ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার তাঁর স্ত্রীকে দেখছে ছেলেটা।

সুন্দরী বউ নিয়ে চলাচলের এই এক হ্যাঁপা। লোকজন হ্যাংলার মতো বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এরকম উটকো সমস্যায় তাঁকে প্রায়শই পড়তে হয়। এমনিতেই এই দেশের মানুষ মেয়ে মানুষ দেখলেই অসভ্যের মতো নির্লজ্জ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পয়োধর দেখে, পেট দেখে, পিঠ দেখে, পিছন দেখে। কিছুই দেখতে বাদ রাখে না। আর, সুন্দরী হলে তো কথাই নেই। সবার যেনো লালা ঝরে জিভ দিয়ে। হাভাতের মতো হা করে তাকিয়ে থাকে, মাথায় মুগুরের বাড়ি পড়লেও সরতে চায় না। একটা পুরো জাতি কীভাবে এমন অসভ্য হয়, সেটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না তাঁর। মেয়েদের প্রতি যাদের এমন আদিম মনোভাব, তারা কীভাবে সামনের দিকে এগোবে?

মাত্র কিছুদিন আগেই এরকম ঝামেলায় পড়তে হয়েছিলো তাঁকে। কোঁকড়া চুলের এক ছোকরা ছিলো তাঁদের পাশের বগিতে। ট্রেন যতোবার যতো স্টেশনে থেমেছে, ততবারই সেই ছোকরা প্লাটফর্মে নেমে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকেছে  প্রেমকাতর সতৃষ্ণ নয়নে।

খুবই বিরক্তিকর এক অভিজ্ঞতা এটি। এরকম পরিস্থিতিতে কাউকে কিছু বলা যায় না। আবার সহ্যও করা যায় না। প্লাটফর্ম সরকারী সম্পত্তি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার অধিকার সকলেরই রয়েছে। যতো ক্ষমতাই থাক না কেনো, কেউ শুধুমাত্র প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে কাউকে দেখছে, এই অপরাধে জেল ফাঁস দেওয়া যায় না।

তাঁর পুরুষালী অহমিকা অবশ্য এই অত্যাচার সইতে পারলো না। সহ্য করতে না পেরেই শেষে সরাসরি আক্রমণে নেমে গেলেন তিনি। শারীরিক আক্রমণ নয়, মৌখিক আক্রমণ। এক স্টেশনে ট্রেন থামতেই ছোকরা তার কামরা থেকে নেমে এসেছে প্লাটফর্মে। চুলে ভাঁজ কেটে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনিও এর জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। ছোকরাকে শুনিয়ে স্ত্রীর সাথে তিনি তাকে নিয়ে নানা ধরণের ব্যাঙ্গ, বিদ্রূপ, কৌতুক, হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলেন। ছোকরাকে অপমানে আহত করাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তবে, ছোকরা বড় ডেঁপো। সেও আকাশের দিকে তাকিয়ে একই ধরনের অবমাননাকর পাল্টা উত্তর দিয়ে তাঁকে স্ত্রীর সামনেই তাঁকে অপমান করে ছেড়েছে। ঢিল মারলে যে পাটকেল খেতে হয়, সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন তিনি।

আজ আর সেই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। ভিন্ন কিছু করতে হবে। এমন কিছু যাতে এই বদমায়েশটার বদমায়েশি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

সামান্য একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি। এক পা আরের পায়ের উপরে দিয়ে ঋজু হলেন। তারপর সোজাসুজি তাকালেন ছেলেটার দিকে। মাত্র কয়েক হাত দূরে বসে আছে ছেলেটা।

‘এই ছেলে শোনো।’ গলায় কর্তৃত্বের ভাব নিয়ে তিনি ডাকলেন।

চমকে উঠলো ছেলেটা। আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিছুটা বিভ্রান্ত। কাকে ডাকছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

‘কথা কানে যাচ্ছে না? এদিকে এসো।’ গম্ভীর স্বরে আবারো ডাকলেন তিনি।

ছেলেটা একবার বামে, একবার ডানে তাকালো। অল্পবয়েসী আর কেউ নেই, যাকে তুমি করে ডাকা যাবে। তাকেই যে ডাকা হচ্ছে, সেটা বুঝতে এখন আর বাকি রইলো না তার। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে চেহারাটা। ইতঃস্তত করছে। ডাকে সাড়া দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

‘কই এসো, তোমাকে ডাকছি।’ গলায় আরো কর্তৃত্বের স্বর এনে হাত ইশারা করে ডাকলেন তিনি।

এবার আর এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। নিজের আসন থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে এগিয়ে আসে সে।

তাঁর ঠিক পাশের শূন্য আসনটার দিকে ইশারা করলেন। ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। মুখের সব রক্ত সরে গেছে। ঘাম জমেছে নাকের উপরে এবং নীচে। প্রচণ্ড রকমের ঘাবড়ে গেছে সে।

‘বসো এখানে।’ ধমকের স্বরে তিনি বলেন।

ধমক খেয়েই পাশের শূন্য আসনটায় বসে পড়ে ছেলেটা। কোলের মাঝখানে হাত নিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসেছে সে।

ছেলেটাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করেন তিনি। তারপর শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

‘নাম কী তোমার?’

‘অনীল মুখার্জী।’

‘কী করো তুমি?’

‘আজ্ঞে, চাকুরি।’

‘কোথায়? কী চাকুরি?’

‘রাইটার্স বিল্ডিং এ। কেরানির চাকুরি।’

‘মাইনে কতো পাও?’

‘আজ্ঞে, সাকুল্যে তিরিশ টাকা।’

‘হুমম!’ দম নিলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘তুমি কী করো সেটা তো জিজ্ঞেস করলাম আমি। আমি কি করি জিজ্ঞেস করবে না তুমি?’

‘কী করেন আপনি?’ যন্ত্রের মতো ছেলেটি বলে।

‘ডেপুটিগিরি করি।’

‘কতো বেতন পাই জিজ্ঞেস করো এবার। তোমাকে তোআমি একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম।’ ঠোঁটের কোণে বাঁকা একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলা করছে তাঁর,

‘কতো পান?’ ম্লান মুখে ছেলেটি বলে।

‘মাসে বেতন পাই আটশো টাকা।’ রসিয়ে রসিয়ে বলেন তিনি।

ঢোক গেলে ছেলেটি।

‘তোমাকে আমার পরিচয় দেওয়া হয় নি। আমার নাম বঙ্কিম চাটুজ্যে। চাকুরির বাইরে বইও লিখি আমি। তাতেও বেশ আয় হয়। এই ধরো গিয়ে সর্বসাকুল্যে আমার আয় মাসে দুই হাজার টাকার মতো।’

সংকুচিত হয়ে সিটের সাথে মিশে যেতে থাকে ছেলেটি।

‘তুমি এই স্ত্রী লোকটিকে দেখবার জন্য বার বার তাকাচ্ছিলে, তাই না? আমি এর ঘোমটা খুলে দিচ্ছি। তুমি ভালো করে দেখো এখন।’

কিছুক্ষণ থামেন তিনি। ছেলেটির দিকে তাকান। মাথা হেট করে বসে আছে সে। বিব্রত এবং বিপর্যস্ত। দৃষ্টি ট্রেনের মেঝের দিকে। মুখের কোণে বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠে তাঁর। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন।

‘আমি দুই হাজার টাকা এঁর শ্রী চরণে দিয়েও মন পাইনে। তুমি তো বাপু মাত্র তিরিশ টাকার কেরানি। দেখো তো এর মন জয় করতে পারো কি না।’ কাঁধ ঝাকান তিনি। শারীরিক ভাষাতে পরিষ্কার অবজ্ঞা ফুটে উঠেছে।

চরম লজ্জা ও অপমানে অধোবদন হয়ে থাকে ছেলেটি। মাথা তুলে তাকায় না।

কুউউ ঝিকঝিক শব্দে ট্রেনটা ছুটে যেতে থাকে তেপান্তর ভেদ করে, সমান্তরাল দুটো লাইন ধরে।