নয়
পাশাপাশি অনেকগুলো পাহাড় আর পাহাড় । জঙ্গল পরিস্কার করে পাহাড়ের গায়ে তাঁবু খাটিয়ে নির্মিত হয়েছে হরিনা ট্রানজিট ক্যাম্প। সকালে দলে দলে যুবকদের মার্চপাষ্ট করতে দেখে আলমের মনে এক ধরনের শিহরণ জাগে। ক্যাম্পের মধ্যে মাইক বাঁধা। সে মাইকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। সকালে সমগ্র ক্যাম্পে হৈ- হৈ- রৈ-রৈ কাণ্ড । কেউ দল বেঁধে প্যারেড করছে, কেউ রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। কেউ কেউ দল বেঁধে লাকড়ি কেটে আনছে। কেউ বা নতুন করে জঙ্গল সাফ করছে। কিন্তু সশস্ত্র ট্রেনিং এর কোন ব্যবস্থা আলমের চোখে পড়ল না। পরে অবশ্য আলম জেনেছে এটা একটা ট্রানজিট ক্যাম্প। এখানে কোন ট্রেনিং হবে না। এখান থেকে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হবে।
কিছুদিন যেতে না যেতে আলম নির্বাচিত হলো ট্রেনিং সেন্টার যাওয়ার জন্য। একদিন তাদের খোলা ট্রাকে তোলা হল ট্রেনিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে। সারা রাত গাড়ী চলে আগরতলা উদয়পুর পার হয়ে অবশেষে তারা উম্পিনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌছল। চতুর্দিকে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। এর মধ্যে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হোয়েছে রাস্তা এবং পাহাড়ের গায়ে ট্রেনিং সেন্টার। ট্রেনিং সেন্টারে যাওয়ার পরদিন আবার তাদের বাছাই করা হল। অতঃপর পরদিন থেকে ট্রেনিং।
সূর্য ওঠার আগেই তীক্ষ্ণ স্বরে হুসাইল বেজে ওঠে। হুসাইল বাজার সাথে সাথে সবাইকে বের হয়ে আসতে হয় স্ব স্ব তাঁবু থেকে। অতঃপর লাইন ধরে দাঁড়ানো। তারপর দীর্ঘ এক পাহাড়ী পথ ধরে লং মার্চ। প্রায় ৪/৫ মাইল বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার পর চা বিরতি। লাইন ধরে লঙ্গরখানা থেকে চা-নাস্তা সংগ্রহ করে খাওয়া, অতঃপর আবার ট্রেনিং গ্রাউণ্ডে চলে যাওয়া। প্রথম প্রথম সবাইকে বিভিন্ন অস্ত্রের সাথে পরিচয় করানো হয়। তারপর সে সকল অস্ত্রের বিভিন্ন পার্টস এর নাম ও তার কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, অতঃপর সে অস্ত্র পরিচালনা শেখানো। চুড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সে অস্ত্র দিয়ে টার্গেট ফায়ারিং করানো। উম্পিনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে আলফা, ব্রেবো, চার্লি, ডালডা, ইকো, পাঁচটি কোম্পানীতে ভাগ করে আলাদা আলাদা ভাবে ট্রেনিং প্রদান করা হয়। আলম চার্লি গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত হয়। প্রত্যেক গ্রুপে আবার এক একটি স্কোয়াড। সামরিক প্রশিক্ষণের বাইরেও তাদের স্কোয়াড ভিত্তিতে প্রতিদিন অনেক কাজ করতে হয়। একদিন পুরো ট্রেনিং সেন্টারের সকল টয়লেট পরিস্কার করা, একদিন রান্নাবান্না করা, একদিন বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে আনা। কখনো কখনো আবার রেশন সামগ্রী, ভারী তাঁবু ইত্যাদি মূল সড়ক থেকে মাথায় করে বহন করে নিয়ে আসা। এভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেল ২৬ দিন। আলম থ্রি-নট-থ্রি ও মার্ক ফোর রাইফেল, এস,এমজি, এইচ,ই-৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, ইত্যাদি অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহন শেষ করেছে । প্রশিক্ষণ শেষে আলম নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আবিস্কার করে-আকু-পাকু করতে থাকে-দেশে ফিরার জন্য। আবেগ-উত্তেজনায় নির্ঘুম রাত কাটে আলমের-কবে ফিরবে দেশে। পরিশেষে আসে সে মাহন্দ্রক্ষণ।
উম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টার থেকে একদিন একরাত ভ্রমণ করে আলম তাদের দল সহ চলে আসল আবারো হরিনা ক্যাম্পে। তবে এবার হরিনা আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে মাত্র দু’দিন তাদের রাখা হল। অতঃপর সতের জনের একটি গেরিলা দল-১৫৭ নং সিটি গেরিলা গ্রুপ গঠন করে তাদের দেশে পাঠানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হল। একজন কমান্ডার, একজন ডেপুটি কমান্ডার, দু’জন সেকেন্ড ইন কমান্ড নিয়ে গঠিত হল সতের জনের ১৫৭ নং সিটি গেরিলা গ্রুপ। আলম সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পেল। একদিন সন্ধ্যায় দেশের উদ্দেশ্যে তারা যাত্রা করল। দশটি এসএমসি,( রাশিয়ান স্ট্রেন),পাঁচটি এস,এল,আর, মাত্র তিন প্যাকেট এইচ ই ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে তাদের রওয়ানা হতে হল রণাঙ্গণের উদ্দেশ্যে। একটি খোলা ট্রাক তাদের সীমান্তের নিরাপদ দূরত্বে নামিয়ে দিয়ে গেল। অতঃপর পায়ে হেটে যাত্রা। পাহাড়ী সীমান্ত। যত সীমান্তের কাছে যাচ্ছে তত পাহাড়ী দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করছে তারা। রাতের আঁধার ক্রমে ঘনীভূত হতে লাগল। দুর্ভেদ্য পাহাড়ী ঝোঁপ-ঝাড় ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ মুক্তিসেনা। প্রত্যেকের কাঁধে কোন না কোন মারাণাস্ত্র। কারো শরীরে সামারিক কোন পোষাক নেই। উল্টিয়ে পড়া লুঙ্গি, কোমড়ে শক্ত করে বাঁধা গামছা, গায়ে হাওয়াই শার্ট, পা খালি । ঝোঁপ-ঝাড় ভাঙ্গার খস্ খস্ আওয়াজ, কখনো কখনো পানির মধ্যে পা পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ-রাতের নৈঃশব্দকে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। কখনো কখনো গভীর খাদে নেমে যাচ্ছে কাফেলা, আবার কখনো কখনো পাহাড়ের খাড়া গাত্র বেঁয়ে উপরে ওঠা। এভাবে চলতে লাগল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। লক্ষ্য তাদের শত্রু কবলিত মাতৃভূমি। বুকে ইস্পাত কঠিন সংকল্প। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে হবে। কোন আপোষ নেই। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততেই হবে। এ সকল ভাবনা আলমের মনে অনুরণিত হচ্ছে অনুক্ষণ। কখনো কখনো মনে উঁকি দিচ্ছে তার মায়ের মুখ। তার ভাই-বোন-বাবা, আত্মীয় স্বজন সবার মুখচ্ছবি একে একে তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। যেন স্বপ্ন দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে আলম। নিকষ কালো আঁধার। প্রত্যেকে সামনের ব্যক্তির জামার পেছনের কলার ধরে রেখেছে। সবার সামনে গাইড। তার হাতে রুমাল মোড়ানো টর্চ লাইট। অনেকক্ষণ চলতে চলতে রাতের আধাঁর ক্রমে তরল হয়ে আসে। গাইড বলল, তারা ঠিক সীমান্ত রেখায় পৌঁছে গেছে। একটি সরু নদী। ওপারে বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ বিরহের পর হঠাৎ প্রেয়সীর সান্নিধ্য পাওয়ার মত এক তীব্র অনুভুতি আলমের সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টের মত খেলে গেল। ভোরে শূচিশুভ্র আলোতে ছোট্ট নদীর ওপারে অপলক নেত্রে সে তাকিয়ে রইল-তার প্রিয় জন্মভূমির প্রতি। নিজের দেশ, দেশের মাটি, মানুষকে এভাবে টানে, তা কখনো জানা ছিল না আলমের। কখন ছোট্ট নদী পাড়ি দিয়ে দেশের মাটি স্পর্শ করবে তার জন্য আলমের মনটা যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চারি দিকে পাহাড় ঘেরা একটি সমতল ভূমি। কিছু বাঁশের বেড়ার ঘর। সীমান্তে দেশে প্রবেশকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প। দুপুরে গরুর মাংস পাক করা হল । দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি নিয়ে পরম তৃপ্তিকে উদরপূর্তি করে ঘুমিয়ে পড়ল শুকনো খড়ের বিছানার উপর। পড়ন্ত বিকেল থেকে আবার প্রস্তুতি, শুরু হল যাত্রা । সূর্য যখন অস্থাচলগামী, তখন যার যার অস্ত্রসম্ভার কাঁধে ঝুলিয়ে আবার যাত্রা। একটি সরু লম্বা নৌকা দিয়ে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে সকলকে নদী পার হতে হবে। চান্মেসরী নদী। নদীর ওপার বাংলাদেশ। একটি লম্বা জেলে নৌকা আড়াআড়ী করে নদী পার হল একে একে সবাই। নদী পার হয়ে স্বদেশের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে এক অদ্ভূত অনুভূতি আলমকে আচ্ছন্ন করল। ছোট্ট নদী-এপার ওপার তেমন কোন তফাৎ নেই। তবু ও মাতৃভূমি। মাতৃভূমিতে পা রাখার এক অনামিক শিহরণে আলমের সবার্ঙ্গ যেন কাঁটা দিয়ে ওঠল। নিজের অবচেতন মনেই সে হঠাৎ ওবু হয়ে পড়ল। নিবিড়ভাবে চুম্বন করল মাতৃভূমির মাটিকে। যেন পরম ময়তাময়ী মা, যে আজ শত্রুর কবলে তার চরণে চুম্বন করল আলম। অতঃপর সবাই সরু লাইনে আবার যাত্রা। দুর্গম গিরি পথ চলতে চলতে ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আধাঁর ঘনীভূত হচ্ছে।

দশ
উচুঁনিচু গহীন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের গাত্র বেয়ে সরীসৃপের মত একেঁবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে কিছু অকুতোভয় মুক্তিপাগল তরুনের মিছিল । বুকের গহীনে তাদের সুতীব্র আবেগ-উত্তেজনা। দেশ মাতৃকার জন্য তারা যুদ্ধ করবে। বিদেশী একটি দুধর্ষ দখলদার বাহনীর হাতে থেকে তারা দেশকে উদ্ধার করবে। এ কঠিন পণে উজ্জীবিত তাদের তনু-মন-প্রাণ। কখনো গগণচুম্বী পাহাড়, কখনো সুগভীর খাদ, ঝিরি ঝিরি পাহাড়ী ঝর্ণার শব্দের সাথে তরুলতার শণ্ শণ্, কখনো হিংস্র শ্বাপদকুলের হিস্ হিস্ শব্দ, সব মিলিয়ে এক অদ্ভূদ ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। সামনে পিছনে কিছুই দৃশ্যমান নয়। শুধু সামনের ব্যক্তির গায়ের জামা ধরে এগিয়ে চলা। সবার সামনে রুমালে মোড়ানো টর্চ হাতে আছে গাইড। নিজ থেকে পথ চেনার বা দেখার কিছু নেই। শুধু সামনের জনকে অনুসরণ। এভাবে হাটতে হাটতে আলম ভাবছে তার প্রিয় জননীসহ তার নিকটাত্মীয়দের কথা। কেমন আছে তারা? সবাই বেঁচে আছেত? কেমন আছে তার মা? সে চলে যাওয়ার পর কেমন জানি সে করেছে? তার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে তার বড় বোনের কথা, যে তাকে সারাক্ষণ অনুপ্রাণিত করত যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। না জানি সে কেমন আছে। বিভিন্ন জনের কাছে শোণা কথা-খান সেনারা সোমত্ত মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে-এ অলুক্ষণে ভাবনা তাকে মাঝে মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা দেয়। তার বুকটা কেঁপে ওঠে অজানা শঙ্কায়। এ যাত্রায় তাদের সাথে দেখা হবে কিনা কে জানে। দেশ যেদিন শত্রুমুক্ত হবে, সেদিন কি তাদের সাথে তার দেখা হবে? ইত্যাকার ভাবনায় তার মনটা কাতর হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পাহাড় অতিক্রম করে তারা একটি খোলা বিলে উপনীত হয়েছে। হাটু পরিমাণ পানি, এতগুলো লোকের চলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সামনে আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। সুদুরে টিম টিম আলোতে বুঝা যাচ্ছে না কোন লোকালয় কিনা। বিলের মাঝামাঝি যেতে অদূরে গুলির শব্দ ভেসে আসল। কমান্ডার ও গাইড সর্তক করলেন, কোন পাল্টা গুলি করা যাবে না। সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পাক সৈন্যরা গুলি ছুড়ছে আন্দাজে কিংবা ভয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাফেলা এগিয়ে চলল। কিছুদূর যেতে না যেতেই বৃষ্টির মত গুলি শুরু হল। প্রথমে মনে হলো শত্রু পক্ষের আক্রমণ। না, লক্ষ্যহীন গুলি ছোড়া। কমান্ডারের নির্দেশে পানির মধেই সবাই উঁবু হয়ে বসে পড়ল। কয়েক মিনিট পর গুলি বন্ধ হলে আবার যাত্রা শুরু। কিছু দূর হাটার পর পাওয়া গেল একটি পাকা সড়ক। গাইড ফিস্ ফিস্ করে বলল- রামগড় সড়ক। দ্রুত সড়ক পাড় হল নিশিথ রাতের এ অভিযাত্রি দল। দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের এক টানা ঘেউ ঘেউ শব্দে আলম অনুমান করতে পারছে তারা ক্রমে একটি লোকালয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনতিদূরে টিম্ টিম্ বাতির শিখাও দেখা যাচ্ছে। এভাবে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর তারা একটি লোকালয়ে প্রবেশ করল। সারা রাত হাটার পর রাতের আঁধার ক্রমে তরল হয়ে আসে। বিভিন্ন মসজিদ থেকে ভেসে আসা মোয়াজ্জিনের আজান ইতোমধ্যেই রাতের নৈঃশব্দ ভেঙ্গে দিয়েছে। একটি গ্রামের মাটির বড় আলপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে একদল মুক্তিযোদ্ধা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মসজিদ থেকে মুসল্লিরা বের হতে শুরু করেছে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অনেক বয়স্ক মুরুব্বীরাও তাদের সালাম দিচ্ছে। শশ্রুমন্ডিত কিছু হুজুর মার্কা লোক যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম দিচ্ছে, তখন আলমের ভীষণ অস্বস্তি লাগতে লাগল। এরা রাজাকার কিংবা জামায়াতের লোক নয়ত, ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম দিচ্ছে নাতো, এরকম একটি শঙ্কা আলমের মনে উঁকি মারল। আস্তে আস্তে পূর্বাকাশে উদীয়মান সুর্যের রক্তিম আভা রাতের আঁধারকে পুরাপুরি দ্রবীভূত করে ফেলেছে। প্রথম সুর্যের আলোতে আলম তার মাতৃভুমির রূপ দেখতে পেল। সবুজ শ্যামল একটি গ্রাম, দেখতে তার কাছে তার গ্রামের কোন অংশের মত মনে হতে লাগল। এলাকার নাম আবুর হাট। আলমের মনে পড়ল যাওয়ার সময়ও আলম এ আবুর হাটের উপর দিয়ে গিয়েছিল। কিছুদূর গিয়ে একটি স্কুলে-আবুর হাট স্কুল-তারা আশ্রয় নিল। সুদীর্ঘ সাদা দালানের একটি স্কুল । সামনে নাতিবৃহৎ সবুজ মাঠ। মাঠের সাথে একটি পুকুর। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ গোসল করতে শুরু করল। জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পাহাড়, জলমগ্ন, কখনো কর্দমাক্ত বিল অতিক্রম করে সারা রাতের অক্লান্ত পথচলায় ক্লান্ত আলমও সে পুকুরের পানিতে গোসল করল। সহযোদ্ধা একজন থেকে তার জলগামছাটা নিয়ে সেও পুকুরে নেমে পড়ল। অনেক দিন পর পুকুরে গোসল করার এ সুযোগ তার সকল অবসাদ যেন দূরীভূত করে দিল। স্কুল কক্ষের মেঝেতে গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল আলম। স্থানীয় লোকজন, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছিল, তারা কখন কিভাবে খাবারের ব্যবস্থা করল আলম তা জানে না। সহযোদ্ধাদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে আলম দেখল, খাওয়ার আয়োজন চলছে। আলমও ওঠে সবার সাথে বসে খেয়ে নিল। শূণ্য উদরে দীর্ঘ সময় পর খাবার পরার সাথে আরো অবসাদ আলমকে গ্রাস করল।
বিকেলের সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সবার মধ্যে আবার সাজ সাজ রব। যে যার তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিচ্ছে। তল্পিতল্পা বলতে কাঁধের অস্ত্র, কারো কারো সাথে একটি অতিরিক্ত জলগামছা ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। যে যার অস্ত্রটাই কাঁধে ঝুলিয়ে নিতে লাগল । আলম তার অস্ত্রটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল, হাতে তার গুলির অতিরিক্ত একটি ম্যাগাজিন। প্রত্যেকের সাথে তার গানের সাথে লাগানো গুলির ম্যাগাজিনের অতিরিক্ত একটি গুলি ভর্তি ম্যাগাজিন ছিল। তাছাড়া নেভাল কমান্ডোদের জন্য নিয়ে আসা কিছু অস্ত্র-এন্টিভেসেল মাইন, ফ্রগ লেগস-ইত্যাদি ছিল আলমদের সাথে। স্কুল থেকে বের হয়ে সোজা পশ্চিমে হাটা শুরু করল মুক্তিযোদ্ধাদের দল। ততক্ষণে সূর্য অস্থাচলে অনেকটা হেলে পড়েছে। খুব বেশিক্ষণ হাটতে হল না আলমদের। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা গিয়ে পৌছল বঙ্গোপসাগরের তীরে। উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুদ্ধ সাগর বক্ষে সাদা পাল তোলা একটি বৃহৎ তরণী, ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে। মাঝি-মাল্লা দু’জন । একে একে মুক্তিযোদ্ধারা ওঠে পড়ল সে নৌকায়। অস্থাচলগামী সূর্যের রক্তিম আভা ঢেউয়ের চূড়ায় এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। সবার যখন নৌকায় ওঠা সম্পন্ন হল, তখন মাঝি ‘বদর বদর’ বলে নৌকার নোঙর তুলে নিল। পালের টানে তির্ তির্ করে কেঁপে উঠল নৌকা। ক্রমে পালে বাতাস লাগল, নৌকা তর তর করে এগিয়ে চলল। পাক-নৌসেনাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের নিকটতম কোন উপকন্ঠে তারা নামবে। এদিক সেদিক বিক্ষিপ্ত কিছু জেলে নৌকা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝি পেছনের গলূই এ বসে হাল ধরেছে শক্ত হাতে। তার সহযোগী মাল্লা সামনের গলুইয়ে বসে শক্ত হাতে ধরে আছে পালের রশি। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই নৌকার পেটের মধ্যে দু’পাশে হেলান দিয়ে এমন ভাবে বসেছে, যাতে দূর থেকে মনে হবে নৌকাতে কেহ নেই। মাঝি সর্তক করে দিলেন-যে কোন সময় পাকবাহিনীর টহল বোট আসতে পারে। তাদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে দু’তিন জন গামছা পড়ে নৌকার উপর এমন ভাবে হাটাহাটি করছে যেন দূর থেকে মনে হয় এটিও একটি জেলে নৌকা। সমুদ্রের গর্জনের মধ্যে আলমেরা সমবেত কন্ঠে গান ধরল, তীর হারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে,আমরা কজন নতুন মাঝি— — —। হঠাৎ দূর থেকে কিসের যেন শব্দ ভেসে আসতে লাগল। মাঝি গান বন্ধ করতে বলল। শব্দ ক্রমে নিকটবর্তী হতে লাগল। মনে হচ্ছে ইঞ্জিনচালিত কোন নৌ-যানের শব্দ। আলমরা সবাই নড়েচড়ে বসল। প্রত্যেকে স্ব স্ব অস্ত্রটি হাতের কাছে নিল। কমান্ডার বললেন- নির্দেশ ছাড়া কেউ যাতে কোন প্রকার ফায়ার ওপেন না করে। সম্ভাব্য কোন হামলার আশঙ্কায় আলম তার এসএমজি অস্ত্রটি হাতের শক্তমুঠোয় ধরল। গ্রেনেড এর বাক্সটিও পরখ করে দেখল। আবেগ উত্তেজনায় বক্ষ তার দ্রুত ওঠানামা করছে। গন্তব্যে পৌছার আগেই কী তাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে? তাদের রণক্ষেত্র হল চট্টগ্রাম শহর। দ্রুত গতিতে একটি গান বোট উত্তর দিগ থেকে এগিয়ে আসছে, তা শব্দ থেকে বুঝতে পারছে আলম। নৌকার গলুইয়ের মধ্যে থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শব্দ যত তীব্র হচ্ছে, আবেগ উত্তেজনা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। হ্যা, উপরে জেলের বেশে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তি যোদ্ধারা জানাল, পাকিস্তানী গানবোট। মাঝি বলল, এ তাদের নিয়মিত টহল। তীব্র বেগে এগিয়ে গেল তারা আলমদের নৌকা থেকে কয়েক শ গজ দূর দিয়ে । সম্ভবত তারা এটাকেও জেলে নৌকা ভেবেছে। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। পাক সেনারা টের পেয়ে আক্রমণ করলে এ যুদ্ধটা হত অসম। কারণ পাক সেনাদের বোটে ছিল মেশিন গান । তার বিরুদ্ধে পালের নৌকা থেকে যুদ্ধ হত এক অসম যুদ্ধ, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয় ক্ষতি হত সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া এ রকম কোন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও ছিল না আলমদের। তারা গেরিলা যুদ্ধর প্রশিক্ষণ নিয়ে যাচ্ছে শহরে। ক্রমে সন্ধ্যার আঁধার ঘনীভূত হতে লাগল। ততক্ষণে সাগর থেকে সকল জেলে নৌকা একে একে সরে পড়েছে। তবুও এদিক সেদিক টিম টিম আলোর রেখা দেখে বুঝা যাচ্ছে, এখনো কয়েকটি জেলে নৌকা আছে। তাদের জাল তুলতে পারে নি বলে তারা এখনো রয়ে গেছে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদ মানুষকে কত বেপরোয়া করতে পারে তা ভাবছে আলম। যে কোন সময় পাক হানাদারদের আঘাতে এ জেলেদের সলিল সমাধি ঘটতে পারে, সে আশঙ্কা বুকে নিয়েও তারা সাগরের এ অথৈই জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রাত দিন। একই ভাবে তার মনে প্রশ্ন জাগল, এ যে মাঝি, তার সাথে আরো একজন মাল্লা। তারা কী কেবল জীবিকার তাগিদে মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপারের এ কঠিন পেশা বেঁচে নিয়েছে? নাকি তারাও এক এক জন মুক্তিযোদ্ধা? দেশ মাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে তারাও জীবন বাজি রেখে ভূমিকা রাখার প্রেরণায় উদ্দীপিত? তাদের কথা কী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে? এসব ভাবনায় আলম যখন আচ্ছন্ন প্রায়, তখন সকলের মাঝে চাপা গুঞ্জনে আলম হতচকিত হয়ে উঠল। কী ব্যাপার? কমান্ডার মাঝির সাথে ভীষণ রাগারাগি করছে। আলম দাঁড়িয়ে দেখল পশ্চিম দিগন্তে কিছু আলো চোখে পড়ছে। মনে হয় কোন লোকালয়। মাঝি দিগ ভুল করে নৌকাটিকে সন্দীপের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কমান্ডার তাকে খুব বকাবকি করলেও উত্তাল তরঙ্গবিক্ষুদ্ধ দিক্-চিহ্নহীন অথৈ সমুদ্রে রাতের আঁধারে কোনরূপ দিগ্-যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া মাঝিরা কিভাবে সঠিক দিগ্ নির্ণয় করে, আলম তা ভেবেই বরং বিস্মিত হচ্ছিল। মাঝি নৌকার গতি ঠিক বিপরীতমূখী করলেন। সোঝা পূর্বদিকের তীরে আসলে চট্টগ্রাম শহরের উপকন্ঠে পৌছা যাবে। নৌকা নতুন গতিপথে যাত্রা শুরু করল।
আলম ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন সে রাতের আঁধার অনেকটা কেটে গেছে। নৌকা চলার পরিবর্তে যেন শুধু ভেসে আছে। পূর্বদিকে উপকুল দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা। মাঝি বলল, এটা বাঁশবাড়িয়া। আমাদের বাঁশবাড়িয়া খালে প্রবেশ করতে হবে। ইতোমধ্যেই দু’জন মুক্তিযোদ্ধা রেক্ষি করার জন্য নেমে গিয়েছিল। তারা ফিরে এসে রিপোর্ট করল, স্থানটি আপাতত নিরাপদ। সিদ্ধান্ত হল সবাই চলে যাবে শহরে, কেবল দু’তিন জন থাকবে। কারণ, দিনের বেলায় অস্ত্র নামানো যাবে না। সারা দিন নৌকা নিয়ে ভেসে থাকতে হবে সাগরে। অতঃপর রাতে অস্ত্র নামাতে হবে নৌকা থেকে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক একে একে সবাই নেমে পড়ল নৌকা থেকে। আলম ও মোঃ নুরুল ইসলাম ১৫৭নং গেরিলা গ্রুপের দুই টু-আই,সি রয়ে গেল। শহরের এত কাছে এসেও নামতে না পেরে আলমের মনটা একটু ভারী হয়ে আসল। তবুও কর্তব্যের কারণে তাদের থাকতেই হবে। ভোরের আলো পুরাপুরি ফোটার আগেই একে একে সবাই শহরের দিকে চলে গেল। সবাইকে আপাতত শহরে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করে থেকে যোগাযোগ রাখতে বলা হল। সুর্য ওঠার সাথে সাথে নৌকাটি বাঁশবাড়িয়া খাল থেকে বের হয়ে সমুদ্রের দূরবর্তী উপকুলে ভাসতে লাগল। মাঝির পরামর্শ মোতাবেক আলম ও নুরুল ইসলাম পড়নে জলগামছা পেছিয়ে গায়ে কেবল গেঞ্জিটা রেখে জেলের বেশ ধরে নৌকার দু’গলুইয়ে বসে হেটে সময় কাটাতে লাগল। অস্ত্রগুলো নৌকার পাটাতনের নিচে বিছিয়ে পাটাতনের তক্তা দিয়ে আড়াল করে রাখা হল। চর্তদিকে জেলে নৌকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। দূর থেকে জেলেরা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল আলমদের নৌকাটিকে। কয়েক ঘন্টা পর পর পাক নৌ সেনাদের ইঞ্জিন চালিত গানবোট দ্রুত গতিতে এদিক সেদিক ছোটা-ছুটি করতে লাগল। একবার খুব কাছ দিয়ে একটি গানবোট যখন যাচ্ছিল, তিন চার জন পাক সেনা তাতে, তখন আলমের একবার মনে হল মাত্র একটি এইচ ই ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে তাদের সলিল সমাধি রচনা করা যায়। কিন্ত তাতে পরবর্তী ঘটনা তাদের অনুকুলে থাকবে না। তাদের এখন লক্ষ্য হল অস্ত্রগুলো নামিয়ে নিয়ে নিরাপদে শহরে পৌছতে হবে। এভাবে নানা ইচ্ছা অনিচ্ছার দোদুল দোলায় দোলে দু’জন মাঝি মাল্লা সহ তারা চার জন সারা দিন ছাউনি ছাড়া একটি নৌকাতে ভেসে ভেসে কাটাল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে তাদের আবার বাঁশবাড়িয়া খালে ঢুকতে হবে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও স্বেচ্ছাসেবকেদের সাথে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। নৌকা থেকে নামিয়ে অস্ত্র কোথায় রাখা হবে তার একটি ব্যবস্থা তারা করেছেন। যত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে নৌকা তত তীরবর্তী হতে থাকে। জেলে নৌকাগুলো সন্ধ্যার আঁধার নামার সাথে সাথে তীরে এসে নোঙর করেছে। রাত সাড়ে আটটার দিকে আলমদের নৌকাটি আস্তে আস্তে বাশঁবাড়িয়া খালে ঢুকে পড়ে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা আগে থেকেই লোক প্রস্তুত করে রেখেছিল। তারা দ্রুত অস্ত্রগুলো চটের থলে পেছিয়ে কয়েকটি বোচ্কা তৈরী করে রওয়ানা দিল। দু’দিনের সহযাত্রী মাঝি-মাল্লাদের বিদায় জানিয়ে আলম ও ইসলাম তাদের পিছু নিল। কিছুক্ষণ পর তারা স্থানীয় একটি বাড়িতে প্রবেশ করল। বাড়ির মালিক শফিউর রহমান। সিদ্ধান্ত হল আপাতত তার বাড়ীর পেছনে একটি গর্ত করে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখা হবে। শহরে সেল্টার ঠিক করার পর তা আবার নিয়ে যাওয়া হবে।
আগে থেকেই লোক ঠিক করা ছিল। তারা শফিউর রহমানের ঘরের পেছনে গর্ত খুড়তে লেগে গেল। অস্ত্রগুলো সে গর্তে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হল। আলম ও ইসলাম সে রাত সে বাড়িতে কাটাল। অনেকদিন পর নিতান্ত ঘরোয়া পরিবেশের খানা, আলম উদরপূর্তি করে যেন খেল। বাড়ির মহিলাদের প্রচণ্ড আগ্রহ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখবে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তারা ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছে একজন ছোট্ট কিশোর, লিকলিকে শরীর, গোঁফ-দাঁড়ি এখনো গজায়নি। তাই তারা তাকে অন্দর মহলে ডেকে নিয়ে গেল। অন্দর মহলের মহিলারা তাকে দেখার জন্য যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এক মধ্য বয়সী মহিলা আলমের মাথায়, থুতুনীতে হাত বুলিয়ে আদরে সোহাগে তাকে ভরিয়ে দিতে লাগল।
-তুমি কোন মায়ের সন্তান
-তোমার মা-বাবা কি জানে তুমি মুক্তিযুদ্ধে গেছ?
-হায়! হায়! না জানি তারা এখন কেমন করছে? আরো অনেক প্রশ্ন একসাথে।
-তোমরা পারবেতো বাবা?
-আমাদের দেশ স্বাধীন হবেতো?
-ইন্ডিয়া আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেনা কেন?
-পাকিস্তানী হার্মাদদের হাত থেকে আমরা কবে রক্ষা পাব?
-কবে নাগাদ আমরা স্বাধীন হতে পারব?
উৎকণ্ঠিত গ্রাম্যবালাদের এজাতীয় অনেক প্রশ্নের কোন জবাব আলমের জানা নেই। তবু সে বলল এবং আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বলল,
-আমাদের দেশ সহসা স্বাধীন হবে,
-আমরা সহসা দেশকে হানাদারমুক্ত করব। আলম নিজেও জানে না তার এ আত্মপ্রত্যয়ের ভিত্তি কী। তবে সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, স্বাধীনতা পেতে তাদের আর হয়তো বেশি দিন যুদ্ধ করতে হবে না।
অনেকদিন পর মাতৃসম এক রমণীর হৃদয় নিংড়ানো আদর সোহাগে আলম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। স্নেহময়ী জননীর কথা তার মনে পড়ল। মনে পড়ল তার বাবা-ভাইবোন সবার কথা। সত্যিইতো, তারা এখন কেমন আছে? সবাই বেঁচে আছেত ? এক অজানা শঙ্কায় তার হৃৎপৃণ্ড যেন মোচড় দিয়ে উঠল। দু’ফোটা তপ্ত অশ্র তার গণ্ড বেয়ে কোলে গড়িয়ে পড়ল। সে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। জননী ও জন্মভূমির প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালবাসা কত গভীর হতে পারে এ যুদ্ধে না গেলে আলম কখনো তা অনুভব করতে পারত না।
ইতোমধ্যে আশ্রয়দাতার বাড়ির উঠোনে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে তারা ফিস্ ফিস্ করে আলাপ করছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের খবর শুণে তারা যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা জানার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ এসে আলমদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। লোকগুলোর হৃদয়নিংড়ানো আতিথেয়তা আলমের মনে এক অদ্ভুত ভাল লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।
এগার
বাঁশবাড়িয়া বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন আগুন্তুক, একজন টগবগে যুবক, আর একজন কিশোর। উভয়ের গায়ে বড় বড় চেকের হাফ শার্ট, পড়নে লুঙ্গি। পাবলিক বাস আসলে তারা বাসে ওঠবে। গন্তব্য আপাততঃ শহর। আলম বুঝতে পারল, স্থানীয় লোকজন তাদের দিকে কিছুটা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শহরগামী একটি পাবলিক বাস এসে দাঁড়াল। সমবেত কিছু যাত্রীর সাথে ওরা দু’জন বাসে ওঠে পড়ল। খুব বেশি যাত্রী নেই বাসে। শহরের দিকে মানুষ এখন খুব একটা যেতে চায় না। কারণ পথে পথে চেকপোষ্ট বসেছে। সেখানে কেবল অহেতুক হয়রানি করা হয় না, সন্দেহ হলে রাজাকার আলবদর এর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে সবাই আবার ফিরে না। তাই পারতপক্ষে মানুষ শহরমুখো হয় না।
কুমিরা স্টপেজে আসতেই বাস থামাল রাজাকারেরা। এখানে একটি চেকপোস্ট আছে। ভীতসন্ত্রস্ত যাত্রীরা যে যার আসনে বসে আছে। ক্ষীণকায় দু’জন রাজাকার বাসে ওঠল। তাদের কাঁধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তারা ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের পরখ করতে লাগল। আলম আর ইসলাম ইচ্ছে করে দু’জন আলাদা আলাদা বসেছে। আলম লক্ষ্য করল, তার উভয় হাতের কনুইতে ট্রেনিং দেওয়ার সময় যে ঘা হয়েছিল, তা এখনো দগদগে। তাছাড়া তার দু’হাটুতেও ঘায়ের দাগ বিদ্যমান। সামরিক ট্রেনিং এর অকাট্য প্রমাণ। আলমের বুক দূরু দূরু করতে লাগল। এ পর্যায়ে এসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়বে নাত? না, বাসের ভিতরে চতুর্দিকে ঘুরে যাত্রীদের কয়েকটি বোচকায় রাইফেলের গুতো দিয়ে পরিক্ষা করল, অতঃপর খুব দ্রুত নেমে পড়ল। কন্ট্রাকটরের হাঁকের সাথে সাথে বাস আবার রওয়ানা হল। আলম ভাবতে লাগল এ যাত্রায় কি বাঁচা গেল? নাকি সামনে আরো বিপদ আছে?
এভাবে বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রী ওঠানামা করতে করতে এক সময় বাসটি দেওয়ান হাট মোড়ে এসে পৌছে। আলম ও ইসলাম নেমে পড়ল। কারণ তাদের আপাততঃ গন্তব্য পতেঙ্গা। দীর্ঘ দিন পর নিজের শহরে ফিরে কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে। প্রথমে পরখ করল আলম রাস্তায় বাস চলাচল স্বাভাবিকভাবে করে কিনা। হ্যাঁ, রাস্তার পূর্ব পাশে গিয়ে সে সল্টগোলাগামী বাসে ওঠে পড়ল।
বাসে যাত্রীদের দিকে তাকাল আলম, যদি পরিচিত কেউ থাকে। না, তেমন কাউকে দেখল না আলম। আধাঁ ঘন্টার মধ্যে বাস সল্টগোলা এসে গেল । নেমে পড়ল আলম। মঞ্জুর কেন্টিনটা এখনো চলছে। তারা দু’জন মঞ্জুর কেন্টিনে ঢুকল। আগে কিছু খবরাখবর নিতে হবে। অতঃপর গন্তব্য ঠিক করতে হবে। এখনো তারা জানে না তাদের অগ্রবর্তী দলের সদস্যরা কোথায়? তাদের জন্য কোথায় সেল্টার কিংবা যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছে। মঞ্জুর কেন্টিনে ঢুকে তারা খাবারের নির্দেশ দিল। কর্ণফুলীর অপর পারেই আলমের নানা বাড়ি। ঈশান মিস্ত্রির খালের পূর্ব প্রান্ত থেকে নৌকায় ওঠে ওপারে যেত তারা। আপাততঃ সেখানে যাবে কিনা চিন্তা করছে আলম। এক বেয়ারা খাবার নিয়ে আসল। আলম তাকে জিজ্ঞেস করল, খালের পাড় থেকে ওপারে যাওয়ার নৌকায় ওঠা যাবে কিনা। বেয়ারা বলল, না, খালের মুখ পাক সেনারা তার দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। ওদিকে গেল যে কোন মানুষ বিপদে পড়তে হবে। হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতেই একটি মালবাহি ট্রাক তাদের দেখে দাঁড়াল। ট্রাকের শ্রমিকেরা পতেঙ্গা এলাকার। তারা ইসলামকে চিনতে পারল। ট্রাক থামিয়ে তারা দু’জনকে ট্রাকে তুলে নিল। আলম ও ইসলামকে গাদাগাদি করে ড্রাইভার সিটে বসাল তারা। আলম বুঝতে পারছেনা তারা যে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশে ফিরছে, এ কথা ট্রাকের শ্রমিকেরা জানে কিনা। তারা যখন তার সহযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাস করছে, তারা কোথায় গিয়েছিল, তখন আলম বুঝতে পারল তারা আসলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাদের চিনে নাই। মনে মনে আলম বরং স্বস্তি পেল। কিন্তু ট্রাক থেকে কোথায় নামবে সে। ট্রাকটি পনর নং হয়ে ঐদিকের একটি ব্রিক ফিল্ডে যাবে। তারা দু’জন আর একসাথে কোন দিকে যাওয়া ঠিক হবে না বলে ইসলাম নেমে পড়ল নয়া রাস্তার মাথায়। আলম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল লালদিয়ার চর নামক জায়গায় তার বহু আত্মীয় বাড়ি আছে। সে কর্নফুলীর তীরবর্তী জনপদ লালদিয়ার চর নামক স্থানে নেমে পড়ল।
ট্রাক থেকে নেমে সামান্য হেটেই এক আত্মীয় বাড়ীতে ঢুকল আলম। অনেক লম্বা সে বাড়ীর নাম “ডাইলের বাড়ী”। তার চাচার শশুর বাড়ী। ঘটনাচক্রে তার চাচীমাও সেদিন সেখানে। আলমকে পেয়ে তার সেকি আনন্দ। কারণ সে জানত আলম বাড়িতে কিছু না বলে পালিয়ে যুদ্ধে গেছে। বাগে পেয়ে সে যেন আলমকে আর ছাড়তেই চাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই পাঞ্জাবীরা লালদিয়ারচরের প্রচুর ঘরবাড়ি জালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। বিমানবন্দর সংলগ্ন হওয়ার কারণে লালদিয়ারচরবাসী পাকিস্তানী সৈন্যদের তোপের মুখে। যখন তখন ধরে নিয়ে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। তাদের হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল সাবাড় করে ফেলছে। তারপরও বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে তারা কোন দিকে যায়নি-যেতে পারে নি। পড়ে আছে মাটি কামড়ে। এখানে এসে আলমের লাভ হল, তার বাড়িতে না থাকা সময়ের সব ঘটনা সে খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে পারল তার চাচী মার কাছে। সে চলে যাওয়ার পর তার বাবা মার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, বিগত প্রায় চার মাসা এলাকাতে কী কী ঘটনা ঘটেছে তার অনেক কিছুই সে জানতে পারল। কী ভাবে তার বাড়িতে যাওয়া যায় সে ব্যাপারেও সে একটা ধারণা পেল। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই সে রওয়ানা হল তার নিজ বাড়ি মাইজ পাড়ার দিকে।
বার
কয়েক মাস পরে বাড়িতে আসল আলম। মাঝখানে ক,টি মাস। অথচ আলমের কাছে মনে হচ্ছে কত যুগ। তাকে দেখে আলমের মা-সে যেমনটি ভেবেছিল-হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নি, আলমকে ঝাঁপটে ধরে নি। মিতভাষী তার মাকে অধিকতর গম্ভীর মনে হল আলমের । কোন অনুযোগও সে করল না আলমের এভাবে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে। সবার অলক্ষ্যে সে কেবল তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছল আঁচলে। কেবল তার বড় আপা হাউ মাউ করে কেঁদে আলমকে জড়িয়ে ধরল। শুকিয়ে তার শরীর প্রায় কঙ্কালসার হয়ে গেছে। আলম চলে যাওয়ার পর হতে সে নিয়মিত নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সে আলমকে প্ররোচিত করেছিল, সে ধারণাটা অনুশোচনা হয়ে তাকে সর্বাপেক্ষা পীড়া দিচ্ছিল। অহর্নিশ যে ভয় তাকে পীড়া দিত তাহল, আলম যদি ফিরে না আসে? বাড়িতে এসেও আলম সকল আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে পারল না। কারণ যেমন সংগোপনে সে এসেছে তেমনি সংগোপনে তাকে চলে যেতে হবে। আলমের রক্তেও তখন যুদ্ধের উম্মাদনা। পাঞ্জাবী হায়নাদের আঘাত হানতে হবে। সহসা শহরে একটি গোপন সেল্টার ঠিক করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে অপারেশন শুরু করতে হবে।
শহরের সেল্টার থেকে আলম আজ এসেছে তার প্রিয় জননীকে দেখতে। তার ইচ্ছা আজ তার মায়ের সাথে থাকবে। তার বাবাও আছে। অনেক দিন পর বাবা-মা-ভাই-বোনের সাথে দেখা। ছেলে বাড়িতে এসেছে। ভাল-মন্দ রান্না করেছে আলমের মা। মাছ, মুরগী,মাংশ আরো কত কি। বাবা মা, ভাই বোন সবাইকে নিয়ে এক সাথে অনেক দিন পর মায়ের হাতের রান্না যেন তৃপ্তি মিটিয়ে খেল আলম। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এক সাথে খবর শুণতে বসল। আলমের একান্ত ইচ্ছা – আজ সে তার মা-বাবার সাথে থাকবে। কিন্তু তার মা ব্যাপারটি মেনে নিল না। অনেকটা জোর করে তার এক জ্ঞাতি চাচার বাড়িতে তাদের জন্য বিছানা করে আসল। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলম সে বাড়িতে গেল তার বাবাসহ। তাদের বাড়ির পেছনে একটি ছোট পুকুর। পুকুরের উত্তর পাড় সংলগ্ন বাড়িটি। তখন রাত প্রায় ১০-৩০ঘটিকা। আলম, তার বাবা ও ঐ বাড়ির তার জেঠাত ভাই পেয়ার সবাই এক সাথে বসে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সংবাদ পর্যালোচনা শুণছিল। হঠাৎ অস্ফুট একটি শব্ধ কানে আসল সকলের। মনে হচ্ছে কোন গাড়ীর শব্ধ। আবার শব্দটি যখন থেমে গেল, তখন মনে হল গাড়ীটি বুঝি নিকটে কোথাও থেমেছে। রেডিও বন্ধ করে সবাই উৎকর্ণ হল ঘটনা বুঝার জন্য। আলমের জেটাত ভাই পেয়ার গেল খবর নিতে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সে হাপাতে হাপাতে ফিরে এসে বলতে লাগল‘পাক আর্মিরা আলমদের বাড়ী ঘিরে ফেলেছে’। আলম ও আলমের বাবা প্রথমত বিষয়টি বিশ্বাস করতে চাইল না। কারণ পেয়ার ছিল খুব ভীতু ধরণের ছেলে এবং কোন কথা বাড়িয়ে বলার অভ্যেস ছিল তার। তবুও তারা দ্রুত উঠোনে নেমে আসল। চাঁদের আলোয় তখন সবকিছু ফকফকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আলমের মা, বোন, সবাই পেছনের পুকুর দিয়ে এসে জানাল-পাক সেনারা বাড়ি ঘেরাও করে আলম ও তার বাবাকে খোঁজাখোঁজি করেছে। ঘরে খানা তল্লাসি চালিয়েছে । তার এক বৃদ্ধ দাদা-তার বাবার চাচাকে আলম ও তার বাবা সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে না পারায় বেদম প্রহার করেছে । আলমের মেঝো চাচাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে।
আলম ও তার বাবা সেখানে থাকা আর নিরাপদ মনে করল না। তারা রাতের অন্ধকারে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ল। গ্রামের মানুষ অধিকাংশ ইতোমধ্যেই ঘুমিয়ে গেছে। তবুও কোন কোন ঘরে কেরোসিনে প্রদীপ টিম্ টিম্ করে জ্বলছে। তার আবছা কম্পিত আলো কুঁড়ে ঘরের বেঁড়ার ফাঁক দিয়ে উঠোনে এসে পড়ছে। আলম ও তার বাবা ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামের এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, কারো ঘরের বারন্দায়, কারো বাড়ির ওটানের ঝোঁপের আড়ালে বসে, বাকি রাত কাটাল। ভোরের আলো ফুটার আগেই পিতাপুত্র তাদের গ্রামের দক্ষিণের বিল পাড়ি দিয়ে পোড়াপাড়া নামক গ্রামে উপনীত হল। লক্ষ্য কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে তারা আপাতত শহরের দিকে যাবে। ভোর তখন হয় হয়। রাতের আঁধার ক্রমে তরল হয়ে আসছে। ১৫ নং ঘাট হয়ে নদী পার হওয়ার জন্য বিল অতিক্রম করছে আলম ও তার বাবা। দূরে অস্ফুটে কিসের শব্দ যেন তারা শুণতে পাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রচণ্ড গর্জনে কিছু যুদ্ধ বিমান তাদের মাথার উপর এসে পড়ল। আলম ও তার বাবা বিলের মাঝে আলের পাশে শূয়ে পড়ল। আলম ভাবল পাক বাহিনীর বিমান, বিমান বন্দরে নামার জন্য ঘুর পাক খাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে পাক খেয়ে এক সাথে একাধিক বিমান পতেঙ্গা বিমান বন্দরের উপর আসতে সেগুলো থেকে কলার তোড়ের মত কি যেন ঝাঁকে ঝাঁকে মাটির দিকে নেমে আসতে লাগল। মুহুর্তের মধ্যে বিকট শব্দে একটির পর একটি বোমা বিস্ফোরিত হতে লাগল। সমগ্র পতেঙ্গা কেঁপে কেঁপে ওঠল। আলমের বুঝতে আর বাকি রইলনা যে, এ বিমান মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের বিমান। প্রচণ্ড বিপদের মধ্যেও তার বুক আনন্দে ভরে গেল। বোমার আঘাতে অদূরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠল। সম্ভবত কর্ণফুলীর তীর সংলগ্ন কোন তৈল স্থাপনা কিংবা কোন জাহাজে আঘাত করেছে এ বোমা। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে আক্রমণ শেষ করে বিমানগুলো আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। দ্রুত গাত্রোত্থান করে আলম ও তার বাবা আবারও এগিয়ে যেতে লাগল কর্ণফুলীর দিকে। তারা নদী তীরে যখন পৌছে, তখনো মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে এদিক সেদিক। নদীতে কোন নৌকা দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর একটি নৌকা ভেসে যেতে দেখেই আলমের বাবা ডাক দিল। মাঝি প্রথমে আসতে চাইল না। তাকে অনুনয় করার পর সে নৌকা তীরে ভিড়িয়ে তুলে নিল। স্রোত অনকুলে, নৌকা তীর তীর করে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার কিসের দূরাগত গর্জন অস্ফুট ভাবে শোনা যেতে লাগল। আলম বলল- বিমান আবারো আসছে মনে হয়। তার কথা শেষ হতে না হতে আবারো এক ঝাঁক ধবল বকপক্ষীর মত বিমান তাদের মাথার উপর ঘুরপাক খেতে লাগল। মাঝি বৈঠা ছেড়ে দিয়ে নৌকাতেই শুয়ে পড়ল। তবে হালটা এক হাতে ধরে রাখল। নৌকা স্রোতের টানে চলতে লাগল ঠিক পথেই। আলম ও তার বাবা নৌকার গলুইয়ের মধ্যেই সটান শুয়ে পড়ে দেখতে লাগল বিমানগুলো ডিগাবাজির কসরৎ । বিমানগুলো এক এক বার ডিগবাজি খেয়ে নিচে নামে আর ওঠার সময় ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড শব্দে এক একটি বোমা বিস্ফোরিত হতে থাকে। আলমের মনে হতে লাগল তারা যেন যুদ্ধের একটি জীবন্ত সিনেমা দেখছে। মাটি থেকে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলা অগ্নিস্ফুলিংগ হয়ে বিমানগুলোর পিছু ছুটছে, আর মাছের মত ডিগবাজি খেতে খেতে সে বিমান যেখান থেকে কামানের গোলা নিক্ষিপ্ত হচেছ, ঠিক সে বরাবর গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে মেশিন গানের গুলি বৃষ্টি নিক্ষেপ করছে এবং বোমা ফেলছে। বিমানগুলো আক্রমণ নৈপুন্য দেখে আলমের বাবা বারংবার মার, মার করে ছেঁচিয়ে ওঠছে, যেন তার এ চিৎকার বৈমানিকেরা শুণতে পাচ্ছে। কামানের গোলা নিক্ষেপের প্রত্যুত্তরে যেখানে বিমানগুলো পাল্টা আক্রমণ করছে সেখান থেকে আর গোলা আসে না। এভাবে আধা ঘন্টা ধরে বিমানগুলো তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখল। এক সময় নীচ থেকে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলা নিক্ষেপ সস্পূর্ন বন্ধ হয়ে গেল। আলম বুঝতে পারল, হয়ত সেগুলো বিমাননিক্ষিপ্ত বোমায় ধ্বংস হয়ে গেছে নতুবা তাদের গোলা নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু একটি বিমানেও তারা আঘাত হানতে পারল না। পক্ষান্তরে বিমান বন্দরের পার্শ্বে, কর্নফুলীর তীরস্থ কোন কোন তেল স্থাপনাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল। নিজেদের মহাবিপদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের এ সাফল্যে পুলকিত হল আলম ও তার বাবা। বিমান হামলার এ মহড়া দেখতে দেখতে আলমদের নৌকা ততক্ষণে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। মাঝি ওঠে আবারও বৈঠা ধরল। কিছুক্ষণ পূর্বে নৌকার গলুইতে ভয়ে সেধিয়ে যাওয়া মাঝিও আনন্দে চিৎকার দিয় ওঠল-মার শালাদের।
গুপ্তাখাল বরাবর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠেছে । আগুনের লেলিহান শিখা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আগুনের এ লেলিহান শিখা যেন সমগ্র পতেঙ্গাকে গ্রাস করে ফেলবে। এবার ভয়ে আলমের বুক দুরু দুরু কেঁপে ওঠল। এতদূর থেকে আলম আগুনের তাপ অনুভব করতে পারছে। মাঝি বলল- আর যাওয়া যাবে না। হঠাৎ করে বাঁক নিয়ে নৌকা একটি খালের মুখে ঢুকে পড়ল। কর্ণফুলীর পূর্বতীরে জায়গাটার নাম জুলদা। জুলদা খালের কিঞ্চিৎ ভিতরে ঢুকে আলম ও তার বাবা নৌকা থেকে নেমে পড়ল। কূলে ওঠে আলম ও তার বাবা দেখতে পেল কর্ণফুলীতে একটি ভাসমান জাহাজ বোমার আঘাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাজি নৌকাটিকে খালের ভিতরে দিয়ে নিয়ে চলল।
তের
না, গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মরক্ষার জন্য আলম যুদ্ধে যায় নি। তাকে ফিরে যেতে হবে চট্টগ্রাম শহরে। জুলদা, ডাঙ্গারচর হয়ে পাকিস্তান বাজার বরাবর শহরে উঠল সে। অতঃপর সেল্টারে ফিরে যাওয়া। ১৫৭ নং সিটি গেরিলা গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড সে। তার গ্রুপের সদস্য সংখ্যা সতর। ইতোমধ্যে শহরে তাদের জন্য সেল্টার এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেল্টার বলতে কোন স্থায়ী নিবাস নয়। মাদারবাড়ি, মোগলঠুলী, কদমতলী-শহরের কেন্দ্রস্থলের এসব মহল্লাগুলোতে আলমদের আত্মগোপন করে থাকতে হবে। সেখান থেকেই তাদের চালাতে হবে গেরিলা অপারেশন। শহরে টহলরত পাকবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ এর উপর আচমকা হামলা, বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা, তেলের পাম্প, বিদ্যুৎ স্থাপনা, সরকারী অফিস, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা , ব্যাংক পাড়া, আদালত চত্বর, সার্কিট হাউস ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ন স্থানগুলোতে বোমা হামলা করে পাক হানাদারদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া তাদের লক্ষ্য। এক দিন এক বাড়িতে রাত কাটাচ্ছে তারা । বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপের হামলায় ইতোমধ্যে শহরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদররা যেমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতায় জনগণের মনোবলও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন গেরিলা হামলার পরিকল্পনা করতে গিয়ে আলমদের আবার মাথায় রাখতে হচ্ছে, যাতে কোন সাধারণ নাগরিক এ হামলার শিকার না হয় এবং হামলার প্রতিক্রিয়ায়ও যাতে সাধারণ জনগণের উপর সরাসরি পড়তে না পারে। প্রতি দিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই মুড়িমুড়কির মত বোমা ফাটছে শহরে। কোন কোন বোমায় পাকসেনা কিংবা তাদের দোসর রাজাকার আলবদর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পাকসেনারা এদিক সেদিক চলাচল করছে। শহরের অবস্থা যখন এমন নাজুক, সে সময়ে নৌ-কমান্ডোদের সফল আক্রমণে কয়েকটি জাহাজ নদী ও সাগরে ডুবে গেছে। এ সকল ঘটনা মানুষের মনোবল আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কৃতিত্বগাঁথা পল্লবিত হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। মানুষের মধ্যে ডুবে থেকে এসব প্রশংসা-গাঁথা শুণতে আলমের বেশ ভাল লাগছে। তারা যা করছে তার সাথে মনের মাধুরি মিশিয়ে মানুষ প্রচার করছে আরো বেশি। শহরের মধ্যেও মানুষ বিভিন্ন অলিগলির দোকানে কিংবা বাসায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান, আকাশ বাণীর খবর শুণছে। শহরের এ গেরিলা তৎপরতায় আলমদের গ্রুপের কোন সদস্য যেমন হতাহত হয়নি, তেমনি কেউ ধরাও পড়েনি। যদিও গেরিলা সন্দেহে প্রতিদিন কোন না কোন স্থান থেকে কিছু ছাত্র যুবককে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সার্কিট হাউস, সেনানিবাস, পতেঙ্গাস্থ বিওসি নামক তেল কোম্পানীর মেইন ইনস্টিলেশন এ তারা কিছু কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প-সাধারণ মানুষের ভাষায় জল্লাদখানা-নির্মাণ করেছে। সেখানে প্রচুর মানুষ পাকসেনাদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শহরে গেরিলা তৎপরতা ইতোমধ্যে এমন বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে পাক সেনারা তাদের টহল অত্যন্ত সীমিত করে ফেলেছে। তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গেরিলারা কখনো কখনো লক্ষ্যহীন বোমাবাজি করছে। পাকসেনারা এমন আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে যে, কোন গাড়ীর চাকা ব্রাস্ট হওয়া কিংবা অন্য কোন দুমদাম শব্দ শুণলেও তারা অতিদ্রুত মাটিতে শূয়ে পজিশন নিয়ে ফেলে। গেরিলাদের উপর্যুপরী আক্রমণে তাদের মনোবল শূণ্যের কোটায় পৌছে গেছে। আলমের গ্রুপ তখন শহরের মোগলঠুলী নামক জায়গায় কয়েকটি বাড়িকে তাদের অস্থায়ী সেল্টার করেছে । ইতোমধ্যে শহরের বিভিন্ন স্থানে গেরিলাদের দুঃসাহসী হামলায় পাকসেনারা মারাত্বক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। শহরে অপারেশনরত বিভিন্ন গ্রুপ তাদের পরিকল্পনা মত গেরিলা অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন শহরের অলিতে গলিতে ঘোরাঘুরি করে রাতে এক এক জন এক এক বাড়িতে তাদের আত্মীয় পরিচয়ে আশ্রয় নিয়ে রাত অতিবাহিত করছে। কখনো কখনো অস্ত্র বিশেষভাবে এইচই ৩৬ হ্যান্ডগ্রেনেড ফুরিয়ে গেলে তা জোগাড় করার জন্য কাউকে না কাউকে আবার সীমান্তপাড়ি দিতে হচ্ছে। এভাবে ১৫৭ নং সিটি গেরিলা গ্রূপের সদস্য হিসাবে আলম তার প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার একটি রুটিন তৈরি করে ফেলেছে। সে ভাবতে শুরু করেছে সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন তার মাতৃভূমি পাক হানাদার মুক্ত হবে। কল্পনার ডানায় ভর করে সে হারিয়ে যায় কোন এক অলস মুহুর্তে। কোন এক সোনালী সকালে হঠাৎ পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেবে। বুক উঁচিয়ে কাঁধে রাশিয়ান স্টেন গান ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরবে আলম। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো অগুণিত মানুষ দু’হাত নেড়ে তাদের স্বাগত জানাবে। কোন কোন বয়স্ক মানুষ দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। আবেগাপ্লুত হয়ে অঝোরে কেঁদে দেবে। কখনো কখনো অগুণিত তরুণ-তরুণী মুষ্ঠিবদ্ধ হাত শূণ্যে তুলে জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দেবে। হয়ত সদ্য যৌবণা কোন গ্রাম্য তরুণী দুরু দুরু বুকে বিস্ফারিত নেত্রে অবাক বিস্ময়ে দেখবে তার মত একজন কিশোর কী বীরদর্পে যুদ্ধজয় করে দেশে ফিরছে। কল্পনার এ দৃশ্যটা আলমকে সর্বাপেক্ষা রোমাঞ্চিত করে তুলে। তার ভাবনার ফানুষ কল্পনার সুতা বেয়ে আরো এগিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হলে সে স্কুলে ফিরে যাবে, তার সহপাঠিরা তাকে দেখে বিস্মিত হবে, যুদ্ধের কাহিনী শুণতে চাইবে। অলস মুহুর্তের এলিয়ে পড়া আধশোয়া অবস্থা থেকে সে একটু নড়ে চড়ে বসে। দ্রীম! দূরাগত কোন বোমার শব্দে আলমের তন্দ্রা ভাঙ্গে। গ্রেনেড থ্রু করে পালিয়ে যাওয়, আত্মগোপন , আবার হামলার প্রস্তুতি এভাবেই পার হচ্ছে একটির পর একটি দিন। যত দিন যাচ্ছে ততই আলমের মনে হচ্ছে মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসছে।
আলমের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠি তার কাছে একটি চিটি লিখে, প্রবল আগ্রহে জানতে চায়-মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী। জবাবে আলম লিখে-আসন্ন কুরবানের ঈদ আমরা স্বাধীন বাংলার মাটিতে উদযাপন করব। কুরবানের ঈদের তখন মাত্র মাস খানেক বাকি। ঐদিকে সম্মুখ বাহিনী দ্রুত মিরেশ্বরাইয়ের দিকে এগিয়ে আসছে-তীব্র লড়াই চলছে পাক বাহিনীর সাথে। সর্বাপেক্ষা তীব্র যুদ্ধ হয় ফৌজদার হাট এলাকায়।
১৫ ই ডিসেম্বর চতুর্র্দিকে থমথমে অবস্থা-ভারী গোলার শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে শহর। রাজপথে হতচকিত মানুষেরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটলেও ভয়-বিহ্বলতার পরিবর্তে সকলের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা-কী ঘটতে যাচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা পাততাড়ি গুটিয়ে সেনানিবাসের দিকে চলে যাচ্ছে বলে লোকজন বলাবলি করতে লাগল। সাধারণ মানুষ আন্দাজ করতে লাগল চুড়ান্ত কিছু একটা যেন ঘটতে যাচ্ছে। ১৫ ই ডিসেম্বর, রাত ৭-৩০ঘটিকা । একটি বাসার আঙ্গিনায় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা শুনছে আলম। ঐ ঘরের বাসিন্দারাও দলবদ্ধ হয়ে সে বক্তৃতা শুণছে। ইয়াহিয়া তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলছিল-উর্দ্দু ভাল না বুঝলেও আলম এ শব্দগুলো বুঝতে পারল, যার অর্থ দাঁড়ায়-যতক্ষণ পাকিস্তানের বারকোটি মুজাহিদ জিন্দা থাকবে, ততক্ষণ পাকিস্তানের কিছু হতে দেব না ইনশাল্লাহ। হু হু করে হেসে ওঠল ঘরের সকল শ্রোতা নারী-পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। যত জোর দিয়েই বলুক-আলমের বুঝতে বাকি রইল না-ইয়াহিয়া খানের এ বক্তব্য তাদের মত সাধারণ বাঙালিদের কাছে হাস্যকর প্রতিভাত হচ্ছে। ঘরের লোকগুলো যেন সমস্বরে বলে ওঠল-মুক্তিযোদ্ধাদের খেচকা মাইরে তোমার পাকিস্তানের কবর হয়ে গেছে। ঘরের লোকেরা জানেনা তাদের এ কথাগুলো তাদের অতি কাছে দাঁড়িয়ে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে কিভাবে আবেগ আপ্লুত করে তুলেছে। আনন্দে গর্বে আলমের বুকের ছাতি যেন এক হাত ফুলে ওঠল।
ইয়াহিয়ার বক্তৃতা শোণা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আলম ঐখান থেকে তার নির্দিষ্ট সেল্টারের দিকে চলে গেল। রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে গোলা-গুলির শব্দ বৃদ্ধি পেতে লাগল। আলমদের সেল্টারে খবর এসে পৌছল, পাক সৈন্যরা তাদের সকল অস্থায়ী পোস্ট থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সেনানিবাসের দিকে চলে যাচ্ছে। আলমদের কাছে খবর এসেছে এ সময়ে শহরের অভ্যন্তরে গেরিলা হামলা বন্ধ রাখার জন্য। গভীর রাত পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। শহরের উত্তর প্রান্তে আকাশে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। এক সময় গোলাগুলির শব্দ থেকে আসে। সেল্টারে আলমের সাথে তার কোন সহযোদ্ধা ছিল না। আবেগ- উত্তেজনা উৎকন্ঠায় সারা রাত তার বিনিদ্র অবস্থায় কাটে।
নতুন যুগের রক্তস্নাত-অরুণাদয়
১৫ ই ডিসেম্বরের রাতের আধাঁর ক্রমে তরল হয়ে আসেছে। ১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১, ভোরের রক্তিম আভা কেবল পূর্বাকাশে ফুটে ওঠছে। আলমের কেবলি মনে হচ্ছে, এ যেন এক নতুন প্রভাত, নতুন যুগের সূচনা। দ্রুত গাত্রোত্থান করে মুখে কিছু না দিয়েই সেল্টার থেকে বের হয়ে পড়ে আলম। সে একা। গত রাতে তার সহযোদ্ধারা এক এক জন এক এক সেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিল। মোগলঠুলীর গলি রাস্তা পার হয়ে আলম বড় রাস্তায় ওঠে। কে যেন চিৎকার করে ওঠল-পালিয়েছে-পাকিস্তানী সৈন্যরা পালিয়ে গেছে। মুহুর্তের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল চর্তুদিকে। রাস্তায় মানুষ জড়ো হওয়া শুরু হল। সবার চোখে-মুখে উৎকন্ঠা মিশ্রিত আনন্দ-উচ্ছাস। দ্রুত কদমতলীর মূল রাস্তায় ওঠে আসল আলম। ততক্ষণে রাস্তায় মানুষের ঢল নেমে গেছে। প্রত্যেকের মুখে এক কথা-পাক বাহিনী পরাজিত হয়েছে। তারা সহসা আত্মসমর্পন করবে। আনন্দ-আবেগ- উচ্ছাসে এ খবরের সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য মানুষের তর সইছে না। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে মিছিল শুরু হয়ে গেল। সাথে সাথে চতুর্দিক থেকে শ্লোগান শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে গেল রাজপথ। আলম অবাক হয়ে ভাবে-কোথায় ছিল এ জনতা, কে তাদের সংগঠিত করল। আলম এগিয়ে চলে রাজপথ ধরে। কী করবে, তার সহযোদ্ধার কে কোথায় কিছুই জানেনা সে এ মুহুর্তে। কদমতলীর মোড় থেকে সে এগিয়ে যাচ্ছে দেওয়ানহাট মোড়ের দিকে। কদমতলীর রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন ভবনের ছাদে ছাদে মহিলা ও শিশুরা দাড়িয়ে জনতার মিছিল দেখছে আর বাঙলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা নেড়ে অভিবাধন জানাচ্ছে এবং কেউ কেউ উদ্বাহু নৃত্য করছে। আলম কিছুটা অবাক হয়। তাৎক্ষণিক বাংলাদেশের এ পতাক তার কোথায় পেল। ২৫ শে মার্চে আগে এ পতাকা বাড়ির ছাদে ছাদে উড়ত। ২৫শে মার্চের পর এ পতাকা আর প্রকাশ্যে দেখা যায় নি। কারো কাছে এ পতাকা পাওয়া গেলে পাক সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে নিমর্মভাবে হত্যা করেছে। তাই মারণাস্ত্রের মত নয় মাসব্যাপি বাংলাদেশের পতাকাও ছিল বিপজ্জনক-জীবনের জন্য ঝৃঁকিপূর্ণ। অথচ তারপরও মানুষ কীভাবে সযত্নে এ পতাকা সংরক্ষণ করেছে- এমনি একটি দিনের প্রত্যাশায়। চতুর্দিকে এরকম একই দৃশ্য দেখতে দেখতে আলম দেওয়ান হাটের মোড়ে এসে পড়ে। এ সময়ে পাকিস্তানী সৈন্য বহনকারী একটি ট্রাক বন্দরের দিকে যাচ্ছিল । সৈন্যভর্তি এ ট্রাকের চতুর্দিকে মেশিনগান, এস,এল,আর, তাক করা। আগ্রাবাদ রাস্তা পার হওয়ার সময় লোকজন তাদের লক্ষ্য করে খিস্তি-খেউড় করছিল। ট্রাকের উপর দণ্ডায়মান সৈন্যরা তখন ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত-বিপর্যস্থ তাদের চেহারা। রাস্তা থেকে কে এক জন তাদের দিকে একটি পাথর ছুড়ে মারতেই একজন সৈন্য গুলি ছুড়ল। লুঠিয়ে পড়ল একজন। লোকজন ছুটাছুটি শুরু করল। কিছুলোক গুলিবিদ্ধ লোকটিকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে জানে না আলম। ট্রাক দ্রুত বন্দরের দিকে অপসৃয়মান হল।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাবাহিনীর দীর্ঘ একটি কনভয় দেওয়ানহাটের মোড় হয়ে আগ্রাবাদ রাস্তায় ওঠে আসল। প্রথমে উল্লসিত জনতা কিছুটা ভড়কে গেল । কিন্তু পরমুহুর্তেই সৈন্যদের পোশাক ও তাদের বহনকারী গাড়ি দেখে তারা বুঝে পেলল এ কনভয় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর। সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু গাড়ি। মিত্র বাহিনীর গাড়ী দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে শ্লোগানে তারা মিত্র বাহিনীর জোয়ানদের অভিবাদন জানাতে থাকে। জবাবে মিত্র বাহিনীর জোয়ানেরা ও ‘জেয়বাংলা’ বলে, হাতের অস্ত্র উঁচিয়ে লোকজনের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মধ্যে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন। মিত্র বাহিনী হিসাবে একটি বিদেশী সেনাবাহিনির সদস্যদের নিজের দেশে প্রবেশ করাকে সে দেশের আমজনগণ এভাবে সংবর্ধনা দিয়েছে কিনা আলমের জানা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গাড়ীতে ওঠে পড়ে আলম। মিত্র বাহিনীর কনভয়টি চট্টগ্রাম নৌ-বাহিনি ঘাটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। পাক সেনারা চট্টগ্রাম সেনানিবাস ব্যতীত নৌ-বাহিনী ঘাটিতে জড়ো হয়েছে। নৌ-ঘাটির সদর দরজায় নেমে পড়ে আলম। তখন বেশ কয়েকজন পাক নৌ-সেনাকে নদী থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসছে সাধারণ মানুষ। একটি অন্তর্বাস ছাড়া কারো পড়নে কোন বস্ত্র ছিল না। জনতার রুদ্ররোষের শঙ্কায় ভীত-বিহ্বল এসকল নৌসেনারা হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে কর্ণফুলি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সাম্পানের মাঝিরা উদ্ধার না করলে কর্ণফুলীর খরস্রোতা লোনা জলে তাদের সলিল সমাধি ঘটত। এ সকল পাক নৌ-সেনাদের উদ্ধারের পর জনতা কোনরূপ হেনস্থা না করেই তাদের মিত্র বাহিনীর হাতে সোপর্দ করল। আলমের মনে হল বিজয়ের আনন্দে চিরায়ত কোমল মনের অধিকারী বাঙালির মন মহৎ হয়ে গেছে । চলবে——-।
* আমার কৈফিয়ত-
(বহুদিন পূর্বে স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা নামে আমার একটি ধারাবাহিক লেখা-যার ব্যাপ্তি সেই ১৯৬৫ ইং সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালীন সময় থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালীন সময় পর্যন্ত বিস্তৃত-লিখেছিলাম। সাধ থাকা সত্বেও সাধ্যের অভাবে অদ্যাবধি তা ছাপার মুখ দেখেনি। ইদানীং মুক্তমনায় লেখার সময়ও পাই না। হঠাৎ মনে হল মুক্তমনায় ধারাবাহিকভাবে লেখাটি দিই না। পাঠক বিরক্ত না হলে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাব। তবে এ লেখাটি একজন কিশোর কিভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধায় রুপান্তরিত হল এবং একটি নতুন স্বদেশের স্বপ্ন দেখেছিল এবং স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল, অনেকটা তার আত্মজৈবনিক স্মৃতি কথা-অবশ্যই কোন ইতিহাস নয়। মোটা দাগে এখানে সময়-কালের উল্লেখ থাকলেও ইতিহাসের সন-তারিখের সাথে হুবহু মিল খোঁজা সমীচিন হবে না। তবে ইচ্ছাকৃত ইতিহাস বিকৃতির কোন প্রয়াস রচনার স্বার্থে এ লেখায় করা হয়নি।)