“Science flies you to the moon. Religion flies you into buildings.”

― Victor Stenger (Remembering 9/11 atrocities)

প্রিয় লেখক পদার্থবিদ এবং দার্শনিক ভিক্টর স্টেঙ্গর ( উইকি: Victor J. Stenger) আর নেই। তিনি দিন কয়েক আগে (২৭শে অগাস্ট) মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন, পাশাপাশি ছিলেন হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এমিরিটাস অধ্যাপক। মারা গেছেন ৭৯ বছর বয়সে।

আমার লেখালিখির জীবনে যদি একজনমাত্র লেখকের প্রভাবের কথা আমাকে উল্লেখ করতে বলা হয়, তাঁর নাম হবে অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর। তাঁর বই বেরুনো মাত্র আমি কিনতাম, গোগ্রাসে গিলতাম তাঁর সমস্ত বই। ভদ্রলোকের লেখার সাথে আগে তেমন পরিচিত ছিলাম না আমি। হঠাৎ করেই, ২০০৩ সালে কীভাবে যেন আমার হাতে এসে গেল  ‘Has Science Found God? The Latest Results in the Search for Purpose in the Universe’, পড়ে একেবারে অভিভূত হয়ে গেলাম। খুব কম বইই আমি এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলতে পারি। ‘হ্যাস সায়ন্স ফাউন্ড গড?’ ছিল এমনি একটি বিরল ধারার বই। তারপর প্রতি বছরই স্টেঙ্গরের অন্যান্য বই গুলো একটি দুটি করে আমার বইয়ের আলমারির তাকে জমা হতে থাকলো–

* Timeless Reality : Symmetry, Simplicity, and Multiple Universes

* Physics and Psychics

* The Unconscious Quantum

* The Comprehensible Cosmos: Where Do the Laws of Physics Come From?

* God: The Failed Hypothesis. How Science Shows That God Does Not Exist

* Quantum Gods: Creation, Chaos, and the Search for Cosmic Consciousness

* God and the Folly of Faith: The Incompatibility of Science and Religion

* The Fallacy of Fine-Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us

* The New Atheism: Taking a Stand for Science and Reason

* God and the Atom

[ফেসবুকে দেখলাম বহু বিখ্যাত লেখকদের অনেক বইয়ের উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। আমি আজ অধ্যাপক স্টেঙ্গরের স্মৃতি-ভারাক্রান্ত। আমি আজ কেবল একজন লেখকের দশটি বইয়ের উল্লেখ করলাম। হ্যা, উপরের বইগুলো আমাকে আলোড়িত করেছিল অতীতে, এখনো অহর্নিশি আলোড়িত করে, এবং হয়তো করে যাবে অনন্ত কাল।]

 

চিত্র: আমার বইয়ের আলমারির বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে ভিক্টর স্টেঙ্গরের লেখা বইগুলো

আজ মনে পড়ছে, ব্লগে এবং অন্যত্র বিতর্কের সময় আমি ভিক্টর স্টেঙ্গরের বইগুলো থেকে বহু রেফারেন্স ব্যবহার করেছি। হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধানে’ কিংবা রিচার্ড ডকিন্সের ‘গড ডিলুশন’-এর কথা মনে রেখেও বলছি, আমি যদি বিতর্কের সময় একজন লেখকের বই হাতের কাছে রাখতে চাইতাম – তিনি হলেন ‘যদ্যপি আমার গুরু’ অধ্যাপক স্টেঙ্গর। তাঁর ‘Has Science Found God?’, ‘God: The Failed Hypothesis’, ‘God and the Folly of Faith’ প্রভৃতি বইগুলো যেন ছিল ধর্মান্ধদের কফিনে শেষ পেরেক। এর মধ্যে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘গড: দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ বইটি নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার লিস্টে পর্যন্ত উঠেছিল, যা এর আগে প্রমিথিউস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অন্য কোন বইয়ের ক্ষেত্রে ঘটেনি।  বইটি সে সময় ‘নিউ এথিজম’ বা ‘নতুন দিনের নাস্তিকতা’র আন্দোলনে দিয়েছিল এক নতুন মাত্রা।

আমার সাথে ইমেইলে যোগাযোগ ছিল তার। প্রায়ই পদার্থবিজ্ঞানের গূঢ় বিষয় নিয়ে তার সাথে আলোচনা করতাম। এত বিখ্যাত একজন লেখক, নামকরা বিজ্ঞানী, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি কখনোই কার্পন্য বোধ করেননি। আমার সম্পাদিত ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ বইটিতে স্টেঙ্গরের দুটি প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। একটি প্রবন্ধের অনুবাদ করেছিলেন প্রিয় বিজ্ঞান লেখক ড. প্রদীপ দেব (দেখুন এখানে)। ড. স্টেঙ্গর স্বেচ্ছায় তাঁর লেখা অনুবাদের অনুমতি দিয়েছিলেন মুক্তমনাকে। মুক্তমনার কাজকর্ম সম্বন্ধেও তিনি খোঁজ খবর রাখতেন। বছর কয়েক আগে ডারউইন দিবস উপলক্ষে একটা আয়োজন করেছিলাম মুক্তমনার পক্ষ থেকে। তিনি মুক্তমনার জন্য একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছিলেন আমাদের। এই তো কয়েক মাস আগেও, আমার এবং মীজান রহমানের লেখা (প্রকাশিতব্য) ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটি লেখার সময় তাঁর সাথে কনসেপ্টগুলো নিয়ে ইমেইলে অনেক আলোচনা করেছিলাম। শুধু বই নিয়ে নয়, খুব ছোট খাট বিষয় নিয়েও তিনি আমাকে ইমেল করতেন। এবার হঠাৎ তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে দেখা পূর্ণিমার চাঁদের ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়ে বলেছিলেন – ‘কি সুন্দর’! আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয় লেখক এবং বিজ্ঞানীকে তখন দেখতাম মাটির কাছাকাছি নেমে আসতে। তখন কি আমি ছাই জানতাম, সামনে হয়তো আর কাজপাগল আর শিশুর মতোই সরল বিজ্ঞানীটির কাছ থেকে ইমেল পাব না?

 

চিত্র: কাজ পাগল কিন্তু শিশুর মতোই সরল  বিজ্ঞানীটির কাছ থেকে মাঝে মধ্যেই এ ধরণের ইমেইল চলে আসতো

অধ্যাপক স্টেঙ্গরের প্রভাব কেবল আমাকে নয়, আলোড়িত করেছিল আমার কাছের অনেক মুক্তমনা সহযোদ্ধাকেও। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, রায়হান আবীরেরে সাথে অবিশ্বাসের দর্শন বইটি লেখার সময় ভিক্টর স্টেঙ্গরের লেখার সন্ধান পেয়ে কীরকম উল্লসিত হয়ে উঠেছিল সে। তার নিজের কথাতেই সে বলেছে একটি ব্লগপোস্টে

‘…২০০৯ এর ডিসেম্বরের দিকে অভিদা আর বন্যাপা ঢাকায় এসেছিলেন। সে সুবাদে এই দুই বিখ্যাত মানুষের সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছিলো। বন্যাপা সুটকেস ভর্তি বই এবং চকলেট নিয়ে আসছিলেন। আমরা নিজেদের বই ভাগাভাগি করে, সে বইয়ের গন্ধ শুকতে শুকতে আর চকলেট খেতে খেতে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনে তরুণদের ভূমিকা এবং করণীয় নামক বিষয় নিয়ে বিশাল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছিলাম। একেবারে শেষ মূহুর্তে অভিদা ভিক্টর স্টেংগরের “নিউ এইথিজম” বইটা কোন চিপা থেকে বের করে মুহাম্মদের হাতে দিয়ে বললেন, বইটা পড়তে। অনেক কিছু জানা যাবে। … বন্ধু মুহাম্মদের আগে সে বই আমি কব্জা করে পড়া শুরু করলাম। “অনেক কিছু জানার জন্য” না বরঞ্চ বইয়ের শুরুতে INGERSOLL’S VOW নামে ইঙ্গারসল সাহেবের একটি বক্তৃতার কিয়দংশ পড়ে মুগ্ধ হবার কারণে। তারপর পুরো বইটা অল্প দিনের কাছে মুখস্ত করে ফেলি। নাস্তিকতা নিয়ে বাজারে অনেক বই পাওয়া যায় কিন্তু নিউ এইথিসজমের বিশেষত্ব ছিলো মুলত এর রেফারেন্স কালেকশন। বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিবর্তন, এস্ট্রোফিজিক্স, ধর্ম, ঈশ্বর হাইপোথিসিস সহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান সময়ে নাস্তিকতার পুরো দর্শনটাই ফুটে উঠেছিলো। …’

সত্যই তাই। রিচার্ড ডকিন্স, স্যাম হ্যারিস, ক্রিস্টোফার হিচেন্স, মাইকেল শারমার, লরেন্স ক্রাউস, এমনকি স্টিফেন হকিং এর মতো প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং মুক্তমনা দার্শনিক থাকা সত্ত্বেও ভিক্টর স্টেঙ্গরই ছিলেন আমার এবং রায়হানের ‘হিরো’। এতো স্পষ্ট ‘টু-দ্য-পয়েন্ট’ যুক্তি আর পরিশীলিত ভাবে এর আগে কেউ নাস্তিকতা আর সংশয়বাদকে ডিফেন্ড করে যাননি।

অধ্যাপক স্টেঙ্গর তাঁর সর্বশেষ বইটির কাজ তিনি শেষ করে গেছেন – ‘God and the Multiverse: Humanity’s Expanding View of the Cosmos’। আগামী সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে বইটি বাজারে বেরুনোর কথা। বইটি দেখে যাওয়ার আগেই স্টেঙ্গরকে চলে যেতে হল চিরকালের জন্য, কিন্তু আমার মতো অগণিত পাঠক আর লেখকের হৃদয়ে তাঁর স্থান চির জাগরুক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

মুক্তমনা আর্কাইভ থেকে: