নেশনরা অমর নহে, তাহাদের আদি ছিল, তাহাদের অন্তও ঘটিবে! – রবীন্দ্রনাথ, আত্মশক্তি

প্রায় দু কোটি মানবসন্তানকে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ ঠাউরে বাংলাদেশে নিক্ষেপ করতে চাইছে মোডিফাইড ভারত! মোদি দেশপ্রেমিক নয়?

ভারতে যেটুকু জায়গায় ৩৮০ টি মানবপ্রানী বাসা বেঁধে থাকে , বাংলাদেশের ঠিক ততটুকুন জায়গাতেই মাথা গুঁজে থাকে তার প্রায় তিনগুণ। তবু। হতে পারে মোদির গর্জন নির্বাচনকালিন টয়লেট টিস্যু বা সত্যি সত্যি হয়ত মমতার ভোট ব্যাংক হিসেবে প্রতিপালিত অনেক অনেক ‘বাংলাদেশী বাঙ্গালি’। কিন্তু এমন ভারতীয়ের কি অভাব যাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে না এই ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ সিনড্রোম, যাদের ভাবনায় জড়িয়ে থাকছে না এক দল ‘খাদক বাংলাদেশী’ যারা ভারতীয়দের সব উন্নয়ন কুরে কুরে খাচ্ছে, চেটেপুটে শেষ করে দিচ্ছে সব? নইলে মোদি কি করে খেললেন ‘বাংলাদেশী’ তাস? কি করেই বা পেলেন অমন চোখ জুড়ানো সাফল্য পেলেন নির্বাচনী পরীক্ষায়?

তাহলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মানুষ দেশপ্রেমিক নয়? নিজের দেশের সম্পদ তারা অন্য দেশের পেটে ঢোকাতে রাজি নয়; তো, তারা দেশপ্রেমিক নয়?

বলতে কি, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা ধরে এগুলে দুনিয়াভর খালি দেশপ্রেমিকের দেখা মেলে; আর পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মানুষ ‘দেশের সম্পদ’ দেশেই রেখে দিতে চেয়ে খাঁটি দেশপ্রেমিকের কাজই করছে, সেই বিষয়ে সন্দেহ কি! কিন্তু গোলমাল দেখা দেয়, যখন উত্তর প্রদেশ/বিহার/উড়িষ্যা থেকেও দলে দলে মানুষ এসে ভিড় করে পশ্চিমবঙ্গে; প্রশ্ন উঠে, তখনও কি পশ্চিমবঙ্গের দেশপ্রেমিকগণের শঙ্কিত হওয়া উচিত? সম্পদ-শরিক কি এক্ষেত্রেও উড়ে এসে জুড়ে বসে না?

তবে দেশপ্রেমের কিছু স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম কিন্তু সত্যি গোল বাঁধতে দেয় না, হিসেব-নিকেশ খুব সহজ হয়ে যায় একটু ভাবলেই, যেমনঃ বাংলাদেশীরা হাতের নাগালে থেকেও বাসা বাঁধতে পারে না পশ্চিমবঙ্গে, অ-ভারতীয় বলে, অন্যদিকে বহু দূর হতে এসে দূর ভারতীয়রা সব লুটেপুটে নিতে পারে, ভারতীয় বলে! আর একজন পশ্চিমবঙ্গীয় একজন দূর ভারতীয়ের জন্য যে স্যক্রিফাইসটুকু করল, তা-ও কিন্তু তার দেশপ্রেমেরই অংশ! ভারতীয় দেশপ্রেম!!

আসলে দেশপ্রেম কাকে বলে? নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের দেশের মানুষ, পশু-পাখি, গাছ-পালা, নদী-নালা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সহ দেশের সবকিছুর (কোন কিছু বাদ পড়ে যেতে পারে, এই ভয়ে ‘সবকিছু’ ঢুকিয়ে দেয়া হল) প্রতি প্রেমই দেশপ্রেম, তাই নয় কি?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একটা সময় তো পৃথিবীটা বিভক্ত ছিল না এমন করে, ছিল না এত এত দেশের দেয়াল, তখন কি ছিল না মানুষের প্রেম নিজের মাটি, নিজের মানুষ, পশু-পাখি, গাছ-পালা, নদী-নালা, ইতিহাস, ঐতিহ্য – এ সবকিছুর প্রতি? এই যে মাটি-মানুষ-প্রকৃতি – এগুলোর প্রতি ভালবাসা মানুষের, এদের সঙ্গে আদানপ্রদান, এ তো সহজাত, এর জন্য আলাদা করে পাঠ্যপুস্তকের পরতে পরতে ‘দেশপ্রেম’ ঢুকিয়ে দেয়ার দরকার হল??? তোতা পাখির মত মুখস্থ করানোর দরকার হল দেশপ্রেমের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য?

‘দেশপ্রেম’ শিক্ষণের ফলাফল বড়ই চমকপ্রদ! গোলাম আযম কিন্তু বাংলাদেশেই জন্মেছিলেন, এই দেশের মাটি-মানুষ-প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু উনার মগজে খুব নিখুঁতভাবে খোদাই করে দেয়া হয়েছিল ‘পাকিস্তান’; বলতে কি, পাকিস্তান নামক দেশটির প্রতি প্রেম দেখানোর ‘যথার্থ’ শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি, যার ‘পরিপূর্ণ’ ও ‘সফল’ চর্চা করেছিলেন জন্মস্থানের তিরিশ লাখ লোকের খুনে হাত রাঙ্গিয়ে! দেশপ্রেমের কি প্রবল শিক্ষাই না পেয়েছিলেন জিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শাহ আজিজ (জিয়ার ভাব-গুরু না ভাবশিষ্য??), ‘বাংলা ভাষা’ শব্দটিকেও মুছে দিতে চেয়েছিলেন, সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন ‘বাংলাদেশী ভাষা’!! দেশপ্রেমে বলিয়ান, কি বলেন? গোলামের দেশ তো পাকিস্তান, কিন্তু এই বছরখানেক আগেই হেফাজত সেনাদের ‘তোমার আমার ঠিকানা, মক্কা-মদিনা’ শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ; হেফাজতিদের ঠিকানা তাহলে আরব, বাংলাদেশ নয়??? ‘দেশপ্রেমে’র কি বিপুল শিক্ষাই না ধারণ করছিল মাদ্রাসার ছেলেগুলি, যে জান দেবে, তবু ‘ঠিকানা’র নিশানা উড়াবেই!

দেশপ্রেম সত্যি এক অদ্ভুত ব্যাপার! আমার বাড়ি থেকে হয়ত হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় পশ্চিমবঙ্গ, তবু তার জন্য শত শত মাইল দূরের সেইন্টমার্টিনের চেয়ে অতিরিক্ত কোন ভালবাসা থাকবে না আমার, দেশের অবমাননা হয়ে যাবে যে! কারণ দেশপ্রেম এমনটাই শিখিয়েছে! একই কারণে ওয়াঙ্গারি মাথাই পৃথিবীর সবুজ বিপ্লবের জন্য নোবেল পেলে তার খবর না নিলেও চল্বে, কিন্তু ডক্টর ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তির সনতারিখ মুখস্থ করে নিতে হবে, উপস্থিত বক্তৃতা দিতে হবে তার জীবন ও কর্মের বর্ণনা করে; এমনকি যদি আমি মাথাইয়ের সবুজ বিপ্লব দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের গ্রামের পতিত জমি সবুজে ভরে ফেলি, তবুও ইউনুস গর্বেও বুক ফুলাতে হবে আমায়! মাথাই হৃদে খানিক জায়গা পেতে পারে বটে, তবে শর্ত হচ্ছে ইউনুসের নীচে রাখতে হবে তাকে! বাংলাদেশী দেশপ্রেম!

জাফর ইকবাল স্যার আমেরিকার বিখ্যাত বেলোকোরে গবেষক হিসেবে দীর্ঘ আটবছর ছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতি বছর নোবেলের জন্য নমিনেশন পেত, তাই নোবেল মাছ-ভাতের মতই হয়ে যাওয়ার কথা স্যারের কাছে, অন্তত আমরা যেমন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই, স্যারের বেলা তেমনটি হওয়ার কথা না! সেই জাফর স্যার কিন্তু প্রতি বছর নোবেল কমিটির ঘোষণায় কান উৎকীর্ণ করে রাখতেন, একজন বাংলাদেশীর নাম শোনার অপেক্ষায়! আমরাও কিন্তু তাই করতাম! এখনও করি! কিন্তু কেন করি? কেন এমন হয়?

দেশপ্রেমের শিক্ষা খুব সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করে আজকের যুগে। সবার মধ্যেই দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় এর মহান মর্মবাণী। আর কোন শিক্ষা কি এত দ্রুত বিকাশ লাভ করে দেশের কোমল-মতি বালক-বালিকাদের অন্তঃকরণে??? যু

যুদ্ধংদেহী বুশকে হারিয়ে ক্লিনটন যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেনে আমেরিকায়, গর্ব করে বলেছিলেন প্রিয় দেশবাসীকে, ‘আমেরিকা উইল লিড দ্যা ওয়ার্ল্ড!’ এমনকি আজকের যুগের ওবামাবতারও কি ভিন্ন কিছু বলছেন? ‘আমেরিকা উইল বি দ্যা গ্রেটেস্ট নেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড?’ – ওবামাবতারও তো তাই নিশ্চিত করতে চান, নাকি?

আচ্ছা, কেউ যদি গ্রেট হতে চায়, হতে চায় ‘সবার চেয়ে সেরা’, সমস্যা কি? কম্পিটিশনের চিন্তা? তো প্রতিযোগিতা তো খুবই উপকারী ঔষধ, আজকের সভ্যতা প্রতিযোগিতা না থাকলে এগুতো কি? তবে কথা হচ্ছে, প্রতিযোগীতাটা কার মধ্যে হবে? একজন মানুষ আর একজন মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করবেই, নইলে উৎকর্ষতা আসবে কি করে? তাই ভারতের সুধাংশু ভারতের দীপকের চেয়ে বড় হতে চাইবেই, এমনকি সুধাংশু বাংলাদেশের শেখরের চাইতেও বড় হতে চাইতে পারে! খুবই স্বাভাবিক! একই সঙ্গে প্রাকৃতিক!

কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যায়, যখন ভারত রাষ্ট্র তার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বড় হতে চায়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একচ্ছত্র সম্রাট বনে যেতে চায়! ভারতের এক সুধাংশু বাংলাদেশের এক শেখরের চেয়ে বেশী সামর্থ্য দেখাতেই পারে, কিন্তু আবার হাজারো অন্য সুধাংশু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য শেখরদের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে পারে ন্যাচারাল প্রতিযোগীতায়! মানুষে-মানুষে এমন প্রতিযোগীতা/ পাস-ফেইল/ উৎকর্ষতার বিচারে পিছিয়ে পড়া বা এগিয়ে যাওয়া খুবই প্রাকৃতিক, খুবই জেনেটিক, কিন্তু রাষ্ট্রের বেলা?

বলতে কি, যখন মানুষের একান্ত স্বাভাবিক প্রতিযোগীতা, যা শুধু মানুষেই মানায়, তা ছিনতাই হয় রাষ্ট্র কর্তৃক, রাষ্ট্র নিজেই জড়িয়ে পড়ে ভীম-ভীষণ প্রতিযোগিতায়, একটি জন-সমষ্টিকে যেনতেন-ভাবে বিজয়ী করতে সে তখন উঠেপড়ে লাগে , শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার লোভে তখব সভ্যতার সবগুলো পোশাক খুলে ফেলতেও আপত্তি থাকে না তার; ও হ্যা, সঙ্গে থাকে এক খণ্ড অতি আবশ্যকীয় লেবাস – দেশপ্রেম, ও তার জন্য নিবেদিত কুট ও রণনীতির অন্যান্য আচাড়!

অথচ এমন যদি হত, রাষ্ট্র নিজে কোন প্রতিযোগিতায় জড়াত না, বরং, মানুষে-মানুষে প্রতিযোগিতার জন্য উত্তম পরিবেশটুকু নিশ্চিত করে দিত শুধু, তাহলে আমরা হয়ত শ্রেষ্ঠ জাতি পেতাম না, কিন্তু শ্রেষ্ঠ মানুষ তো পেতাম! যাদের চিন্তা-গবেষণায়-কাজে ধরিত্রীতে থাকত না কোন দ্বেষ-প্রেম, থাকত শুধু প্রকৃতি ও মানব-প্রেম!

অনেক অনেক ছোট থাকতে এক শিক্ষকের মুখে জেনেছিলাম, ‘রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন ব্রিটিশের পা-চাটা….’, থাক আর নাই বাড়ালাম। পুরো ভারত যখন স্বদেশীকতার জ্বরে আক্রান্ত, তখন রবীন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তো রবীন্দ্রনাথ কি দেশপ্রেমিক ছিলেন? রবীন্দ্রনাথ তার ‘Nationalism’ –এ লিখেছিলেন:

Nations Live in an atmosphere of fear, greed, and panic, due to the preying of one nation upon other for material wealth. Its civilization is carnivorous and cannibalistic, feeding upon the blood of weaker nations. Its one idea is to thwart all greatness outside its own boundaries. Never before were there such terrible jealousies, such betrayals of trust; all this is called patriotism, whose creed is politics.

আসলে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশীকতার নামে সুদীপদের জ্বালাও-পোড়াও কখনই মন থেকে নিতে পারেননি, দেশের মানুষকে ঠকিয়ে-সর্বনাশ করে কিভাবে দেশের উন্নয়ন করা যায় তা সত্যি তার মাথায় ঢুকত না, আজকের যুগে বেঁচে থাকলে জামাত-বিএনপি কর্তৃক মানুষ-বৃক্ষ-গরু পুড়িয়ে ‘হাসিনা বিতাড়ন’ চেষ্টা দেখেও তিনি হতভম্ব হতেন নিঃসন্দেহে! রবীন্দ্রনাথ স্বদেশীকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে নিয়েছিলেন? যেই রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন মুক্তির কথা লিখে গেছেন, উনি মুক্তি চাননি তার দেশের মানুষের, তা হয়?

ইতিহাস ঘাঁটলে রবীন্দ্র-দেশপ্রেমের ভুরি ভুরি নজির পাওয়া যায়, তবে তা ছিল ‘রাবীন্দ্রিক দেশপ্রেম’, খানিক আলাদা, যা আগাগোড়া মোড়া ছিল বিশ্বপ্রেম দিয়ে! আর সেজন্যই হয়ত ছাড়িয়ে নিতে পেরেছিলেন নিজেকে সর্বগ্রাসী দ্বেষ-প্রেমের শক্ত বাঁধন থেকে!

আজ থেকে প্রায় দু-আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক Diogenes এবং Seneca জাতির সীমানা সূর্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করার কথা ভেবেছিলেন। আজকের যুগে এ নিছকই পাগলামি, অসুস্থ ভাবনা। একের পর এক সোল্লাসে দেশের দেয়াল গড়ছি আমরা। কিন্তু এরপর?

পৃথিবীর সব ক’টি বাড়ি মুছে যাবে
রয়ে যাবে একখণ্ড বিশাল শোক
মানবিক ভূগোলের নামে,/
একদিন আমাদের গ্রহটি
একতাল শূন্যের আকারে
নিজেরই ভিতরে ঘুরে যাবে। (ভবিষ্যৎ বাণী, জুল সুপেরভিয়েল)