১.
অনেক দিন আগে, প্রায় দশ হাজার বছর আগে এক নিওলিথ মানুষ বেরিয়ে এসেছিল তার পাহাড়ী গুহা থেকে শিশির ভেজা সকালে। তার সামনে – কিছু ছোট সবুজ গাছ পেরিয়ে – বহু নিচে একটা উপত্যকা নিজেকে বিছিয়ে রেখেছিল লাল, হলুদ আর বাদামি গাছের আবরণে। উপত্যকার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল এক স্বচ্ছ নদী। তারপর নদী পেরিয়ে জংলী সবুজ ঘাসের মাঠ, তাতে ফুটে ছিল নীল-বেগুনি ফুল। অবশেষে মাঠের প্রান্তরে দিগন্তের ধারে কুয়াশার মাঝে জেগে ছিল স্তরে স্তরে নীল পাহাড়।

সূর্য উঠছে এই পাহাড়ের পেছন দিয়ে। ওপরে নীল নীল আকাশ, চোখ তুলে তাকায় নিওলিথ মানুষ সেই দিকে। আদিম চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে আকাশ চিরে চলে যাওয়া দুটি শুভ্র সরলরেখা। ধীরে, খুব ধীরে অসীম নীলে তুলোর মত ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে সেই রেখার মাথায় সূর্যের আলোকে প্রতিবিম্বিত করে কোন ধাতব বস্তু। ভেসে যায় খুব ধীরে মাটির অনেক ওপর, বাতাসের তরলে উড়ে যায় এক বিমান বোয়াল মাছের মত।

এ কোন প্রাণী, ভাবে সেই নিওলিথ জীব, যে আকাশের গা ঘেঁষে চলে? একটা চাপা শব্দ আস্তে আস্তে উপত্যকার ওপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ধাতব পাখি নিচু স্বরের তীক্ষ্ণতায় ভরিয়ে দেয় জনশূন্য আদিম প্রান্তর, তার ইঞ্জিন থেকে নির্গত ধোঁয়া অতি-উচ্চতার স্ফটিক ঠাণ্ডায় ঘনীভূত হয়ে যায়।

তার পাহাড় ও নিচের উপত্যকাটি ছাড়া নিওলিথ মানুষ জানে না এই পৃথিবীতে আর কি আছে। তার গোষ্ঠী থেকে সে হারিয়ে গেছে বহুকাল। আজ সে চিন্তা করে পাহাড়ের ঐ পারে বন পেরিয়ে কি রহস্য সঞ্চিত আছে তার জন্য। সেখানে বাস করে কি আকাশের গায় ঝলসে ওঠা পাখিরা? নাকি সেই পাখি এসেছে রাতের আকাশের গায়ে জ্বলে থাকা আলোর বিন্দুগুলো থেকে? ঐ পাখি কি দেখতে পাচ্ছে এই নিচে, বহু নিচে ক্ষুদ্র মানবকে? জানছে তার অস্তিত্ব?

অতি উচ্চতার বাতাস ধীরে ধীরে ধোঁয়ার সরলরেখাকে সাপের মত বাঁকিয়ে দেয়, দিগন্তে মিলিয়ে যেতে থাকে ধাতব পাখি। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নিওলিথ মানুষ। এক অসীম নিসঙ্গতায় ভরে যায় মন। এই পাখি কি দেখেছে তাকে? জেনেছে তার অস্তিত্ব? সে কি জানে তার স্বপ্নের কথা? সে কি বলবে কাউকে আদিম বুনো পাহাড়ে দেখেছে সে এক সঙ্গহীন মানুষ? বিশাল আকাশের নিচে হৃতমান নিওলিথ প্রাণী প্রার্থনা করে ঐশ্বরিক পাখির কৃপা।

তারপর সে ফিরে আসে গুহাতে। গুহার কোণায় জ্বলে আগুণ। গুহার একপাশে একটা বড় পাথর, পাথরের ওপর ছোট একটা অবতল জায়গা। সেখানে রাখা আছে রং। লাল-বাদামি মাটি, সবুজ পাথরের গুঁড়ো আর গাছের বাকল তেলের সাথে মিশিয়ে আগুনের উত্তাপে নিওলিথ মানুষ তৈরি করেছে রং। একটা ছোট ডাল নিয়ে তরল রং তুলে আধো অন্ধকারে সে আঁকে ছবি, গুহার দেয়ালে। আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির ছবি। সেই পাখি ঝলকায় সূর্যের আলোতে। পাখির পেছনে সে আঁকে দুটি রঙ্গিন মেঘের রেখা। আকাশের বিমান উড়ে যায় নিওলিথ গুহায়।

২.
দশ হাজার বছর পর সেই নিওলিথ গুহা ঢাকা ছিল লতাগুল্মে। সেই প্রাচীন মানুষটির বসবাসের কোন চিহ্ন ছিল না পাথরের মেঝেতে, কিন্তু দেয়ালের গায়ে ছিল তার আঁকা চিত্রকর্ম। একটি ছোট গ্রাম ছড়িয়ে থেকে নিচের উপত্যকায়। একদিন গ্রামের ছেলেমেয়েরা পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে পেল সেই গুহা। তারপর সেই নিওলিথ মানুষের ছবি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এল মানুষেরা। একদিন এক পর্যটকদলের সাথে আসে এক বৈমানিক। সে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের গায়ে আঁকা সেই ধাতব পাখির দিকে। সেই পাখির পেটে আঁকা আছে কয়েকটি দাগ দিয়ে একটি চিহ্ন। চিহ্নটি তার চেনা। তার বিমানের নিচে আঁকা আছে একই চিহ্ন।

গুহা থেকে বার হয়ে আসে বৈমানিক।

সেই বৈমানিক দেখেছিল কি নিওলিথ মানুষটিকে? অনেক নিচে, পৃথিবীর কোণায় আদিম মানুষটি যখন প্রার্থনা করছিল ধাতব পাখির ঐশ্বরিক কৃপা? দশ হাজার বছর পর গুহার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বৈমানিক যেখানে একদিন দাঁড়িয়ে ছিল নিওলিথ মানুষ। সামনে ছড়ানো থাকে ছোট্ট সাজানো গ্রামটি। আকাশের দিকে তাকায় বৈমানিক। সে আজ নিওলিথ মানব, তার জন্য কি আকাশের গায়ে উড়ে যাবে কোন ধাতব পাখি? আকাশের দিকে তাকিয়ে নিওলিথ স্বপ্ন দেখে বৈমানিক।