চট্টগ্রাম কলেজের দুই মেধাবী ছাত্র রায়হান রাহী ও উল্লাস দাস। তারা ছিলেন এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তাই সর্বশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পরীক্ষার। পরীক্ষার জন্য এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে ৩০ মার্চ রবিবার কলেজে যাচ্ছিলেন সকাল ১১ টার দিকে, পথিমধ্যে তাদের দুজনকে ডেকে নিয়ে কয়েকজন মিলে ধর্মানুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে মারধোর শুরু করে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় ৫ পৃষ্ঠার একটি লিফলেট জনগণের মধ্যে বিলিয়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করা হয়। প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ধর্ম নিয়ে করা তাদের বিভিন্ন মন্তব্য ঐ লিফলেটে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়।


রায়হান রাহী

একটা পর্যায়ে তথাকথিত নাস্তিক্যবাদ প্রচারের অভিযোগে ঐ এলাকার ধর্মান্ধ জনগণকে সাথে নিয়ে রাহী ও উল্লাসকে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়। প্রথমে টেক মসজিদের ভেতরে নিয়ে মারধোর করতে করতে তাদের মূল রাস্তায় নামিয়ে আনলে, সেখানে পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক অপেক্ষারত আরো কিছু মানুষ অংশ নেয় ২ তথাকথিত নাস্তিককে গণধোলাই দিতে। নারায়ে তাকবির বলে ধ্বনি দিয়ে চলতে থাকে নির্মম গণধোলাই। গণধোলাই এর একপর্যায়ে মুমূর্ষু রায়হান ও উল্লাসকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের দুজনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, আর পুলিশের সাথে থানায় যায় ধর্মানুভুতিতে আঘাত প্রাপ্ত ধর্মান্ধ এবং তাদের অনুভূতি জাগ্রতকারী গোষ্ঠী।


উল্লাস দাস

পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়, উত্তেজিত ধর্মান্ধ জনতার ঢল নেমে আসে থানায়। সবার দাবী ৫৭ ধারায় জামিন অযোগ্য অপরাধ করেছে তারা তাই এই ধারায়ই মামলা করতে হবে। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা, বয়স (দুজনারই ১৭ বছর) বিবেচনা করে পুলিশ এই ধারায় না এগোতে চাইলেও উত্তেজিত ধর্মান্ধ জনতার চাপে পুলিশ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পুলিশের মধ্যেও কয়েকজন ৫৭ ধারায় মামলা করতে আগ্রহী ছিলো যুক্তি হলো এটি সাইবার অপরাধ।

আসুন দেখি পুলিশের এজাহারে কি লেখা হয়েছে – “…………… দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাইয়া দেখিতে পাই যে, দুই জন লোককে ৫০/৬০ জন উত্তেজিত জনতা মারধোর করিতেছে। তাৎক্ষনিকভাবে ধৃত আসামীদ্বয়কে উত্তেজিত জনতার কবল হইতে উদ্ধার করিয়া উপস্থিত জনসাধরনকে জিজ্ঞেস করিয়া জানিতে পারি যে, উক্ত আসামীদ্বয় ফেইসবুকে ইসলাম ধর্ম ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অবমাননাকর ও মানহানিকর ধর্মীয় উস্কানি মূলক বক্তব্য পোস্ট করিয়াছে। এই সময় ঘটনার বিষয়ে ধৃত আসামীদ্বয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করিলে তাহারা উপস্থিত লোকজনের সামনে নাম ঠিকানা প্রকাশ করে ফেইসবুকে প্রকাশিত কটূক্তির বিষয় স্বীকার করে।

তখন ১ নম্বর আসামী কাজী মাহমুদুর রহমান রায়হান (রায়হান রাহী) তাহার ব্যবহৃত SYMPHONY-XPLORE, W-35 মডেলের মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেইসবুকে তাহার আইডি খুলিয়া ইনবক্সের মন্তব্যগুলো উপস্থিত জনসাধরনের সামনে উপস্থাপন করিলে দেখা যায়, কাজী রায়হান রাহী, ফারাবী সাফাউর রহমান নামক ফেইসবুক আইডির সহিত ফেইসবুকে ম্যাসেজ আদান প্রদান কালে লিখেন যে, ‘এমনকি কোন নারীর যদি অন্তত ৩০ বছর বয়সে স্বামী মারা যায়, সে আরেকবার বিয়ে করে। আয়শার ক্ষেত্রে কি হয়েছিলো?’ উক্ত ১ নং আসামী এইরুপ ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে বিদ্রূপ করিয়া কুরুচিপূর্ণ অসংখ্য ম্যাসেজ লিখেন। একই বিষয়ে ধৃত ১ নং আসামীর ফেইসবুক পেজে জনৈক ইমরান আজাদ নামের আইডির এক ব্যক্তি ম্যাসেজে লিখেন যে ‘প্রচলিত কোন প্রথাকে যিনি বন্ধ করতে পারেন না তিনি কেমন নবী?’


(সহ ব্লগারদের পরামর্শ অনুযায়ী নিরাপত্তা জনিত কারণে রাহী ও উল্লাসের পিতা-মাতার নাম ও ঠিকানা মুছে দেয়া হল। এই চিত্রটি নেয়া হয়েছে ব্লগার শেহাবের পোস্ট থেকে)

এরুপভাবে ধৃত ২ নং আসামী উল্লাস দাস তাহার আইডির মাধ্যমে ধৃত ১ আসামীর ফেইসবুক আইডিতে মন্তব্ব্য পোস্ট করেন যে, ‘ আদর্শ নিয়া কথা কচ্ছু? কয়টা দেশ ১৪০০ বছরে ইছলামি আদর্শ মানছে হুনি? হুরপরীর লোভ দেখাইয়া আর কতো? সনাতন, ইসলাম সব ই ফ্লপ খাইবে। ’ এইরূপ ইচ্ছাকৃতভাবে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কুরুচিপূর্ণ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কীয় মান হানিকর বিভিন্ন মন্তব্য করিয়া আইন শৃঙ্খলা অবনতিসহ এবং ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করিয়া তথা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানিয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩) এর ৫৭ ধারায় অপরাধ করিয়াছে।……….”

উল্লাসের পরিবার থেকে নিয়োগকৃত উকিল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আর এই মামলা লড়বেন নাহ। কারণ ছেলেটা হিন্দু হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, তিনি তার ধর্মের উর্দ্ধে যেয়ে কিছু করতে পারবেন না। গতকাল ৩১ মার্চ সোমবার বিকাল সাড়ে চারটার পরে চট্টগ্রাম নতুন আদালত ভবনের ২০৮ নম্বর রুমে এই মামলার কাজ চলে। সেখানে উল্লাসকে হাজির না করে শুধু রাহিকে হাজির করা হয়। ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়ে রাহি, খুব কাঁদছিলো ছেলেটি। এরপর বিচারক তাদের রিমান্ড মঞ্জুর না করে, জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।

এই বিষয়ে ব্লগার সুমিত চৌধুরী বলেন, ‘শেষে যখন আদালত থেকে ফিরে আসছিলাম তখন খুবই খারাপ লাগছিলো। দেখছিলাম দিক-বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে গেছে রাহির বাবা, কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায় তার মা। দেশীয় আইন অনুযায়ী নাবালক ছেলেগুলোর কথা ভেবে মুষড়ে পড়ছিলাম বারবার। এখনো মাত্র সতেরো বছর বয়স, অথচ এই বয়সেই তাদের আসামী বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো চার দেয়ালের মাঝে! সময়টা এখন তাদের খুবই ঝুঁকিপূর্ণ আর এই সময়েই কিনা তারা গিয়ে পড়ল কুখ্যাত সব আসামীদের মাঝে! একবার ভাবুন কি শিখে বের হবে তারা! কেমন মানুষদের সংস্পর্শে থাকবে তারা! কী হবে তাদের আগামীর ভবিষ্যত! জেলের ভেতরটা কতটা খারাপ তা একমাত্র ঐখানে যারা থেকে এসেছে তারাই জানে। ঐখানে যারা থাকে তারাতো সাধারণের চাইতে আরো অতিমাত্রার আস্তিক, একবার ভাবুন যখন তারা জানবে এরা কি দোষে এসেছে কি অবস্থাটা হবে তাদের! তার চাইতেও বড় কথা অনেক বছর যাবৎ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বেশ আরাম-আয়েশে আর প্রভাবের সাথেই আছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিবিরের নাছির। এসব আর ভাবতে পারছি না, নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে! আর কিছু না হোক অন্তত তাদের বয়েসটা বিবেচনা করা দরকার ছিলো বিচারকের…….’

নেপথ্যে সেই ফারাবিঃ উপরের মামলার এজাহারে ফারাবি সাফাউর রহমানের নাম ইতিমধ্যেই এসেছে। ফারাবির সাথে ব্যক্তিগত ম্যাসেজের কথোপকথন উত্তেজিত জনতা বারবার বলছিলো, আর প্রচারকৃত লিফলেটেও ফারাবির সাথে ব্যক্তিগত ধর্ম নিয়ে আলোচনা গুলো উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রচার করা হয়। প্রশ্ন হলো, ২ জনের মধ্যে ব্যক্তিগত কথোপকথন অর্থাৎ ফেসবুক চ্যাট কিভাবে এতো মানুষে জেনে গেলো? প্রথমত এই মামলার গণধোলাই খাওয়া ভিকটিম তা প্রকাশ করতে পারে অথবা ফারাবি প্রকাশ করতে পারে। যেহেতু ভিকটিমের প্রকাশ করার প্রশ্নই আসেনা, তাই প্রকাশ করতে পারে একমাত্র ফারাবি।

রাহী এবং উল্লাস পরিচিত মুখের সেলিব্রেটি টাইপের কেউ নয়। কোন উল্লেখযোগ্য ব্লগে লেখালেখি করতেও তাদের দেখিনি, অবশ্য এই ক্ষেত্রে তাদের বয়স এবং পড়াশুনার ব্যপারটাও আমাদের বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু রাহী ও উল্লাস উভয়েই ফারাবির সাথে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করেছে একথা একেবারেই স্পষ্ট। এছাড়াও ফারাবির বিভিন্ন লেখায় বিভিন্ন সময়ে উল্লাস ও রাহীকে যুক্তিতর্ক করতে দেখা যায়। আমি ফারাবির সাথে এই রকম কিছু মন্তব্যের স্ক্রিনশট প্রকাশ করছি, কারণ মন্তব্যগুলো ডিলেট হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী।

তবে এখানেই ক্ষান্ত নয় ফারাবি, ৩১ শে মার্চ সোমবার রাতে তার মাধ্যমেই গ্রেফতার হয়েছে রাহী এটি স্বীকার করে নিয়ে ফারাবি লিখেন – “আমার এই status এ কাজী রায়হান রাহীর কমেন্ট দ্বারাই আজকে পুলিশ কাজী রায়হান রাহীকে গ্রেফতার করেছে। উম্মুল মুমেনীনদেরকে নিয়ে কাজী রায়হান রাহী এত বাজে বাজে কমেন্ট করেছে যে তাকে কোন ভদ্র ঘরের ছেলে বলা যায় না। আসলে এটা শুধু কাজী রায়হান রাহী নয় অনলাইনের প্রত্যেকটা নাস্তিকই আসিফ মহিউদ্দীন, অভিজিৎ রায় এরা সব সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকে নিয়ে মিথ্যাচার করে, অশ্লীল কথা বলে। যেমন সূরা আত তাহরীমের ১ম ১২ আয়াতের শানে নুযুলে উম্মুল মুমেনীন মারিয়া কিবতিয়ার নাম কোন তাফসীরকারক উল্লেখ না করলেও এই অভিজিৎ রায় উনার লেখা নোটে ও ব্লগে উম্মুল মুমেনীন মারিয়া কিবতিয়ার প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে চরম অশ্লীল কিছু কথা বলেছে তার লেখা নোটে ও ব্লগে।

এরপরে ফারাবি নাস্তিকদের প্রকাশ্যে হত্যা করার হুমকি দিয়ে বলেন –

“এখন সময় এসেছে যেইসব নাস্তিক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে অশ্লীল কথা বলবে তাদের কে থাবা বাবার ন্যায় তিলতিল মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করা। বাংলাদেশে হয় আমরা মুসলমানরা বেঁচে থাকব নয় নাস্তিকরা বেঁচে থাকবে।”

শুনেছি অপ্রাপ্তবয়স্ক এই দুজনার পরিবারেও রয়েছে আতঙ্ক, রাহী এবং উল্লাসের এবার আর এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া তো হচ্ছেই নাহ, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ। উল্লাসের বাবা অপেক্ষায় আছে, ছেলেকে কোন রকম মামলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাবার। উল্লাসের পরিবারের উপর চলছে স্থানীয় জামাত শিবিরের হুমকি ধামকি। কতো বড় সাহস তাদের ছেলের হিন্দু হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে! অন্যদিকে রাহীর মা শুধু মূর্ছা যাচ্ছে, আর রাহীকে ফিরে পেতে চাচ্ছে। আমাদের কি কিছুই করার নেই?