রতন ভাবে, আর ছয়টা মাস…। এখন আর শরীরে কুলায় না। বয়েস হয়েছে। ডায়াবেটিস আছে। আজ পনোরো বছর অফিস করছে ঢাকা গিয়ে। সাড়ে ছটার লঞ্চ ধরে গজারিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল। সেখান থেকে ট্রেন চেপে কমলাপুর স্টেশন। ট্রেন পাল্টিয়ে কোন একটা ট্রেনে ধরে শেষে অফিস। সাকুল্যে সাত হাজার টাকার পিয়নের চাকরি। জমিজিরত নেই। ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া। বসতবাড়িটুকু ছাড়া আর কোন সম্বল নেই। ওটুকু আছে বলে সে শেকড়হীন হয়নি । নইলে আরো কয়েক কোটি শহুরে বস্তিবাসীর খাতায় তার নামটুকু উঠতে পারতো। মনে মনে এজন্য এক ধরনের গর্ব আছে রতনের। গত পনেরো বছর এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চাকরি করে গেছে এই অহংকারের জোরেই। যেটুকু জমিজিরত ছিল বাপের আমলেই নদীর গর্ভে গেছে। চাকরির পয়সায়ই তাই মাসান্তে ভরসা।

ছ’মাস পর সমিতি ভাঙ্গবে। সমিতি থেকে লাভসহ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে রতন। সে টাকায় দোকান করবে। আর দৌড়াতে হবে না। বসে বসে বাকী জীবনটা দোকানদারী করবে। রতনের উৎফুল্ল লাগে । চোখের সামনে দোকানের একটা ছবি ভেসে উঠে। চিপসের প্যাকেট, খাঁচিতে ডিম, মুগ-মুসুরের ডাল, মাথার পেছনে স্নো-পাউডার, হরলিক্সের বয়াম, বাঁ পাশে একটা ব্যানার ঝুলবে, এখানে মোবাইলে টাকা ভরা হয়…। এইসব কিছুর মধ্যে রতন নিজেকে পরিতৃপ্তি আর সুখি একটা চেহারায় দেখতে পায়, রেল স্টেশনের হাশেমের মত। হাশেমের একটা দোকান আছে নারায়ণগঞ্জ স্টেশনের প্লাটফর্মে। ট্রেনের অপেক্ষায় রতন সেখানে বসে একটু চা খায়। সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতা তাদের। হাশেমই বলেছে দোকানের কথা। পাইকারি বাজারের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিবে। মাসে একবার এসে মালসামান কিনে লঞ্চে করে নিয়ে যাবে। হাশেমকে দেখে রতনের হিংসা হয়। রেল স্টেশনের পাশেই বাসা। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে দোকানে এসে বসে। ইচ্ছা হলে কাউকে বসিয়ে একটু বাসা থেকে ঘুরে আসে। কত স্বাধীন সে! কারুর জমাখরচের টাইম নাই। কারুর ধমক নাই। টাইমে গিয়ে না পৌঁছালে বেতন কাটার কেউ নাই। রতন ভাবে, হাশেম তার চেয়ে কত ভাল আছে।…
রতনকে ভোররাতে উঠে অফিসের জন্য তৈরি হতে হয়। নুরী উঠে তারচেয়েও আগে। উঠে ভাত বসায়। এদিকে এখনো গ্যাস আসেনি। মাটির চুলায় একটায় ভাত অন্যটায় তরকারি। এই সময়টা খুব তাড়াহুড়ার থাকে। ৬টার মধ্যে সব কিছু রেডি থাকতে হয়। হাঁটা পথে লঞ্চঘাটে তার বাড়ি থেকে ২০-২৫ মিনিট লাগে। মাপা হিসাব, ঘড়িতে ৬টা বাজতেই ঘর থেকে বের হয়। এখনকার জনা বিশেক লোক রোজ দিনের প্রথম লঞ্চটা ধরে। নারায়ণগঞ্জ বিসিকে, ঢাকার উত্তরা পর্যন্ত লোকে চাকরি করতে রোজ প্যাসেনঞ্জারি করে এই রুটে। এই লঞ্চেই একটা লোকের সঙ্গে রতনের পরিচয় আছে। সে আসে সেই চাঁদপুর থেকে। নারায়ণগঞ্জের বিসিকে গার্মেন্টেসে কিউসির চাকরি করে। রতনের অফিসের কলিগরা চোখ কপালে তোলে রতনকে দেখে, বলে, এত দূর থিকা আসো রোজ! ঢাকাতে বাসা লইয়া থাকো না ক্যান?
-কন কি, ভিটাবাড়ি আছে না?

-থাকুক। মাইনষে দেশবাড়ি থিকা ঢাকায় আইসা মেসে থাকে না?

রতন মনে মনে খুব বিরক্ত হয় এসব কথায়। কিন্তু স্যার গোছের লোকে বললে মাথা চুলকে বিনয়ে কেলিয়ে একটু হাসতে হয়। মনে মনে অবশ্য সে গালি দেয়, হালারপুত! …

লঞ্চের হুইসেলে চটক ভাঙ্গে রতনের। এক-দুই মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না লঞ্চ। রতন অভ্যস্ত পায়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে উঠে। গরম বলে বারান্দার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। লঞ্চ ফের হুইসেল দিয়ে ঘুরতে থাকে, নারায়ণগঞ্জমুখী হয়।

দেখতে দেখতে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ফেলে টার্মিনাল দৃশ্যপটে চলে আসে। সাতটা চল্লিশে নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে কমলাপুরগামী ট্রেন। ট্রেন ধরার জন্য রতন দ্রুত লঞ্চ থেকে নামে। লঞ্চঘাট থেকে ট্রেন স্টেশন হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। রতন এতেই ঘেমে নেয়ে উঠেছে। সকাল থেকেই তেতে উঠেছে রোদ। প্লাটফর্মে গিযে দেখে বেজায় লোক দাঁড়িয়ে কিন্তু ট্রেনের কোন দেখা নাই। হাশেমের দোকানের বেঞ্চিতে গিযে বসে রতন। হাশেম বলে, ট্রেন লেইট। ইঞ্জিন নাকি নষ্ট শুনলাম…।

রতন মাথা নাড়ে। আজো তাহলে নিশ্চিত লেট হবে অফিসে। তিনদিন লেটে একদিনের বেতন কাটে। এ মাসে তার এরমধ্যে দুদিন লেট হয়ে গেছে। সে একটা চা নিয়ে বিরসমুখে খেতে থাকে। দুপাশের বেঞ্চিতে আরো প্যাসেঞ্জার বসে আছে। সবাই গুম নিয়ে কথা বলছে। একজন বলল, আরে ভাই, কবে যে গুম হইয়া যাই সেই কথাই এখন ভাবি!…

এই কথার মধ্যে আনন্দের কিছু নাই। তবু লোকটা শরীর দুলিয়ে হাসে। অন্যজন তাল দিয়ে বলে, আপনে কন এই কথা। আপনের ভাবী কাইল কয়…।

রতন এইসব কথায় গিয়ে যোগ দেয় না। সে জানে তাদের মত লোক গুম হয় না। তাদের মত লোককে কে গুম করবে? এক পয়সা বের করার মুরোদ নেই, তাদের আবার শত্রু কে? হারেস চাচার সঙ্গে বেড়া দেয়া নিয়া ঝগড়া আছে অনেকদিন থেকে। কিন্তু এজন্য হারেস চাচা বা সে কেউ কাউকে গুম করবে না। গুম করানোর মত টাকা কোথায়? হারেস চাচা সারা বছর বর্গা খাটে অন্যের জমিতে। চাচার সঙ্গে যখন ভাল সম্পর্ক ছিল তখন বলতো, বাজানরে, মন চায় দুই চোখ যে দিকে যায় যাই গা! আর বাঁচতে ভাল লাগে না…। হারেস চাচার বাড়িতে বড় অভাব। অতগুলো ছেলেমেয়ে, সমৎবৎসরে খোরাকি জুটে না। সমত্ত মেয়ের বিয়ের পয়সা জোগাড় হয় না। রতন ভাবে, সে নিজেও কতদিন মনে মনে কামনা করছে, কেউ যদি তাকে গুম করে ফেলতো! সে মরে গেলে তো কিছু দেখতে পেতো না। তখন কে কিভাবে বাঁচছে-মরছে তাকে দেখতে হবে না। অভাবের কথা শুনতে আর ভাল লাগে না…।

ট্রেন এলো বিশ মিনিট লেটে। সিডিউল ফেল করায় দুই ট্রেনের প্যাসেঞ্জার এখন এক ট্রেনে। সে কি গুতোগুতি আর ঠেলাঠেলি! পা রাখার জায়গা নেই। প্রত্যেক কামড়াতে ঝগড়া। অফিস টাইমে রোজকার চিত্র। রতন আজকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। দুপাশের সিটের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঠেলাঠেলি থেকে এই জায়গাটা নিরাপদ । লোকজন চেঁচামেচি করছে। ঝগড়া করছে সিটে বসা নিয়ে। এর মধ্যেই ট্রেন ছাড়লো। রতন ভাবে, আজ লেট মানে সব দিকেই লেট। কমলাপুর থেকে যে ট্রেনটা ছাড়বে সেটাও তো গড়বড় হয়ে গেলো। এখন বাসে গেলে টাকার চাইতে সময়ই বেশি লাগবে। একচোট গালাগালি শুনতে হবে। মিজান সাব তো দেখেই বলবে, কী ফালাইতে আইছো অপিসে! টেবিল-চেয়ার যদি আমারই মুছতে হয় তুমি কী ফালাইবা?…

রতন অফিসে পৌঁছায় দশটায়। মনে মনে একটা কঠিন পণ করে ফেলে, উল্টাসিধা কিছু আজকে হলে শালার চাকরিতে লাত্থি মাইরা আজই চলে আসবে! কয়েকটা মাস কষ্ট হবে ঠিকই, কিন্তু দোকান তো হচ্ছেই, চাকরির পরোয়া আর করতে হবে না। রতন তাই একটা হালকা চালে অফিসে গিয়ে ঢুকে। টেবিলে টেবিলে পানি বোতল দিয়ে আসে। চা বানিয়ে টেবিলে রেখে আসে। আশ্চর্য, কেউ একটাও কথা বলে না তাকে দেখে! পাঁচ মিনিট লেট হলে যেখানে কথা শুনতে হয় সেখানে আজ এক ঘন্টা লেট। রতন ভাবে, চাকরি আছে তো?

না, চাকরি তার আছে। তবে নারায়ণগঞ্জের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগায় বড় স্যার যে ক’জন ছিল সবাই সেখানে ছুটে গেছে। অফিসের অবস্থাও তাই আজকে একটু অন্য রকম। রতনের লেট কাউন্ট করার মত অবস্থা ছিল না। রতন মনে মনে ভাবে, ভালই হইছে। আজ কাজকর্মে একটুও মন বসতাছে না। দোকানের স্বপ্ন তার সব মনোযোগ নষ্ট করে ফেলেছে। বৃস্পতিবারের অফিস এমনিতে চাপ থাকে। পরদিন ছুটি বলে কাজের একটা বাড়তি প্রেশার থাকে। অফিস প্রায় খালি। রতনের কাজও তাই আজ কম। নইলে একটু পর পর ফটোকপির পিছনে দৌড়াতেই জান বের হয়ে যায়। রতন খুশি মনে চায়ের কাপে চামচ নাড়ে। এটা তার নিজের চা। সুরুত সুরুত করে চায়ে চুমুক দেয়। কোন মতে সাড়ে ছয়টা বাজিয়ে বের হতে পারলেই হলো, আজ কি বলে কয়ে আধ ঘন্টা আগে বের হওয়া যাবে না? তাহলে বাজারে গিয়ে নবী মিস্ত্রিকে ধরা যাবে। নবী মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঘরের চালা সারানোর দরকার। দোকানের জন্য কাঠ কিনে রাখতে চায়। কাঠ কিনাবে মিস্ত্রিকে দিয়ে। সেসব নিয়া কথা বলা দরকার।

লঞ্চ থেকে নেমে ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকার পথ বেয়ে রোজ বাড়ি ফেরে রতন। যখন বাড়ি ফেরে তখন প্রায় মধ্য রাত! ছেলেমেয়ে সব ঘুমিয়ে পড়েছে। পাড়া ঘুমিয়ে পড়েছে। বউ ঢুলু ঢুলু চোখে দরজা খুলে দেয়। ঘরের ভেতরটায় বড্ড গরম। উঠানেই বসে সে। কলপাড় থেকে গা ধুয়ে আসে। খালি গায়ে গামছা দুলিয়ে বাতাস খায়। মাথার উপর কালো আকাশে তারা জ্বলে অনেক রাত পর্যন্ত। সে ভাত খেয়ে এসে পান মুখে দেয়। সিগারেট ধরায়। উঠনের একপাশে মৌসুমী সবজির মাচা। সে উঠে গিয়ে ঝিঙের মাচার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারে ছরছর করে কিছু একটা দৌড়ে পালায়। চালকুমড়ার লতাটা বেয়ে উঠেছে ঘরের চালায়। বর্ষার আগেই ঘরের চালাটা সারাতে হবে। উঠানের মাঝখানে জলচৌকি নিয়ে আরো কিছুটা রাত সে বসে থাকে। কাল তো ছুটি, অতো তাড়া নেই। একা একা কথা বলে নিজের সঙ্গে মনে মনে। নানা শলা পরামর্শ, ভবিষ্যত ভাবনা আর স্বপ্নের কথা…।

হাই তুলে রতন। ঘুম পাচ্ছে। উঠে দাঁড়ায়, দুই হাত উপরে তুলে বাঁকা হয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গে। একটা পেঁচা উড়ে যেতে দেখে। রাতজাগা নির্ঘুম তারাগুলোকে ঘরের বাইরে রেখে সে শুতে যায়।

পরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে রতনের। জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে লাগায় চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছাড়ে। কলপাড়ে গিয়ে দাঁত ব্রাস করে। গোসল করতে যাবে তখন সুরুজের ছেলে এসে বলে, আব্বায় আফনেরে সমিতির অফিসে একবার যাইতে কইছে…।

রতন বলে, যা, আমি গোসল কইরা আসতাছি।

প্রত্যেক শুক্রবার সঞ্চয়ের টাকা জমা দেয় রতন। সে একটু ভ্রু কুঁচকায়। অত তাড়া কিয়ের সমিতির ট্যাকা দেয়ার?

বালতি থেকে দুই মগ পানি মাথায় ঢালতেই গোসলখানায় নুরীর মুখ উঁকি দেয়। রতন বলে, কি?

‘সমিতির অফিসে দুনিয়ার মাইনষে ভিড় কইরা আছে…’। নুরীর চোখে-মুখে উৎকন্ঠা, উত্তেজনা।

রতন দ্রুত গোসল সারে। নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে। অফিসের সামনে দেড়-দুইশো লোকের ভীড়। রতন ভীড় ঠেলে সামনে এগোয়। কিছু উত্তেজিত যুবক অফিস ঘরে হামলা চালিয়েছে। বোরখা পরা এক মহিলা মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। লোকজন জিজ্ঞেস করছে, কত টাকা রাখছো তুমি? ঐ মাতারি কথা কও?…
-ডিপুজিট করছি বাজান! তিরিশ হাজার রাখলে এক বছরে ষাইট হাজার দিবো কইছিল…!
একজন ফোড়ন কাটলো, ঠিকই আছে, তোমাগো লোভ বেশি, অহন বুঝো!
রতন এসব কিছুই শুনতে পায় না। সে সুরুজকে খুঁজে। পেয়েও যায় একটু পরে। সে নেতা গোছের লোক। এর মধ্যেই নেতৃত্ব কাঁধে নিয়ে ফেলেছে। তাকে ঘিরে থাকা লোকজনকে সে সংঘঠিত করছে। সুরুজ বলে, আন্দোলন হবে। একটা পাই পয়সা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে…।

দুপুরের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো জায়গাটা। ধারনার চাইতে দেখা গেলো আরো বেশি মানুষের আমানত সংগ্রহ করেছিল সমিতি। আশেপাশের গ্রাম তো বটেই দূরের গ্রাম থেকেও লোকে খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। গ্রাম গ্রাম ঘুরে ডাবল লাভের লোভ দেখিয়ে এরা টাকা তুলেছে। এই রকম কয়েকজন মাঠকর্মীকে এর মধ্যেই পিটিয়ে প্রায় মেরে ফেলার অবস্থা করে ফেলেছে সুরুজের লোকজন। পুলিশ এসেছে। পাবলিককে শান্ত হতে বলছে। তাদের হয়ে একজনকে কথা বলার জন্য বলল। অবধারিতভাবে সুরুজ এগিয়ে গেলো।

গনগনে রোদের মধ্যে শ্লোগন চলতে লাগলো। সাংবাদিক আসছে। বড় কাগজের মফস্বলের পাতায় কাল ছাপা হবে “ কোটি টাকা নিয়ে ভেগে গেলো মাল্টিপার্পাস সোসাইটি”…।

দুপুর তিনটার দিকে হঠাৎ একটা হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেলো। কারা যেন অফিসে আগুন দিতে চেষ্টা করতেই পুলিশ বাঁধা দেয়। জনতা তাতে ক্ষেপে যায়। শুরু হয়ে পুলিশের উপর ঢিল ছোড়াছুড়ি। ফলশ্রুতিতে লাঠি চার্জ। ইদ্রিস মেম্বার এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। আশ্বাস দেন তিনি প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টার একটা ফয়সালা করবেন…।

নামের একটা লিস্ট করা হলো ক্ষতিগ্রস্তদের। লাইন ধরে লোকের নাম আর টাকার পরিমাণ লেখা হলো। রতন উঠে যেতেই সুরুজ তার কাঁধ চেপে ধরে। খাড়া, কই যাছ? নাম লেখাবি না?

রতনের মুখটা কালো হয়ে আছে। সারাদিনের ক্লান্তি-ক্ষোভ তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। সে সুরুজের দিকে বিতৃষ্ণার নজরে চেয়ে বলল, এই মেম্বার আর পুলিশরে বখরা না দিয়া ওরা ব্যবসা করছে তোর মনে হয়? তুই বিশ্বাস করছ এতগুলি টাকা নিয়া ওরা ভাগছে আর ওরা কিছু জানে নাই? থু করে থুতু ফেলল রতন। তর আন্দোলনের সখ তুই কর। আমি আর এর মধ্যে নাই…

তারপর রতন কোথায় কোথায় ঘুরে কে জানে। রাত দশটার দিকে বাড়ি আসে। সারাদিনে চাউর হয়ে গেছে রতন টাকা মাইর খাইছে সমিতিতে। একেকজন একেক কথা বলছে, সত্তর-আশি হাজার নাকি হবে টাকার পরিমাণ! নুরী সারাদিন এই নিয়ে গজগজ করেছে। উঠানে পা ছড়িয়ে বসে কান্নাকাটি করেছে। এখন স্বামীকে কাছে পেয়ে ফের সেই কাজটাই করতে শুরু করলো। লোকমুখে টাকার পরিমাণ রতনের বাড়ি অব্দি সমিতির লাভের অফারের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি আকারে এসে পৌঁছেছে। এত টাকার শোক আর আপত রতনের শান্ত অবস্থা নুরীকে আরো ক্ষিপ্ত করে তুললো।

-নিজের বুদ্ধিতে একলা একলা সারা জীবন কাম কইরা ফতুর হইল। ক্যা, ঘরে কি আমরা মানুষ না? আমাগো একবার জিগাইলোও না…।

রতনের আর সহ্য হলো না। তেড়ে গিয়ে বউয়ের মুখটা চেপে ধরে বলল, হারামজাদি , ট্যাকা কি তোর বাপের! আমার ট্যাকা আমি গাঙে ফালামু তুই কওয়ার কে…। বউকে মেরে রতন হাঁপাতে থাকে। এই প্রথম তার কান্না পায় টাকার শোকে। তার সব আশা- আকাংখা শেষ! রতনের নিজেকে খুব ক্লান্ত ও বুড়ো মনে হতে থাকে। তার যেন অনেক বয়েস হয়ে গেছে। আর পারবে না সে…। ঘরের পেছনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। লম্বা লম্বা টানে সিগারেটের লাল আলোটা দীপ্ত হয়ে উঠে। সে আলোতে তার চোখের নিচের কোলটা ভেজা দেখা যায়।… অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রতন। নুরীর নাকী-সুরের কান্নার মৃদু শব্দ এখনো আসছে উঠোন থেকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতন। ঘর থেকে গামছাটা নিয়ে কলপাড়ে গিয়ে ঢুকে। কয়েক বালতি পানি ঢালে শরীরে। তবু মনে হয় শরীর পুড়ে যাচ্ছে…। ঘরে এসে দেখে নুরী ভাত বেড়ে রেখেছে। রতন কোন শব্দ না করে খেতে থাকে। গুড়া মাছ আর ডাল। রাক্ষসের মত খিদে লেগেছিল। খাওয়া শেষে সিগারেট ধরায়। আজ আর চোখের পাতা মেলে রাখতে পারে না। শোয়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে যায়।

ফজরে আজানে ঘুম ভাঙ্গে। সাড়ে ছটায় লঞ্চ। সাড়ে সাতটায় ট্রেন। ন’টায় অফিস গিয়ে পৌঁছাতে হবে। নইলে লেট ধরবে। বেতন কাটেব। মিজান সাব বলবো, বালের চাকরি করোনি মিয়া! সময় মত আইতে পারলে আইবা, নাইলে কাইল থিকা আইবা না…।
আজ ভীড়ের ট্রেনে রতন উঠতেই পারে না। হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলতে থাকে। রতন মরিয়া হয়ে হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে থাকে। যারা নিরাপদে দরজায় কাছে জায়গা পেয়েছে তারা হায় হায় করে উঠে। নাইমা যান মিয়া! মরবেন তো!… কারুর কথাই তার কানে যায় না। প্রাণপণে হাতলটা ধরে ঝুলে থাকে রতন… চোখে তার সমিতির হারানো টাকা আর দোকানের সপ্ন…।