মানুষের পবিত্র বায়োবীয় অনুভূতিকে রক্ষা করার জন্য বর্তমান সরকার জনগণের জন্য উপহার হিসেবে এনেছে ৫৭ ধারা। প্রথমেই জেনে নি, ৫৭ ধরায় কী লেখা আছে-

(১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এই ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।

ইহা পড়িবার মাত্র, অনেক কট্টর ধার্মিক হয়তো আনন্দে গদগদ হয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। এখানে বলে রাখা ভাল এই ৫৭ ধারার প্যাকেজ শুধু বিশেষ ধর্মের জন্য, সকল ধর্ম ইহার আওতায় পড়বে না। এই আইনে কোথাও বলা হয়নি অনুভূতিতে আঘাতের মাত্রা কীরূপ হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। অনুভূতি রক্ষার আইননের প্রধান ও প্রথম সমস্যা এখানেই। চার্লস ডারউইন যখন বিবর্তনবাদ তত্ত্ব প্রকাশ করেন তখন হাজারো মানুষের অনুভূতি চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিবর্তনবাদ যেহেতু সকল ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক সেহেতু এই তত্ত্ব নিয়ে বর্তমানে লেখা হলে তা কী অপরাধ বলে গণ্য হবে? পৃথিবীর ইতিহাস কয়েক কোটি লক্ষ বছরের। এই ইতিহাসটুকু পড়ালেও কী তা অপরাধ বলে গণ্য হবে? চাঁদ কখনো দ্বি-খণ্ডিত হয়নি এটা বললেও কী তা অপরাধ বলে গণ্য হবে? মানুষের কখনো দশ হাত, দশ মাথা ছিল না, হনুমান কখনো কথা বলতে পারত না। এসব লেখা হলেও কী তা অপরাধ বলে গণ্য হবে?

আমাদের মহান রাষ্ট্র যেহেতু অনুভূতি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে সেহেতু ভেবেছিলাম সরকার কোন বিশেষ ধর্মের নয় বরং সকল ধর্মের অনুভূতি রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের ধন্য করবে। কিন্তু বিধি হায়! সরকার একচক্ষু দৈত্যে মতন শুধু একটি বিশেষ ধর্মের অনুভূতি রক্ষার দায়িত্বে নেমেছে। যারা মফস্বল বা ছোট শহরে বসবাস করেছেন বা গ্রামে বড় হয়েছেন তারা নিশ্চই জানেন; গ্রাম্য মাহফিলে অন্য ধর্ম সর্ম্পকে কী ধরনের রসাত্বক ও হাসি তামাশা করা হয়। কেউ যদি না জানেন তাহলে ইইউটিউবে গেলেও এই চিত্রটি দেখতে পাবেন। আপনি ফেসবুকের চিপায়, মেসেজের খোপে ধর্ম নিয়ে কী লিখেছেন তার জন্য আপনার জেল জরিমানাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে মজমা জমিয়ে দুই উরুর ফাঁকে উত্তাপ ছড়িয়ে অন্য ধর্মের মেয়েদের ও দেবী নিয়ে আদিরসাত্বক গল্প বয়ান করলে আপনি কোন আইনের আওতায় পড়বেন না। বরং ইহা আপনার ধর্মীয় অধিকার হিসেবে গণ্য হবে। শুধু এখানেই শেষ নয়, ফেসবুকে অন্য ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীদের কুৎসিত গালাগালি করা এবং এসব নামে আইডি খোলা এই ব-দ্বীপে জায়েজ। বুঝতেই পাচ্ছেন, এখানে শুধু বিশেষ ধর্মের অনুভূতি রক্ষা করা হয়। অনেক মর্ডান মুমিন যুক্তি দেখাবেন এখানে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের অনুভূতিই তো প্রাধাণ্য পাবে! তাহলে প্রশ্ন আসে, এখানে আপনারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আপনারদের ধর্ম আজ হুমকির মুখে তাই ধর্মকে লাইফ সার্পোটে বাঁচানোর জন্য আপনারা আইন করেছেন, তাহলে ভারত-ইউরোপ-আমেরিকায় আপনাদের ধর্মের লোকদের কী অবস্থা তাই না? ইহুদি নাসাদের চব্বিশ ঘন্টা গালাগালি করেও আপনারা তাদের দেশে ধর্মীয় উপসানালয় বানানোর অধিকার পাচ্ছেন, ধর্মীয় বিদ্যালয় বানানোর সুযোগ পাচ্ছেন অথচ আপনারা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেই আপনাদের ধর্ম নাই নাই হওয়ার ভয়ে আপনারা মুশড়ে পড়ছেন। ৫৭ ধারা আপনাদের অনুভূতিকে যতোটুকু না রক্ষা করতে পারছে, তার থেকে সমগ্র দুনিয়ার কাছে আপনাদের অনুভূতিকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করছে।

২০০১ সালের পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্নভাবে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি ঘর, মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে। রামুতে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর বাড়িঘর, সমগ্র মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। গত দুই বছর আগে ৫০টাকা দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মসজিদে ঢিল মারা হয়। পরবর্তীতে মসজিদ ভাঙার অজুহাদ তুলে হিন্দুদের দোকান লুট ও বাড়ি ঘরে ভাঙচুর করা হয়। নির্বাচন পূর্ববর্তী সময় ও নির্বাচন পরবর্তীতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর ঝড় বয়ে যায়। এসব কর্ম-কাণ্ড যদি অন্য কোন দেশে হতো তাহলে কয়েক হাজার মানুষকে জেলে ঢুকানো হতো। কিন্তু অসম্প্রাদায়িক(!) বঙ্গদেশে এর কোন বিচার হয় না। বিচার হওয়ার তো দূরের কথা এই ঘটনার কারণে কাউকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয় না।

এই দেশের জনগণ ১৪ দলীয় জোট ও ১৮ দলীয় জোটের জটে আটকে আছে। আগে শুনতাম আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে মানুষ একটু সস্তিতে থাকত। যাকে মন্দের ভাল হলা হতো। অথচ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই জামিন অযোগ্য ৫৭ ধারা প্রণয়ন করা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। কেউ যদি বিরোধী দলের উপর এই দায় চাপাতে চায় তাহলেও সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ যে ব্যর্থতার পরিচয় নিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা দেখেছি ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর হামলায় আওয়ামী বিএনপি জামাত এক হয়ে মাঠে নেমেছে। বর্তমান সরকারের আমলে এতোগুলো সাম্প্রদায়িক হামলার হয়েছে, তাহলে প্রশ্ন আসে ৫৭ ধারা কাদের জন্য প্রযোজ্য? সরকার যদি মানুষের অনুভূতির হেফাজতে নামে তাহলে ভিন্নধর্মী মানুষের অনুভূতি রক্ষার দায়িত্ব কেন নিচ্ছে না? সবাই শুধু ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলছে ভাসুরের নাম কেউ মুখে নিচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না ৫৭ ধারা শুধু বিশেষ ধর্মকে হেফাজত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

শেষে একটু বায়োবীয় অনুভূতির অনুভূতি বিষয়ে বলা যাক। রাষ্ট্রের জনগণ ও রাষ্ট্র যদি আরো বেশি ধার্মীক হয়ে উঠে তাহলে কী পহেলা বৈশাখ, শহিদ মিনারে ফুল দেওয়া, পহেলা ফাল্গুন পালন করা বন্ধ হয়ে যাবে? কারণ এগুলো বিশেষ এক শ্রেণির অনুভূতি প্রতিনিয়ত আঘাত করে যাচ্ছে? তখন কী অনুভূতি রক্ষার নামে পহেলা বৈশাখ ও শহিদ মিনারে ফুল দেওয়া আইন করে বন্ধ করা হবে? প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা ছিল, থাকে এবং ভবিষ্যতে থাকতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হল ক্ষমতায় থাকার পাশাপাশি রাজনৈতি দল ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে থাকতে চায় তা মাথায় রাখতে হবে। না হয় এই ৫৭ ধারার কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগকে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে স্থান নিতে হবে। আওয়ামী লীগের আমলে অনেক নিরীহ ব্লগার-ফেসবুকার জেল খেটেছে, ভবিষ্যতেও হয়তো খাটবে। ক্ষমতার পালা বদলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও হয়তো এই কালো আইনের প্রয়োগ করবে তারপরও এই আইন নাজিল করার জন্য এই দায় আওয়ামলীগ সরকারকেই বহন করতে হবে। সিন্ধান্ত এখন সরকারের, তারা কী ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে স্থান নিতে চায় নাকি ভুল সংশোধনের মানসিকতায় ৫৭ বাতিল করতে চায়।