানসম্মত ও প্রমিত জনসম্পদ তৈরি হবে না। সেজন্য প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জরুরি যেখানে উচ্চশিক্ষিত এবং যোগ্য ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষকমণ্ডলীর অধীনে পঠন-পাঠন সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশে এই রকম উল্লেখযোগ্য দুটি প্রতিষ্ঠান আছে- বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দুটি ছাড়াও সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে আরো বেশ কয়েকটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির বিষয়াদির শিক্ষাক্রম চালু আছে। তবে সবদিক বিবেচনা করে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে হ্যান্ডপিক করাই যায়, কারণ বহুবিধ কারণে এ দুইটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম কিংবা সেখানকার গ্রাজুয়েটরা মানসম্মত কিনা সেটা বোঝা যায় বেশ কয়েকটি উপায়ে– বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের ছাত্র ভর্তি হচ্ছে, সেখানে কারা পড়াচ্ছেন, যাঁরা পড়াচ্ছেন তাঁদের গবেষণা অভিজ্ঞতা ও ডিগ্রির আন্তর্জাতিকতা কতখানি প্রমিত, সেখানে কেমন পাঠ্যক্রম চালু আছে, সেই পাঠ্যক্রম কতখানি আধুনিক, সেখানে কী ধরনের টেক্সটবই পড়ানো হয়, কাদের লেখা টেক্সটবই পড়ানো হয়, ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটি কীরুপ, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ও সম্পর্ক কীরুপ, ছাত্র-ছাত্রী অনুপাত কেমন, সেখানে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস-অভিজ্ঞতা কেমন, সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাদারী দক্ষতা কেমন হয়, তাদের প্লেসমেন্ট উত্তর-আমেরিকার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে থাকে, শিক্ষার্থীদের হাইটেক সুবিধাদি পর্যাপ্ত কি-না, তাদের মাথাপিছু ব্যান্ডউইথ কত নির্ধারিত হয়েছে ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ক্ষেত্রে যেমন কোন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কোন্‌ কোম্পানিতে চাকরি পেল সেটাও গুরুত্ব পায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা বৃদ্ধিতে। আমাদের এখানে কর্পোরেট–সংস্কৃতি এখনো শৈশবে। মাত্র ডজনখানেক বহুজাতিক কোম্পানি আছে যেখানে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের স্নাতক নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। আগামী ৫০ বছরে হয়ত এটা আরো বিকশিত হবে। কিন্তু আপাতত এই ক্ষেত্রে প্লেসমেন্ট বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এবং এই সংক্রান্ত অবদান সূচকবদ্ধ করা যাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চ দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা থাকা শিক্ষকদের জন্য একটা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। এটা না থাকলে স্নাতকদের দক্ষতা নিম্নগামী হবে। শ্রেণীকক্ষে কীভাবে পাঠদান করা হচ্ছে, সেখানে আধুনিক টুল ( যেমন পাওয়ার পয়েন্ট, অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিকমানের পাঠ্যবই, রিসার্চ পেপারের রেফারেন্স ইত্যাদি) ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন ক্রেডেনশিয়াল ফ্যাকাল্টি একজন অনুকরণযোগ্য মেন্টর হতে পারেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নিয়মিত পাঠদান ও গবেষণার [২] পাশাপাশি একটা সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে পারেন। এটা একপ্রকার সামাজিক অবদানও বটে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে আমাদের অবস্থান এখন পর্যন্ত হতাশাজনক থাকলেও এটা অচিরেই উন্নত হবে বলে আশা করা যায়। তবে সেটার সবটাই শিক্ষকমণ্ডলী কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে আছে তা-ও ঠিক নয়। অবকাঠামোর ব্যাপক-ভিত্তিক উন্নয়ন না হলে এটা সম্ভব হবে না। উন্নত ও দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী শুধু পড়ানোর কাজই করেন না, তাঁরা গবেষণাও পরিচালনা করেন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মেন্টরিংও করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মেন্টরিংয়ের অনুপস্থিতি আমাদের দেশের অনেক দিনের সমস্যা। একদল উঠতি শিক্ষার্থীর সামনে একজন অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব থাকতে হয় যাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা যায়, যার থেকে জীবন সম্পর্কে শিক্ষা নেওয়া যায়। এমনতরো মেন্টর হতে পারেন বাবা, বড়-ভাই, গৃহশিক্ষক অথবা কোনো বড় বিজ্ঞানী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা অ্যাকটিভিস্ট। একটি গ্রহণযোগ্য এবং অনুসরণযোগ্য চরিত্র সামনে থাকলে শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য নির্বাচনে সুবিধা হয়।
একাডেমিক এক্সেলেন্সের পাশাপাশি রিসার্চ এক্সেলেন্সও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি মানসম্মত গবেষণা পরিকাঠামো বজায় রাখা, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গবেষণা-সুনাম বজায় রাখা, পরিচিতি ও সহযোগিতা (collaboration) বিস্তৃত করা, গুরুত্বপূর্ণ ও চটকদার বিষয়সমূহে গবেষণা পরিচালিত করা -– এসবই গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান মূল্যায়নে ভূমিকা রাখে। মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চকে উৎসাহিত করা, দেশ ও বিদেশের গবেষকদের আকৃষ্ট করা, একাধিক মানসম্মত রিসার্চ-সেন্টার পরিচালনার ক্ষমতা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মান প্রদান করে। দুঃখজকভাবে এই জায়গায় আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খুব হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই খুব ভালো স্নাতক বা আন্ডারগ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু নতুন জ্ঞানের সৃজন, যেটা কেবলমাত্র ল্যাবরেটরিতে [৩] গবেষণার মাধ্যমেই হয়, সেটা এদেশে আর হচ্ছে না। এর মূল কারণ খুব সহজ– শিক্ষকদের অত্যল্প বেতন। এতো কম বেতনে মানসম্মত শিক্ষক মানসম্মত পাঠদান চালিয়ে যেতে সম্মত হবেন না, গবেষণা তো দূর–অস্ত। ভারত বা পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যে পরিমাণ বেতন-ভাতাদি দেওয়া হয় সেটা আমাদের থেকে ঢের বেশী। ফলে এই সংক্রান্ত মূল্যায়ন অর্থপূর্ণ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও গবেষণাভাতা এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বৃত্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেটে গবেষণাবরাদ্দের পরিমাণও বাড়াতে হবে। এটা ছাড়া এখানে কোনো অবদান সম্ভব নয়। অবশ্য এটা আগামী ৫০ বছরে খুব একটা বদলাবে বলে প্রতীতি হয় না।

২. প্রাতিষ্ঠানিক অবদান (institutional contribution) :
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পরপরই আসে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবদান। আমাদের দেশে এধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গুরুত্বের দিক দিয়ে প্রথমেই আসে আণবিক শক্তি কমিশনের নাম। পাকিস্তান আমলে পারমাণবিক বোমা কর্মসূচি থাকায় এই কমিশন ছিল খুবই শক্তিশালী। বাংলাদেশ পর্যায়ে এই কমিশন অনেকখানিই স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা এগিয়ে আসায় এই কমিশন আবারো কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। তবে এটুকু অন্তত বলা যায়, আণবিক শক্তি কমিশনের গবেষণা পরিকাঠামো নিতান্ত ফেলনা নয়। এরপরই BCSIR ও BARC এর কথা বলা যায়। শিল্প গবেষণায় অবদানের তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে অবদান অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য। কৃষিক্ষেত্রে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদান অনেক সুদূরপ্রসারী। নানান জাতের উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন করে ১৬ কোটি মানুষের মুখে খাবার যোগান অব্যাহত রাখা সামান্য কথা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার অবদান মূল্যায়ন করতে হলে সেখানকার গবেষকদের তাত্ত্বিক ও ফলিত গবেষণাকর্মকে আন্তর্জাতিক জার্নাল ও কনফারেন্সে প্রকাশযোগ্য হতে হবে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিকমানের দেশীয় জার্নাল প্রকাশ ও সম্পাদনার ঐতিহ্য শুরু করতে হবে [৪], দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাগসই প্রযুক্তির সাহায্যে দেশীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধান করতে হবে, বিভিন্ন সুলভ যন্ত্রপাতি (যেমন উন্নত চুলা, ব্যাটারী-চালিত রিক্সা, উন্নত সার-প্রদান যন্ত্র, নিড়ানি যন্ত্র ইত্যাদি) নির্মাণ করতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিজ্ঞান-মেলার আয়োজনের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপারে স্থানীয় ও আঞ্চলিক মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে হবে, গণমানুষের দৈনন্দিন সমস্যাকে সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশে ডায়রিয়া ও ডাইবেটিসের মতো মারাত্মক রোগের চিকিৎসায় যথাক্রমে ICDDRB এবং BIRDEM হাসপাতাল অননুকরণীয় অবদান রেখেছে। দৈনন্দিন যে অগণিত সংখ্যক রোগী এ দুই জায়গায় পরিষেবা গ্রহণ করছে সেটা ভীষণ উল্লেখযোগ্য। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে সামান্য বাজেটে চালিত ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও তার শাখাসমূহ চিকিৎসাগবেষণায় দুর্দান্ত অবদান রাখতে পেরেছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল

এই ক্ষেত্রে একটি দুর্দান্ত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে সিভিল-মিলিটারি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল। এক্ষেত্রে ভারতীয় মডেল আমরা অনুসরণ করতে পারি। চীনের গবেষণা পরিকাঠামো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপে সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে দুর্দান্ত গবেষণাগুলো সামরিক–বেসামরিক যৌথ প্রয়াসেই সংঘটিত হয়। এ ধরনের যৌথ প্রয়াসের প্রধান উদাহরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষককে দিয়ে প্রাথমিক স্তরের তাত্ত্বিক ও ফলিত গবেষণা করিয়ে নিয়ে সেই ফলাফলের ভিত্তিতে বেসামরিক কোম্পানি বা সিভিল কন্ট্র্যাকটরের সাহায্যে রিসার্চ প্রটোটাইপ উদ্ভাবন করা। আমেরিকায় এই পদ্ধতিতে বহুতর গবেষণা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে শৃংখলার অভাবে এবং দুর্নীতির কারণে বেসামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো আনুপাতিক অবদান রাখতে ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অন্যদিকে, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহ (যেমন বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি) বিকশিত হতে ব্যর্থ হচ্ছে। একটি অভিন্ন ছত্রের অধীনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ে আসতে পারলে সামরিক শৃংখলা ও বেসামরিক ধীশক্তির যৌথ প্রয়াসে আমারা কিছু অনুকরণযোগ্য ও গর্ব করার মতো প্রতিষ্ঠান পেতে পারি। এসব সম্ভাব্য সিভিল-মিলিটারি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের সামরিক ও বেসামরিক বাজারে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এতে শুধু অবিকশিত মেধারই শৃংখলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না, শৃঙ্খলিত কল্পনারও সার্থক প্রয়োগ ঘটবে। অতি সাধারণ ওয়াকি-টকিও যদি আমরা দেশীয় প্রকৌশলী দিয়ে দেশেই তৈরি করতে পারি তবে সেটা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা শুধু বাঁচাতেই পারবে না, বাইরে থেকে আকর্ষণ করে নিয়েও আসতে পারব। এটা একটা দারুণ সম্ভাবনা এবং এর অবদান দীর্ঘমেয়াদী ও গভীর হতে বাধ্য।
একটি প্রতিষ্ঠান যখন সফল হয় তখন শুধু সেই প্রতিষ্ঠানটিই সফল হয় না বা ঐ প্রতিষ্ঠানের গুটিকয়েক উঁচুদরের গবেষকই সফল হয় না, জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশও সফল হয়। একটি বড় প্রতিষ্ঠান যখন গড়ে ওঠে তখন শুধু একটি বড় ভবনই নির্মিত হয় না, বা অনেকগুলো মানুষই শুধু চাকরি পায় না, তাকে ঘিরে আরো অনেক মানুষের পরোক্ষ জীবিকার ব্যবস্থাও ঘটে। ঐ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে একদল ঠিকাদারের আবির্ভাব হবে, একদল কনসালটেন্টের সমাবেশ ঘটবে। এরা সবাই মিলে একটা উদ্ভাবনের সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে। এমনই মিলিত প্রয়াসের উদাহরণ হিসেবে দেখি ইউরোপের সার্নে পরমাণু খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার করে ফেলল। বিজ্ঞানীরা কীভাবে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করবেন তার সমাধান খুঁজতে গিয়েই ইন্টারনেটের আইডিয়া বেরিয়ে আসে। ফলে একটি প্রতিষ্ঠানের অবদান শুধু একটি প্রোডাক্টেই সীমাবদ্ধ নয়, বরঞ্চ তাকে ঘিরে যে একটা জনসংস্কৃতি গড়ে ওঠে সেটাও একটা পরোক্ষ অবদান এবং তা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।

বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি

৩. লেখালেখির অবদান (contribution through publication):
– বই লেখা (পাঠ্য বা জনপ্রিয়)
– প্রবন্ধ লেখা, পত্রিকায় বা অনলাইনে
– পত্রিকা প্রকাশ করা
– ব্লগ লেখা
– ফেসবুকে লেখা / শেয়ার করা
–এসবই বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের খবরাখবর, সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারসমূহ, বিজ্ঞানীদের সাফল্য, প্রযুক্তির পরিকল্পনা ইত্যাদি নানাবিধ চটকদার খবর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার নিমিত্ত মাত্র। এটার সাহায্যে জনসচেতনতা বাড়ে, জনপ্রিয়করণ কর্মযজ্ঞে সুবিধা হয়, বাংলায় সীমিত ক্ষেত্রে পাঠ দান করা যায়, ক্লাব কার্যক্রম চালানো যায়, পাঠচক্র চালানো যায়। শিশু ও কিশোরকে পাঠ্য-সিলেবাসের বাইরে থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আকর্ষণ করার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প। বিশেষ করে এই সময়ে যখন পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। এই মুহুর্তে বিজ্ঞান বইয়ের সিলেবাস খণ্ডিত হয়েছে — বই ছোট হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই বিষয়ের অবদান মূল্যায়ন করতে গেলে টেক্সটবুক বোর্ডের এই তুঘলকি কাণ্ড একটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আশা করা যায়, এই ক্ষেত্রে একটা স্থিতাবস্থা আসবে, আমাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হবে। আর তাহলেই ৫০ বছর পর এক্ষেত্রে একটি অর্থপূর্ণ মূল্যায়ন করা যাবে। সেটা না হলে এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অবদানের মূল্য বৃথা যেতে বাধ্য।

বিজ্ঞানের বই

স্কুলের পাঠ্যের বাইরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণীর পাঠ্যবই বাংলায় রচনার মহতী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় যেটার এখনকার নাম বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির পাঠ্যপুস্তক বিভাগ ভৌতবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও জীববিজ্ঞান শাখায় প্রচুর পাঠ্যবই বাংলায় প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় নানান কারণে এই পুস্তকাদি মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ পারিভাষিক সমস্যা, আমাদের লেখকদের সাবলীল গদ্য-রচনার অপারগতা, শিক্ষকদের বাংলা বই গ্রহণের মানসিকতার অভাব। পাঠ্যবইয়ের মান উচ্চ না হওয়ায় এবং জটিল গদ্য ব্যবহারের ফলে এসব অধিকাংশ পাঠ্যবইই পেডাগজির দিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা এসব সংস্কৃত ও তৎসম শব্দ-ভারাক্রান্ত গ্রন্থ পড়ে কিছুই বুঝতে পারেনি। ফলে এসব পাঠ্যবইয়ের অধিকাংশই আজ অবদান-শূন্য ও রিক্ত অবস্থায় পতিত হয়েছে। কিছু কিছু ব্যতিক্রমী পাঠ্যবই যে রচিত হয়নি, তা নয়। তবে তা গুটিকয়েক মাত্র। অথচ এইসব পাঠ্যবইয়ের অনেক রচয়িতাই ছিলেন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ। সংক্ষেপে এটুকুই বলা যায় যে, বাংলা একাডেমির পাঠ্যপুস্তক রচনা প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি একটি মৃত খাত।
এই আপাত মৃত্যুর আরেকটি কারণ দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এবং প্রকৌশল ও চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো পেশাদার বিষয়গুলোতে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে ইংরেজি ভাষার পাঠ্যপুস্তক ব্যবহৃত হয়। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে উন্নতমান বজায় রাখতে এবং বিদেশের শিক্ষার্থীদের সাথে সমান কাতারে থাকতে এবং সমান বৌদ্ধিক মান বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচলিত পাঠ্যবই ব্যবহার না করে গত্যন্তর নেই। কিন্তু এই উচ্চ মেধাবী ও হাই-প্লেসমেন্ট ধারী শিক্ষার্থী বাদ দিলে আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব পাস ও ডিগ্রি কোর্স চলছে, কিংবা যেসব পলিটেকনিকগুলো দেদারসে ডিপ্লোমা তৈরি করছে – এইসব মধ্যম ও তার নিচের ধাপের শিক্ষার্থীদের জন্য কিন্তু বাংলা পাঠ্যবই খুবই দরকার। আর এরাই কিন্তু আমাদের কল-কারখানা এবং অফিস-আদালতের মূল চালিকা শক্তি। কারণ উচ্চ মেধাবী বেশির ভাগই বিদেশমুখী হয়ে থাকে। কাজেই বাংলায় যদি পাঠ্যপুস্তক লেখা হয়, তাহলে এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যই তা বেশি বেশি লেখা হোক এবং ভালো করে লেখা হোক। এবং একাজে পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা অনেক এগিয়ে। ডিগ্রি ও পাস কোর্সের জন্য তাঁরা সুন্দর বাংলায় প্রচুর পাঠ্যবই লিখেছেন। কাজেই বাংলাপাঠ্যবইয়ের মূল অবদানটা এই মাঝারি-মেধার বিপুল সংখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মূল্য বহন করে এবং ঠিক এজন্যই এটাকে চালু রাখা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে একজন জাঁদরেল অধ্যাপককে এই শ্রেণির জন্য লিখুতে বললেই তিনি নির্ঘাত নাক সিঁটকাবেন। নাসিকাকে উচ্চ রাখবার এই কুলীন প্রয়াস আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ।
আধুনিক ও উচ্চতর বিদ্যার জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক লেখার সমস্যা হলো– পরিভাষা, প্রকাশনা এবং বাংলা ভাষার সতত চলমানতা। পুরোনো কথা আবারো বলতে হচ্ছে। অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের (যেমন ন্যানোপ্রযুক্তি বা নিউরোসায়েন্স) আধুনিক টেক্সটবই বাংলায় লেখা অসম্ভব নয়। কিন্তু সেটা পণ্ডশ্রম হবে। কেননা প্রথমত এই ধরনের বইয়ের প্রকাশক নেই, এই বইয়ের পরিভাষা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে, ফলে শিক্ষার্থীরা পড়ে কিছুই বুঝবে না। উপরন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বোঝার কথা ছিল, তারা এই বিষয়টি বাংলা থেকে শিখবে না, তারা মূল ইংরেজি থেকে শিখবে। তারপরও যেটা লিখিত হবে ৫/১০ বছর পর সেটা এতটাই পুরনো (outdated) হয়ে যাবে যে এর কোনো অর্থই থাকবে না। এই অবদানের কোনো মূল্যই থাকে না। নতুন বিজ্ঞান যেহেতু বাংলাদেশে তৈরি হয় না, বাংলা ভাষায় তার ভাণ্ডারও সৃষ্টি হয়নি। ফলে ন্যানোপ্রযুক্তি বা নিউরোসায়েন্সের মতো অত্যাধুনিক বিষয়ে মান্ধাতার আমলের পরিভাষা দিয়ে জোড়াতালি দিলে শিক্ষা-বিজ্ঞান–জ্ঞান-পাঠদান-গবেষণা-পেডাগজি কোনোটাই হবে না। বিজ্ঞানের কিছু চিরায়ত বিষয়ে চর্চার ঐতিহ্য যেহেতু আমাদের পুরনো– যেমন গণিত, প্রকৃতি, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, ভূগোল, শারীরবিজ্ঞান,কিমিয়া –- সেহেতু এসব ক্ষেত্রে পূর্বতন পরম্পরার সূত্র ধরে পরিভাষা কষ্ট করে তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু নব্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারণে সে পথ রুদ্ধ। অন্যদিকে ভাষার চলমানতা তো রয়েছেই। আজকের পাঠ্যবই কুড়ি বছর বাদে অবোধ্য, অপাঠ্য, ধুত্তোর-ছাই! এসব কারণে আজকাল বিজ্ঞান-শিক্ষকরা হট-সাবজেক্টের উপর বাংলায় লিখতে আগ্রহী হন না। তবে মাঝারি ও নিচের দিকের বিষয়গুলোতে ও শ্রেণিতে কিন্তু লেখা চলে। এবং সেটা চালু রাখা উচিত।
এই প্রসঙ্গে ডঃ মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার কথা বলা যেতে পারে যিনি ১৯৭০ ও ১৯৮০ –র দশকে রসায়নের ওপর বাংলায় বেশ কিছু পাঠ্যবই লেখেন। তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি চার খণ্ডে রচিত ‘জৈব রসায়ন’। কিন্তু এসব বইয়ে তিনি যে উদ্ভট বাংলা ব্যবহার করেন, তাতে এসব বই কখনোই পাঠক-প্রিয়তা পায়নি। ফলে এই টেক্সটবইটি অচিরেই মৃত্যু বরণ করে। ডঃ কুদরত-ই-খুদার অবদান অন্যক্ষেত্রে উজ্জ্বল; যেমন – BCSIR স্থাপনে, তাঁর অবদান শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগে দিকনির্দেশনা প্রদানে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক লেখায় তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা কেবল স্মরণীয়, অনুকরণীয় নয়।

ডঃ কুদরত-ই-খুদা (ডিসেম্বর ১, ১৯০০ - নভেম্বর ৩, ১৯৭৭)

স্বভাবত কারণে বিজ্ঞান-লেখকরা (শিক্ষক- অশিক্ষক-অর্ধ-শিক্ষক-অ্যাকটিভিস্ট-বিশেষজ্ঞ ) পপুলার সায়েন্স বা জনপ্রিয় ধাঁচের সহজ বিজ্ঞান লেখার দিকে ঝুঁকে যান।২০০৫ সাল থেকে পূর্ণমাত্রায় গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হওয়ার ফলশ্রুতিতে এবং সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী নিত্যনতুন অলিম্পিয়াড ও বিজ্ঞান-অনুষ্ঠানের ফলে বিজ্ঞান বিষয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েদের একটা সাধারণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সেই আগ্রহের স্রোতে আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বিজ্ঞান-গ্রন্থের চাহিদা অনেকখানি, যেটা দুইযুগ আগেও ছিল না। এর ফলে গণিত, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং অপরাপর বিষয়াদির ওপরে, এবং অবশ্যই বিজ্ঞান কল্পকাহিনির ওপরেও, সহজ বই লেখার সহজাত প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এসব বইয়ের মূল ভূমিকা হলো বিজ্ঞানের খবরাখবর এবং টেকনিকাল বিষয়গুলো সহজ করে পাঠকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। এটা একটা প্রাথমিক জনসচেতনতামূলক কাজ এবং যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণও বটে। কাজেই এসব গ্রন্থের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। পঞ্চাশ বছর পরেও আবদুল জব্বারের ‘তারা পরিচিতি’, কিংবা আবদুল্লাহ আল-মুতীর ‘আবিষ্কারের নেশায়’ অথবা এ. এম. হারুন-অর-রশীদের ‘পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব’ একেবারে মূল্যহীন হবে না। শুধু বিষয়ের জন্য নয়, ভাষা এবং চিরকালীনতার জন্যও বটে। এইসব বইয়ের ভূমিকা ভুলবার নয়। এগুলি শুধু বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য রচিত হয়নি কিংবা শুধু তাদেরকেই আলোকিত করেনি, বরঞ্চ এমন পাঠককে উজ্জীবিত করেছে যারা বিজ্ঞানের ছাত্রই নন। ওঁরা বিজ্ঞানের অনাস্বাদিত জগতের একটা ছাপচিত্র গ্রহণ করেছেন এ ধরনের বই থেকে। বিজ্ঞানের বিষয়ের মুখোমুখি হলেই তাঁরা সতত স্মৃতিচারণ করেন, “আহা, অমুক লিখতেন, পড়েছি, বেশ!” কাজেই বিজ্ঞানকে সহজ করে লিখে জনপ্রিয়করণের কাজটা অত্যন্ত জরুরি এবং সেটা গুরুত্বের সাথে করা বাঞ্ছনীয়। সহজ বই লিখতে গিয়ে অতিসরলীকরণের বিপদ যেন না ঘটে সেটা দেখা সমকালীন বয়োজ্যেষ্ঠ বিজ্ঞান-লেখকদের একটা কর্তব্য। আইনস্টাইন বলেছিলেন, “সিম্পল; ইফ নট সিম্পলার।” সহজ, কিন্তু অতিসহজ নয়, যাতে ভ্রান্তিবিলাসের সম্ভাবনা প্রকট হয়। কাজেই বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অধ্যাপকেরা যদি একাজে এগিয়ে আসেন তো ভাল হয়। বিশ্বের বরেণ্য প্রায় সকল বিজ্ঞানীই জনবোধ্য বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। আমরা সবাই স্টিফেন হকিংয়ের নাম জানি। বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্ব নিয়ে অঙ্ক কষায় তিনি যেমন সিদ্ধহস্ত, জনবোধ্য বিজ্ঞান-গ্রন্থ লেখাতেও তিনি সমান পারদর্শী। বিদেশে বিজ্ঞানের গরল পাবলিককে সরল করে পরিবেশনের জন্য ‘প্রফেসর অব পাবলিক আণ্ডারস্ট্যান্ডিং অব সায়েন্স’ নামে পদ সৃষ্টি হয়েছে। রিচার্ড ডকিন্স এক সময়ে অক্সফোর্ডে উক্ত পদে আসীনও ছিলেন। অধ্যাপনা ও গবেষণার সময় থেকে কিছু সময় চুরি করে স্রেফ অনুদানের মানসিকতায়ও যদি আমাদের অধ্যাপকেরা জনবোধ্য রচনা লেখেন তো বড় উপকার হয় এবং একটি মূল্যবান অবদান সংযোজিত হয়।
বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি বিজ্ঞানের ধারণা, বার্তা ও বৈজ্ঞানিক ভবিষ্য-চিন্তন জাতীয় ভাবনাগুলিকে চমৎকার করে জনমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। ফিকশনের বাতাবরণে, একটা কাহিনির বুনটে বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ভাবনাগুচ্ছ, চিন্তাপ্রণালী কিংবা কোনো বিশেষ তত্ত্বের কাল্পনিক বহিঃপ্রকাশকে খুব সহজেই পরিবেশন করা যায়। এটা জনসচেতনামূলক অবদান রাখতে সক্ষম। ১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইজাক আসিমভ কিংবা আর্থা সি ক্লার্কের সায়েন্স ফিকশনগুলি বিজ্ঞানের প্রতি সাধারণ ছাত্রছাত্রীকে আকর্ষণ করায় একটা বড় ভূমিকা রাখে। আসিমভের বিখ্যাত ‘ফাউন্ডেশন’ ট্রিলজি কিংবা আর্থার ক্লার্কের দুটি ট্রিলজি – ‘স্পেস ওডিসি’ এবং ‘রামা’ – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির জগতের তিনটি পথিকৃৎ রচনা। বাংলা ভাষায় এমন পথিকৃৎ বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনি আমরা পাইনা। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা’ অনেকখানি ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সেদিক দিয়ে আমাদের দেশের প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের কোনো ট্রিলজি নেই। হুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ কিংবা জাফর ইকবালের ‘কপোট্রনিক সুখদুঃখ’ ছাড়া এককভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনির উল্লেখ করা মুশকিল। তবে তাঁদের যৌথ এবং/অথবা একক প্রভাব অনস্বীকার্য। তাঁদের বিপুল পাঠক-প্রিয়তার ফলে দেশের শিশু-কিশোররা তাঁদের হেন লেখা নেই যে না পড়ে থাকে। এবং সেই সূত্রে তাঁরা দেদারসে তাঁদের বইয়ে বিজ্ঞান অথবা বিজ্ঞানীর রেফারেন্স নিয়ে আসেন। এভাবে একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব তাঁরা রেখেছেন। বিশেষ করে অলিম্পিয়াড-সংস্কৃতি তৈরিতে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাজেই একথা বলা যায়, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পরিণত ধারা তৈরি এখনো বাকি এবং ২০৫০’র দশক অবধি এ ধারায় কী নতুন অবদান সংযুক্ত হবে সেটা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে।
বিজ্ঞান পত্রিকার উপস্থিতি থাকাটা একটি জরুরি বিষয়। উপরন্তু সেটা যদি ধারাবাহিক হয় তবে তো আরো ভালো। একটি ধারাবাহিক বিজ্ঞান-পত্রিকার একটি স্থিতধি পাঠক-সমাজ থাকে। সেই পাঠকসমষ্টির একটি সামাজিক বোধ ও মেজাজ তৈরি হয়। সেটা তৈরি করে ঐ পত্রিকার লেখক-গোষ্ঠী। এই বিজ্ঞানমোদী পাঠক-সমষ্টি সমাজে বিজ্ঞান চেতনা এবং বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞানের ধারক ও বাহক হয়। ফলে যেকোনো সময়ে একটি বিজ্ঞান পত্রিকার উপস্থিতি অত্যন্ত কাম্য একটি প্রপঞ্চ। দুঃখের বিষয়, নিকট-অতীতে আমাদের দেশে সেটা প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গিয়েছিল। ১৯৬০-৭০’র দশকে ছিল ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’, সম্পাদক ডঃ মুহম্মদ ইব্রাহিম। এই পত্রিকাটি মোটামুটি চালু ছিল ১৯৯০ এর দশকের শেষাবধিও। শূন্য দশকে এর মুদ্রিত কপি চোখে না পড়লেও ‘বিজ্ঞান সাময়িকীর চল্লিশ বছর’ বলে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ১৯৬০’র সেপ্টেম্বর থেকে জুলাই ২০০০ অবধি লেখা সংকলিত হয়েছে। ‘স্পুটনিক ও গ্যাগারিনের যুগ’ দ্বারা অনুপ্রাণিত এই সাময়িকীর ৪০ বছরের এই সংকলনটি ঐ চার দশকের একটি সামাজিক বীক্ষণও বটে। দেখা যায়, এই বিস্তৃত সময়ে বহু শিক্ষক-অধ্যাপক-সাংবাদিক-শিক্ষার্থী বিজ্ঞান লিখতে কলম তুলেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ঐ দীর্ঘ সময়ে এতো বিস্তৃত বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দ বাংলায় লেখার মতো কয়েকশত লেখক ছিলেন! এই লেখকেরা এই সমাজেরই মানুষ। কাজেই এই সমাজই এই বিষয়গুলো ধারণ করার ক্ষমতা রাখত। অথচ সেই দার্ঢ্য এই সমাজ দেখাল কৈ? শূন্য দশকে এসে ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর ফেলে যাওয়া শূন্যস্থানে আমরা আর কোনো বিজ্ঞান-পত্রিকাকে স্থায়ীভাবে দেখি না। ‘বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান পত্রিকা’ একটা আলাদা স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখত। এটাকে ঠিক জনবোধ্য বলা যায় না। এছাড়া ‘সায়েন্স ওয়ার্ল্ড’, ‘মহাকাশ বার্তা’, ‘বিজ্ঞানের জয়যাত্রা’ এবং অন্যান্য পত্রিকা কিছুটা মশাল বহন করেছে। কিন্তু বাংলার পত্রিকা স্ট্যান্ডে আবারো ধারাবাহিক একটি বিজ্ঞান পত্রিকা আসতে শুরু করে ২০১২ সালে। ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ পত্রিকাটি সেই থেকে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের একাধিক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে – তারা একাধিক পত্রিকা চালায়, বিজ্ঞান বক্তৃতার আয়োজন করে, একদল তরুণ লেখকগোষ্ঠী তৈরি করেছে, বিভিন্ন বিজ্ঞান কর্মকাণ্ডে তারা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। এটা সম্ভব হতো না যদি না ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ তার পরম্পরা তৈরি করে রেখে যেতো। সমাজের ঐ ভাগশেষ অংশটি প্রচ্ছন্নে ছিল বলেই ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ শূন্য থেকে দ্রুততার সাথে উঠে এসেছে। কাজেই সমাজে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা, ভালোবাসা ও কদর বজায় রাখতে এবং একটা বিজ্ঞান-মেজাজ তৈরি করতে মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকার ধারাবাহিক প্রকাশনা জরুরি। এটা না থাকলে জনপ্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা মুশকিল হয়ে পড়ে। এখানে অবশ্য বলে রাখা ভালো, কাছাকাছি রকমের কাজ/অবদান কিন্তু দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক বা মাসিক বিজ্ঞান কলাম রাখতে পারে। তবে মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকার শক্তি যেখানে, দৈনিক পাতার দুর্বলতাও সেখানে। কাজেই দৈনিকের পাতার জন্য বিজ্ঞান-সাংবাদিকতা এবং বিজ্ঞান-পত্রিকার লেখক হওয়া দুটো ভিন্ন বিষয়। প্রসঙ্গত আমাদের দেশে বিজ্ঞান-সাংবাদিকতা গড়ে ওঠেনি। তার কারণ দৈনিকের বিজ্ঞান-পাতার দৈন্যতা। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের সামাজিকীকরণ এবং সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক অনুধাবনের পরিমাপ গ্রহণ বিজ্ঞান-সাংবাদিক ভিন্ন হয় না। এজন্য আমাদের সমাজে সুস্থ বিজ্ঞান-বোধ বজায় রাখতে একটি স্টেডি বিজ্ঞান-পত্রিকার পাশাপাশি তার জন্য প্রাসঙ্গিক যোগ্য একদল বিজ্ঞান-সাংবাদিকও প্রয়োজন। একই কথা প্রযোজ্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জন্যও। সেখানে ‘সায়েন্স প্রোগ্রাম’ অর্থ হলো কম্পিউটার ও চটকদার যন্ত্রপাতির এক চাকভূম মিশেল! ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেলের মতো বস্তুনিষ্ঠ সায়েন্স প্রোগ্রাম বাংলা ভাষায় আজও হলো না! এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা।
বিজ্ঞান-লেখক এবং বিজ্ঞান-সাংবাদিকের পর আসে ব্লগারদের বিষয়। আশার কথা, বহু বাধা সত্ত্বেও বাংলার ব্লগ-সংস্কৃতি ক্রমোচ্চ ধারায় বিকাশমান। অনলাইনে ইউনিকোডে ‘অভ্র’ ফোনেটিক কী-বোর্ডে লেখার যে কৌশল এক তরুণ প্রমিথিয়াস আবিষ্কার করে দিলেন, আর সেইসাথে যে বাঁধ খুলে দিলেন তার বর্ণনা ব্লগেও সম্ভব কিনা জানি না। আর একইসাথে অর্গল উঠে গেল আত্ম-প্রকাশের চিরন্তন আর্তির। প্রকাশক বা সম্পাদকের কাঁটাচামচের বাইরে গিয়ে নিজের মনোভাব স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা, অন্যের মতামতের প্রেক্ষিতে দৃষ্টিভঙ্গিকে শাণিত করা – এসবই সম্ভব করে দিল ইন্টারনেট, ইউনিকোডে বাংলা লেখার সম্ভাবনা এবং ব্লগ সংস্কৃতি। গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হওয়া বাদ দিয়ে ব্লগার ঝুঁকে পড়ল ইন্টারনেটে। সেখানেই তথ্য, সেখানেই উপাত্ত, প্রয়োজন হলে অচেনা বন্ধু কাঁচতন্তুর নল বেয়ে অজানা ভূখণ্ড থেকে এনে দিচ্ছে অমৃতের ধাম। সে এক দক্ষযজ্ঞ বটে! এই ব্লগারদেরই কেউ কেউ স্বতোপ্রণীত হয়ে তৈরি করেছেন বিজ্ঞান বিষয়ক ব্লগ। মুক্তমনা, জিরো টু ইনফিনিটি, বিজ্ঞানব্লগ, বিজ্ঞানবিশ, পিপীলিকা ইত্যাদি বাংলা ব্লগের উদাহরণ যেখানে প্রচুর জনবোধ্য বিজ্ঞান নিখরচে পাওয়া যায়। ব্লগের অপরিপক্কতা, ঔদ্ধত্য ও একদেশদর্শীতা অতিক্রম করতে পারলে এটা একটা দারুণ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। একইসাথে সামাজিক সাইটগুলোতে (ফেসবুক, টুইটার) নিয়মিত শেয়ার করে বিজ্ঞানের টুকরো খবর অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এটা একটা নতুন মাধ্যম। অস্পৃশ্য এবং সেলিব্রিটি মানুষকেও আজ একটি ক্লিকের মাধ্যমেই চ্যাটরুমে পাওয়া যাচ্ছে, যেটা এই কয়দিন আগেও ছিল অচিন্তিতপূর্ব। ব্লগ লেখালেখি সচেতনতামূলক কাজের একটা বড় মাধ্যম। তথ্য পৌছে যাচ্ছে তেতুলিয়া থেকে টেকনাফে, মুহূর্তে। তাতে বিজ্ঞানের তথ্য যেমন পৌঁছাচ্ছে, তেমনি দাঙ্গার ঘটনাও ঘটছে। ইন্টারনেটের ফলে বাংলা ভাষায় সর্ববৃহৎ ওয়েবপোর্টাল তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার। এটাও সরকারী ও কাজের তথ্যের একটা বড় উৎস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খবর দ্রুত ছড়িয়ে দিতে এর অবদান অনস্বীকার্য।

৪. সাংগাঠনিক কার্যক্রম (Contribution through Activism):
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে লেখালেখির পাশাপাশি সাংগাঠনিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞান ক্লাব পরিচালনা, বিজ্ঞান-মেলার আয়োজন অথবা অংশগ্রহণ, এলাকার ও দেশের সৌখিন বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের উৎসাহ প্রদান, দিকনির্দেশনা প্রদান ও সদাব্যস্ত রাখা – এসবই সাংগাঠনিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি মাঝারি-দরিদ্র দেশগুলোতেও ক্লাব-কার্যক্রম বেশ জনপ্রিয়। এ ধরনের ক্লাব-কার্যক্রমের একটা বড় অংশ হলো সৌখিন জ্যোতির্বিদদের আকাশ পর্যবেক্ষণ এবং ‘নগ্নপদ বিজ্ঞানীদের’ (barefoot scientist) খুঁজে বের করে উৎসাহ প্রদান। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে উৎসাহী শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানকর্মীদেরকে বৈজ্ঞানিক কার্যপদ্ধতির সাথে পরিচিত করানো, বিজ্ঞানের ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, জনপ্রিয় বিজ্ঞান-গ্রন্থ পাঠে উৎসাহ প্রদান, কীভাবে সেসব বই পড়তে হবে সেটা শেখানো, বিজ্ঞান পত্রিকার প্রকাশনা গ্রহণ, বিজ্ঞান-মেলায় কীভাবে অংশ নিতে হবে তা শিখিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রতিটি কর্মকাণ্ডই গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান। সতীর্থদের বা অগ্রজদের কাছ থেকে এসব বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সাংগাঠনিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সংগঠকদের উদ্দেশ্য। এখানে একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের অধ্যাপক অথবা বিজ্ঞান-লেখক মূল ভূমিকা নিতে পারেন। তিনি তাঁর আশেপাশের উৎসাহী মানুষকে উপোরক্ত বিষয়সমূহে তাঁর অর্জিত বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বিতরণ করতে পারেন। এর ফলে সংগঠন ও সমাজ উপকৃত হয়। সমাজে আলো ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে এগুলোও উল্লেখযোগ্য অবদান হয়ে থাকে। কারণ পেশাদার বিজ্ঞানীদের বাইরেও একদল সৌখিন কর্মী বা সৌখিন বিজ্ঞানীর প্রয়োজন যাঁরা ছোটোখাটো খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবতে সক্ষম। এই বিশাল সম্প্রদায়টিকে প্রশিক্ষিত রাখার বিষয়টি একটি বড়সড় অবদান। এই সাধারণ প্রশিক্ষণের বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান পত্রিকার প্রকাশনাও অন্তর্ভুক্ত। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের/সংগঠনের প্রকাশনা থাকে এবং সকল প্রকাশনার থাকে সংগঠন। একটি বিজ্ঞান-পত্রিকার জন্য যথোপযুক্ত বিজ্ঞান-লেখক ও বিজ্ঞান-সাংবাদিক (এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে) তৈরি করতে হয়, বাংলায় সহজ করে লেখা শেখাতে হয়, তার ওপরে সম্পাদনা ও প্রকাশনার বিষয়গুলো থাকে। সব মিলিয়ে এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি। পত্রিকার সম্পাদনা নীতি ও লক্ষ্য, লেখার গুণাগুণ নির্ধারণ – সংগঠনের পাশাপাশি এসবও নির্ধারণ করতে হয়। এবং দক্ষ ও অগ্রজ লেখক-সাংবাদিক-সম্পাদকের কাছ থেকে সংগঠনের অন্যরা সেটা শিখে নিতে পারে। আমাদের দেশে এই ধারাবাহিকতা প্রায়শই ব্যাহত হয়। তথাপি অধুনা-লুপ্ত পত্রিকার মুদ্রিত কপি থেকে আমরা বুঝতে পারি সম্পাদনা ও প্রকাশনায় কী রকম যত্ন নেওয়া হয়েছে অথবা হয়নি।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরর্বতী ক্লাব-অ্যাকটিভিটি পূর্বোল্লিখিত ধারায় চলেছে। অনুসন্ধিৎসু চক্র, অ্যাস্ট্রনমিকাল অ্যাসোসিয়েশন ও সোসাইটি, বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদ, এবং এদের উত্তরসূরী একালের বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি, বাংলাদেশ সায়েন্স আউটরিচ ক্লাব এবং অন্যান্য ক্লাব আছে। আগেও যেমন, এখনো এসব ক্লাব/সংগঠন বিজ্ঞান-বিষয়ক নানারকম কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। আকাশ পর্যবেক্ষণ, তারাচেনা ক্যাম্প, বিজ্ঞান বক্তৃতা, গোল টেবিল আয়োজন, মেলা ও অলিম্পিয়াডের আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচলিত ধারার কার্যক্রম চালু আছে। সম্প্রতি মাধ্যমিক শ্রেণিতে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্য হিসেবে নানা কার্যক্রম দেখা যায়। যেমন উপজেলা ও গ্রামের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞানের নানান সহজ এক্সপেরিমেন্ট দেখানো, ভিডিও প্রদর্শন, নানারকম হাতের কাজ দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি।
এই প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশে একটি বিকল্প আন্দোলনের সূত্রপাত হয় গণিত অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে। ২০০১ সালে এর বীজ রোপিত হয় এবং ২০০৫ সালে এর পূর্ণাঙ্গ যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ নিয়মিত দল পাঠাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে প্রথম ব্রোঞ্জ পদক ও ২০১২ সালে প্রথম রৌপ্যপদক অর্জিত হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা মাইলফলক এবং বড় রকমের অর্জন। এটা মাইলফলক তিনটি কারণে। প্রথমত, শুরুতে উল্লিখিত একুশ শতকের শূন্য দশকে যে ‘নবধারার’ সূচনা হওয়ার কথা বলা হয়েছিল, এটি সেই নবধারার প্রথম আন্তর্জাতিক অর্জন। ইতোপূর্বে আমাদের দেশ অলিম্পিয়াড সংস্কৃতির সাথে পরিচিত ছিল না। তিনজন মানুষের [৫] একক প্রচেষ্টাবলে এটা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে একদম শূন্য থেকে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছি। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থীরা একটা নতুন স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছে, এবং বিজয়ীদের পাশাপাশি অন্যরাও এক সামাজিক তাড়না অনুভব করছে। এটি একটি মূল্যবান অবদান। দ্বিতীয়ত, গণিত অলিম্পিয়াডের সাফল্যের ফলে ইনফরম্যাটিক্স, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, সায়েন্স অলিম্পিয়াড একাদিক্রমে শুরু হয়েছে। এর ফলে সমাজে বিজ্ঞান-চেতনার ও বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান বৃদ্ধির একটা সাধারণ আবহ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজে অগ্রগতি হচ্ছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তৃতীয়ত, উক্ত ‘নবধারার’ সিঞ্চনে সমাজে যে তাড়নার উদ্ভব ঘটেছে সেটার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। এসব অলিম্পিয়াডে সফলদের দেখাদেখি অন্যান্য ছেলেমেয়েরা আগ্রহী হচ্ছে, তারা বিজ্ঞানের বইপত্র পড়ছে, ফলে বিজ্ঞানের বই এবং পত্রিকার চাহিদা বাড়ছে। এসব ছেলেমেয়েরা দেশের সম্পদ। এভাবে অচিরেই এক প্রজন্ম পরে আমরা এমন সব ছেলেমেয়ে পাব, যারা দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে নতুন ও উচ্চ ধাপে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তারা বড় অধ্যাপক হবে, বিজ্ঞানী হবে, সম্পাদক হবে, লেখক হবে, সংগঠক হবে এবং এই প্রতিটি ধারায় তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর লক্ষণ এখনই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ঠাকুরগাঁয়ের মতো দূরবর্তী জায়গায় একটি ক্লাস-সিক্স পড়ুয়া মেয়ে যদি জানতে চায় ‘সলিটন কী’ তখন এ বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকে না। কাজেই এই অলিম্পিয়াড সংস্কৃতির সৃজন আমাদের জন্য একটা বড় মাইলফলক। এখান থেকে আমরা একটা সূচনা-সাল চিহ্নিত করতে পারি যেখান থেকে আমরা পূর্বোক্ত ‘নবধারার’ সালতামামি গ্রহণ করতে পারি। নবধারার সূচনা শূন্য দশকে এবং তার প্রথম অর্জন ২০০৯ সালে গণিত অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ে – এটি আমাদের জন্য একটি সূচনাবিন্দু। এই বিন্দু ধরে উপরোক্ত চতুর্মাত্রিক (একাডেমিক-প্রাতিষ্ঠানিক-প্রকাশনা-সাংগাঠনিক) পথে আমরা যদি এগোই, তাহলে ৫০ বছর পর আমরা কোন অবস্থানে পৌঁছাব সেটা আমরা ২০৫০’র দশকে দেখতে পাব। কোথায় কোথায় আমরা অর্জন পাব, কীভাবে সেটা দেখতে হবে, কীভাবে মাপতে হবে, কোন পদ্ধতিতে সেটা করতে হবে তার একটা সাধারণ সূত্রায়ন আমরা এখানে দিলাম।

শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ২০১৪

অলিম্পিয়াড-সংস্কৃতির একটি বিশেষ উত্তরসূরী ‘শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস’ যেটা প্রথম শুরু হয় ২০১৩ সালে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি এটা চালু করে। এখানে তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ক নানা প্রবন্ধ, পোস্টার ও প্রকল্প হাজির করে। সেখান থেকে ৫০ জনকে নির্বাচিত করে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে দেশের প্রথম আবাসিক বিজ্ঞান ক্যাম্প সফলভাবে সম্পাদন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরই বিজ্ঞান কংগ্রেস ও বিজ্ঞান ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হতে থাকবে বলেও আয়োজকরা জানিয়েছেন। গণিত অলিম্পিয়াডে শুধু গণিতের পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু ফিজিক্স বা জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে তাত্ত্বিক প্রশ্নের পাশাপাশি ল্যাবরেটরির কাজেরও পরীক্ষা নেওয়া হয়। হাতের কাজে আমাদের শিক্ষার্থীরা বরাবরই দুর্বল। কারণ আমাদের স্কুল ল্যাবরেটরিগুলির অবকাঠামোগত এবং শিখনভিত্তিক দুর্বলতা। এছাড়া আন্তর্জাতিক গুগল সায়েন্স ফেয়ার বা এই জাতীয় প্রতিযোগিতায় পঞ্চদশবর্ষীয়রা যে ধরনের ক্রিটিকাল থিঙ্কিং স্কিল প্রদর্শন করে এবং যে ধরনের প্রজেক্ট প্রদর্শন করে সেটা থেকে আমাদের প্রচলিত বিজ্ঞান মেলা সম্পূর্ণ আলাদা। প্রচলিত বিজ্ঞান মেলার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান কংগ্রেসে বাচ্চাদের ক্রিটিকাল থিঙ্কিং, মোহমুক্ত বিশ্লেষণ, নেচার স্টাডি, নিজস্ব চিন্তার পরিস্ফূরণ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিকাশ, পেপার কীভাবে লিখতে হবে, পোস্টার কীভাবে দেখাতে হবে, ধারণাপত্র কীভাবে লিখে, সার-সংক্ষেপ বা অ্যাবস্ট্রাক্ট ও সারাংশ বা সামারি কীভাবে লিখতে হবে সেটা শেখানো হয়। শিক্ষার এই বিকল্প দিকগুলো সমাজের বৈজ্ঞানিক কাণ্ডজ্ঞান বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে অগ্রগতি হচ্ছে সেটা ইতিবাচক এবং আশানুরূপ।
২০০৯ সালের সূচনাবিন্দু থেকে ২০৫৯ সাল অবধি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে কী কী উন্নতি হবে সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু আমরা ওপরে যে চারটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, সেই বিষয়গুলোর মাধ্যমে আমরা অগ্রগতির একটা পরিমাপ গ্রহণ করতে পারব। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান চিহ্নিত হবে তাতে অধ্যাপকের সংখ্যা, অধ্যাপকের শিক্ষা, অধ্যাপনার মান, পাঠ্যক্রমের আধুনিকতা, আন্তর্জাতিক জার্নাল ও কনফারেন্স প্রসিডিংসে গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা, স্নাতকদের প্লেসমেন্ট, তাদের দক্ষতা ও বৌদ্ধিক মান, গবেষণা সেন্টারের সংখ্যা এবং গবেষণা উপকরণের মান ইত্যাদি দিয়ে। একজন শিক্ষক কত ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে পেরেছেন, তিনি কতগুলো মাস্টার্স-পিএইচডি ডিগ্রী দিলেন, কতগুলো পেপার-বই লিখলেন এগুলো তাঁর ব্যক্তিগত মানদণ্ড। প্রাতিষ্ঠানিক অবদানের মাপকাঠি হবে ঐ প্রতিষ্ঠানে কতজন যোগ্য-দক্ষ-উচ্চশিক্ষিত পেশাদার-বিজ্ঞানী/প্রকৌশলী আছেন, তাঁরা কীরকম গবেষণা করছেন, পাবলিশ করছেন, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানের অর্থমূল্য, প্রতিষ্ঠানের সামাজিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অবদান ইত্যাদি [৬]। সংগঠনের মাপকাঠি হবে বিজ্ঞান-পত্রিকা প্রকাশ করে কি-না, ব্লগে ও সোশাল নেটওয়ার্কে উপস্থিতি ও প্রভাব, পত্রিকার সার্কুলেশন সংখ্যা, ইন্টারনেটে লাইক-শেয়ার-হিটের সংখ্যা, কার্যক্রমের ব্যাপকতা, বার্ষিক বাজেটের অর্থমূল্য, নিবেদিত-প্রাণ কর্মী ও সংগঠনের সংখ্যা, অন্যান্য সামাজিক সংস্থা (যেমন সংবাদপত্র) দ্বারা তাদের মূল্যায়ন ইত্যাদি। বিজ্ঞান লেখালেখির মানদণ্ড হতে পারে প্রকাশিত বই-প্রবন্ধের সংখ্যা, তার সাবলীলতা, তার গ্রহণযোগ্যতা, পাঠকের সংখ্যা, ঐসব প্রকাশনার গভীরতা, সাইটেশন সংখ্যা, এসব লেখা শিক্ষার্থীকে মোটিভেট করছে কি-না (কোনো বই পড়ে যদি শিক্ষার্থী রাত জেগে ভাবতে থাকে তবে সেটা সফল বৈকি!), প্রকাশনার মান, টেক্সটের মূল্য ইত্যাদি।
একজন মানুষ বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের অবদান এভাবে আমরা মাপতে পারি। মাপার পদ্ধতিটিও হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে একাধিক বিষয়ের প্রেক্ষিতে। মাপার বা অ্যাসেসমেন্টের কাজটিও করবেন কোনো বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান-লেখক অথবা সংগঠক-প্রবন্ধকার। একজন দার্শনিক বা সাহিত্য-তাত্ত্বিক অথবা কোনো সাংবাদিক এ কাজটি সম্পূর্ণভাবে করতে পারবেন না, কারণ তাদের প্রশ্নগুলো এ খাতের জন্য যথোপযুক্ত নয়। যেমন দর্শনকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা ‘মৃত’ বলেছেন একারণে যে কোনো প্রশ্নের দার্শনিক ভিত্তির বিশ্লেষণ দ্বারা কোনো প্রপঞ্চকে আগাম ব্যাখ্যা করা যায় না। আগামীকাল সূর্য উঠবে কি-না সেটা দার্শনিক সমস্যা হতে পারে, কিন্তু এই দর্শন থেকে আগামীকাল সূর্যগ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। একইভাবে রবীন্দ্রমানসে ধর্ম কী প্রভাব রেখেছিল কিংবা বঙ্কিমের লেখায় হিন্দু মৌলবাদ কতটা ছিল সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির হিসাব মেলানো যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের অবদান চিহ্নিত করতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতন্ত্রের বা মেথডোলজির দরকার। সেখানে সঠিক প্রশ্ন উত্থাপন করে, সঠিক প্রতিকূলতাকে সুচিহ্নিত করে এগুতে হবে। বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের দার্শনিক ভিত্তির অনুসন্ধান সেখানে ভ্রান্ত নির্দেশনা দেখাবে। সুবিবেচিত ও সঠিক কোয়ালিফিকেশন ও কোয়ান্টিফিকেশনের মাধ্যমে ২০৫০’র দশকে কোনো বাংলাভাষী বিজ্ঞানী/বিজ্ঞান-লেখক এই কার্যটি করবেন। আর সেটাই এই খাতের সার্থকতা বলে চিহ্নিত হবে। অলিম্পিয়াড-ধারায় নবদীক্ষিত প্রজন্ম [৭] যখন দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের হাল ধরবে তখন আমরা একটি নীরব বিপ্লব আশা করছি। এই বিপ্লবটি শুরু হতে পারে ২০২০’র দশক থেকে যখন ঐ প্রজন্ম দায়িত্ব গ্রহণ করা শুরু করবে। নতুন আলোয় দীক্ষিত এইসব ছেলে এবং মেয়ে বিজ্ঞান-চিন্তার আলোকে দেশকে নতুন ধারায় এগিয়ে নেবে। এবং সেটা অবশ্যই ইতিবাচক হবে। কারণ এই প্রথম আমরা এই খাতে ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই সম্পৃক্ত করতে পারব সমানভাবে। এই নবধারা অবশ্যই আমাদের নতুন আলোর ঝর্ণাধারায় পথ দেখাবে।

গণিত অলিম্পিয়াড প্রজন্ম

আরেকটি প্রচ্ছন্ন ফ্যাক্টরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এমন কিছু বিজ্ঞানী/বিজ্ঞান-অধ্যাপক আছেন যারা কার্যোব্যপদেশে একেকজন বিজ্ঞান-আমলায় রূপান্তরিত হন। বিশেষ করে যেসব দেশে মহীরুহ আকারে সিভিল-মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট আছে, যাদের কোটি কোটি টাকার সামরিক গবেষণা খাত ও বেসরকারী গবেষণা খাত আছে। এসব বিজ্ঞান-আমলারা শেষ পর্যন্ত ‘ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাডভাইজার’ জাতীয় পদকর্তা হয়ে থাকেন। আমাদের উল্লিখিত চতুর্মাত্রিক পথে এসব বিজ্ঞান-আমলা সাংঘাতিক প্রভাবধারী হন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা নির্দেশনা দেন অথবা প্রভাবিত করেন, প্রতিষ্ঠানের দিক-নির্দেশনা দেন, সরকারী নীতি পরিচালিত করেন, সামরিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেন। তাঁদের চিন্তাভাবনা সুদূরপ্রসারী ফলাফল বয়ে আনে। ভারতে আমরা দেখি একজন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা বা এ. পি. জে. আবদুল কালাম কি এককভাবেই না বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশে এখনো ঐ উঁচু তকমাধারী বিজ্ঞানী-আমলা তৈরি হয়নি (সীমিত ক্ষেত্রে অবশ্য আছেন কয়েকজন) এবং আমাদের দেশে ‘ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাডভাইজার’ পদটি নেই। তবে ২০৫০’র দশক নাগাদ এমন বিজ্ঞানী-আমলা আমরা পাব, আশা করা যায়। তবে বিজ্ঞানী-আমলার প্রভাব নেতিবাচকও হতে পারে। রাশিয়ার লাইসেঙ্কো যেভাবে সেদেশের জেনেটিক্স গবেষণাকে নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছিল সেটা প্রণিধানযোগ্য [৮]।
একজন বিজ্ঞানী-অধ্যাপকের অবদান এখানে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখাব তাঁর অবদান আমরা কীভাবে পরিমাপ করতে পারি। প্রফেসর এ. এম. হারুন-অর-রশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ১৯৩৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি ঢাবির ঐতিহ্যবাহী কালীনারায়ণ স্কলার ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের তিনি কিংব্দন্তীর ছাত্র, গ্লাসগো থেকে ডক্টরেট। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্র আছেন। তিনি তাত্ত্বিক গবেষক ছিলেন এবং বিদেশী জার্নালে তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা আছে। তাঁর গবেষণা-ছাত্রেরা আজ অনেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনি শুধু অধ্যাপনাই করেননি, বিজ্ঞান-সংস্কৃতি পরিষদ স্থাপন করেছেন, কিছুটা সাংগাঠনিক তৎপরতাও দেখিয়েছেন। বিদেশের দুটো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে (জার্মানির কার্লসরুহে এবং মার্কিন ইউসিএলএ) তিনি অধ্যাপনা করেছেন। ট্রিয়েস্টে প্রতিষ্ঠিত প্রফেসর আব্দুস সালামের প্রতিষ্ঠানেও তিনি সংযুক্ত ছিলেন অনেকদিন। পাকিস্তান আমলে আণবিক শক্তি কমিশনে কিছু দিন চাকরি করলেও তিনি মূলত অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। আবার তিনি বিজ্ঞান-সাহিত্যিকও বটে। বাংলায় তিনি প্রচুর পাঠ্যবই ও জনপ্রিয় ধাচের বই লিখেছেন। তাঁর লেখা বিজ্ঞানের সহজ বইগুলো কয়েক প্রজন্ম পাঠকের কাছে উদ্দীপনার উৎসস্থল ছিল। ‘পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব’, ‘মৌলিক কণা’ কিংবা ‘বিজ্ঞানে আমাদের উত্তরাধিকার’ আজো পাঠকের আবিলতার কারণ! বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্য এমন একজন বিজ্ঞানী-অধ্যাপক-সাহিত্যিক তাদের মাঝে ছিলেন! কিংবা একজন জামাল নজরুল ইসলাম বাস করতেন চট্টগ্রামের নিভৃতে, যিনি মহাবিশ্বকে গুণতে চেয়েছিলেন!
এইসব সৌভাগ্য আছে বলেই নবধারাতলে আমরা স্বর্ণগর্ভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিতে পারি।

নোটস:
[১] এখানে ‘আমরা’ ইংরেজির ‘রাজকীয় উই’ শব্দটি নয়, এটি বাংলার ‘আমি-তুমি-সে-তাহারা’। এই আমি-তুমি-সে-তাহারা কারা? এরা তারাই যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্রোতে কাজ করে- শিক্ষক-বিজ্ঞানী–বিশ্লেষক-চিন্তক-শিক্ষার্থী-সৌখিন বিজ্ঞানী ইত্যাদি।
[২] একজন শিক্ষকের মূল্যায়নের একটি অন্যতম স্বীকৃত মাপকাঠি তিনি কয়টি জার্নাল-প্রবন্ধ, কয়টি কনফারেন্স প্রসিডিংস, কয়টি বুক-চ্যাপ্টার প্রকাশ করলেন কিংবা কয়টি মাস্টার্স/পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করলেন। জার্নাল-প্রবন্ধ প্রকাশের ব্যাপারে হাই-ইমপ্যাক্ট-ফ্যাক্টর জার্নাল গুরুত্ব পায়। একটি হাই-ইমপ্যাক্ট-ফ্যাক্টর জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে সত্যিই দুরূহ, বিশেষ করে এর জন্য যখন আলাদা কোনো আর্থিক প্রণোদনাই নেই। কারণ যে গভীরতা ও ব্যাপ্তি ঐ ধরনের প্রবন্ধ দাবী করে সেই মাত্রার গবেষণা করতে মেধাবী ও দক্ষ গবেষকের অন্তত টানা ছয়মাসের শ্রম ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। এবং এই ধরনের গবেষকের সংখ্যাও হতে হবে একাধিক। সাধারণত একটি রিসার্চ টিমের অধীনে এধরনের কার্য সমাধা হয়। এরকম একটি রিসার্চ টিম তৈরি করে ধরে রাখতেও ভাগ্য এবং অর্থের প্রয়োজন।
[৩] কমপিউটার সিমুলেশনেও হতে পারে।
[৪] আন্তর্জাতিকমানের দেশীয় জার্নাল প্রকাশ করা সম্ভব হলে এতে দেশীয় গবেষকরা ভীষণভাবে উৎসাহিত হবেন, দেশীয় প্রকাশনার মান বৃদ্ধি পাবে, দেশের গবেষণা-সংস্কৃতি উন্নত হবে, বিদেশী গবেষকরা এখানে প্রকাশে আগ্রহী হবেন এবং বাংলাদেশী বিজ্ঞান-চর্চার প্রতি ওয়াকিবহাল থাকবেন।
[৫] প্রফেসর জাফর ইকবাল, প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং মুনির হাসান।

বাম থেকে: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, মুনির হাসান


[৬] প্রাতিষ্ঠান যদি সিভিল-মিলিটারি পার্টনারশিপ হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য ভিন্ন মানদণ্ড প্রযোজ্য হবে।
[৭] বিদেশে এই প্রজন্মকে ‘হ্যারি পটার প্রজন্ম’ বলে।
[৮] সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়, অনন্ত বিজয় দাশ, শুদ্ধস্বর, ২০১২।