দেশের অর্ধেক মানুষ মনে করে একাত্তরে তিরিশ লক্ষ শহীদ অতিরঞ্জন।

কোন ভাবেই এত কম সময়ে এত বেশী মানুষ মেরে ফেলা সম্ভব না। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বড়জোর তিন লাখ, এমনকি কমও হতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা তিরিশ লক্ষ এই আষাঢ়ে গল্পের প্রবক্তা শেখ মুজিব। আর সেই আষাঢ়ে গল্পটা প্রথম মঞ্চস্থ হয় বাহাত্তরের আটই জানুয়ারি, মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। সেখানে সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধে দেশের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চান। শেখ মুজিব এমনিতেই ভার্সিটি আউট স্টুডেন্ট ছিলেন, স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজী ভালো জানতেন না। তাই ভুল মৃতের সংখ্যা 3 Lac বলতে গিয়ে 3 Million বলে ফেলেন।

খুবই চমৎকার এবং যৌক্তিক থিউরি,
এই থিউরি সমাধানের জন্য সমস্যাটার কয়েকটা গুরুতর অংশ নিয়ে আমি প্রথমেই আলোচনা করবো।

আমার আজকের নিবন্ধের উদ্দেশ্য এটা নিরূপণ করা নয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত। সেই কাজটি বহু আগেই দেশের প্রচুর মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরা করে গেছেন সুনিপুণ ভাবেই। আপনারা চাইলে মুক্তমনায় ব্লগার যুঞ্চিক্তরের কালজয়ী লেখা ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ : মিথ নাকি বাস্তবতা’ আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পারেন, আমি নিশ্চিত এই লেখা আপনাদের নতুন করে চিন্তার খোরাক জোগাবে। এরপর পড়ে দেখতে পারেন ব্লগার তারিক লিংকনের লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, প্রসঙ্গঃ ৩০ লাখ বাঙালী হত্যার আইকনিক মিথ’।

তবে সত্য মিথ্যা যাই হোক আমার আজকের উদ্দেশ্য এটা খুঁজে বের করা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা তিরিশ লক্ষ এই গল্পের প্রথম প্রবক্তা কি সত্যিই শেখ মুজিব কি না।

যদি ধরে নেই একাত্তরে তিরিশ লক্ষ মানুষের শহীদ হওয়াটা একান্তই মুজিব সাহেবের মস্তিষ্ক প্রসূত, আসল সংখ্যাটা তিন লাখ। তাহলে প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে এই তিন লাখ ফিগারটিই বা আসলো কোথা থেকে। তিরিশ লাখ আগে এসেছে নাকি তিন লাখ। এছাড়া আর কোন ফিগার কি আছে।

একটু ঘটাঘাটি করতেই সত্য বেরিয়ে এলো। একাত্তর সালেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্নে অর্থাৎ মার্চে পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সদম্ভে বলেছিলেন,

“ওদের ত্রিশ লক্ষ হত্যা কর, বাকীরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হবে।”

Robert Payne, Massacre, The Tragedy of Bangladesh and the Phenomenon of Mass Slaughter Throughout History; P:50; New York, Macmillan, 1973

সত্যি বলতে, দেখা যাচ্ছে প্রথম ভুলটা ছিলো জেনারেল ইয়াহিয়া খানের তিনিই সম্ভবত তিন লাখ বলতে গিয়ে তিরিশ লাখ বলে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনিই শেষ না; মাওলানা ভাষানি যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লক্ষ হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিলেন।

কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন তার শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বারবারা বিডলারকে’ তার কয়েকটা লাইন তুলে দেই;

“তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো;
ওটা একটা জল্লাদের ছবি।
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে…”

আমার মনে হয় কবি আসাদ চৌধুরী সম্ভবত পনেরো হাজার বলতে গিয়ে বলেছিলেন পনেরো লক্ষ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো ‘চরমপত্র’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিলো এম আর আখতার মুকুল রচিত ও উপস্থাপিত চরমপত্র।

‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালু হওয়ার দিন ২৫শে মে থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রচারিত হয়েছে। ‘চরমপত্র’ – এর প্রতিটি অধ্যায় রচনা ও পাঠ করেন এম আর আখতার মুকুল। ‘চরমপত্র’ ছিল ব্যাঙ্গাত্মক ও শ্লেষাত্মক মন্তব্যে ভরপুর একটি অনুষ্ঠান মূলত এটা ছিলো খবরের অনুষ্ঠান। মানসম্মত রেকর্ডিং স্টুডিওর অভাবে টেপ রেকর্ডারে ‘চরমপত্র’ রেকর্ডিং করা হতো এবং ৮-১০ মিনিটের এই টেপ নিয়মিতভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারিত হতো। ‘চরমপত্র’ – এর প্রতিটি অনুষ্ঠানের রচনা ও ব্রডকাস্টিং-এর জন্য এম আর আখতার মুকুল এর পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়েছিল ৭ টাকা ২৫ পয়সা।
চরমপত্রের শেষ প্রচার দিবস অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের কিছু অংশ সরাসরি তুলে দিচ্ছি;

…২৫ শা মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করনের অর্ডার দিয়া কি চোটপাট! জেনারেল টিক্কা খান সেই অর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙ্গালির খুন দিয়া গোসল করলো। তারপর বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক, দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মইদ্দে তৈরি হইলো বিচ্ছু…

(চরমপত্র; পৃঃ৩২৫)

সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস মুক্তিযুদ্ধের সময়ই লিখেছিলেন “আশি লক্ষ মানুষ কেন মারা যাবে”।যেই আর্টিকেল পরবর্তীতে তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়। দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক তার পত্রিকায় ২২.১২.১৯৭১ তারিখে “ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও” শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখে। সেখানে পরিস্কার লেখা হয়,

“হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দু’শতাধিক বুদ্ধিজীবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে…”

এটা প্রকাশিত হয় কিন্তু বাহাত্তরের আগে, অর্থাৎ মুজিব দেশে আসারও আঠারো দিন আগের কথা। তখনও দেশের সবখান থেকে পাকিস্তানী শত্রুমুক্ত হইনি আমরা।

এরপর আন্তর্জাতিক মহলে আসি; রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র “প্রাভদা পত্রিকা” ডিসেম্বরেই ৩০ লক্ষ শহীদের বিষয়টি তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করে। তাদের পত্রিকায় দেখা যায়;

“over 30 lakh persons were killed throughout Bangladesh by the Pakistani occupation forces during the last nine months”।

ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করে এভাবে, Pak Army Killed over 30Lakh people” যেটা প্রকাশিত হয় ০৫.০১.১৯৭২ তারিখে মুজিব দেশে আসার ৩ দিন আগে।

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয় ক্ষতি চুলচেরা পরিমাপ নয় বরং এটা অনুসন্ধান করা যে শহীদের সংখ্যা তিরিশ লক্ষ এই আষাঢ়ে গল্পের প্রবক্তা কি আসলেই শেখ মুজিব কি না। ফ্যক্টস এন্ড ডকুমেন্টস যাচাই করে এই পর্যন্ত পড়ে আসা যেকোন একজন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ নিশ্চয়ই মেনে নিতে বাধ্য হবেন তিরিশ লাখ ফিগারটা মুজিবের মাথায় হঠাৎ করে আসেনি। মুজিব জেলে থাকতে থাকতেই সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এই সত্য পৌঁছে গিয়েছিলো।

জাতির জনকের প্রয়াণ দিবসে আজ অন্তত তাকে একটা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেই…