স্থান কাল পরিবেশের ভিন্নতা থাকলেও অসুস্থতার কোন ভিন্নতা নেই। শুধু বাংলাদেশেই নয় এই অসুস্থ মানুষগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এরা মগজে এক প্রকার ভাইরাস নিয়ে চলাফেরা করে। এই ভাইরাস কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের মগজ থেকে মগজে বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে। আর মস্তিষ্কের মধ্যে প্রতিনিয়ত উৎপাদন করে যাচ্ছে ঘৃণা ও হত্যার উন্মাদনা। তাই সারা বিশ্বে এদের চরিত্রও একি রকম।

আজকে ঘুম থেকে উঠেই ফারাবী নামক এক অসুস্থ, মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষের ফতোয়া শুনলাম। তিনি মূলত ইসলামিক লেখা লিখে থাকেন। এই অসুস্থ মানুষটার সাথে একবার দেখাও হয়েছিল। তিনি তখন ওয়াদা করেছেন; তিনি আর কোন মেয়েকে ফেসবুকে জ্বালাবেন না, কাউকে টিজিং করবেন না। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আগের মত মেয়েদের জ্বালাতন, বিভিন্ন মানুষের বিরুদ্ধে হত্যার ফতোয়া জারি, বিভিন্ন মানুষের মা-বোন নিয়ে গালাগালি এমনকি হিন্দু মেয়েদের গনিমতের মাল হিসেবে আখ্যায়িত করে অনবরত স্ট্যাটাস দিতে থাকেন। সাক্ষাতে অবশ্য ফারাবী বলেছে- তার আইডিটি সে একা চালায় না। কয়েকজনের কাছে তার পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে তারাও প্রয়োজনবোধে তার আইডিটি ব্যবহার করে। অবশ্য দু-একজনের নামও বলেছে তিনি।

শাহবাগ আন্দোলনের সময় ধর্মান্ধ উন্মাদদের হাতে নিহত হন রাজিব হায়দার। তখন ফারাবী স্ট্যাটাস দেয়-রাজিব হায়দারের জানাজা যে হুজুর পড়াবে, সেই হুজুরকেও হত্যা করা হবে। ফারাবী জেল থেকে বের হয়ে পারভেজ আলম কে হত্যা করার জন্য স্ট্যাটাস দেন। মজার বিষয় হল পারভেজ ভাই এই অসুস্থ ফারাবীর মুক্তির কথা বলেছিলেন। পাগল জেল থেকে ছাড়ালে কী পরিণতি নয় তা মনে হয় এবার পারভেজ ভাই বুজেছেন। কারণ পাগল শুধু পারভেজ ভাইকে কামড়াতে চায় নি আরও অনেককে প্রতিনিয়ত কামড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকে ব্লগারদের গ্রেফতারে সাথে ফারাবীর গ্রেফতার গুলিয়ে ফেলেন। মনে রাখা উচিত, ফারাবীকে হত্যার হুমকির জন্য গ্রেফতার হয়। লেখালেখি জন্য নয় বরং হত্যার হুমকির জন্য গ্রেফতার হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক আমলের সময় ভাস্কর্য ভাঙ্গার মুমিনদের মধ্যে তিনি সামনের কাতারে ছিলেন। ফারাবী পূর্বে হিজবুত তাহরী করত জেল থেকে ছাড়া পেয়ে চরমোনাই পীরের গ্রুপে যোগ দেয়। হত্যার হুমকির আগেও হিজবুত তাহরী হিসেবে একাধিকবার গ্রেফতার হয়।

ফেসবুক ও ব্লগের বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ ফারাবী সাহেব এখন বেশ জনপ্রিয়। এই লাইনের লোকজন অবশ্য এই ব-দ্বীপে ভালই জনপ্রিয়তা পায়। তার একেকটা স্ট্যাটাসে দুই তিন হাজার লাইক পড়ে। এমনকি হত্যার হুমকি দেওয়া স্ট্যাটাসগুলোতে একই হাল। হত্যার ফতোয়া নামক স্ট্যাটাসগুলোতে ফেসবুকের কথিত বড় বড় বুদ্ধিজীবীদের লাইক থাকে। তার মধ্যে একজন হলেন বিএনপি ও জামাত-পন্থী লেখক ওহাইদুজ্জামান অন্যতম। তিনি নাকি আবার শিক্ষক। তার খোমা অবশ্য বিভিন্ন টক শো’তে টকমারানীদের সাথে দেখা যায়। শুধু তিনিই নন, একসময় নাস্তিকদের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকে ফারাবীর কোলে গড়াগড়ি খেয়েছেন। অনেকে ফারাবীকে ব্লো জব দিয়ে এখন মুখ ধুয়ে ফেলেছেন।

ফারাবী অনেকদিন ধরেই অভিজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্ট্যাটাস, ব্লগ লিখে যাচ্ছেন। অভিজিৎ রায়ের বিপক্ষে অনবরত লেগে থাকার মূল কারণ অভিজিৎ রায়ের অসাধারণ সব বই ও ব্লগিং। বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের কাছে অভিজিৎ রায় খুব জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার মূল কারণ সর্ব সাধারণের জন্য তাঁর বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা, যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা ও সহজবোধ্য গদ্য। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে সহজভাষায় সহজবোধ্যভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরাই অভিজিৎ রায়ের মূল বৈশিষ্ট্য। অভিজিৎ রায় নিজের দর্শন শুধু লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ করে রাখেননি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও এর বাহিরে নয়। নিজের কথাই বলি ভার্সিটিতে যখন প্রথম ভর্তি হই; অভিজিৎ রায়ের কতো ব্লগ ও বই পড়ে যে রাত কাটিয়ে দিতাম তার অন্ত নেই। এরকম আরও অসংখ্য মানুষ আছে যারা অভিজিৎ রায়ের সকল পড়ে থাকেন। আমার এক ছোট বোন অবিশ্বাসের দর্শন বইটি পড়েছিল চুরি করে। কারণ বাপ-মা দেখলে পড়তে দেবে না তাই চুরি করে পড়তে হয়েছে। শুদ্ধস্বরে সবচেয়ে বিক্রিত বইগুলোর একটি অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর-এর অবিশ্বাসের দর্শন।

এবছর অভিজিৎ রায়-এর নতুন বই-বিশ্বাসের ভাইরাস। এই বইটি মস্তিষ্কে টিকা-রূপে কাজ করে। রকমারিতে বিক্রিত বইগুলোর প্রথম সারিতে ছিল বইটি। বইটির জনপ্রিয়তাই এতো ফতোয়ার মূল কারণ। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বইটি স্বাভাবিকভাবে নেবে না এটাই স্বাভাবিক। প্রগতিশীল বেশধারী লোকজন ’বিবি থেকে বেগম’ বইটি প্রকাশের বিরোধিতার করেছিলেন সে ক্ষেত্রে অভিজিৎ রায়ের বইগুলো ফারাবী টাইপ মানুষের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেটাই স্বাভাবিক। তবে এসব হত্যার ফতোয়া কিংবা বইয়ের বিরোধিতা এটাই প্রমাণ করে বইগুলোয় কতোটা শক্তি আছে। কতোটা শক্তি থাকলে মানুষের মনের অন্ধকার দ্বারটি খুলে ফেলতে পারে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েট নয় অভিজিৎ রায়ের বইগুলো ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। সারা দেশের অসংখ্য পাঠকের ধর্মান্ধতা আজো দূর করে যাচ্ছে অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো। তাই ফারাবীর ফতোয়ায় ছেঁচড়া জঙ্গির হুমকিতে রকমারির মতন বই বিক্রয় সাইট থেকে অভিজিৎ রায়, হুমায়ুন আজাদের বই সরিয়ে ফেললেও জ্ঞান পিপাষু পাঠক কষ্ট করে হলেও অভিজিৎ দার বইগুলো সংগ্রহ করবে। বিশ্বাসের ভাইরাসের টিকা যেহেতু বাজারে এসেছে সেহেতু সমগ্র-জাতিকে একদিন এই ভাইরাস গ্রহণ করতে হবে তা নিজেদের প্রয়োজনেই। এই দেশ থেকে তসলিমা নাসরিনকে বিতাড়িত করা হয়েছে, দাউদ হায়দারকে রাষ্ট্রীয় ভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। কারো লেখা অন্যকারো পছন্দ হতে নাই পারে। পছন্দ না করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু কাউকে লেখার কারণে একমাত্র বর্বর রাষ্ট্রেই বের হয়ে যেতে হয়। সেই কলঙ্কের কালি আমরা স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই নিজেদের গালে মেখে ছিলাম। সর্বশেষ হুমায়ুন আজাদকে হত্যা চেষ্টা। আজ হয়তো ফারাবী নামক অসুস্থ ব্যক্তি স্ট্যাটাস দিয়েছে কিন্তু গত বছর তো ব্লগ দিয়া ইন্টারনেট চালানো লোকজন সাধারণ ব্লগারদের ফাঁসি চেয়ে বসল।

ভাবতে অবাক লাগে, ১৫০ বছর আগে মাইকেল মধু সূদন দত্ত মেঘনাদ বধ লিখেছেন, কয়েক বছর আগে ড্যান ব্রাউন দি দ্যা ভিঞ্চি কোড লিখেছেন। ধর্মীয় গণ্ডী থেকে চিন্তা করলে মানব ইতিহাসে এগুলো সবচেয়ে বড় ধর্মাবমাননা সাহিত্য। যারা পড়েছেন তারা অবশ্যই মেনে নেবেন এগুলোর তুলনায় একশ ভাগের একভাগ আমাদের সমাজে লেখা সম্ভব নয়। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস না পড়েই ধর্মাবমাননার জন্য এই দেশে নিষিদ্ধ। অথচ সাহিত্য কখনো মানুষকে ঘৃণা শেখায় না, হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে না তারপরও ধর্মীয় সমাজ এগুলো সহ্য করে না। এই সমাজে প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা বলতে পারবেন, ধর্ষণ করতে পারবেন, দুর্নীতি লুট সবই করতে পারবেন। ধর্মের নামে ব্যবসা, হত্যা, অত্যাচার, বাজারে মজমা জমিয়ে রসালাপ করে অন্য ধর্ম সম্পর্কে গিবত করতে পারবেন কিন্তু এগুলোর বিপক্ষে বলা যাবে না। ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা যাবে না শুধু অন্ধের মতন অনুসরণ করে যেতে হবে। এরপরও কিছু মানুষ সময়ের বিপক্ষে হাঁটতে চায়। বিপরীত স্রোতে লড়ে যায়। এসব মানুষদের শক্তিশালী লেখনীর উজ্জ্বল তেজ ধর্মান্ধদের চোখ ঝলসিয়ে দেয়। অভিজিৎ রায়ের বইয়ের বিরোধিতা করে কোন লাভ নেই বরং আপনাদের প্রকৃত চেহারা সারা পৃথিবীর কাছে ফুটে উঠছে। আপনাদের চরিত্র যতো স্পষ্ট হবে ততই আপনাদের ঘৃণা করতে সুবিধে হবে। আর বেশি দিন বাকী নেই যেদিন অভিজিৎ রায়ের বিশ্বাসের এন্টিভাইরাস আপনাদেরও নিতে হবে। সর্বশেষ একটা কথাই বলতে চাই; বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়। আপনারা এলরেডি বাজারের পচা ফল। দুর্গন্ধ অনেক ছড়িয়েছেন এখন শুধু পোকা ফোটা বাকি!!!

***শিরোনামটি- দাদার একটি বইয়ের নাম অনুসারেই দিলাম।