আট

পতেঙ্গা থেকে পাবলিক বাসে কদমতলী বাস টার্মিনাল- কদমতলী থেকে শুভপুর বাসে করে বড়তাকিয়া নামক স্থানে নামতে হবে। এর বেশী ঠিকানা আলম সংগ্রহ করতে পারে নি। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্টপেজে পাকিস্তানী সেনারা বাসে উঠে তল্লাসী করছে। বাসে যাত্রীর সংখ্যা খুব কম। প্রত্যেকটি যাত্রীকে তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। নানা প্রশ্ন করেছে। কাউকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর তার খবর আর কেউ পায় না। এভাবে প্রতিদিন নিখোঁজ হচ্ছে কত লোক, তার হিসাব নেই । কিন্তু আলমকে কোন চেক পোস্টেই কোন প্রশ্ন করে নি। অথচ একটি প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর তার জানা ছিল না। তাকে যদি প্রশ্ন করা হত, এ ছোকড়া, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আত্মীয় বাড়ী।
কোথায় সে আত্মীয় বাড়ি?
কি তার নাম?
কোন থানা, কোন গ্রাম?
কিছুই জানা নেই। সে শুধু মনে রেখেছে বড়তাকিয়া নেমে যেতে হবে। মিরেশ্বরাই চেক পোষ্টে নাকি খুব কড়াকড়ি। বড়তাকিয়া থেকে আবুতোরাব বাজার। অতঃপর ভারতগামী স্মরনার্থী পাওয়া যাবে। বড়তাকিয়া নেমেই একটি রিক্সা যোগে আবুতোরাব বাজারে পৌছল আলম। একটি গ্রাম্য বাজার। কয়েকটি চায়ের দোকান ও মুদির দোকান। মধ্যখানে কয়েক সারি অস্থায়ী ছাউনি, যেখানে ক্ষুদ্র পসারীরা বাজারের দিন নানা পণ্য নিয়ে বসে। একটি চায়ের দোখানে ঢুকল আলম। ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। ইতোমধ্যেই দুপুর গড়িয়ে গেছে। ভাত পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করে ভাতের অর্ডার করল সে। কিশোর বয়সের একজন আগুন্তুক দেখে দোকানের বয়-বেয়ারারা প্রচণ্ড কৌতুহলে তাকে দেখছে, আলমও তা বুঝতে পারছে। একজন বেয়ারা টিনের থালায় এক প্লেট ভাত, এক বাটি বেগুন-সব্জি নিয়ে আসল। মাথা নিচু করে খাচ্ছে আলম। তার বুকে ধুকপুকানি। কোথায় যাবে এর পর? হোটেলের একজন বেয়ারা তার কাছে এগিয়ে আসল।
কোথায় যাবেন আপনি?
চমকে উঠল আলম। কি বলবে সে? লোকটাইবা কোন পক্ষের?
আপনি কি ওপারে যাবেন?
বেয়ারাটা পুনঃ প্রশ্ন করল। কেন জানি না, এবার যেন আলম একটু ভরসা পেল।
কি ভাবে যাওয়া যায়?
আলম পাল্টা প্রশ্ন করল। বেয়ারারা যেন বুঝেই ফেলল আলম আসলে ওপারে যাওয়ার জন্য এসেছে। তাকে ছেঁকে ধরল তারা।
আপনি কি শহর থেকে এসেছেন?
শহরের অবস্থা কি?
পাঞ্জাবীরা নাকি খুব অত্যাচার করছে?
ঘর-বাড়ি নাকি জ্বালিয়ে দিচ্ছে?
মা-বোনদের নাকি ধরে নিয়ে যাচ্ছে?
যুবক ছেলেদের নাকি ধরে নিয়ে হত্যা করছে ?
এক সাথে অনেক প্রশ্ন। আলম এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে একজন যুবক এসে উপস্থিত হল সেখানে। আলম কিছুটা ভড়কে গেল। শান্ত গলায় ছেলেটি আলমকে ইঙ্গিত করে বলল-চলেন। আলম নিঃশব্দে যন্ত্রচালিতের মত তাকে অনুসরণ করল। সে জানে না কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাজার থেকে বের হতেই সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা গ্রাম। হাটতে হাটতে যুবকটার সাথে কথা হল আলমের। বয়সে তার চেয়ে বেশী- টগবগে তরুণ, নাম নুরুল আবছার, পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে পালিয়ে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে বলে। বেশী দুর হাটতে হল না তাকে। গ্রাম্য পথে কিছু দূর হেটেই তাকে ঢোকানো হল একটি বাড়িতে। বেশ বড় বাড়ি। সুদীর্ঘ ও সুউচ্চ মাটির ঘর। টিনের ছাউনি। সুপ্রসস্থ উঠোন। বাড়ির লোকেরা যে মাত্র কিছুদিন পুর্বেই চলে গেছে, তা বাড়ির অবস্থা দেখেই বুঝা যায়। বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করেই আলম চমকে উঠে। কিছু যুবক বিভিন্ন অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ!
এরা কারা? মুক্তিযোদ্ধা-না রাজাকার? প্রধান সড়কের এত কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্থানা হয় কিভাবে? শঙ্কা ভয়ে শীতল হয়ে আসে আলমের সর্বাঙ্গ। আলমকে মাটির ঘরের একটি কামরায় নিয়ে গেল তারা। অতঃপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ক্রমান্বয়ে তাদের প্রশ্নের ধরন থেকে আলম বুঝতে পারে, এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। আলমের মনে হল, তার প্রতি তাদের সন্দেহ তিরোহিত হয়েছে। অবাক বিস্ময়ে সে তাদের দেখছে। হঠাৎ শঙ্কা যেন স্বস্তিতে পরিণত হওয়ায় হাফ ছেড়ে বাঁচে আলম। যে যুবকটি আলমকে নিয়ে গিয়েছিল সে তাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে গেল। সেখানে বিভিন্ন অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে কিছু যুবক নাড়াছাড়া করছে। আলমকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করল তারাও। অতঃপর এক টুকরো সাদা কাগজে লিখল কিভাবে ওপারে যেতে হবে, কোন বাজারের পর কোন হাট, অতঃপর কোন ঘাট পার হয়ে কোন রাস্তা দিয়ে কোন দিকে যেতে হবে, ইত্যাদি লিখে দিয়ে বলা হল-পথে পথে অনেক শ্মরণার্থীর দল পাওয়া যাবে, তাদের অনুসরণ করলে কোন অসুবিধা হবে না। অতঃপর বিকালেই আলমকে তাদের আস্তানা থেকে বের হতে হল। এতক্ষণের স্বস্তি আবার হতাশায় রূপান্তরিত হল। আলম ভেবেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যখন পড়া গেছে, তারাই তাকে ওপারে পৌছে দেওয়ার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করবে। কিন্তু হা!হতোস্মি। অগত্যা তাকে দেখিয়ে দেওয়া মাটির ডাঙ্গা ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা পেছনে ফেলে এগিয়ে চলে আলম। পিঁপড়ার মত পিলপিল করে পলায়নপর মানুষের নিরবচ্ছিন্ন মিছিল। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা-জীবন রক্ষার তাগিদে ছুটছে ত ছুটছেই। যবুথবু এক বৃদ্ধকে কাঁথার মধ্যে শোয়ায়ে কাঁথার দু’প্রান্তে রশি বেঁধে বাঁশ গলিয়ে দোলনার মত কাঁধে নিয়ে চলছে দু’জন মধ্যবয়সী পুরুষ। সমাজ-সংসার থেকে বহু পূর্বেই অকেজো হয়ে যাওয়া মানুষটিকেও বাঁচানোর জন্যে পরমাত্মীয়দের কি প্রাণান্তকর প্রয়াস! ধনুকের মত বাঁকা এক থুত্থরে বুড়ি লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে চলছে, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে। বাম হাতে নিবিড়ভাবে বুকে চেপে রাখা একটি পুঁটলি, হয়ত তার আজন্মের জমানো ধন । সবচেয়ে বড় বোঁচকাটি মধ্য বয়সী পুরুষের মাথায়। সাথে আরো জনাকয়েক নারী-পুরুষ ও ছোট্ট ছেলে মেয়ে, এভাবে এক একটি করে শত শত পরিবার । প্রত্যেকের হাতে কিছু না কিছু পোটলা-পুঁটলি, লোটা-বাটি-ঘটি। বয়ষ্ক মহিলাদের কারো কারো এক কোলে শিশু, আর অন্য কোলে কাঁসা বা পিতলের কলসী-নানা ব্যবহার্য খুঁটিনাটি জিনিসে ভর্তি। তরুণ-তরুণীর সংখ্যাও কম নয়। আলমের একদম পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে এক তরুণী-সদ্য-যৌবনা। তার মাথায়ও একটি টিনের পেটরা, ডান হাতে শক্ত করে ধরা, বাম হাতে শরীরে লেপ্টে থাকা বৃষ্টিভেজা শাড়ী সামলে হাটার চেষ্টা। এত কষ্টেও যেন হাসির একটি রেখা মলিন হয়ে তার ঠোঁটে লেগে আছে। আলমের সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি ঠোঁটে হাসির রেখাটি যেন আরো স্পষ্ট হয়। আলমের মনে হল সেও যেন মেয়েটিকে আগে থেকেই চিনে। প্রত্যুত্তরে আলম কিন্তু হাসতে পারল না। সে কেবল ভাবল, এত কষ্ঠে মানুষ যখন জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়, তখনো তার মুখে হাসি থাকতে পারে! শরীরে লেপ্টেথাকা বৃষ্টিস্নাত শাড়ীর ভাজে ভাজে উঁকি দেয় যার সদ্য যৌবণ, তেমন একটি মেয়ের সহাস্য অথচ নীরব সম্ভাষণ আলমের মনে ভাল লাগার এক অদ্ভূত শিহরণের জন্ম দেয়। কিছুক্ষণের জন্য তার সকল ক্লান্তি যেন ধূয়েমুছে যায় । তার ইচ্ছে জাগে মেয়েটির আরো কাছে ঘেষে হাটতে, কথা বলতে, জানতে চাইতে, কোথায় তাদের বাড়ি? কোথায় যাবে তারা? কিন্তু কিছুই সে করতে পারে না। কেবল তার দৃষ্টির মধ্য থেকে সে পথ চলতে থাকে। মাঝে মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় ঘটে দু’জনের মধ্যে। মেয়েটির ঠোঁটে হাসির রেখাটি যেন লেগেই আছে। মানুষ আর প্রকৃতির এ বৈরিতাকে সে যেন প্রচণ্ড ভ্রুকুটি করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পাশেই একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অতি কষ্টে নিজের চেয়ে ভারি শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে-কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে। বাচ্চাদের কারো হাতে ছাগলের রশি, কারো হাতে গরুর, কারো বগলদাবায় হাঁস কিংবা মুরগী-পিতলের কলসী, ভিতরে চাল-ডাল। এভাবে এক একটি পরিবার মিলে যেন মানুষের অবিরাম স্রোত-কেবলই ছুটছে, অজানা গন্তব্যে, বেঁচে থাকার আদিম তাগিদে, সবুজ শ্যামল গাঁয়ের মধ্যে, ফসলের মাঠ ছিড়ে বয়ে চলা আঁকা-বাঁকা মাটির কখনো ডাঙ্গা,কখনো আল পথ ধরে। কারো সাথে কারো কোন কথা নেই। কেবল উর্ধ্ব শ্বাসে ছুটে চলা, হিংস্র-ব্যাঘ্র-তাড়িত ভয়ার্ত হরিণ শাবকের মত । থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টি-যেন ব্যাথাতুর জন্মভূমি-জননী অঝোর অশ্রু ধারায় তার গৃহত্যাগী সন্তানদের-যারা জানে না তাদের গন্তব্য-বলছে-বিদায় বৎস! বিদায়! এহেন একটি কাফেলার মধ্যে মিশে আছে আলম-স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া খড় কুটোর মত । অগুণিত মানুষের মধ্যে ও সে একা, নিতান্ত একা। এ বহমান নিরবচ্ছিন্ন মানবস্রোতে তার আপনজন-একান্ত পরিচিত-এ নিরলস পদযাত্রায় দূদণ্ড আলাপ করার মত-কেউ নেই। কেউ তাকে একটু জিজ্ঞেসও করছে না, তুমি কার ছেলে বাপু, বাড়ি কোথায়, কোথায় যাবে, সাথে কেউ আছে নাকি? তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা-বাবার দৃষ্টির অগোচরে এত সময় সে কখনো কাটায় নি। ১৪ বছরের কিশোর- ইতিপূর্বে যে কখনো বাড়ির ত্রি-সীমানা অতিক্রম করে নি-সে ও ছুটেছে, অপরিচিত অগুণিত মানুষের পলায়নপর কাফেলার সাথে, তবে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নয়, এক ইস্পাত কঠিন সংকল্প বুকে ধারন করে। যুদ্ধ করতে হবে, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হবে তাকে, হানাদার কবলিত স্বদেশভূমিকে মুক্ত করতে হবে। সে শুণেছে সীমান্তের ওপারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাসা ভাসা শুণেছে সে। তার চাচা, তার বাবা, কিছু যুবক ছেলেকে নিয়ে-যারা বয়সে তার চেয়ে বড়, তাদের ঘরে বসে কানাঘুষা করতে শুণেছে সে। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ওপারে যাবে। সে বুঝে ফেলেছে, বয়সের কারণে তারা তাকে নেবে না। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, তাকে পালিয়েই যেতে হবে। বাবা মা কাউকে না বলে, সে একদিন কেটে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে। উপায় ছিল না। বাবা মাকে বলে কখনো যাওয়া যেত না। বাবা-মার অত্যন্ত আদুরে-অনুগত ছেলে, ঘর পালানো ছেলের মত একদিন বের হয়ে পড়ল, সাথে সম্বল বলতে নগদ ৫ টাকা, যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র সপ্তাহ খানেক পূর্বে তার বাবার কিনে দেওয়া হাতের একটি ক্যামি ঘড়ি। শুধু জানতো তার বড় বোন-যে তাকে অনুক্ষণ প্রেরণা দিত, উৎসাহ জোগাত যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে।
বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল মাটির ডাঙ্গা, একে বেঁকে চলে গেছে অনেক দূর। পূর্বে না পশ্চিমে, উত্তর না দক্ষিণে কিছুই চিহ্নিত করতে পারছে না আলম। মেঠো রাস্তাটিই তাকে যেন টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা গন্তব্যে। সন্ধ্যা পর্যন্ত হাটার পর আলম একটা বাজারে গিয়ে পৌঁছল । ছোট দারোগার হাট। বড্ড ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। জঠরে ক্ষুধার জ্বালা। গ্রামের বাজার। ভাত পাওয়া যাবে কিনা জানে না আলম। খোঁজাখুজি করে এক দোখানে ভাত পাওয়া গেল। বেগুন দিয়ে টেংরা মাছের তরকারী ও ডাল। কিন্তু রাত কাটাবে কোথায়? বাজার ততক্ষণে প্রায় জনশূণ্য হয়ে গেছে। একটি মনোহারি দোকান খোলা আছে তখনো। আলম দ্বিধা সংকোচ নিয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেস করল -একটু থাকার জায়গা দেওয়া যাবে কিনা । দোকানী সব শুণে বলল তার দোকানের বাহিরে আঙ্গিনায় দোকানের মালামাল রাখার একটি চৌকি আছে । ইচ্ছা করলে ঔখানে রাত কাটাতে পার। এ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা করা যাবে না। অগত্যা তাতেই সম্মত হতে হল আলমকে। বাজারের সকল দোখানপাট যখন বন্ধ হোয়ে গেল, আলম দোকানের আঙ্গিনার চৌকিতে শুয়ে পড়ল। একদল কুকুরের টানা ঘেউ ঘেউ শব্দে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রভাতী সূর্যের রক্তিম বিভায় রাতের ঘন আধাঁর তরল হয়ে এসেছে। দ্রুত গাত্রোত্থান করে সে আবার রওয়ানা হল। আবার গ্রামের কাঁচা বড় আল পথ। এবারও আলম একা নয়। তার সহযাত্রির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আস্তে আস্তে মিছিলে রূপ নিচ্ছে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা । সে মিছিলেরই এক জন হয়ে গেল আলম। পথিমধ্যে আরো একটি বাজার অতিক্রম করল আলম। আবুর হাট। অতঃপর সামনে এক নদী। ফেনী নদী । ভূভুইয়ার ঘাট। নৌকায় পাড়ি দিতে হবে। ঘাটে প্রচুর লোক জমে গেছে ইতোমধ্যে। তিন চারটি জেলে নৌকা। মানুষের হুড়াহুড়ি। কার আগে কে উঠবে। অনেক অচেনা মনুষ্যকুলের সাথে কোন রকমে তৃতীয় নৌকাটিতে একটু জায়গা করে নিল আলম। খরস্রোতা ছোট্ট নদী । অনেক ধরনের মানুষ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবা, কিশোর-কিশোরী ও অন্তসত্ত্বা মা ও মাতৃক্রোড়াশ্রিতা শিশু। কে হিন্দু, কে মুসলিম চেনার কোন উপায় নেই। সন্তান-বিয়োগ-কাতর প্রকৃতির অঝোর অশ্রু ধারা মুসলধারার বৃষ্টি হয়ে মাথার সিঁথি-সিঁদুর, কপালের টিপ মুছে দিয়ে যেন বলছে-তোর কেউ আজ আর হিন্দু নস, নস বৌদ্দ-খৃষ্টান- মুসলমান। তোরা আমারই সন্তান-মানুষ। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে যাত্রীর সংখ্যা বেশী। তাই নৌকাটি নদীর পানিতে কানায় কানায় ডুবে গেছে। একটু কাত হলেই মনে হয় ডুবে যাবে। এ ধরনের নৌকা আলম ইতিপূর্বে দেখেনি। কর্ণফুলীর ওপারে নানার বাড়ি যাওয়ার জন্য আলম অনেকবার সাম্পানে উঠেছে। সামনের দিক সরু ও পেছনের দিক মোটা, দু’দাঁড় বিশিষ্ট সাম্পান । আর এগুলো অনেকটা জেলে নৌকার মত। মাঝি এদিকে বসেন, ঐদিকে সরেন, চিৎকার করে যাত্রিদের নির্দেশ দিচ্ছে, নৌকার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। যাত্রীদের হুড়াহুড়িতে নৌকা মাঝে মধ্যে এমনভাবে দুলে উঠে, যেন এই মাত্র ডুবল। নৌকার পেছনে লম্বা একটি দাঁড় মাঝি ডানে বামে নাড়তেই নৌকাটি হেলে দুলে চলতে লাগল। যাত্রীদের হৈ চৈ ও হুড়াহুড়ি বন্ধ হল। নীরব বিষন্নতায় পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দই বেশ বড় হয়ে বাজতে লাগল। যাত্রীরা নীরব হলেও তাদের ঠোটের নড়াচড়া দেখে বুঝা যাচ্ছে, সবাই যার যার ইষ্টনাম জপছে। নৌকাটি মাঝ নদীতে যেতেই নদী পারে ছুটাছুটি। খান সেনারা আসল নাকি? এবার সশব্দে ইষ্টনাম জপতে লাগল নৌকাভর্তি ভয়ার্ত মানুষেরা। মাঝে মধ্যে নাকি স্পীড বোটে করে খান সেনারা এ নদীতে টহল দেয়। তাদের সামনে পড়লে সবার সলিল সমাধি। একই নৌকায় হে খোদা-ভগবান- হে ভগবান খোদা, আল্লাহ-রাম এর সংমিশ্রিত উচ্চারণ এক ভয়াল আবহের সৃষ্টি করল। ভয়ার্ত মানুষদের ঈষ্টনাম ও দোয়া-দরূদের সাথে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মিলে একাকার হয়ে গেল। একটি ইঞ্জিন বোট সশব্দে দ্রুত চলে গেল। না, কোন পাক সেনাদের দেখা গেল না। ভয় শঙ্কার মধ্য দিয়ে নৌকা কখন তীরে পৌছে গেছে টের পায় নি আলম। অতঃপর কাঁদা-চরে নৌকা থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হল সবাই। আবারো যাত্রা। পূর্বপরিচয়হীন অগুণিত মানুষের সাথে। হাটতে হাটতে ভাবনায় আক্রান্ত হয় আলম। কোথায় যাচ্ছে সে? কোত্থেকে আসছে? তার মানসপটে ভেসে উঠে তারই সে ছায়াসুনিবিড় গ্রামের ছবি, পেছনে ফেলে আসা তার প্রিয় জনক-জননীর-ভাই-বোনের মুখগুলো। তারা নিশ্চয় ইতোমধেই তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। তার জননী নিশ্চয় বিলাপ শুরু করেছে। সে যেন আর কান্না ছেপে রাখতে পারছে না। বৃষ্টির জলের সাথে চোখের লোনা জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি চলতে লাগল। রাস্তাঘাট ভীষণ পিচ্ছিল। জামা কাপড় ইতোমধ্যে ভিজে সারা শরীরে লেপ্টে গেছে। পা দুটো একটু একটু ব্যাথা করছে । পেটের ক্ষিধে ক্রমান্বয়ে তীব্র হচ্ছে। তবুও যন্ত্রচালিতের মত আলম চলমান কাফেলাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে।কখনো ছোট ছোট নদী, কখনো খাল, ডিঙ্গি নৌকা, কাঁচা মাটির আলপথ, কাঁদা জলে পিচ্ছিল ডাঙ্গা, এসব অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের কাফেলা।
গভীর রাতে কাফেলা থমকে দাঁড়াল এক জায়গায়। অন্ধকারেও আলম বুঝতে পারল এ দূর্বাচ্ছাদিত এক চিলতে জমি। অদূরেই সীমান্তরেখা। থেকে থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে আলোর ঝল্সানিতে গোলাগুলির গতিও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সীমান্ত ফাঁড়ির বাংকারের ভীত সন্ত্রস্ত পাক সেনারা মাঝে মধ্যে ফায়ার করে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। রাত গভীর হলে এ সীমান্ত দিয়েই ভারতে প্রবেশ করতে হবে। তাই উম্মুক্ত আকাশের নীচে বসে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা। সারাদিন বৃষ্টি শেষে মেঘমুক্ত আকাশে এখন ঝলমলে চাঁদ, নিচে ঘাসের মঘমল, শরীরে দুঃসহ ক্লান্তি, জঠরে ক্ষুধার জ্বালা, নেতিয়ে পড়ছে আলমের শরীর। ক্ষুধার জ্বালা এত তীব্র হতে পারে আলমের এর পূর্বে কোন ধারণা ছিল না। যে কোন সময় পাকসেনাদের লক্ষ্যহীন একটি গোলা এখানে এসেও পড়তে পারে-সতর্ক করলেন গাইড। তাতে সবারই ভবলীলা সাঙ্গ হোয়ে যেতে পারে। তাই প্রয়োজনে মাটিতে শুয়ে যাওয়ার কথাও বলল সে।
অপেক্ষার পালা শেষে এক সময় রাত গভীর হল। চাঁদটা তখনো পশ্চিমাকাশে হেলে ঘরছাড়া এ মানুষগুলোকে আলো দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘ এসে কিছুক্ষণের জন্য চাঁদকে আড়াল করছে। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কিছু তারা মিট্ মিট্ করছে। সবাইকে সিঙ্গেল লাইনে দাঁড়াতে বলল গাইড। তাকে নিঃশব্ধে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলল, গুলির শব্দ শোনা মাত্র সকলকে মাটিতে শুয়ে পড়তে হবে- টু শব্দটি করা যাবে না। অতঃপর সবাই শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতায় গাইডকে অনুসরণ করে চলতে লাগল। কেবল মানুষের নিঃশ্বাসের হিস্ হিস্ শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু দূর যেতেই পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন সকল নীরবতাকে ভেঙ্গে খান্ খান্ করে দিচ্ছে। নিজের বুকের ধুকপুক শব্দটি আলমের কাছে যেন কামানের গোলার দূরাগত শব্দের মত মনে হতে লাগল। এই বুঝি পাক সেনারা টের পেয়ে গেল, আর সাথে সাথে এক ঝাঁক গোলা অগুণিত মানব সন্তানের ভব লীলা সাঙ্গ করে দিল। হাটু জলে ভরা বিল অতিক্রম করে একটি পাকা সড়কে উঠল তারা। অন্ধকারেও আলম বুঝতে পারছে এ এক পীচঢালা সড়ক।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোড-গাইড বললেন। সবাই হামাগুড়ি দেন- ফিস ফিস করে নির্দশ দিল গাইড। এক প্রকার হামাগুড়ি দিয়েই তারা সড়কটি পার হতে লাগল। দুপদাপ শব্দ হচ্ছে। পুরা মিছিলটি যখন রাস্তা অতিক্রম করল, সাথে সাথে উজ্জ্বল এক আলোক পিণ্ড সমগ্র এলাকাকে আলোকিত করে দিল। শত্রুর অবস্থান অবলোকন করার জন্য পাক সেনারা সার্চ লাইট ছুঁড়েচে। তৎক্ষণে আলমদের কাফেলা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বিক্ষিপ্ত কিছু গোলাগুলি ও হল। গাইড বলল আমাদের বিপদ কেটে গেছে। বস্তুতঃ পাক সেনারা তাদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্যই ফাঁকা গুলি ছুড়ে থাকে। অন্যথায় রাতে তারা বাংকার থেকে বাহিরও হয় না।
বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর ভোরের উদীয়মান সূর্যের আভায় রাতের আঁধার ক্রমে তরল হয়ে আসতে লাগল। একটি বাজারে গিয়ে উঠল কাফেলা। শ্রীনগর বাজার। দোকানপাঠ তখনো খুলে নি। একটি দোকানের আঙ্গিনায় বসে পড়ে আলম। প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও এক উদ্ভূত অনুভূতি আলমকে আচ্ছন্ন করে। সে আজ অন্য দেশে। পাকিস্তানী সৈন্যদের নাগালের বাইরে। আপাততঃ মৃত্যুভয় নেই। কিন্তু এখন সে কোথায় যাবে? কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার? ক্ষুধায় নাড়িভূড়ি মোচ্ড় দিয়ে উঠল। কিন্তু পকেটে তখন কানাকড়িও নেই। কেহ কি তাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য ডাকবে না? এমন একটি প্রত্যাশা আলমের মনে উঁকি মারলেও হা!হতোস্মি! ক্রমান্বয়ে সূর্য যখন পূর্বাকাশে উদ্ভাসিত হল, তখন সে আবার যাত্রা শুরু করল, অনেকের সাথে, কিন্তু একা একা। কোথায় যেতে হবে তাকে? দেশে সে শুণে এসেছে হরিনা নামক স্থানে ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে তাকে পৌছতে হবে। কোথায় সে হরিনা? যাকেই জিজ্ঞেস করে সেই বলে-এইত সামনে। আলম ভাবে খুব কাছে কোন জায়গায় বোধ হয় হরিনা হবে। সে ভরসায় সে হাটে। কিন্তু পথ যে পুরায় না। পাহাড়ী পথ। আঁকা-বাঁকা ও উঁচু নীচু। কখনো উঠতে উঠতে আকাশে উঠতে হয়। আবার নামতে নামতে নামতে যেন পাতালে। ক্ষুধা ক্লান্তি অবসাদে আলমের পা যেন আর চলে না। তবু তাকে হাটতে হবে। তাদের পাশ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে চলে যাচ্ছে ভারতীয় সৈন্য ও অস্ত্র বোঝাই সাজোয়া যান। সমগ্র সীমান্ত জুড়েই ভারতীয় ট্যাংক ও সাজোয়া বহর দেয়ালের মত সমগ্র সীমান্তরেখাকে ঘিরে রেখেছে। অগুনিত সৈন্য নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ মাটি কেটে রাস্তা পরিস্কার করছে, কেউবা পরিখা খনন করছে। আবার কেউ কেউ জঙ্গল পরিস্কার করে নতুন তাঁবু কাটাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে আলম ভাবে, ইস্ ! এ ভারতীয় সৈন্য যদি একসাথে মার্চ করিয়ে দেওয়া যেত, তাহলেত পাকিস্তানীরা পরাজয় মানতে বাধ্য হত। এসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছে আলম, কিন্তু পথের যেন শেষ হচ্ছে না। তার সামনে পেছনে অগুনিত মানুষের কাফেলা। সবার হাতে স্বগৃহ থেকে বয়ে আনা সেই পোটলাপুটলি, ঘটি, লোটা-বাটি-কম্বল, হাস-মুরগী ছাগল ছানা ইত্যাদি ।
ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে আলম আর যেন এক পাও এগুতে পারছে না । সে বমি করতে লাগল। পেট থেকে যেন তার নাড়িভূড়ি শুদ্ধ বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। আলম দেখতে পেল পাহাড়ের গভীর খাদে ছড়ার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। খুব কষ্টে এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ের পিচ্ছিল গাত্র বেঁয়ে বেঁয়ে আলম অনেক নীচে-অনেক নীচে পাহাড়ের পাদদেশে নামল। দু’পাহাড়ের মধ্য খানে বরফ শীতল স্বচ্ছ পানির স্রোত তির তির করে এগিয়ে যাচ্ছে। অঞ্জলি ভরে পানি পান করল আলম। সে যেন একটু শক্তি ফিরে পেল। পাহাড়ের গা বেয়ে আবার হামাগুড়ি দিয়ে উপরে ওঠা, অতঃপর আবারো যাত্রা। সে উচুঁ নীচু দুর্গম পাহাড়। কখনো উঠতে উঠতে শীর্ষে, কখনো অনেক গভীরে যেন পাতালপুরী। এভাবে প্রায় সারা দিন হাটার পর পরিশেষে আলম পৌছে যায় হরিনা নামক স্থানে , যেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনেচ্ছুদের জন্য নির্মিত হয়েছে একটি ইয়ুথ ক্যাম্প। জঙ্গল কেটে একাদিক পাহাড়ের গাত্রে নির্মান করা হয়েছে এ ক্যাম্প। বিশাল এক ক্যাম্প। অনেক তাঁবু খাটানো। ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌছতেই এলাকার ছেলেরা কিভাবে খবর পেয়ে গেল আলম বুঝতে পারেনি। তারা আলমকে তাদের তাঁবুতে নিয়ে গেল। বিদেশ বিভূঁয়ে বিশেষভাবে এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এত দিন পর নিজের এলাকার পরিচিত জনদের পেয়ে যারপরনাই ভাল লাগল আলমের। ক্লান্তি অবসাদের সাথে অনেক দিন পর একান্ত পরিচিত জনের সাথে সাক্ষাতের আনন্দের মিশ্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন আলম যেন নির্বাক হোয়ে গেল। তার জন্য প্রথমেই তারা ভাতের ব্যবস্থা করল। ডাল আর সব্জি। গোগ্রাসে গিলল আলম। অনেক বেলা পর আলম উদরপূর্তি ভাত খেল । ক্লান্তি অবসাদে সে তাঁবুর মেঝেতে শুয়ে পড়ল। চলবে—