প্রদীপ দেব লিখিত  ‘উপমহাদেশের এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী’ (শুদ্ধস্বর, ২০১৪) শিরোনামে পুস্তিকাটি আমি আগ্রহ সহকারে পড়েছি। বেশ ভাল লেগেছে, যত্নসহকারে লেখা ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি সুলিখিত এবং এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমিও তা শেষ করেছি সেভাবেই। প্রদীপের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, তবে ইন্টারনেটের বিশেষ করে মুক্তমনার কল্যাণে নামটি সুপরিচিত এবং ওর একটি বিশ্লেষণধর্মী শক্তিশালী  কলম রয়েছে যা রুচিশীল এবং মুক্তমনকে টানে। প্রথমেই গ্রন্থকার সম্বন্ধে যা জানি তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিবৃত করি। শুনেছি প্রদীপ অস্ট্রেলিয়বাসী ও চিকিৎসা পদার্থবিদ্যাচর্চায় কর্মরত RMIT  বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে। ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি করেছে যথাক্রমে ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে। পিএইচডি করে ২০০১ সালে একই বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে; পরে ২০০৭ সালে কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ফিজিক্সে ’ MAppSc’ করেছে।

প্রদীপ দেব মুক্তমনায় নিয়মিত লিখে থাকে। আমাদের ‘মুক্তান্বেষা’ ম্যাগাজিনেও তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে – ২য়বর্ষ, ১ম সংখ্যা (জুলাই ২০০৮ দ্রষ্টব্য)।  এছাড়া ঢাকা থেকে আমার সম্পাদিত ’চারদিক’ থেকে প্রকাশিত  ’স্বতন্ত্র ভাবনা’ (২০০৮) ও ’বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (২০১২) এই দুটি সঙ্কলন গ্রন্থেও ওর লেখা রয়েছে। আইনস্টাইনকে নিয়ে ‘আইনস্টাইনের কাল’ নামে ওর সুন্দর একটি বই রয়েছে। এছাড়া ফাইনম্যান, পল ডিরাক, মেরী কুরি সহ বেশ ক’জন বিজ্ঞানীর ঘটনাবহুল জীবন নিয়েও প্রদীপ চমৎকার  সব প্রবন্ধ লিখেছে। প্রদীপের লেখা ব্লগগুলো মুক্তমনা ওয়েব সাইটে পাওয়া যাবে (এখানে)।

যা হোক বইটির কথায় আসি। উপমহাদেশের শুধু পদার্থবিজ্ঞানীদের নিয়ে এত বিস্তৃতভাবে আর কেউ বই লিখেছেন কি না জানা নেই আমার। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এ এম  হারুন অর রশীদ উপমহাদেশের কতিপয় বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন বেশ ক’বছর আগে ’উপমহাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী’ শিরোনামে। এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন ১০ জন অতি পরিচিত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী যাঁরা হলেন: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (প্রথম বাঙালি বিজ্ঞানী), আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (পথিকৃৎ রসায়ন বিজ্ঞানী), রামানুজম (একটি প্রহেলিকা ও বেদনাময় স্মৃতি), চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী), মেঘনাদ সাহা (প্রথম জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব), কাজী মোতাহার হোসেন (সংখ্যায়নের মোতিহার), মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা (বিজ্ঞানসাধক ও সংগঠক), সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর (বিজ্ঞান ও সুন্দরের পূজারি) ও আবদুস সালাম (এক ব্যতিক্রমী বিশ্বব্যক্তিত্ব)। এ তালিকায় উল্লিখিত সকল পদার্থবিদই প্রদীপের বইয়ে স্থান পেয়েছে।  প্রদীপের বইয়ের পদার্থবিদগণ হচ্ছেন:  জগদীশচন্দ্র বসু, দেবেন্দ্রমোহণ বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, শিশির কুমার মিত্র, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কে এস কৃষ্ণান, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর, বিক্রম সারাভাই ও আবদুস সালাম। মোটামুটি কালানুক্রমিকভাবে সজ্জিত।

স্যার জগদীশচন্দ্র হলেন উপমহাদেশের পথিকৃৎ পদার্থবিদ যদিও পরে উদ্ভিদ শারীরবিদ্যায় (Plant Physiology) অশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, আর এ বিদ্যাতেও তিনি পদার্থবিদ্যাকে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর আবিষ্কৃত তরুলিপি বা বর্হিপ্রণোদনায় বৃক্ষের সাড়া রেকর্ডকারী যন্ত্র ও তরুর বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র বিশ্বে অতি সুপরিচিত দুটি যন্ত্র নিঃসন্দেহে। বৃক্ষের অনুভূতি সাড়াদানকারী যন্ত্রটির বোস নাম দিয়েছিলেন সমতাল তরুলিপি যন্ত্র বা রেজোনান্ট রেকর্ডার (resonant recorder)। আর তরুর বৃদ্ধি-পরিমাপকটির নামকরণ করেছিলেন বৃদ্ধিমান যন্ত্র বা ক্রেস্কোগ্রাফ (crescograph)। আচার্য বসুর সাথে রবীন্দ্রনাথের ছিল পরম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বিলেতে বিজ্ঞান জগতে জগদীশচন্দ্রের কৃতিত্বের কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন:

’বিজ্ঞানলক্ষীর প্রিয় পশ্চিম মন্দিরে

দূর সিন্ধুতীরে

হে বন্ধু গিয়েছো তুমি; জয়মাল্যখানি

সেথা হতে আনি

দীনহীনা জননীর লজ্জানত শিরে

পরায়েছ ধীরে।’

 

বোসের উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার কথা সাধারণ মানুষ যতটা জানে, তাঁর তাড়িত তরঙ্গ নিয়ে গবেষণার কথা ততটা প্রচারিত নয়। তিনি মার্কনি ও লজের সমসাময়িক। মার্কনি তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন ২৫ সেমি দৈর্ঘের আর তার সাহায্যে বিনা তারে বার্তা প্রেরণে সক্ষম হয়েছিলেন। হার্জের পরে তাড়িত চৌম্বক সৃষ্টি ও এর ধর্ম নিয়ে তাৎপর্যময় গবেষণা করেছিলেন লজ (Lodge)।  তিনি ১৮৮৭-৮৮ সালে দেখিয়েছিলেন যে তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ তারের মধ্য দিয়ে সঞ্চালন করা সম্ভব, কিন্তু এরা যে মুক্তস্থানেও (free space free space) সঞ্চালিত হতে পারে তা তিনি দেখাতে পারেন নি।

 

সে যাই হোক  লজের গবেষণা অনেককে অনুপ্রাণিত করেছিলো যার মধ্যে মার্কনি এবং জগদীশচন্দ্রও ছিলেন। ১৮৯৭ সালে মার্কনি ২৫ সে.মি তরঙ্গ ব্যবহার করে চার মাইল দূরে তারবিহীন বার্তা (wireless message) প্রেরণ করেছিলেন। আর একই সময়ে জগদীশচন্দ্র মাইক্রো তরঙ্গ (৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য) ব্যবহার করে সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে বিনা তারে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আমরা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর ফাদার ই লাঁফো’র (E. Lafont S. J) একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিতে পারি:

 

My dear Jagadish,

 I would like to give a public lecture at St Xavier College Hall on “Telegraphy without wires” but as the instruments you so kindly gave me are not working order and as I would like to take this opportunity to vindicate your rights to priority over Marconi, would you assist me in my lecture with your presence and work your own instruments. Let me know as soon as possible as I intend inviting the Lieutenant Governor    

–          E. Lafont S. J

 

বলা বাহুল্য যে আচার্য বসু ছোটলাট অর্থাৎ বাংলার লে: গভর্নরের উপস্থিতিতে মাইক্রোতরঙ্গ ব্যবহার করে বিনা তারে মুক্তস্থানের মধ্যদিয়ে বার্তা-প্রেরণের প্রদর্শনী উপস্থাপন করেছিলেন সবাইকে হতবাক করে। জগদীশচন্দ্র কেন অতি ক্ষুদ্র তাড়িত তরঙ্গ ব্যবহার করতেন ক্রিস্টালের গুণাগুণ অনুশীলনে তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন – যে যেসব ক্রিস্টাল সাধারণ আলোয় অস্বচ্ছ সেগুলি জগদীশচন্দ্র ব্যবহৃত তাড়িত বিকিরণে স্বচ্ছ। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করায় বোস তাড়িত বর্ণালীর আলোক অংশের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে হার্জিয়ান তরঙ্গের আলোসম আচরণ অনুশীলনে ক্ষুদ্রতর তাড়িত তরঙ্গ অধিকতর উপযুক্ত। বোস এর ফলে কক্ষের পরিপার্শ্ব থেকে আসা প্রতিফলন দূর করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া এ কারণে বোসের ব্যবহৃত যন্ত্রটি ছোট আকারের এবং সহজেই বহণযোগ্য হয়েছিল। এ সম্পর্কে আচার্য বসু ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত প্রথম গবেষণা-পত্রটিতে লিখেছিলেন :

“The radiating box, thus constructed, is very portable. The one I have been using, for some time past, is 7 inches in height, 6 inches in length, and 4 inches in breadth.”

তাঁর গবেষণা সম্পর্কে তিনি নিজেই একবার মন্তব্য করেছিলেন যে তাঁকে অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে, ”..natural substances which would polarize the transmitted electric ray এবং .. ..   the analogy between electric radiation and light would be complete if the classes of substances which polarize light were also found to polarize electric ray.”, for all crystals are transparent to it.

তিনি Beryl, Apatite, Nemalite (a fibrous Variety of Brucite), Barytes,Microcline, Rock Salt, black Tourmaline and Iceland Spar ..’ প্রভৃতি ক্রিস্টাল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন নিবিড়ভাবে। এ সম্পর্কে তিনি পরে সংক্ষেপে মন্তব্য করেছিলেন-

Theoretically all crystals with the exception of those belonging to the Regular System (i.e. Rock Salt), ought to polarize light. But this could not hitherto be verified in the case of opaque crystals. There is no such difficulty with the electric ray.

যথার্থ অর্থেই তাঁকে মাইক্রোতরঙ্গ আলোক বিদ্যার জনক বলা হয়ে থাকে। পরে অবশ্য তিনি ১ ও ২.৫ সেমি দৈর্ঘ্যের বিকিরণ নিয়েও বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন।

ভূমিকায় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে এত কথা বলা হলো এই কারণে যে তিনি ছিলেন এই উপমহাদেশে পদার্থবিদ্যা চর্চার সত্যিকার অর্থেই পথিকৃৎ এবং প্রদীপ এই মহান বিজ্ঞানীর রচনা দিয়েই ওর বই শুরু করেছে।

প্রদীপের ২য় প্রবন্ধ ড. দেবেন্দ্র মোহন বসুকে নিয়ে (১৮৮৫-১৯৭৫), যিনি পদার্থবিজ্ঞান জগতে সাধারণভাবে ডি. এম. বোস (D. M. Bose) নামে অধিক পরিচিত। ১ম বিশ্বযুদ্ধকালে তিনি জার্মানীতে আটকা পড়েছিলেন, এবং সেসময় পিএচডি থিসিস সম্পূর্ণ করলেও জমা দিতে পারছিলেন না। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি কোলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন (১৯১৩) ডক্টরেট ডিগ্রীসহ, এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ঘোষ  অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯১৪ সালে আর এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। দেশে ফেরার সময় তিনি তাঁর তরুণ সহকর্মীদের যেমন ড. মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্য বেশ কিছু বই নিয়ে আসেন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিকস ছাড়াও নিয়ে এসেছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের তাপগতিবিদ্যার ওপর লিখিত বিখ্যাত বইটিও।

দেবেন্দ্রনাথকে বলা যেতে পারে ভারতে কণা-পদার্থবিদ্যা (Particle physics) গবেষণার অগ্রদূত। তবে তিনি চুম্বকত্ব নিয়েও চমৎকার গবেষণা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ডি. এম. বসুর সরাসরি সম্পৃক্ততা না ঘটলেও অপ্রত্যক্ষভাবে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে একটি ঘটনার সাথে –

দু’বছর (১৯২৪-১৯২৬) প্যারিস ও বার্লিনে শিক্ষা-ছুটি শেষে এস এন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন প্রতিষ্ঠিত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে সুখ্যাতি নিয়ে। ১৯২৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। ড. ডি. এম বয়সও ছিলেন একজন প্রার্থী। অন্যদিকে এস এন বোস  ছিলেন একজন যোগ্য ও শক্তিশালী প্রার্থী, যিনি ১৯২১ সাল থেকে রীডার পদে অধিষ্ঠিত, যাঁর পক্ষে আইনস্টাইন, পল লেঞ্জেভিনের মত খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা সুপারিশ করেছিলেন।

কিন্তু এত বড় বড় মানুষের সুপারিশ সত্ত্বেও নির্বাচক কমিটি বিখ্যাত পদার্থবিদ সোমেরফিল্ডের (Sommerfeld) সুপারিশ ক্রমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ডি এম বোসকে অধ্যাপক পদে নির্বাচন করেন। তবে কাযনির্বাহী পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় (২৭.০৯.২৬) যে ড. ডি এম বোস অপারগতা প্রকাশ করলে সে স্থানে সত্যেন বোস অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাবে। সোমেরফিল্ডের সুপারিশ ছিল,

“Both Candidates very good SN Bose famous theoretician, DM Bose fine experimenter and theoretician perhaps latter preferable”.

দেবেন্দ্রমোহন বসু এই পদে যোগ না দেওয়ায়, সত্যেন বোসকে এই পদে নিযুক্তি দেযা হলে বোস অধ্যাপক পদে যোগ দেন (১১. ০২. ২৭)। এর কিছুদিন পরেই তিনি ঢাকা হলের প্রভোস্ট ও বিজ্ঞান অনুষদের ডীন নিযুক্ত হন।

 

প্রদীপের বইয়ে ৩য় পদার্থবিদ হলেন ১৯৩০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্যার সি. ভি. রমন। বস্তুত এশিয়ার মধ্যে বিজ্ঞানে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। ১৯০৮ সাল থেকে রমন কোলকাতায় ভারতীয় হিসাব বিভাগে সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন, তবে বহুবাজার স্ট্রীটস্থ মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ’ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার সমিতি’তে (Indian Association for Cultivation of Science : IACS) আলো ও শব্দতরঙ্গ নিয়ে খন্ডকালীন সময়ে গবেষণা করতেন। ১৯১৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষের আমন্ত্রণে বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যার পালিত প্রফেসর হিসেবে তিনি যোগ দেন যদিও মূল গবেষণা উক্ত সমিতির ল্যাবরেটরিতেই করতেন। এখানেই রমন-কৃষ্ণাণ সহযোগিতায় নতুন ধরণের আলোক বিকিরণ আবিষ্কৃত হয়, যা পরবর্তীকালে রমন প্রপঞ্চ (Raman Effect) নামে খ্যাত হয় এবং রমনের জন্য বয়ে আনে নোবেল পুরস্কারের দুর্লভ সম্মান ১৯৩০ সালে। রমন IACS ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ১৯০৮-১৯৩২ পর্যন্ত কোলকাতায় ছিলেন এবং বাংলার বিজ্ঞান সাধনায় প্রভূত অবদান রেখেছিলেন। রমন প্রতিভাসটি সম্পর্কে সামান্য দ’কথা বলে নিই- বিস্তারে যাওয়ার অবকাশ নেই: ধরা যাক একটি একবর্ণী (monochromatic) আলো  যেমন পারদ আর্ক থেকে নিঃসৃত 4358 oA বর্ণ রেখাটি কোন জৈব পদার্থ (কঠিন,তরল বা গ্যাসীয়)- ধরা যাক টলুইনের (tolune) ভিতর দিয়ে অতিক্রম করল। যদি বিক্ষিপ্ত আলোকে সমকোণে যথাযথ বর্ণালীবীক্ষণের মধ্য দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়, তাহলে দেখা যায় যে এই বিক্ষিপ্ত বর্ণালীতে শুধু মূল একবর্ণী রেখাটিই থাকবে না-  এর দুপাশে দুটি নতুন বিকিরণ রেখাগুচ্ছ দৃষ্ট হবে: ক্ষুদ্রতর কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট রেখাসমূহকে স্টোকস রেখা (Stokes lines) এবং উচ্চতর কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট রেখাগুচ্ছকে প্রতি-স্টোকস রেখা (anti Stokes lines) বলা হয়। মূল রেখার দুপাশে দৃষ্ট এই বর্ণালীগুচ্ছকে বলা হয় রমন রেখা (Raman lines) । তত্ত্বীয়ভাবে এই রেখার উপস্থিতি সম্পর্কে স্মেকল ১৯২৩ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করলেও রমন ও তাঁর সহকর্মীরা সর্বপ্রথম পরীক্ষণ দ্বার এর উপস্থিতি প্রমাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে স্মেকলের ব্যখ্যার আরও পরিপূর্ণতা লাভ করে হাইসেনবার্গ ও ক্রেমারে হাতে (১৯২৫)।

প্রদীপের বইয়ের পরবর্তী পদার্থবিদ হলেন শিশির কুমার মিত্র (১৮৯০-১৯৬৩), খ্যাতনামা বেতার পদার্থবিদ বা রেডিও ফিজিসিস্ট (Radio Physicist)। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে  Radio Physics & Wireless  বিভাগ স্থাপন এবং এই বিষয়ে গবেষণার পথিকৃতই শুধু নন এই শৃঙ্খলার একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তি। ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে পদার্থবিদ্যায় প্রথম শেনীতে প্রথম হয়ে এম. এসসি ডিগ্রী অর্জন করলেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ চালু হলে (১৯১৪) শিশির কুমার স্যার আশুতোষের আহ্বানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিলেন প্রভাষক হিসেবে সহকর্মী হিসেবে পেলেন খ্যাতনামা ব্যক্তিদের – স্যার সিভি রমন, ডি. এম বোস, মেঘনাদ সাহা, সত্যেনবোস …। সময় নষ্ট না করে তরুণ শিশির কুমার রমনের তত্ত্বাবধানে আলোকবিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করলেন IACS’ এর ল্যবোরটিরিতে। কয়েক বছর পরেই অর্জন করলেন ডি. এসসি ডিগ্রী – থিসিসের শিরোনাম ছিল:  ‘Interference and Diffraction of Light’। প্যারিসে অধ্যাপক গুন্টনের তত্ত্বাবধানে রেডিও ফিজিক্স নিয়ে কাজ করে দেশে ফিরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করলেন এই শৃঙ্খলার ওপর পাঠদান ও গবেষণা। বায়ুম-লের ওপর তাঁর গবেষণা বেশ চমকপ্রদ।

 

প্রদীপের বইয়ের পরবর্তী পদার্থবিদ হলেন – জ্যেতিঃপর্দর্থদ্যিার পথিকৃৎ ‘সাহা আয়োনাইজেশন’ সমীকরণের আবিষ্কারক ড. মেঘনাদ সাহা। সাহা ছিলেন ঢাকার ছেলে এবং সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সহপাঠী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। নোবেল পুরস্কারের জন্য সাহার নাম চারবার প্রস্তাব করেছিলেন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা – যেমন ড. ডি এম বোস ও শিশির কুমার মিত্র (১৯৩০), আর্থার কম্পটন (১৯৩৭), এস কে মিত্র (১৯৩৯), পুনরায় আর্থার কম্পটন (১৯৪০)।

সত্যেন বোস ১৯২১ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদ থেকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রীডার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এখানে এসে দুবছর (১৯২৪-২৬) শিক্ষা ছুটি ব্যতিরেকে দীর্ঘ ২৪ বছর বিভাগের উন্নয়নে কালাতিপাত করেছেন। এ সময় তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ছাড়াও কেদারেশ্বর ব্যনার্জির নেতৃত্বে রঞ্জন-রশ্মির গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে জৈব অণুর গড়ন ছাড়াও পাটের তন্তু নিয়ে কাজ হয়েছে, কৃষ্ণানের নেতৃত্বে ক্রিস্টাল ম্যাগনেটিজম নিয়ে তাৎপর্যময় গবেষণা হয়েছে, সুশীল চন্দ্র বিশ্বাস ও জ্ঞান ঘোষের সাথে রসায়ন-পদার্থবিদ্যায় বেশ ভাল কাজ হয়েছে। এস আর খাস্তগীরের নেতৃত্বে রেডিও পদার্থবিদ্যা ও ওয়ারলেস গবেষণাগার গড়ে উঠেছিল এবং আবহাওয়া বিজ্ঞান ও আয়নোস্ফিয়ার নিয়ে নিবিড় গবেষণা চালিত হতো। শচীন্দ্রমোহন মিত্রের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী দল আলোক বিজ্ঞান, রমন প্রপঞ্চ, প্রতিপ্রভা বর্ণালী নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৪৫ সালে অধ্যাপক বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে খয়রা প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। এখানে বোসের তাৎপর্যময় গবেষণা ছিল তাঁর নেতৃত্বে একটি থার্মোলুমিনিসেন্স বর্ণালীবীক্ষণ নির্মিত হয়েছিল। ঢাকায় সত্যেন বোস ঢাকাবাসীর কাছে ছিলেন ’বোস সাহেব” আর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে তিনি পরিচয় লাভ করলেন ‘মাস্টার মশাই’।

এর পর প্রদীপ আলোচনা করেছেন কে. এস. কৃষ্ণান, রমন প্রপঞ্চের সহ আবিষ্কর্তা’র অবদান নিয়ে। কৃষ্ণান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে রীডার হিসেবে যোগ দেন ১৯২৮ সালে এবং ছিলেন সাত বছর (বস্তুত ৫ বছর) এবং ১৯৩৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভাগ ছেড়ে চলে যান পাকাপাকিভাবে কালিটভেশন অব সায়েন্সে। এই ৫ বছরে রমন বর্ণালী ছাড়াও, তিনি ক্রিস্টাল চুম্বকত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বিশ্বনন্দিত কাজ করেন।

এর পর প্রদীপ ভারতীয় পরমাণু চুল্লি নির্মাণ ও পারমাণবিক গবেষণা ও টাটা মৌলিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার জনক হোমি ভাবা, চন্দ্রশেখর সীমা খ্যাত সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর, ভারতীয় রকেট-নির্মাণ ও মুক্তস্থান নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ বিক্রম সারাভাই এবং সব শেষে পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত আহমেদিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী আবদুস সালামের বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেছেন।  ইলেকট্রো-উইক বলের সম্মিলনকারীর অন্যতম অবদানকারী হলেন আবদুস সালাম।

আমাকে যা অবাক করে তাহলো বিভিন্ন শৃঙ্খলার পদার্থ বিজ্ঞানীদের কঠিন কঠিন গবেষণার কাজকর্মকে কী সুন্দর মনোমুগ্ধকর ও সাবলীলভাষায় যত্নের সাথে সাধারণ পাঠকদের উপহার দিয়েছে প্রদীপ। এখানেই প্রদীপ দেবের কৃতিত্ব এবং তার সাফল্য। ইংরেজিতে বললে বলতে হয়, প্রদীপ – ‘Hats off to you’ ।

 

________________

 

অজয় রায়

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়