সাফল্য এমনি এমনি আসে না। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম লাগে, নিষ্ঠা লাগে, আন্তরিকতা লাগে। লাগে সর্বভুখ এক ক্ষুধা, সাফল্য অর্জনের ক্ষুধা।

এর আগে সতেরোটা বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে জার্মানি। বারোবার সেমিফাইনালে খেলেছে। সাতবার ফাইনালে। তিনবার চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় দিয়েছে। এই সাফল্য ঈর্ষণীয়। ব্রাজিলের পরেই তাদের অবস্থান বিশ্বকাপ ফুটবলের অর্জনের ক্ষেত্রে। অন্য অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত জার্মানি।

তারপরেও কথা থাকে। সাফল্যের মাঝে ছন্দপতন থাকে, থাকে ব্যর্থতার গ্লানি, থাকে অসফলতার অস্ফুট বেদনা, অপমানে নীল হবার যন্ত্রণা।

এই গ্লানি, এই অপমান, এই বেদনা, এই নীল যন্ত্রণাকে মোছার কাহিনি শুরু হয়েছিলো চৌদ্দ বছর আগে।

নব্বই সালে আর্জেন্টিনাকে পরাজিত করে কাপ জিতেছিলো জার্মানি। কিন্তু, পরের বারই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় তারা। সতর্কবার্তাটা এতো অস্পষ্ট ছিলো যে, অনেকেই তা খেয়াল করে নি। আটানব্বইয়ে ফ্রান্স বিশ্বকাপেও কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা পেরোতে ব্যর্থ হয় তারা। এবার সতর্কবার্তা বাজে আরেকটু জোরেসোরে। কেউ কেউ একটু নড়ে চড়ে বসে। ঝড়ের পূর্বাভাষ এসে গিয়েছে যে।

ঝড়টা আসে ঠিক দুবছরের মাথায়। এর ভয়ংকর ধাক্কায় জার্মান ফুটবল গড়িয়ে পড়ে খাদের অতল তলে। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্যায়ের বাধা অতিক্রম করতে অসামর্থ হয় জার্মানি।

এবার আর  শুধু নড়ে চড়ে বসে থাকে না কেউ। দুর্যোগ মোকাবেলায় কোমর বেঁধে নেমে পড়ে সবাই। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকানো হয়। দেখার চেষ্টা করা হয় সমস্যাটা আসলে কোথায়।  রোগটা বাসা বেধেছে ঠিক কোন জায়গায়? রোগ না জানলে চিকিৎসা হবে কীভাবে?

সত্তরের দশকে ইতালি যে সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, ঠিক সেই একই সমস্যার মধ্যে পতিত হয়েছিলো জার্মানি। ইতালিয়ানরা নিজস্ব খেলোয়াড় তৈরি করছিলো না সেই সময়। সিরি এ-র বিশাল টাকা হাতছানি দিয়ে ডেকেছে সারা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের। এসি মিলান, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাস, সবাই টাকার বস্তা নিয়ে বিদেশি খেলোয়াড় প্রলুব্ধ করায় ব্যস্ত থেকেছে। স্থানীয় খেলোয়াড় উন্নয়নে মনোযোগ দেবার বিন্দুমাত্র সময় তাদের হয় নি।

একটা দল কতজন বিদেশি খেলোয়াড়কে খেলাতে পারবে, সেই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম বাধা ছিলো না। ফলে, এরা তাদের সব টাকা ঢেলেছে বিদেশি খেলোয়াড় কেনার পিছনে। স্থানীয় খেলোয়াড়েরা এই সব পক্ষপাতিত্ব দেখেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে নি। এর মাঝে যদিও বা কোনো স্থানীয় খেলোয়াড় নিজের মেধা, যোগ্যতা, অধ্যাবসায়ে উঠে এসেছে, তাকে প্রায়শই বসে থাকতে হয়েছে সাইড বেঞ্চে। তার জায়গায় খেলেছে ব্রাজিল, জার্মানি বা উরুগুয়ের কেউ।

এর থেকে উত্তরণের আশায় মধ্য সত্তরে একটা দলে কতজন বিদেশি খেলোয়াড় খেলবে তা সুনির্দিষ্ট করে দেয় ইতালিয়ান ফুটবল কর্তৃপক্ষ। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় খেলোয়াড়রা বেশি বেশি করে খেলার সুযোগ পায়। আখেরে লাভ হয় ইতালির। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ জিতে নেয় তারা। এর নেতৃত্ব দেয় ছোট এক দলে খেলা তরুণ খেলোয়াড় পাওলো রসি।

দুই হাজার সালে ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টে অপমানিত হবার পরে জার্মান ফুটবল কর্তৃপক্ষ আমূল পরিবর্তন্সূচক কিছু পদক্ষেপ নেয়। মূল ইস্যুকে চিহ্নিত করা হয় দ্রুতগতিতে। তরুণ খেলোয়াড়দের উন্নয়ন এবং দেশি খেলোয়াড়দের দেশে ধরে রাখা ছাড়া জার্মান ফুটবলের উন্নতির কোনো সুযোগ নেই।

দুই হাজার এক সালেই ছত্রিশটা প্রফেশনাল ক্লাবকে বাধ্য করা হয় তাদের ইয়ূথ একাডেমি গড়ে তোলার জন্য। টিমগুলো খেলোয়াড়দের স্কিল উন্নতিকরণ শুরু করে অল্প বয়েস থেকে। খেলার ফলাফলের চেয়ে তাদেরকে শেখানো হতে থাকে খেলার কলাকৌশল, শারীরিক এবং মানসিক দুই ধরনেরই।

জার্মান ডেভেলপমেন্ট সিস্টেম এর মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে গাদা গাদা খেলোয়াড়। মুলার, লাম, ওজিল, নুইয়ার টনি ক্রুজ, মার্কো রিউজ, এরা সবাই এই সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসা খেলোয়াড়। এদের বেশির ভাগের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি না।

এদের বেশিরভাগই বেছে নেয় বুন্দেসলিগাকে তাদের ক্যারিয়ার গঠনের উদ্দেশ্যে। যে তেইশজন খেলোয়াড় বর্তমানে ব্রাজিলে রয়েছে, এদের মধ্যে ষোল জনই খেলে বুন্দেসলিগায়। চার বছর আগের টিমের তেইশ জনই খেলতো বুন্দেসলিগায়। এর বিপরীতে ব্রাজিলের জাতীয় দলের মাত্র চারজন খেলে ব্রাজিলে। বাকিরা সবাই বিদেশে।

জার্মান সিস্টেমে একজন খেলোয়াড়কে ছয় বছর বয়স থেকে প্রফেশনাল হিসাবে খেলা পর্যন্ত একই সিস্টেমের মধ্যে থাকার কারণে একই ভাবেই, একই কলাকৌশলে খেলার সুযোগ পায়।

এর বাইরে, এদের মধ্যে জাতীয় দলের জার্সির জন্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে গভীর অহংবোধ। তুমি যখন জার্মান জাতীয় দলের হয়ে খেলছো, তোমার হাতেই জার্মানির গর্ব অহংকার রয়েছে। একে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার।

জার্মানির প্রাক্তন মিডফিল্ডার ডিয়েটমার হ্যামান ইংল্যান্ডের একটা খবরের কাগজের সাথে সাক্ষাৎকারের বলেছেন যে, “জাতীয় দলের জার্সিই মূখ্য, ব্যক্তি এখানে কিছু না। আপনি যখন একটা দল হিসাবে খেলবেন তখন ব্যক্তি কোনো ফ্যাক্টর নয়। নেইমার আহত হয়ে খেলার বাইরে থাকার কারণে ব্রাজিল দলে যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, আমাদের দলে এরকম কিছু ঘটবে না। আমাদের দলে কেউ আহত হলে, এটা নিয়ে কোনো মাতামাতি হতো না, বরং যা আছে তাই নিয়েই এগিয়ে যেতাম আমরা। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় আমরা তার জার্সি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম না।

বিনয় এখানে বিশাল জিনিস। আপনাকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে, কারণ, দলের প্রতি আপনার দায়িত্ব রয়েছে। জার্মান খেলোয়াড়দের কখনোই হাল না ছেড়ে দেবার, কখনোই গা ঢিল না দেবার শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্রাজিলের সাথে পাঁচ গোলে এগিয়ে যাবার পরেও দেখেছেন কেউ সামান্যতম ঢিলেমি দেয় নি খেলায়। শূন্য-শূন্য গোলে খেলা থাকলে যেভাবে তারা খেলতো, পাঁচ গোলে এগিয়ে থাকার পরেও সেভাবেই খেলেছে তারা।

দলই এখানে মূখ্য এবং দলের জন্য বিনীতভাবে আত্মত্যাগ করার শিক্ষা দেওয়া হয় তাদের।

ধারাবাহিকতা এবং প্রফেশনালিজম শিক্ষা দেওয়া হয় জাতীয় দলে আসার বহু আগে থেকে। কাজেই এরা যখন জাতীয় দলে আসে, নতুন করে কিছু শেখানোর প্রয়োজন পড়ে না।“

এই রকম একটা দল বিশ্বকাপের প্রতিটা আসরে যে ধারাবাহিকতা দেখাবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এবারেরটা সহ পরপর চারটে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা এই ধারাবাহিকতারই অংশ। জার্মানরা যে সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে, তাতে এই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও যে অক্ষুণ্ণ থাকবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।

সাফল্যের জন্য গভীর নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করে যাওয়া একটা দলের সাফল্যের জন্য শুভকামনার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, তারপরেও আগামীকালের ফাইনালে শুভকামনা রইলো জার্মানদের জন্য। শুভ কামনা রইলো আর্জেন্টিনার জন্যও। মাঝারি মানের একটা দল নিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে আসাটাও কম কৃতিত্বের নয়।

জার্মান ফুটবলের গতিময় সৌন্দর্য এবং ল্যাটিন ফুটবলের ধ্রুপদী শিল্পিত রূপ দেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

————————————————–

এই  লেখাটা লিখেছিলাম বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের জন্য। সেখানে এটা প্রকাশিত হয়েছে গতকাল। আজ মুক্তমনায় প্রকাশ করার আগেই খেলার শেষ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার জন্য জার্মানির জন্য অভিনন্দন রইলো। প্রত্যাশার চেয়ে ভালো খেলা উপহার দেবার জন্য আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন।