দুই
স্বপ্নের রঙ ফিকে হয় ক্রমে
১৯৭৪ ইং সাল । দেশে আকাল পড়েছে । মানুষের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের আকাল। শনৈঃশনৈ বাড়ছে চাউলের দাম । ডাল, তেল, নুন, মরিচ, পেয়াজ ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের দামও হু হু করে বাড়ছে। চরম আকাল পড়েছে শিশুখাদ্যের বাজারেও। মানুষের হাতে টাকা নেই । আলম ভাবে-একি দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি ? বইপুস্তকে পড়লেও এ শব্দটি আলমের কাছে এখনো দুর্বোধ্য। সমাস এর ব্যাস বাক্য সে জানে-ভিক্ষার অভাব দুর্ভিক্ষ। কিন্তু ভিক্ষার অভাব হওয়ার মত পরিস্থিতি কী আদৌ হতে পারে ? চিরায়ত ভেতো বাঙালিরা এবার ভাতের পরিবর্তে দু’বেলা রুটি খাওয়া শুরু করেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই সকালের নাস্তায়ও রুটি পছন্দ হত না আলমের। এখন প্রতিদিন রাতে ভাতের পরিবর্তে তাকে খেতে হচ্ছে রুটি-তাও আবার কচু-ঘেঁচু-ডাঁটা-কলমিলতা ইত্যাকার শাকসব্জি সিদ্ধ করে । স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে যেখান চাউল পাওয়া যেত টাকায় দেড় সের, দুই সের, সেখানে এখন প্রতি সের চাউলের দাম এসে ঠেকেছে ছয় থেকে সাত/আট টাকায়। আলম অবাক বিস্ময়ে দেখে-মানুষ ভিখেরিদেরও এখন আর ভিক্ষা দিতে চায় না। বরং বিরক্তি প্রকাশ করছে যখন ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক দ্বারে এসে হাঁক দেয়।

আলম বুঝতে পারে, দুর্ভিক্ষ তাদের সমাজকে গ্রাস করছে এবং তা ক্রমে ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করেছে। রাজপথে কঙ্কালসাড় ভিখারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। রাস্তার অলিতে গলিতে বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে । অন্ন নেই, বস্ত্র নেই-চতুর্দিকে কেবলি হাহাকার। বিভিন্ন এলাকায় সরকারী উদ্যোগে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। পতেঙ্গায়ও একাধিক লঙ্গরখানা খোলা হল । সে সমস্ত লঙ্গরখানায় প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ ভিড় করছে । কাঁকড় মেশানো দু’টি রুটির সাথে যৎসামান্য ডাল-বাজি। কোন কোন দিন যৎসামান্য চাল-ডালের দলাপাকানো খিঁচুড়ি। অনাহারে মৃত ও শূণ্য সানকি হাতে হাড্ডিসার মানুষের ছবি জাতীয় পত্র-পত্রিকার পাতা জুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে দেদার । বাসন্তী নাম্নী এক তরুণীর জালপড়ে আব্রু রক্ষার ছবি সারা দেশটাকেই যেন বেআব্রু করে দিল। নিজের পাতে ভাতের সাথে আলুর টুকরা দেখে আলম টের পায়, দুর্ভিক্ষের ছোবল ক্রমে তার পরিবারকেও গ্রাস করতে শুরু করেছে। আলমের মা ঘরের পেছনের খালি জায়গায় ডাঁটা শাক লাগিয়েছে। সে ডাঁটা শাকের সাথে কেসারির ডাল মিশিয়ে সব্জি রান্না-তার সাথে গমের আটার রুটি যেন নিত্য দিনের খাদ্য তালিকায় পরিণত হয়েছে।

আলমের ছোট বোন আনোয়ারা পড়ত শহরস্থ নন্দন কানন গার্লস হাই স্কুলে। তখনো পতেঙ্গায় মেয়েদের আলাদা কোন স্কুল চালু হয় নি। জনৈক নজরুল মেম্বারের বাড়ির ঘাটায় একটি গার্লস স্কুল করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় নি। পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা চালু করার জন্য তাকে পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে এনে ভর্তি করানো হয়েছিল ৭ম শ্রেণীতে । ৯ম শ্রেণীতে ওঠার পর স্কুলের মাসিক বেতন আর ইউনিফরম সেলানোর টাকার অভাবে আনোয়ারার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

আলমের কনিষ্ঠ বোন-স্বাধীনতার পরে যার জন্ম এবং যাকে সোহাগ করে সবাই বুড়ি বলে ডাকত-নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হল। চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য আত্মীয় স্বজনদের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিলেন আলমের মা-বাবা । সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল। অনন্যোপায় আলম পরিশেষে একদিন তার বোনকে পাঁজা কোলে স্থানীয় গ্রাম্য ডাক্তার বাবু শশাঙ্ক ধর -যিনি আলমদের পারিবারিক চিকিৎসক এবং আলমের বাবার বন্ধুর মত ছিলেন-তার কাছে নিয়ে গেলে তিনিও চিকিৎসা দিতে রাজি হলেন না-চিকৎসা ফি ও ঔষধের দাম পাবে না মনে করে। ঐদিন সন্ধ্যায় বিনা চিকিৎসায় ফুটফুটে বুড়ি মারা গেল। হাউমাউ করে কেউ কাঁদল না। শোকে সবাই যেন বোবা হয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জনে তাকে বিদায় জানাল। নামাজের পুরানো সাদা শাড়ী পেঁচিয়ে বড়পুকুর পাড়ে তাকে অন্তিম শয়ানে শায়িত করা হল।

আলমের প্রিয় দাদী মা-এ বয়সেও যার সাথে এক বিছানায় শুত আলম, বৃটিশ আমলের নানা ঐতিহাসিক গল্পের সাথে রূপকথার গল্প এবং নানা খনার বচন শোনাত আলমকে-কয়েক দিনের জ্বরে ভোগে সেও এ ধরাধাম থেকে চির বিদায় নিল। তাকে দাফন করার কাফনের কাপড় কিভাবে জোগাড় হবে এ ভাবনায় আলমের শোকাহত বাবা যখন বিচলিত, তখন আলমের মা তার বড় পেটীতে রক্ষিত পূর্বে কিনে রাখা এক থান সাদা কাফনের কাপড় বের করে দিল । মুসলধারার বৃষ্টির মধ্যে মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানের সদ্য খনন করা কবরে তাকে যখন শায়িত করা হচ্ছিল- তখন এক পরামাত্মীয়ের দুঃসহ বিচ্ছেদ বেদনায় আলমের কেবলি মনে হল-এক অব্যক্ত অভিমান বুকে নিয়ে তার আজন্ম সাথী দাদীমা তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

আলমের বাবা বার্মা ইস্টার্ন লিঃ নামক একটি তেল বিপণন কোম্পানীর তালিকাভূক্ত ঠিকাদার । মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবার ছিল তাদের। আজ তার বোনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হল কিনা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে । মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী আলম বুঝতে শুরু করল-কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতা মানুষকে মুক্তি দেবে না। তার জন্য অপরিহার্য অর্থনৈতিক মুক্তি। সে উপলব্ধি করা শুরু করল-স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি মানুষের পেটে ভাত না থাকে।

আলম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ফলে তার বাবাকেও আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছিল। ফলে দীর্ঘ নয় মাস তার কোন ঠিকাধারী কাজ ছিল না। যুদ্ধকালীন নয় মাসে নিজের পুঁজি খেয়ে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে আলমের বাবা তার ঠিকাধারী ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছেন না । তাই পরিবারের আসন্ন দারিদ্র্য আলমের মনে এক ধরণের অপরাধ বোধের জন্ম দেয়।

প্রতিদিন দুই তিনটি টিউশনি, নিজের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগল আলম। সে ভাবে-একি তার স্বপ্নের বাংলাদেশ ! আবার শান্তনা খোঁজে-যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, এমন হতেই পারে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তর্কে সে স্বাধীনতা-উত্তর কিংবা বিপ্লবোত্তর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে-নেতাদের কাছে যেমনটি সে শুণেছে-তাদের বুঝাবার চেষ্টা করে বিপ্লব বা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেশের অবস্থা এমন হতে পারে। তবুও স্বাধীনতার এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন প্রতিকুল অবস্থায় পড়তে হবে, তা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয় আলমের নিজেরও ।

যে বিষয়টি আলমকে যারপরনাই ব্যথিত করছে তাহল, একটি মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যেন বিভক্ত হয়ে পড়ল। যে মানুষগুলো দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখেছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে, স্বাধীনতার পর পর তারা এত স্বার্থান্ধ হয়ে যেতে পারে? কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না আলম। কিন্তু এটাই এখন সময়ের নির্মম বাস্তবতা।

দেশের এহেন চরম দুর্ভিক্ষের সময়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছেলেরা নতুন শ্লোগানে মাঠে নামল। তারা শ্লোগান দিতে শুরু করল-“এক নেতা, এক দেশ-বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।” “ দেশে এল নতুন বাদ-মুজিববাদ, মুজিববাদ।” চার খলিফা বলে খ্যাত ছাত্র নেতাদের দুই জন আ,স,ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ এবং তাদের সাথে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মেজর এম, এ, জলিল এর নেতৃত্বে জন্ম নিল নতুন একটি রাজনৈতিক দল, “জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)”। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগানকে সামনে নিয়ে আসল। প্রচুর তরুণ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের নেতারা এ দলে যোগ দিল। তারা পাল্টা শ্লোগান তুলল-“সর্বনাশা মুজিব বাদ-কেড়ে নিল পেটের ভাত।”স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুরও কঠোর ভাষায় সমালোচনা শুরু করল তারা। লালদিঘীর মাঠে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাসদ এর এক জনসভায় আসম আব্দুর রব বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার পরিবর্তে জুতার ফিতা বলে সম্বোধন করলেন । ভীষণ কষ্ট পেল আলম । রাজনীতির এসব দ্বন্দ্ব-বির্তক আলম এখন আর বুঝে ওঠতে পারে না। কিন্তু তার ভাবতে ভীষণ কষ্ট লাগে, কী ঐক্যবদ্ধই না ছিল সমগ্র জাতি। এত তাড়াতাড়ি সে ঐক্যে ছিড় ধরল !

এক দিকে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। নতুন একটি শব্দের সাথে পরিচিত হল আলম। হাইজ্যাক! এর আগে আলম এ শব্দ কখনো শুণেনি। অস্ত্রের মুখে কিছু যুবক জোর করে টাকা, গাড়ী ছিনিয়ে নিচ্ছে যত্রতত্র । এরই নাম হাইজ্যাক। এ,টি, দেবের ইংলিশ টু বাংলা ডিকশনারী দেখে আলম জানল হাইজ্যাক শব্দের বাংলা অর্থ ছিনতাই। টালমাটাল দেশের অবস্থা। কোন কিছুর উপর যেন আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং রিলিফের মাল, কাপড়, টাকা ইত্যাদি চুরি, আত্মসাৎ এর কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়ছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

আওয়ামী লীগের কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীর বাসা থেকে সেনা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে উদ্ধার হতে লাগলো শিশু খাদ্য সহ বিভিন্ন রিলিফ সামগ্রী। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা রিলিফ বিতরণের বিভিন্ন কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়ল। সরকার এ সমস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করল না । এসব সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করছে। দ্রুত জনপ্রিয়তা কমছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের। পরিস্থিতি এতটা নাজুক হয়ে পড়ল যে, বঙ্গবন্ধুও অসহায়ের মত বলছে, আমার সামনে চোর,পেছনে চোর,ডানে চোর বায়ে চোর। মানুষ পায় সোনার খনি,আমি পেয়েছি চোরের খনি ।

কী করবে বুঝে ওঠতে পারছে না আলম। বড় বোনের বিবাহের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে । ছোট বোনের লেখাপড়া বন্ধ । তার এক ছোট ভাই নাছির আলম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে শহরস্থ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছোট্ট দু’জন এখনো স্কুলে যায় নি। আলমের নিজ বাড়িতেই রাতে অনেক পরিবারের উনুনে হাড়ি ছড়ে না। সারাদিন পাড়ায় হেটে আলমের দাদীমা যখন নিজের ঘরের বারন্দার খুঁটি ধরে ধপাস করে বসে-দীর্ঘ শ্বাসের পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, তখন আলম বুঝতে পারে, তার ক্ষুদ্রাকৃতির গৌরবর্ণের, প্রতিবেশীর প্রতি অতি সহানুভূতিশীল দাদী-যে আলমকে মুক্তিবাহীনির পরিবর্তে মানিক বাহিনী বলে ডাকে-গ্রামের কত ঘরে আজ কোন রান্না হয়নি, তার খবর নিয়ে এসেছে। দুর্ভিক্ষের ছোবল এত নিষ্ঠুর হতে পারে আলম ভাবতে পারে নি। দু’বেলা দু’মুঠো চালের অভাবে মানুষ উপোস থাকবে-আলমে কাছে এ এক অপার বিস্ময় ।

আলমের পাশের ঘরের দাদা, তার বাবার নিজ চাচা, ফয়েজ আহম্মদ-একজন অবসর প্রাপ্ত নাবিক, অত্যন্ত অমায়িক সজ্জন, যার একমাত্র ছেলেও নাবিক, স্বাধীনতার পর যে আর জাহাজ যেতে পারে নি-কিছুদিন লাগাতার অনাহারে অর্ধাহারে থাকার পর এক রাতে যে ঘুমাল-তার সে ঘুম আর ভাঙ্গল না। অনাহারে মৃত্যুর প্রথম চাক্ষুস দেখা ঘটনা আলমের।পরদিন সকালে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন যারা তাকে দেখতে আসল, কবর পাড়ে নিয়ে গেল-তারা কেউ জানতে চাইল না-লোকটার কি হয়েছিল । সবাই কেবল মুখ চাওয়া-চাওয়ী করল।

সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু কলেজে প্রথম বছরের সিলেবাস ও শেষ হয় নি এখনো। তবুও পরীক্ষায় অবতীর্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। মরিয়া হয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে আলম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলম টিউশনি শুরু করল বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে। মাসের শেষে কিছু টাকা পাওয়া যাবে, যা দিয়ে সে নিজের খরচ ও তার পরিবারকে সাহায্য করবে।

২৫ সে জানুয়ারী, ১৯৭৫ ইং, সকালে জাতীয় পত্রপত্রিকায় বড় বড় লাল হরফে সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হল- ২৪ জানুয়ারী দেশের সংবিধানে এক মৌলিক পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ সহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে । “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ(বাকশাল)” নামে নতুন একটি জাতীয় দল গঠন করা হয়েছে। দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে। যারা রাজনীতি করবে তাদের এ দলের সদস্য হতে হবে। দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ সহ মাত্র চারটি জাতীয় পত্রিকা ছাড়া আর সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হল। বলা হল, দেশ এখন দ্বিতীয় বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাবে।

২৫ সে জানুয়ারী জাতীয় সংসদে নতুন সিস্টেম এ যাওয়া সম্পর্কে এক দীর্ঘ ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। পরদিন পত্রিকার পাতায় খুব মনোযোগ দিয়ে সে ভাষণ পড়ল আলম। তার ভাষণে বঙ্গবন্ধু সিস্টেম পরিবর্তনের কথা বললেন । বললেন শোষিতের গণতন্ত্রের কথা। এ দুটি কথা আলমের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য ঠেকল। তার দীর্ঘ ভাষণে দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক করুণ চিত্র অকপটে তুলে ধরলেন তিনি। ঘুষ, দুর্নীতি, কালবাজারী, এমনকি হাজার হাজার মানুষের অনাহারে মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় তিনি ক্ষোভের সাথে উল্লেখ করলেন।

স্বাধীনতা-উত্তর দেশের এহেন পরিস্থিতির জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের একশ্রেণীর মানুষ, বিশেষভাবে উপর তলার শিক্ষিত মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। তিনি তার ভাষণে বললেন-এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকেরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ । যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখা পড়া করেছি। তিনি আরো বললেন-আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন।আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন, খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিষ কিনতে যান করাপশন, বিদেশে গেলে টাকার উপর করাপশন । তারা কারা? আমরা যারা ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল —।

নতুন সিস্টেম কার্যকরী করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে জেলায় জেলায় গভর্ণর নিয়োগ করা হল। গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর এ উদ্যোগ দেশের অবস্থার কী পরিবর্তন ঘটাবে এবং তা কিভাবে ঘটাবে তা আলমের বোধগম্য হয় না। পরিচিত ছাত্র লীগ কিংবা আওয়ামী লীগের কোন নেতার মুখে সহজবোধ্য কোন ব্যাখা আলম শুনতে পাচ্ছে না। শুধু দ্বিতীয় বিপ্লব কথাটি তারা আউড়াচ্ছেন। কেহ কেহ বলছেন-সমাজতন্ত্র করতে হলে এভাবেই যেতে হবে। জাতীয় দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার সাথে সাথে নতুন কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচীও ঘোষণা করা হল।

আলম ভাবে-বঙ্গবন্ধু নিজেই যেখানে দেশের দূরাবস্থার কথা উপলব্ধি করেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কথা বলছেন এবং নতুন করে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে একটি জাতীয় দল গঠন করেছেন, তখন অবস্থার একটা পরিবর্তন হতেই পারে। দেশের অবস্থার পরিবর্তন হলে, দুর্ভিক্ষ তিরোহিত হবে, হয়ত তার পারিবারিক দূরাবস্থারও কেটে যাব- এ আশায় আবারও বুক বাঁধে আলম । চলবে—