এই সেদিনও নিজেকে খুব সুখি মনে হতো বিল্লুর। বিল্লু মানে বিল্লাল হোসেন, “ভাই ভাই অটোমোবিল” গ্যারেজের মিস্ত্রি। মাসে- ছ’মাসে একবার গ্যারেজের ট্যাক্সি নিয়ে ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে লং ড্রাইভ। আছে মদের আড্ডা, জুয়া…। বিয়ে-থা করেনি। তবে ফূর্তির একটা মেয়ে মানুষ আছে। জীবনের এই রঙ্গরসে কোন পিছুটান নেই। সবাই জানে বিল্লু মিস্ত্রির হাত লম্বা, যা কামায় সবই উড়িয়ে ফেলে। তার আপন-পর জ্ঞান নেই। সবার জন্যই দরাজ কলিজা!… নিজের সম্পর্কে এসব শুনতে বিল্লুও ভালবাসে। সে তাই আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। সাপ্তাহান্তে যা কামায় দুদিনেই উড়িয়ে দেয়। তবু রাতের বেলা ঘুমুতে যাবার সময় বিল্লুর নিজেকে সুখি মনে হয়।…আহ্ কত সুখি ছিল সে!

কিন্তু একদিন রাত-দুপুরে তার ফূর্তির মেয়েমানুষ অকস্মাৎ তাকে জানায়- সে তিন মাসে পোয়াতি এবং সে হলফ করে জানিয়েছে এটা বিল্লুরই সন্তান!

তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে বিল্লু।চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় কমলার দিকে। এই প্রথম কমলাকে কুৎসিত মনে হয় বিল্লুর। তার ইচ্ছা করে লাত্থি মেরে নষ্টা মেয়েমানুষটাকে বিছানা থেকে ফেলে দেয়!

-তুমি খুশি হওনি? কমলাকে লাজুক দেখায়।

মাথায় আগুন চড়ে যায় বিল্লুর। ধেড়ে মাগীটার ছিনালী দেখে তার আর সহ্য হলো না। ঠাস করে সজোরে থাপ্পরটা পড়লো কমলার গালে। একটু্ও শব্দ করলো না কমলা। যেন প্রস্তুতই ছিল এরকম কিছুর জন্য! মুখটা শুধু ঘুরে পাশ ফিরে গেলো। এ-পাশ থেকে বিল্লু লক্ষ্য করলো না কমলার ঠোটের কোণে চিকচিক করছে বালির মত মিহি একটু হাসি।

-আমার সাথে বেঈমানি করলি ক্যান!আমি…’ বিল্লু দাতেঁ দাঁত চাপলো।রাতদুপুরে বেশি জোরে কথা বলা যায় না।লোকে অবশ্য জানেই তাদের ব্যাপারটা। তবু…

বলতে গেলে বিল্লুর সংসারই করছে কমলা। শুরুটা এমন ছিল, দেবর মানুষ-ব্যাচলর, ঘরের সঙ্গে ঘর-আমরা থাকতে তুমি হোটেলে খাবে কেন? না, বিনে পয়সায় না, বিল্লু তার জন্য খরচা দিবে। এতে দু’পক্ষেরই লাভ হলো। বিল্লুকে আর হোটেলের তেল ভাসা টকটকে লাল রঙের তরকারি খেতে হবে না। শত হোক ঘরের খাওয়া। কমলার লাভটাই বেশি- নগদ পয়সাটা হাতে আসছে। নিজের পুরুষ মানুষটা কুঁড়ে- একদিন রিকশা নিয়ে বেরুলে দুদিন ঘরে শুয়ে থাকে। লোকটারও দোষ নেই, শ্বাসের সমস্যা আছে, যেদিন শ্বাস উঠে সেদিন আর রিকশা নিয়ে বের হতে পারে না। বিল্লু তাদের সঙ্গে খাওয়া শুরু করাতে কমলাকে এখন বাজার-সদাই নিয়ে ভাবতে হয় না। বিল্লুর সংসার জ্ঞান নেই। দুদিনেই সেটা কমলা বুঝেছে। তাই বলে কমলা তাকে ঠকায়নি। বাজারের পয়সা হাতে থাকলে সে কিছুতে বিল্লুর কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেয় না। হ্যাঁ, যেদিন থেকে কমলা বিল্লুর সঙ্গে শোয়া আরম্ভ করেছে সেদিন থেকে হিসেবটা বদলে গেছে। এটা ইউসুফের এক্সিডেন্টের পর। বিল্লু তখন থেকে ঘর ভাড়াটা দেয়া শুরু করে। লোকে আড়ালে কমলাকে দেখে মুখ টিপে হাসে, মুখ বাঁকা করে। কমলা পরোয়া করে না। জীবনকে সে চিনেছে। তার মত আর কে হাড়ে হাড়ে জীবনকে চিনেছে? কে কি বলল এসব দেখলে দিন চলে না। ঘরে অথর্ব স্বামী। ছেলে দুটোর কথা ভাবে সে। একদিন হয়ত মাকে “খানকি” বলে যে যার মত পথ ধরবে। লেখাপড়া আর কতটা শিখবে তাদের ঘরে ছেলেপেলে, বড়টাকে বিল্লুকে বলে গ্যারেজে কাজ শেখাতে দিয়ে দিবে ভাবছে কমলা। কমলার ছেলেকে কি আর বিল্লু যেনতেন কারুর কাছে পাঠাবে? ছে্লে দুটোকে একটা পথ করে দিয়ে যাবে সে বেঁচে থাকতে…।

কাল অনেক রাতে ঘরে ফিরেছিল বিল্লু। অনেকদিন পর অনেকখানি মদ গিলে এসেছিল। কখন যে বেহুস হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরও পায়নি। পরদিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙ্গে। কাপড়ের খসখসানি আর চুরির টংটাং শব্দে ঘুমটা চটে যায়। চেয়ে দেখে কমলা চেয়ে আছে তার দিকে। প্রচন্ড একটা মাথা ব্যথা অনুভূত হয় বিল্লুর।মুখের ভেতরে বিশ্রী একটা স্বাদ। খুব গলা শুকাতে লাগলো। সে যন্ত্রণায় চোখ কুচকে বন্ধ করলো।

-কাল রাতে বাতি না নিভাইয়া শুয়ে পড়ছিলা। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়ায় আছিলাম…। কমলা আঙ্গুলে ওড়না প্যাচায় বলতে বলতে।

-এগুলি বলার জন্য খাড়ায় আছো? বিল্লুর রক্তজবার মত চোখ মেলে বলে।বিল্লুকে দেখে এখন কমলার ভয় লাগে।

কঠোর একটা কন্ঠে বিল্লু কৌফিয়ত চায় কমলার কাছে, তুমি আমার খোঁজে গ্যারেজে লোক পাঠাইছিলা?

-হু।

-ক্যান?

-বাহ্, তুমি ঘরে আসো না। কই থাকো না থাকো…

-আমি কি করি না করি সেটা নিয়া তোমার মাথাব্যথা ক্যান?

-বাহ্ মাথা ব্যথা থকবো না?
-না থাকবো না।

-ঠিক আছে তুমি না চাইলে আর…।

-রাতবিরাতে তুমি আর আমার ঘরে ঢুকবা না।

সোজাসুজি তাকালো এবার কমলা বিল্লুর দিকে। চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে বিল্লুর। কমলা ভেবে পায় না পুরুষ মানুষ মেয়েমানুষের বিষয়ে এতখানি! পুরুষ মানুষের জন্মই যেন মেয়েমানুষের শরীর আর গর্ভকে ভেবে ভেবে আতংকিত হওয়া। চেয়ে থেকে থেকে অদ্ভূতভাবে হাসলো কমলা। পুরুষ মানুষ তো কম চিনলো না এ জীবনে…।

-আমার এক বন্ধু আছে, পরিচিত ক্লিনিক, তুমি সেখানে যাইবা। বিল্লু বলে, আমার কথা শোন, আমি তোমারে তিরিশ হাজার টাকা দিমু। টাকাটা নিয়া দেশে চলে যা্ও। দেশে গেলে আরো বিশ হাজার দিমু। আমারে মুক্তি দাও…। শেষ দিকে মিনতি ঝরে পড়ে বিল্লুর কন্ঠে।

কমলা চেয়েই থাকে বিল্লুর দিকে। হায়রে পুরুষ মানুষ! কমলা ভেবে পায় না লোকটাকে সে ঘৃণা করবে না করুণা করবে? এমন তাগড়া জোয়ান একটা মরদ, কি বাহাদুরি করে বেড়ায় বাইরে। কমলা নিজের চোখে দেখেছে পাড়ায় কাকে যেন ছোরা নিয়ে দৌড়াচ্ছে বিল্লু। বিল্লু তো একটা গুন্ডা। ওর কাছে পার্টির ছেলেরা আসে। বিল্লুর কাছে একটা পিস্তলও আছে। কমলাকে সেটা দিয়ে একটা গুলি চালালেই হয়! তা না, দেখো কেমন মেয়েমানুষে আচঁল ধরে ভেউ ভেউ করছে! একটা বাচ্চা জন্ম নিবে তাতে তার সমস্যাটা কি? সে কি তাকে বিয়ে করতে বলছে? বলছে তাকে ঘরে তুলে আনতে? থাকো না তুমি তোমার মত। তোমার একটা সন্তান আমার কাছে থাকলো…। কমলা মনে মনে হাসে। মায়ার বাঁধন। ফূর্তি করতে আসা পুরুষমানুষ এই বাঁধনকেই ভয় পায়।

কমলা ওড়নায় মুখ মুছে বলে, আচ্ছা দেখি।

-আমার ঘরে আর আসবা না!

-আচ্ছা।

-তুমি কি টাকা নিয়া দেশের বাড়ি যাইবা?

-যাবো।

-তাহলে আমার লগে ক্লিনিকে যাইবা।

-কবে যাইতে হইব?

-ধরো কাইল পরশু।
-তুমি টাকাটা আগে দিলে মতির বাপেরে আগেই গেরামে পাঠাই দিতাম।

বিল্লু চেয়ে দেখে কমলাকে। কমলার মুখে এতটুকু দ্বিধা-শংকোচ নেই।

কমলা ঘরে এসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে। দেশগ্রামের কথা মনে পড়ে তার। এখন এই বস্তিতে বসে বসতবাড়ি, ঢাল বেয়ে নামা ফসলের খেত, নদীর পাড়… এইসব খুব টানে। বুকের ভেতর হু হু করে উঠে। কিন্তু কমলা জানে এসব খেয়ে তো মানুষ বাঁচে না। তাদের গ্রামটা কত সুন্দর দেখতে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই খেতে পায় না। কমলা সেখানে ফিরে গিয়ে কি করবে? তিরিস হাজার টাকায় কিছু করা যাবে হয়ত। আরো বিশ হাজার দিবে বলছে। কমলা ভাবতে বসে, হাস-মুরগির ফার্ম…। কিন্তু কিছুই মন:পুত হয় না। সব কিছু ফেলে পা ছড়িয়ে বসে কমলা উদাস হয়ে যায়, ভেবে ভেবে দুপুর গড়িয়ে যায়। আজ কমলার কিছুই ভাল লাগে না।

মোড়ের রাস্তায় এক ঠ্যাঙ্গা বকের মত দাঁড়িয়ে ছিল ইউসুফ। দুবগলে ক্র্যাচ। কমলার পোয়াতি হবার খবর পাওয়ার পর থেকে বিল্লুর কেমন জানি আড়ষ্ট লাগে ইউসুফের কাছে নিজেকে। বিল্লু এড়িয়ে যাবে ভেবেও দাঁড়িয়ে পড়ল। বিল্লু উসখুস করে বলে, কেমন আছো?

-ভাল আছি। শুকনো মুখে জবাব দেয় ইউসুফ। পাশে ছোট ছেলেটা বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। ইউসুফ শুকনোভাবে একুট হাসে।

-চা খাইছো?

ইউসুফ জানায় সে চা খাবে না।

বিল্লু পানের দোকান থেকে এক প্যাকেট শেখ সিগারেট কিনে ইউসুফের হাতে দেয়। সিগারেট পেয়ে খুশিই হয় ইউসুফ। বিড়ি-সিগারেটে পয়সাটারই অভাব। কমলা কাছ থেকে তো এসবের জন্য চারআনাও মিলবে না। তার নিজের কোন রোজগার নেই। কতদিন লোকের ফেলে দেয়া সিগারেট লুকিয়ে তুলে নিয়ে টেনেছে। তামাকের নেশা বড় সাংঘাতিক!

বিল্লু চলে যেতে ইউসুফ লোভীর মত প্যাকট ভেঙ্গে সিগারেট ধরায়। রাস্তায় ছালা বিছিয়ে এক লোক সবজি বেচতে বসেছে। রোজ দেখে ইউসুফ চেয়ে চেয়ে লোকটার বেচাকেনা। অনেকদিন লোকটা তাকে সিগারেট খাইয়েছে। আজ ইউসুফের ফেরত দেবার দিন। লোকটাকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো ইউসুফ। ক্যাচ নামিয়ে লোকটার সঙ্গে বসলো। একটা চৌকি নিয়ে তরকারি বেচতে পারবে না সে? লোকটা বলে, বাজারে বসলে কিছু টেকাটুকা দেওন লাগবো। ভ্যানে নিয়া বেচলে বেশি লাভ। তয় তুমি তো আর ভ্যান চাইলাতে পারবা না। তুমি কোন জায়গায় বইসা বেচতে পারো…। এরপর তরিতরকারির দরদাম নিয়ে আলাপ চালালো। দুপুরটা ইউসুফ এমনি করেই কাটিয়ে দেয়। খিদে পেলে তারপর ঘরে যায়। কমলা খেতে দিলে খায়। খোড়া হয়ে যাবার পর এরকমই চলছে তার রুটিন।

পাতলা একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিল ইউসুফ। তাকে দেখতে লাগছিল একটা লাশের মত। কাঁথাটা মুখের উপর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। কমলা ভেবেছিল ইউসুফ ঘুমিয়ে পড়েছে। সে মাথা তুলে একটু চেয়ে দেখে। কমলা অবশ্য ইউসুফকে নিয়ে অত ভাবে না। কমলাও জানে ইউসুফ সব বুঝে। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। কমলা অভ্যাস মত ইউসুফকে চেয়ে দেখে। সত্যি একটা কাপড়ে ঢাকা লাশের মত মনে হয় ইউসুফকে তার। শ্বাস পড়ছে কিনা সন্দেহ। মরেই গেলো নাকি লোকটা?

কমলার সতর্ক বিছানা ত্যাগ ইউসুফ টের পায়। আলতো দরজায় ছিটকিনি খুলে দরজা ভেজিয়ে বেড়িয়ে পড়ল কমলা। ইউসুফ কোন সাড়াশব্দ করে না। একটা লাশের মতই চুপ করে শুয়ে থাকে। ছোট ছেলেটা ঘুমের মধ্যে কথা বলে উঠে এ-সময়। ইউসুফ ছেলেকে বুকের উপর এনে শোয়ায়। অকারণেই ঘুমন্ত ছেলের সঙ্গে কথা বলতে থাকে, ঘুমা, ঘুমা…। জাগিস না, ঘুমা…ঘুমা…

আজ কমলা এত জলদি ফিরে এলো! ইউসুফ ভাবে। আধঘন্টায় ফিরে এলো? ইউসুফ ঘুমিয়ে থাকার ভান করে। তাকে অবাক করে দিয়ে কমলা তার পিঠে মৃদু মৃদু ধাক্কা দিতে থাকে।

-এই যে, এই যে…

ইউসুফ ফিরে চায়। কমলা বিছানায় বসে আছে। অনেককাল কমলাকে তার খুব কাছের কেউ মনে হয়নি। আজ যেন কমলা খুব আপনার হয়ে উঠেছে। তার মুখে সেরকম একটা ভাব। ইউসুফ উঠে বসে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় কমলার দিকে। কমলা ধীর-স্থীরভাবে বলে, কাল গেরামে যাও একবার। কাম আছে। দুদিন পরে আমি আসমু। তুমি পোলা দুইডারে নিয়া যাওগা।

ইউসুফ চুপ করে থাকে। কিছু বলে না।

এখান থিকা আমরা গেরামেই ভাল থাকুম। ব্যবসাপাতি শুরু করুম। কাইল তাইলে ভোরে রওনা দেও?

ইউসুফ সম্মতির মাথা নাড়ে। দুজনের আর কথা হয় না। ইউসুফের আর ঘুম আসে না। কমলাও জেগে থাকে। কাল সকালে বিল্লু তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাবে। কমলার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ইউসুফ টের পায় কমলার কাঁদছে। সে বুঝতে পারে না কি হয়েছে কমলার। মেয়েমানুষের কান্নাকাটি সব সময় বুঝাও যায় না। দুজনেই পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কখন দুজন ঘুমিয়ে পড়ে টেরও পায় না। সকালে ঘুম ভাঙ্গে মর্জিনার মার গলায়। সে যেন কাকে বলছে, মাডার কেইস, ঠেলা আছে, অত সোজা না বাইর হওন…।

কমলা চোখ ডলে ঘর থেকে বের হয়।

মহিলা পুরুষের একটা ভীড় বস্তিতে। কি হইছে, কি হইছে? কমলা জিজ্ঞেস করে সবাইকে।

এ- ওর গা টেপাটেপি করে কমলার কথা শুনে। কে একজন ফিসফিস করে আরেকজনের কানে বলে, খানকিটারে এইবার বস্তি থিকা বাইর করতে হইব!

মর্জিনার মা জোরে জোরে বলে, আরে আমগো বিল্লুরে কাইল রাতে গ্যারেজ থিকা পুলিশে ধইরা নিয়া গেছে-শুনছোত নি?

কমলার মুখ হা হয়ে যায়। কোন শব্দ বের হয় না।

একজন বলে, খুনের কেইস। বিল্লু নাকি দলে ছিল!

আইরিনের বাপ বলে, আরে না, এইটা রাজনীতি, তোমরা বুঝতা না। দেখবা বিল্লুগো দল ক্ষমতায় আইলে এই মামলা পানি হইয়া যাইবো!

ইলেকট্রিক মিস্ত্রি শমসের বলে, না খালু, এইটা সেই কেইস না, বিল্লুরে ধরছে কমিশনার বাচ্চু মাডার কেসে।

আইরিপেনর বাপ কপট ধমক দিয়া বলে, দুর ব্যাটা তুই জানছ না!

মিস্ত্রি বলে, থানার লোক আমারে বলছে। আমি তো আবার থানার কারেন্টের কাজ করি মাঝে মধ্যে। আপনে পরে মিলাইয়া নিয়েন। বিল্লু ফাঁইসা গেছে কইয়া রাখলাম!

মাখন মিয়ার এই বস্তিতে আদালত-থানা-পুলিশে দৌড়াদৌড়ির অভিজ্ঞতা আছে। সে সব জান্তার মত বলল, বিল্লুর ঠিকই ফাঁইসা গেছে। কথা সত্য। সে নিচু স্বরে বলে, মিমিমাম পনেরো বছরের জেল হইবো দেইখা নিয়ো!…

কমলা ঘরে এসে দুয়ার দিয়ে বসে। ইউসুফ দরফর করে উঠে বসে এ-সময়। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তার গেরামে যাবার কথা ভোরে। সে অপরাধীর মত মুখ করে কমলার দিকে তাকায়। কমলা চিন্তিত আনমনা একটা মুখে বলে, যাওনের কাম নাই…।

মাস ছয় পর এক দুপুরে ভাত খেতে বসে ইউসুফের গলায় ভাত আটকে যাবার জোগার হয়। কমলা আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে, ব্যবসা করবা?

ঢোগ গিলে গলা থেকে ভাত নামায় ইউসুফ। কমলাকে চেয়ে দেখে ভাল করে। কমলার মুখ কঠিন। ইউসুফ ভাতের থালায় ভাত নেড়ে গ্রাস বানাতে বানাতে বলে, ব্যবসা করুম ট্যাকা কই?

ট্যাকা আমি দিমু।

ভাতের একটা ডেলা বাঁ গালে রেখে ইউসুফ বলে, বাজারে একটা চৌকি নিতে পারলে তরকারি বেচতে পারুম।আমাগো জাত ব্যবসা।এইটা খুব পারুম…।

ফতুর বাপেরে কইয়া বাজারে একটা চৌকির ব্যবস্থা কইরা দিমু। আমি একটা মেশিন কিইন্না ঘরে অর্ডারের মাল সিলামু…।

তারপর কমলা গভীর এক ভাবনায় হারিয়ে যায়। পনেরো বছর পর যদি সে নিজে বেঁচে থাকে, পনেরো বছর পর যদি এক জেলখাটা কয়েদী ফিরে আসে, অন্তত নিশ্চিন্তে দুটো ভাত তো খেতে পাবে, তার একটা বন্দবস্ত করে রাখতে হবে এখনি…।