তিন
স্বপ্নের শেষ দেউটি যেন নিভে গেল
১৫ ই আগস্ট, ১৯৭৫ ইং, শুক্রবার, সকালে কলেজ। সকাল ৬-৩০ ঘটিকার সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে সকাল ৮-০০ ঘটিকার মধ্যে আলম পৌছে গেছে চট্টগ্রাম কলেজ গেইটে। কলেজে পৌছেই চতুর্দিকে কেমন যেন থমথমে অবস্থা মনে হল আলমের। কে যেন বলে ওঠল, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। চমকে ওঠল আলম। এটা কী করে সম্ভব! বিশ্বাস হল না আলমের । দ্রুত সে বের হয়ে পড়ল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে। প্যারেড গ্রাউণ্ড পার হয়ে চকবাজার মোড়ে পৌছল আলম । সেখানে দোকানে দোকানে মানুষের জটলা। উৎকর্ণ হয়ে রেডিও শুণছে মানুষ। ঘোষক সরকার কবির উদ্দিন বারংবার ঘোষণা করছেন-শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।

মেজর ডালিম পরিচয় দানকারী জনৈক ব্যক্তি ইংরেজীতে বারংবার ঘোষণা দিচ্ছে-শেখ মুজিব হ্যাজ বিন কিল্ড। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে । দেশে সামরিক শাসন জারীর ঘোষণার সাথে সাথে মেজর ডালিম ঘোষণা দিচ্ছে-বাংলাদেশের নাম হবে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ । মাথাটি ঝিম্ ঝিম্ করে ওঠে আলমের। আলম শঙ্কিত হয়-নিশ্চয় পাকিস্তানপন্থীরাই এ অভ্যূথান ঘটিয়েছে । জটলার মধ্যে থেকে কে যেন আনন্দ-উচ্ছাস প্রকাশ করল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেহ কেহ নানা কটুক্তি করছে-যা আলমের বুকে যেন শেলের মত বিধঁছে । তার পা যেন আর চলে না।

কোন রকমে চকবাজার স্টপেজ থেকে একটি বাসে ওঠল সে । বাসে যাত্রীর সংখ্যাও খুব কম। তাদের মধ্যেও একই কথা বলাবলি হচ্ছে। আক্ষেপ বা ক্ষোভ কারো চোখে মুখে দেখছে না আলম । বরং কেউ কেউ শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে। আলম ভাবতে পারে না-মুহুর্তের মধ্যে এ কি পরিবর্তন! আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছিল সেটা আলম বুঝতে পেরেছিল । কিন্তু তলে তলে মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিও এত ক্ষুদ্ধ হয়েছিল-সেটা আলম ভাবতে পারে নি। এত বড় একটি নির্মম ঘটনা, স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে হত্যা-কোথায় মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়বে, ওল্টো বিরূপ মন্তব্য করতেও তাদের বাঁধছে না।

বাস এক সময় ৯ নং গুপ্তাখাল স্টপেজে এসে পৌছে। আলম বাস থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। পথে পথে মানুষের ঝটলা-জল্পনা-কল্পনা। নানা মন্তব্যও তার কানে ভেসে আসছে ।আলম দ্রুত পদবিক্ষেপে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে ।

পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় অভ্যূত্থানের নায়কদের ইউনিফরম পরিহিত ছবি সহ সংবাদ প্রকাশিত হল। মেজর ডালিম, কর্ণেল ফারুক, কর্ণেল রশীদ, নুর, আরো কতিপয় তরুণ সেনানায়ক-যারা সেনা অভ্যূত্থান ঘটিয়েছে-তাদের সূর্যসৈনিক হিসাবে চিহ্নিত করা হল। বঙ্গবন্ধুর ঘরে কি পরিমান দেশী-বিদেশী টাকা ও সোনাদানা পাওয়া গেছে তার বিশাল ফিরিস্তিও পত্রিকায় ছাপানো হল। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিবারের সকল সদস্যদের হত্যা করার সংবাদও ইতোমধ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

এতকিছুর পরও আলম যখন ঘটনার বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছিল না, তখন সে অবাক বিস্ময়ে শুণতে লাগল সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল এ,কে,এম, শফি উল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান এ, কে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান এম, এইচ, খান, একে একে সুবোধ বালকের মত অভ্যূথানকারীদের সমর্থন জানিয়ে রেডিওতে বক্তব্য প্রদান করছেন। বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী, আওয়ামী লীগের অন্যতম জৈষ্ঠ্য নেতা, বঙ্গবন্ধু সরকারেরই মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিলেন। কালরঙের কিস্তি টুপি মাথায় দিয়ে মিডিয়াতে আবির্ভূত হলেন তিনি। তার এ কিস্তি টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করা হল।

কোন হিসাব মিলাতে পারছে না আলম। এত বড় একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা এক আঘাতেই কুপোকাত হয়ে গেল ? কোথায় মুক্তিযুদ্ধের বীরোত্তম সেক্টর কমাণ্ডারগণ ? তারাও কি এ পরিবর্তনের পক্ষে ? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করে ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী কিভাবে আবার রাষ্ট্রপতি হয়? তাহলে কারা ক্ষমতা দখল করল? তার বিস্ময় আরো বেড়ে যায় যখন সে দেখে আওয়ামী লীগের নেতারা একে একে নতুন করে মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছেন। ক্ষোভে, অপমানে বিচলিত আলম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংঘটনের কোন সঙ্গবদ্ধ বা সাংগঠনিক প্রয়াসের সন্ধানে উদভ্রান্তের মত হন্যে হয়ে ঘুরে । কিন্তু হা-হতোস্মি ! কোন সংবাদ সে পায় না। তার স্বপ্নের শেষ দেউটি যেন নিভে গেল। চলবে—-