“নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না!”

– হেলাল হাফিজ

আমাদের সবার মধ্যেই আছে আঞ্চলিকতা। নিজ ডিস্টিকের মানুষ হলে এক্সট্রা সুবিধা, কোন একটা অফিসে গিয়ে আগে খোঁজ করলেন নিজ ডিস্টিকের কেউ আছে কিনা, তাহলে সুবিধা পাওয়া যাবে, কাজটা তাড়াতাড়ি হবে। একবার কক্সবাজার বেড়াতে গেলাম। ১১ জনের একটা দল, হোটেলে কোন রুম নেই। হোটেল ম্যানেজার যখন জানতে পারলেন এখানে ৫-৬ জন হিন্দু আছে, তিনি রুম ম্যানেজ করে দিলেন। আমাকে হিন্দু ঠাউরে বললেন, আপনি হলেন আমার জাতি ভাই, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবেন হোটেলের জন্য তা কি হয়? হেসে বললাম, আমি মুসলিম…। লোকটার মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো। বিব্রত আর লজ্জিত নিজের ভেতরের এই স্বধর্মীয় প্রিয়তার জন্য। এইরকম ঘটনা আরেকবার ঘটেছিল। ট্যাক্সি ক্যাবে করে যাচ্ছি, দূর্গাপূজার দশমীর জন্য ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। ড্রাইভার আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, দেখছেন, এই মালুগুলি ক্যামনে রাস্তা আটকায় ফূর্তি করতাছে, কিছু কইতে গেলেই কইবো সংখ্যালঘু নির্যাতন…। হেসে বললাম, আমি নিজেই একজন মালু! ঠিক, এই মালুগুলির কোন অধিকার নাই রাস্তা আটকানোর…। ড্রাইভারটা বিব্রত কাচুমাচু করে ক্ষমা চাইতে লাগলো। সরি, আমি ভাবছিলাম…জানতাম না…আসলে সবারই অধিকার আছে…হঠাৎ মুখে আইসা গেছে…। আমার মনে পড়ে গিয়েছিল বিদেশী একটা গল্পের কথা। ঠিক এইরকম দৃশ্যপট ছিল। লেখকের নাম ভুলে গেছি। আমি জানি সারা দুনিয়ায় এরকম অভিজ্ঞতা বিচিত্র নয়।

বেশ কিছুদিন আগে কয়েকটা অনলাইন নিউজ সাইটে দেখলাম আসামে বাংলাভাষী মুসলিমদের হত্যা করা হয়েছে। সেই ভয়ে বাকী সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে পালাচ্ছে। এটা খুব সাধারণ ঘটনা আজকের বিশ্বে। আপনি যে কোন দেশি-বিদেশী নিউজ সাইটে গেলে একটা না একটা এ রকম ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সম্পর্কিত কারণে মানুষের উদ্ববাস্তু, গণহত্যা, দেশান্তরিত হবার খবর পাবেন। কার দোষ বেশি, কার কম সেটা কথা না। কথা হচ্ছে মানুষ মরছে। মানুষ গৃহহীন হচ্ছে। মানুষ দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। আর এসব হচ্ছে আপনার আমার আঞ্চলিক প্রিয়তা, স্বধর্ম প্রিয়তার জন্য। পৃথিবীতে যতদিন জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেমের অস্তিত্ব থাকবে এই বর্বরতা চলতেই থাকবে। জাতীয়তাবাদ তা সে ধর্মীয় হোক আর জাতিগত হোক কখনো আপনাকে মানুষের পরিচয়ে মানুষের কাছে নিয়ে যাবে না। দেশপ্রেম বিশ্ব অশান্তির মূলে! জাতীয়তাবাদ মানব সভ্যতার ক্যান্সার! এই দেশপ্রেম, এই জাতীয়তাবাদ, এই আঞ্চলিকতা মানুষকে বঞ্চিত করছে নদীর অধিকার থেকে, সম্পদের অধিকার থেকে, মাটির অধিকার থেকে, সর্বোপরি বেঁচে থাকার অধিকার থেকে। মানুষের মানুষ হবার গল্প কবে শুরু হবে?…

পৃথিবীর ইতিহাস আসলে যুদ্ধের ইতিহাস। সেই ইতিহাসগুলোর মধ্যমণি হয়ে আছে কিছু খুনি রক্তলোলুপ হিংস্র মানুষ। আর এই খুনি রক্তলোলুপদেরকেই বীর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের সম্পদ ও রাজ্য দখলকে সভ্যতার অগ্রগতি বলা হয়েছে। পিছিয়ে থাকা কোন জাতির ভাগ্য খুলে যাওয়া বলেও রটনা করা হয়েছে। এই “বীর” পুংঙ্গবরা মানুষের মাথার খুলি দিয়ে তাদের সিংহাসনকে পোক্ত করেছে। তাদের লিখিত ইতিহাসে স্থান পায়নি অগণিত নিরীহ সাধারণ মানুষের অশ্রু জল গাথা…।

আধুনিক যুগে যুদ্ধকে যৌক্তিক করা হয় জনগণের কাছে। তাদের বুঝানো হয় এই যুদ্ধটা তাদের জন্য কতটা জরুরী। যদি তারা যুদ্ধটা না করে তাহলে শত্রুরা তাদের উপরই আক্রমন করবে। তাই এই ন্যায্য যুদ্ধটা তাদের জন্যই। যুদ্ধের নৈতিক স্বীকৃতি এভাবেই আদায় করা হয় মানুষের কাছ থেকে। সাধারণ মানুষের কাছে আজো তাই তাদের সেনাবাহিনী অত্যন্ত যৌক্তিক একটি অবস্থান। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থে যুদ্ধ বিমান কেনা হয়, মরাণাস্ত্র কেনা হয় কারণ তাদের রাষ্ট্রর সীমার আশেপাশে সদা শত্রু ওঁত পেতে আছে আক্রমন করার জন্য। আর এই আক্রমন থেকে রক্ষা করবে তাদের ফৈজ বাহিনী। তার জন্য অস্ত্র কিনতে হবে অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। আর সে জোগান দিতে বারুদকে রুটি আর ভাতের স্থান নিতে হবে। যুদ্ধে মানুষ মরবে তার জন্য কারখানায় পিতলের ক্যাপসুল তৈরি হচ্ছে, গবেষণাগারে নিবিষ্ট অস্ত্রের আধুনিকায়নে। কতটা ক্যাপসুলে কত সময়ে বেশি মানুষ মারা যায়! পৃথিবীর ঘাতকরা ফর্মূলা আঁটছে কম সময়ে কম খরচে বেশি মানুষকে মারতে হবে। তারপর এই অস্ত্র বেচো “বীরদের” কাছে। যুদ্ধ না হলে ব্যবসা হবে না। ব্যবসার জন্য যুদ্ধ চাই। গরীব খেতে পায় না, দুমুঠো ভাতের জন্য যে দেশের মানুষ দেশান্তরিত হয়ে পশুর মত খাটে, কত নারী রোজ পাচার হয়ে যায় শুধু ভাতের আশ্বাসে। তেমন দেশও শ্বেতহস্তি পোষে! ঠেলাওয়ালারা জানে না কাল তাদের নিরাপত্তার জন্য সরকার বাহাদুর যুদ্ধ জাহাজ কিনেছে। এখন তার ঘামে ভেজা পয়সায় সেই ঋণ শোধ করতে হবে বংশ পরম্পরায়! আমাদের “শত্রুদের” মোকাবেলায় এমন আরো শ্বেতহস্তি কিনতে হবে। প্রয়োজনে পরনের কাপড়টাও বেচে দিতে হবে…।

এই পৃথিবীতে মানুষের নিউক্লিয়াস মানুষই একদিন বোমা মেরে উড়িয়ে দিবে। যেদিন সেই অস্তিত্ব বিলীনের যুদ্ধ সংগঠিত হবে পৃথিবীতে, সেদিনও যুদ্ধের নৈতিকতার গান গাওয়া হবে। হায়, একদিন হয়ত মানুষের ইতিহাস রবে মানুষ রবে না…।

বাংলাদেশে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের খোয়াব দেখেন তারাও দেখছি ভারতে মোদী সরকার গঠনের আশংকায় জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন! যারা ইসলামী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল, যারা বাংলাদেশে ধর্মনিপেক্ষতাকে রোজ একবার করে বলাৎকার করেন তারাই ভারতে হিন্দু মৌলবাদীর ক্ষমতায় আরোহণের সমূহ সম্ভাবনায় হা-হুতাশ প্রকাশ করছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমরা সবাই সেক্যুলার! মোদী ক্ষমতায় আসলে ভারতের মুসলমানদের কি হবে চিন্তা করছেন ইসলামী শাসন প্রিয় ও সেক্যুলারিজম বিরোধীরা। এরা তাহলে বুঝেন একটা ধর্মভিত্তিক দল ক্ষমতায় এলে ভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য বিপদ হতে পারে বা বিপদ না হলেও তাদের স্বার্থটা না দেখাও হতে পারে। সব মিলিয়ে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দল যে গোটা দেশের মানুষের জন্য নয় সেটা তারা ভিন্নদেশের বেলায় তাদের অসমর্থন দিয়ে বুঝিয়ে দেন।…

কেন সেক্যুলারিজম প্রয়োজন’ আজ আমরা এসব দেখে যদি শিখতে না পারি তাহলে আর শিখবো কখন? যাদের ধর্মপ্রীয়তা আছে, অন্তত তাদের সেই ধর্মপ্রীয়তার জন্যও তাদের সেক্যুলারিজমকে সমর্থন করা উচিৎ। দুনিয়াতে যেখানে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানে যাতে তারা সেক্যুলারিজমের সুফল পান, কথিত কোন “রামরাজ্য” বা “খ্রিস্টান রাষ্ট্র” বা এইরকম কোন ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের অমর্যাদায় পড়তে না হয় তার নামই সেক্যুলারিজম…।

রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করে যেমন আমরা এই দেশের হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছি, সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসিয়ে দেশমাত্রিকাকে ভিন্নধর্মীয় নাগরিকের কাছে বিমাতায় পরিণত করেছি তেমনি অন্য কোথাও একই কায়দায় মুসলিমদের অসম্মানের আয়োজন হতে পারে। যদি বলি এসব দেখে মোদীরা ক্ষুব্ধ হয়ে একই রকম কায়দায় মুসলমানদের একই রকম অসম্মান দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো আরো মোদী তৈরি হবে, তাহলে কি ভুল বলা হবে? আপনি যেমন একজন করে শফি তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন (মাদ্রাসা-মক্তবে অনুদান, ওয়াজ মাহফিলের নামে তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নানারকম সহায়তা করে) ওখানেও আপনার মত সেক্যুলারিজমের বলাৎকারকরা মোদী তৈরিতে রোজ সাহায্য করে যাচ্ছে। আপনার যদি ‘মোদী আগ্রাসন’ দেখে জ্বর আসে তাহলে একবার ভাবুন, পল্টনে বা বাইতুল মোকাররমে যখন ইসলামী শাসন কায়েমের কসম খাওয়া হয় তখন কত কত মানুষ রোজ বর্ডার পার হবার কথা ভাবে? আপনি খেলাফতের স্বপ্ন দেখবেন আর অন্যজন রামরাজ্যর খোয়াব দেখবে না-এটা কেমন কথা? অন্যের অশান্তি আর ভয়ের কারণ হয়ে কেমন করে আশা করেন আপনিও শান্তিতে থাকবেন? এক হাতে যেমন তালি বাজে না তেমনি একতরফা শান্তিও হয় না। এপারে শান্তি চাইলে ওপারেরও শান্তির প্রয়োজন। আপনি এখানে “সবার দেশ” গড়তে শুরু করুন, ওখানেও “সবার দেশ” গড়ার জনমত জোরদার হবে…।