অবিশ্বাস্য! শিশুর খুব কাছের মানুষ যারা তারাই করে এই অন্যায়। জন্ম থেকে যারা সব’চে আপন তারাই শিশুর মাথায় ঢোকায় ভয়। ভুত, পেত্নী জ্বীন, রাক্ষসের ভয়। ঈশ্বর, আল্লা, গড, দেবতা ইত্যাদির ভয়। পরকালে আত্মাকে শাস্তি দেবার ভয়। দোজখের ভয়। রূপকথার দানবের ভয়। নিঃসঙ্কোচে এবং দ্বিদ্ধাহীন চিত্তে তারা এইসব করে চলেছে বংশ পরম্পরায়, যুগ যুগান্ত ধরে। কেই কেউ আঙুল দেখিয়ে বলেন যে মা বাবারা এভাবেই আসলে শিশু নির্যাতন করে।

যে মা বাবারা যুক্তি প্রমানের তোয়াক্কা না করে শিশুকে ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস করায় রূপকথার মত গায়েবী নানান ধর্ম, সেই মা বাবারাই আবার তাদের শিশুকে দেয় কঠিন শাস্তি যদি সন্তান দুই আর দুই যোগফল এর উত্তর চার বলতে ভুল করে ফেলে। অথচ ধর্মের বেলায় যোগফলের উত্তর অগ্রাহ্য করা হয়। শিশুকালেই শেখানো হয় যে ধর্মের অদেখা, অজানা অদ্ভুতকে প্রশ্ন করা ক্ষমাহীন ভয়ঙ্কর এক শাস্তিযোগ্য এক অপরাধ। লক্ষ লক্ষ বছর পুড়তে হবে নরকের আগুনে। কে শেখায়? এই একই মা বাবারা। ভয় দেখিয়ে ধর্ম মানতে বাধ্য হবার এমন মগজ ধোলাই করেই চলেছে কাছের মানুষরা, বড়রা আর মা বাবারা। ধর্ম ছাড়া অন্য কোন কিছু কিন্তু যুক্তিহীন হতে পারবে না, শুধু ধর্ম শেখা আর চোখ বন্ধ করে তা পালন করায় কোন যুক্তি থাকবে না। প্রশ্ন করা যাবে না একেবারেই। শুধুমাত্র ভয় করতে হবে। মেনে নিতে হবে। সত্য মিথ্যা যাঁচাই করার চেষ্টাও করা যাবে না। শিশুমনে ধর্মভয় আসলে ঢোকায় মা বাবারাই, কাছের মানুষ, বড়রা, মগজ ধোলাই করে এই মগজধোপারা। ব্যতিক্রম নেই তা নয়। অনেক সচেতন, উদারমনা এবং মুক্ত মনের সোনার মানুষ রয়েছেন যারা খুব ভালো ভাবেই বড় করে চলেছেন তাদের শিশুদের। এরা দায়িত্বশীল সুন্দর মানুষ। প্রানপনে চেষ্টা করে চলেছেন গতানুগতিক না হবার। এসব মানুষই নিয়ে যাচ্ছে অন্যদের সত্যের কাছাকাছি, নিরন্তর।

মগজধোপাদের দিকে আবার একটু চোখ ফেরানো যাক। মগজধোপারা তাদের শিশুদের নিয়ে কি খেলা খেলে তা নিয়েও একটু কথাবার্তা বলা যাক।

প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। একটি সুস্থ সুন্দর শিশুকে ভয় দেখাবার পরে সে কিভাবে বদলে যায় এ নিয়ে ১৯২০ সালে আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরীক্ষা চালানো হয়, এইটি লিটল এলবার্ট এক্সপেরিমেন্ট নামে পরিচিত। যৌথ ভাবে পরীক্ষাটি চালান জন বি ওয়াটসন এবং রসেলী রাইনার নামের দুজন বিজ্ঞানী। পরীক্ষাটিতে আলবার্ট নামের ন’মাসের একটি শিশুর সামনে কয়েকবার একটা সাদা ইঁদুর ছেড়ে দেয়া হয়, প্রথম পর্বে। ইঁদুরখানা শিশুর চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে চলে যায়। ন’মাসের এলবার্ট মোটেও ভয় পায় না। সে ইঁদুরটিকে ছুঁয়েও দেখে। দ্বিতীয় পর্বে সেই একই শিশুর সামনে ঐ ইঁদুরটাই আবার ছেড়ে দেয়া হয়, কিন্তু এবার শিশুটি প্রতিবার ইঁদুর ছোঁয়ার সাথে সাথে পরীক্ষকরা শিশুর চোখের আড়াল থেকে একটি ইস্পাতের পাতে হাতুড়ি পিটিয়ে জোর শব্দ তোলে। বারবার চমকে উঠতে থাকে শিশুটি। পরবর্তী পর্বগুলোতে ইঁদুর দেখলেই ভয় পেতে শুরু করে শিশু এলবার্ট, শব্দ করবারও দরকার হয় না ভয় দেখাতে। ভয়’কে অনেকটা এভাবেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় শিশুমনে। পদ্ধতিটা শব্দই হোক বা অযৌক্তিক শাসন, আতঙ্ক কিংবা পিটুনিই হোক, ব্যপারটা ওই একই, ভয়।

ইচ্ছে করলে এই ভিডিও ক্লিপটি দেখতে পারেন (ব্যাক এরো দিয়ে আবার লেখাটিতে ফিরে আসতে পারবেন)।

Pic: Internet

লিটল এলবার্ট এক্সপেরিমেন্টের পরীক্ষাপদ্ধতি আজকের মাপকাঠিতে নিষ্ঠুর। শিশুটি যা দেখে, স্পর্শ আর অনুভব করে ভয় পেত না, ভয় দেখানোর ব্যপার ঘটবার পর এখন ইঁদুর দেখলেই ভয় পাচ্ছে সে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বুঝবেন যে আজকের বেশিরভাগ মা বাবা, বড় যারা, শিশুর কাছের মানুষ যারা, তারা তাদের আদরের শিশুটিকে গায়েবী ভয় দেখিয়ে বড় করছে। করছে নিঃসঙ্কোচে, দ্বিদ্ধাহীন চিত্তে, অন্ধ বিশ্বাসে, মনের সুখে এবং ধর্মীয় আনন্দে। শিশুদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অলিক রুপকথাভিত্তিক আরও অনেক বিধিনিষেধ। শিশুমনে অতি নির্দয় ভাবে দিয়ে দেয়া হচ্ছে শক্ত বেড়া, মুক্ত চিন্তায় বড় হতে দেবার বদলে দেওয়া হচ্ছে বাধা এবং অর্থহীন নিষেধের কাঁটাতার। শিশুটি বড় হয়ে গেলেও ভয়ের চোটে অনেক কিছুকে নিয়ে অতি সাধারণ প্রশ্নটিও করতে পারছে যে এটা কি, কে, কেন, কখন, কোথায় অথবা কিভাবে হল? ধর্ম নিয়ে তো নয়ই। খামোখাই এক মহা স্ববিরোধী মানসিক যন্ত্রণাতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে শিশুকে।

বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী নিল দেগ্রাস টাইসন বলেন শিশুদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও। প্রাসঙ্গিক একটি ক্লিপ এখানে (ব্যাক এরো দিয়ে আবার লেখাটিতে ফিরে আসতে পারবেন)।

আর প্রখ্যাত প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স বলেন, বড় হয়ে আপন জীবন দর্শন বেছে নেবার সুযোগ দেবার বদলে মা বাবারা যখন শিশুকালেই শিশুর ওপর ধর্মের বোঝা চাপিয়ে দেয় সেটা শিশু নির্যাতনই বটে। তবে ধর্ম বিষয়ে জানা, এতে কোন সমস্যা নেই। প্রাসঙ্গিক একটি লিঙ্ক এখানে

ধনী, ক্ষমতাশালী, পেশীশক্তি আর চালাকদের সাথে আঁতাত করে ধর্মবাদীরা সহজ সরল মানুষদের ভেতর ঢুকিয়েছে পরকালের ভয়। এটা না হলে আজকের গরীব মানুষেরা তাদের পাওনা ছেড়ে দিত না কক্ষনো। ছিনিয়ে নিত তাদের অধিকার। সরল মানুষেরা সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি হওয়া সত্বেও চাপানো ধর্মীয় ভয়ের চোটে ধনী, ক্ষমতাশালী, পেশীশক্তি আর চালাকদের বারোটা বাজায়নি। বরঞ্চ সহজে নিজেদেরকে হতে দিয়েছে প্রতারণা প্রবঞ্চনার শিকার।

একসময় যুক্তিবাদী মানুষেরা সুযোগ সন্ধানী ধর্মবাদীদের কোনঠাসা করত যুক্তি দিয়ে। প্রশ্ন তুলে। বলত মানুষ মরে গেলে তো দেখা যাচ্ছে তার দেহ গলে পচে মিশে যায় মাটির সাথে। কল্পনার চাপানো স্রষ্টা কি করে আবার এই মিশে যাওয়া দেহকে শাস্তি দেবে? যুক্তির কথা। এইবার ধর্মবাদীরা ‘আত্মা’ নামের এক গায়েবী জিনিস পয়দা করল। বলতে শুরু করল, ওই আত্মাকেই দেওয়া হবে কঠিন শাস্তি। সরল মানুষ ক্রমে ক্রমে মেনে নিলো এমন প্রবঞ্চনা। ধর্মবিশ্বাস নামের এই গায়েবী প্রতারণাকে সত্য মানা শুরু করে দিল। অথচ কেউ কোনদিন বৈজ্ঞানিক ভাবে আত্মাকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না, পাবেও না। কাজেই আত্মা বলে কিছু আছে তা কল্পনাতেই রয়ে গেল। ওদিকে সহজ সরল মানুষেরা, তাদের মা বাবাদের কাছ থেকে পাওয়া বিশ্বাস আর ভয় বংশ পরম্পরায় তাদের শিশুদের ওপর চাপাতে থাকলো। যা ক্ষতিকর ভাবে আজও চলছে একযোগে, সগৌরবে!

‘আত্মা নিয়ে ইতং বিতং’ এই নিয়ে অভিজিৎ রায় এর সহজ করে চমৎকার কিছু লেখা পড়ে নিতে পারেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে । এসব নিয়ে যে কোন ভালো লেখা পড়লেই বোঝা যাবে এই পরকাল আত্মা এইসব কতখানি অপরীক্ষিত, ফালতু আর কল্পিত।

এ মুহুর্তে আরেকজন মুক্তমনা ব্লগারের লেখার কথা মনে পড়ছে। অনিক। তার প্রাসঙ্গিক লেখাটি সময় পেলে পড়ে নিন চট করে এখানে

এখনকার প্রজন্ম আজকের এই মুক্ত তথ্যযুগে যে কোন বিষয়েই তথ্য যাঁচাই করে নিতে পারে নিমিষেই। আজকের মানুষ চাইলেই দ্রুত জেনে নিতে পারে আসল ব্যপার। তারা যখন জানতে পারছে ধর্মের গল্প আর রূপকথায় কোন পার্থক্য নেই, দেখছে ঠাকুমার ঝুলি বা থলের ভেতর দেখছে অদ্ভুত সব কল্পজগতের অবাস্তব কাহিনী, মা বাবাদের নিয়ে তখন তারা কি ভাবছে? মুক্ত তথ্যযুগে জ্ঞানের আলোয় নতুনরা উদ্ভাসিত যেমন হচ্ছে তেমনি বিব্রতও হচ্ছে তারা তাদের অভিভাবকের দায়িত্বহীনতার কথা ভেবে। কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে তাদের প্রিয় মানুষদের এই অন্যায়।

দেশের প্রায় সকল শিশুই মানসিক ভাবে নির্যাতিত। ধর্মভয় দেখিয়ে অভিভাবক নিয়ন্ত্রন করেছে শিশুর ধর্মাচরণ। বিনা প্রশ্নে আর নি:সংশয়ে ধর্ম মানতে বাধ্য করা হচ্ছে শিশুদের। অভিভাবকদের চাপানো আপোষহীন ধর্মীয় শাসন, শিশুকালে ঢোকানো ভয়, নিষেধ, শাস্তি ও গায়েবী পুরস্কার আজকের শিশুকে অস্বভাবিক করে বড় করছে। জ্ঞানার্জনের অপার অসীম সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে ধর্মীয় নিষেধের সীমানা টেনে। সাধারণ জ্ঞান অর্জনে শিশুকালে রোপিত ভয় হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর এক মানসিক বাধা। এইসব শিশুরা, যারা বিদ্যান হচ্ছে তাদের মধ্যেও অনেকের রয়ে যাচ্ছে ধর্মীয় অন্ধত্ব, বাড়াবাড়ি, মৌলবাদী ভাবনা আর যুক্তিহীন গোঁড়ামী। এই দৃষ্টিতে আজকের মানুষদের ধর্মীয় গোঁড়ামীর জন্য অভিভাবকরাই দায়ী।

সুতরাং নতুন পুরনো মা বাবারা, শিশুদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সবচেয়ে কাছের মানুষেরা যেন শিশুমনে আর ভয় না ঢোকায় তা আশা করা যাক। এখনকার অভিভাবকরা হোক মুক্ত মনের, হোক সত্যিকার স্নেহপরায়ন আর দ্বায়িত্বশীল মানুষ। শিশু বড় হলে তারপর তাকে তার জীবন দর্শন বেছে নেবার অধিকার দিক এ প্রজন্মের নতুন মা বাবারা। আজকের শিশুদের মগজ ধোলাই বন্ধ হোক। জীবন সুন্দর হোক।

তথ্যসূত্র:

CONDITIONED EMOTIONAL REACTIONSBy John B. Watson and Rosalie Rayner(1920)First published in Journal of Experimental Psychology, 3(1), 1-14.